দিল্লির বর্ডারে কৃষিবিল প্রত্যাহারের দাবিতে অবস্থানরত কৃষকদের লড়াই প্রতিদিন আরও জোরদার হচ্ছে। এখন একটাই আওয়াজ – ‘হয় বিল প্রত্যাহার, না হলে লাগাতার আন্দোলন’। এই আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ল পশ্চিমবঙ্গেও। রাজ্যের নানা প্রান্তে কৃষক সংগঠন ও কৃষকদের সংহতিতে পাশে থাকা ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, মহিলা সংগঠন এবার জোটবদ্ধ হচ্ছেন এক বৃহত্তর সংহতি আন্দোলনের লক্ষ্যে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
২০২১-এর প্রজাতন্ত্র দিবস এক ভিন্ন দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে চলেছে। দিল্লির বর্ডারে কৃষিবিল প্রত্যাহারের দাবিতে অবস্থানরত কৃষকদের লড়াই প্রতিদিন আরও জোরদার হচ্ছে। নিজেদের দাবি পূরণ না হলে তাঁরা যে এক ইঞ্চি জমি ছাড়বেন না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন কৃষকরা। আর সেই প্রেক্ষিতেই দিল্লিতে আগামী ২৬ জানুয়ারি হতে চলেছে ট্রাক্টর র্যালি, তৈরি হচ্ছে ট্যাবলো। তবে শুধু পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকেরাই নন, সারা দেশের কৃষকেরাই জোট বাঁধছেন এই সম্মিলিত প্রতিবাদ কর্মসূচিতে। ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারের কৃষক-বিরোধী কৃষি বিলের বিরুদ্ধে এখন একটাই আওয়াজ – ‘হয় বিল প্রত্যাহার, না হলে লাগাতার আন্দোলন’। সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনাতেও কোনও সমাধান সূত্র বেরোচ্ছে না। কৃষকেরা নিজেদের দাবি আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এই আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ল পশ্চিমবঙ্গেও। পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে কৃষক সংগঠন ও কৃষকদের সংহতিতে পাশে থাকা ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, মহিলা সংগঠন এবার জোটবদ্ধ হচ্ছেন এক বৃহত্তর আন্দোলনের লক্ষ্যে।
বীরভূমে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের উদ্যোগে ৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হল লাগাতার ধরনা। বীরভূমের রামপুরহাটে পদযাত্রা করে এসে রামপুরহাট পাঁচ মাথা মোড়ে শুরু হয় এই ধরনা কর্মসূচি। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের রাজ্য সভাপতি সামিরুল ইসলাম, জেলা কমিটির সদস্য রাজকুমার ভুঁইমালী, শিক্ষিকা মণীষা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ দাস, বদিউজ্জামান-সহ প্রায় ৫০০ জন মানুষ এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন এবং ধরনায় যোগ দেন। ছিলেন কৃষিজীবীরাও।
সামিরুল ইসলাম জানালেন, “আমরা এই আন্দোলনের বিষয়টিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেব। আমাদের সাথিরা গ্রামে যাবেন, গ্রাম থেকে মানুষ আসবেন। কৃষিবিল বিষয়ে বোঝানোর জন্য লিফলেট, ভয়েস রেকর্ডিং, ছোট ছোট তথ্যচিত্র বানানো ইত্যাদির কাজ চলছে, করা হবে পথনাটিকাও।” ২৬ জানুয়ারি বিল প্রত্যাহার না হলে তারা ‘লং মার্চে’-র প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদ-সহ তাঁদের যেখানে যেখানে সংগঠন রয়েছে সেখানেই এই ‘মার্চ’ করা হবে। এই মুহূর্তে দিল্লিতে কোনও প্রতিনিধি দল পাঠানোর তাঁদের পরিকল্পনা নেই। গ্রামকে জোটবদ্ধ করাই মূল লক্ষ্য। নির্বাচনের মুখে এই ধরনের আন্দোলনের উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেরকম পরিস্থিতির জন্য তাঁরা কি তৈরি? সামিরুল বললেন, “সেটা সামলে নেওয়ার ক্ষমতা আমরা রাখি। এখানে আমাদের সংগঠিত শক্তি রয়েছে।” কোনওরকম চাপের মুখেই জেলাভিত্তিক এই আন্দোলন যে মাথা নোয়াবে না তা স্পষ্ট।
অন্যদিকে, অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি (এআইকেএসসিসি) পশ্চিবঙ্গ শাখা ৯ জানুয়ারি থেকে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কলকাতার ধর্মতলায় লাগাতার সংহতি অবস্থান কর্মসূচি নিচ্ছে। এই উদ্যোগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অন্নদাতাদের সংহতিতে বাংলা’। কৃষকদের পাশাপাশি ছাত্র-যুব-শ্রমিক-মহিলা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকেই এই অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ডাক দেওয়া হয়েছে।
৯ তারিখ সকালে এই অবস্থান শুরু হওয়ার পর এই উদ্যোগের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়েছে।
- সারা দেশের সঙ্গে এই অবস্থান মঞ্চ থেকেও ১৩ জানুয়ারি কৃষি বিলের প্রতিলিপি পোড়ানো হবে।
- ১৮ জানুয়ারি পালিত হবে মহিলা কিষান দিবস।
- ২০-২২ জানুয়ারি রানি রাসমণি রোডে চলবে সারা দিনরাতব্যাপী গণঅবস্থান। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্যোগের তরফ থেকে আশা করা হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ এই গণঅবস্থানে অংশ নিতে চলেছেন।
- ২৩ জানুয়ারি উদ্যাপিত হবে আজাদ হিন্দ কিষান দিবস।
- ২৬ জানুয়ারি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলায় জেলায় ট্রাক্টর-সহ কৃষক মিছিল হবে।
“বিজেপি সরকার সংশোধনের নামে কৃষি বিলের মধ্যে দিয়ে কোম্পানি রাজ চালু করতে চাইছে। তার বিরুদ্ধে এই লড়াই ক্রমশই সুসংবদ্ধ হচ্ছে। কলকাতার এই অবস্থানে নিশ্চয়ই কৃষকেরা আসবেন কিন্তু আমরা নিছকই তাঁদের তুলে আনব না। কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা নিশ্চয়ই আসবেন, তবে মূলত কৃষকদের সমর্থনে ছাত্র-যুব-শিক্ষক-শ্রমিক, তাঁরা বৃহত্তরভাবে এতে যোগদান করবেন। ১০ তারিখ আমাদের তরফ থেকে কয়েক জন দিল্লি যাবেন। এই আন্দোলন, অবস্থান থেকে মোদী যেন বোঝে শুধু পাঞ্জাবের কৃষকেরা নন, সারা দেশের কৃষকেরা লড়ছেন, বলছেন, ‘আগে এই বিল পুরোপুরি প্রত্যাহার করো, না হলে আন্দোলন থামবে না,’” জানিয়েছেন এআইকেএসসিসি পশ্চিমবঙ্গ শাখার সম্পাদক কার্তিক পাল। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে তাঁদের দাবি এই কৃষিবিল যে কোনওভাবেই এ রাজ্যে প্রয়োগ হবে না তা ঘোষণা করা হোক এবং সেইসঙ্গে আলু-সহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের সরকারি দর ঘোষণা করে গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে তা সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতে হবে রাজ্য সরকারকে।
অন্যদিকে, ৭ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে দু’সপ্তাহের মধ্যে জানাতে বলেছে দিল্লিতে কৃষক অবস্থানের মতো বিরাট জমায়েতে কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে কেন্দ্রের তরফ থেকে কী গাইডলাইন জারি করা হয়েছে। তবলিঘি জামাতের ঘটনা থেকে কিছু শিক্ষা কেন্দ্র নিয়েছে কি না জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের প্রতিনিধির কাছে। যদিও এখনও পর্যন্ত প্রবল ঠান্ডায় দিল্লিতে কৃষকের মৃত্যু ছাড়া কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা এই অবস্থান থেকে সামনে আসেনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে কোভিড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন ও কেন্দ্রের সময় নিয়ে উত্তর দিতে চাওয়ার বিষয়টি এই আন্দোলনে রাশ টানার পন্থা হতে পারে বলে আন্দোলনের নেতৃত্ব মনে করছেন।
পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা জোটবদ্ধ আন্দোলনও এক নতুন দিশা দেখাতে চলেছে। শুধু কলকাতাকেন্দ্রিক নয় জেলাভিত্তিক আন্দোলন এক্ষেত্রে নতুন করে পথ দেখাচ্ছে।
গ্রাউন্ডজিরো এই আন্দোলন, অবস্থানের খবর নিয়মিত পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে থাকবে।