২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। বাংলায় বিজেপি ৭৫ লক্ষ চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা তুলে নিয়েছে, হয়তো জল মাপা চলছে। কিন্তু প্রায় একইরকম প্রতিশ্রুতি যে আরও আসবে তা বলাই বাহুল্য। আপাতত আগরতলার খোলা আকাশের নীচে ১০৩২৩ জন শিক্ষক চাকরি হারিয়ে অন্ধকারে। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ আপাতত ভূলুন্ঠিত। সরকার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আন্দোলনের মাটি দীর্ঘ হচ্ছে, আগরতলার সিটি সেন্টার থেকে দিল্লির সিংঘু বর্ডার, কৃষক থেকে শিক্ষক। কিন্তু নির্বিকার সরকার। সৌরব চক্রবর্ত্তীর রিপোর্ট।
“রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়….
দিন বদলায় না!”
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহু বছর আগে লিখেছিলেন, কিন্তু লিখে ফেলার এতো বছর পরে-ও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। ত্রিপুরায় ১০৩২৩ জন শিক্ষকের ভাগ্যও এইরকম। ২০১০ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের অস্নাতক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষক পদে নিয়োগ করেছিল। সেখানে ‘মেরিট’-এর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের কথা-ও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় শিক্ষা অধিকার আইন-এর প্রসঙ্গ তুলে ১০৩২৩ জন শিক্ষকের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়।
তৎকালীন বাম সরকারের নিয়োগ করা এই ১০৩২৩ জন শিক্ষকদের নিয়োগনীতি নিয়ে প্রথমে ত্রিপুরা হাইকোর্টে মামলা হয়। সেই মামলার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল কেন্দ্রীয় শিক্ষা অধিকার আইনে ‘নিড’ শব্দটা নেই, সরকার কিভাবে ‘নিড’-এর উপর ভিত্তি করে চাকরি দিচ্ছে! অন্যদিকে ‘টেট পরীক্ষা’ দিয়ে পাশ করে চাকরি পাওয়ার বিষয়টিও চলে আসে, কিন্তু তখন শুধুমাত্র মৌখিক ইন্টারভিউ-র মাধ্যমে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ, তখনকার বিরোধী দল কংগ্রেসের কতিপয় বিধায়কের অঙ্গুলিহেলনেই কয়েকজন চাকরীহীন বেকার তরুণ হাইকোর্টে এই মামলা করেন।
মামলা হওয়ার পর ২০১৪ সালে ত্রিপুরা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক গুপ্ত ও বিচারপতি স্বপন দেবনাথের বেঞ্চ ১০৩২৩ জন শিক্ষকের মূল নীয়োগ নীতিটাই বাতিল করে শিক্ষকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। বাম সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, সেখানে বিচার চলাকালীন পর্যন্ত তাঁদের এডহক (Ad hoc) শিক্ষক হিসেবে রাখা হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রাখে। এই অবস্থায় প্রচুর শিক্ষকের বয়স ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে, যাঁরা এখন নতুনভাবে বিএড ডিগ্রি নিয়ে টেট পরীক্ষায় বসে পুনরায় চাকরিতে ফিরতে পারবেন না। এই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেখানে বাম সরকার ১৩,০০০ নতুন অশিক্ষক পদের সৃষ্টি করেছিল, যেখানে শিক্ষা দপ্তরের বিভিন্ন বিভাগে চাকরিচ্যূত এই ১০৩২৩ জন শিক্ষকদের অঘোষিতভাবে নিয়োগ করাই ছিল মূল পরিকল্পনা। তাছাড়া অঘোষিতভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫-৭ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও রাখা হয়েছিল, কিন্তু পুনরায় ভুল নিয়োগনীতির অভিযোগ তুলে এই পদগুলির বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়। পরে যদিও সুপ্রিম কোর্ট এই পদগুলিকে বৈধ হিসেবেই রায় দেয়।
ইতিমধ্যে ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় ২৫ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করে বিজেপি। নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, এক ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা দিনরাত ত্রিপুরাতেই আস্তানা গড়েছিলেন, জাতীয় সংবাদ মাধ্যমেও তখন ত্রিপুরার নির্বাচন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল। সেখানেই অমিত শাহ, হিমন্ত বিশ্ব শর্মারা এই ১০৩২৩ জন শিক্ষকদের প্রতি ‘ন্যায়’, ‘ইনসাফ’ দেওয়ার কথা বলেছিলেন বার বার। স্যোশাল মিডিয়ায় সেইসবের ভিডিয়ো এখনও আছে। কিন্তু ক্ষমতায় প্রায় ৩ বছর হয়ে যাওয়ার পরেও বিজেপি সরকারের কোনও হেলদোল নেই। সুপ্রিম কোর্টের ইতিবাচক রায় থাকা সত্ত্বেও বর্তমান বিজেপি সরকার এই পদগুলিতে নিয়োগ করতে চাইছে না। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ শিক্ষকদের ‘পূর্বতন সরকারের পাপের ফল’ বলেছেন বারবার। কিন্তু ২০১৮ সালের ভোটের আগে এই শিক্ষকরাই ছিলেন তুরুপের তাস।
২০২০ সালের ৩১ মার্চ লকডাউনের সময় চাকরি চলে যাওয়ার পরে অবসাদ ও আর্থিক সমস্যায় ৩০-র উপরে শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে মোট ৭৮ জনের। এই অসহায় পরিস্থিতিতে ১০৩২৩ জন শিক্ষকদের সংগঠনগুলি বারবার আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছে। বিজেপি সরকারের পুলিশ লাঠি, জলকামান দিয়ে আন্দোলন দমাবার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারের সামনে নিরবচ্ছিন্ন গণধর্ণায় বসেছেন শিক্ষকরা। সারা রাজ্যের বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন, ছাত্র সংগঠনগুলো এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও এখন পর্যন্ত সরকার পক্ষের কেউ এসে তাদের খোঁজ নেননি বলে অভিযোগ জানিয়েছেন ‘আমরা ১০৩২৩’ সংগঠনের নেত্রী ডালিয়া দাশ। তিনি আরও জানান,
“পূর্বতন সরকার আমাদের স্থায়ী ব্যবস্থা করে যেতে পারেনি, কিন্তু বর্তমান সরকার স্থায়ী সমাধান করবে বলেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যা এখন বিশ বাঁও জলে! সরকার নতুন কিছু পোষ্ট তৈরি করেছে, যেখানে ১০৩২৩ জন শিক্ষকদের বয়সের ছাড় দিলেও পরীক্ষায় বসতে হবে অন্য বেকারদের সাথে, অপরদিকে এই শিক্ষকদের চাকরি চলে যাওয়ার কোনও নোটিশ বিদ্যালয়ে বা শিক্ষকদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। সরকার ১০ বছর শিক্ষকতা করা শিক্ষকদের এখন নতুনভাবে ইন্টারভিউতে বসতে বলছেন, যেখানে এমনও শিক্ষক আছেন যার চাকরি জীবন বাকি ২-৩ বছর। তাছাড়া সরকারের মতে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে অর্থাৎ বেছে বেছে নিয়োগ প্রক্রিয়া হবে যা খুবই পরিষ্কার, তাহলে এতোদিন বাকি শিক্ষকরা কোথায় যাবেন!”
কথা বলেছিলাম ত্রিপুরা হিউম্যান রাইটস সংগঠনের নেতৃত্ব পুরোষোত্তম রায় বর্মণের সাথে, তাঁর বক্তব্য, “এই ঘটনা সম্পূর্ণভাবে মানবতাকে আঘাত করে। প্রচুর শিক্ষক মারা গেছেন, সরকারের উচিৎ এখনই তাঁদের একটি স্থায়ী সমাধান করা।” তিনি আরও বলেন, পূর্বতন সরকারের তৈরি ১৩০০০ অশিক্ষক পদ ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট থেকে মান্যতা পেয়েছে, সেখানে ১০৩২৩ জন শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষক আছেন, তাদের নিয়োগ করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তা না করে সরকার এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
১০৩২৩ জন শিক্ষকদের মোট তিনটি সংগঠন যথা, ‘আমরা ১০৩২৩’, ‘জাস্টিস ফর ১০৩২৩’, ‘অল ত্রিপুরা এডহক টিচারস এসোসিয়েশন’ একযোগে ‘জয়েন্ট মুভমেন্ট কমিটি ১০৩২৩’ নামে এই গণধর্ণায় অবস্থান করছে। শিক্ষকদের দাবী, তাদের নিয়মিত কর্মসংস্থান করতে হবে এবং এখন পর্যন্ত যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের বাড়ির যোগ্য ব্যক্তিকে সরকারি চাকরি দিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত এই দাবি না মানা হবে, আন্দোলন চলবে।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে সিটি সেন্টারের পাশেই, সেখানে কৃষকেরা তাদের ফসল, ব্যবসায়ীরা রান্নার জিনিসপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী এনে দিয়ে যাচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়েছে ত্রিপুরা যুক্তিবাদ বিকাশ মঞ্চ, সোনামুড়া নাগরিক মঞ্চ, ত্রিপুরা হিউম্যান রাইটস সংগঠন, ত্রিপুরা বিজ্ঞান মঞ্চ সহ আরও বিভিন্ন সংগঠন। সরকারকে ৬ জানুয়ারির মধ্যে ব্যবস্থা করতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনও বিষয়েই সরকারপক্ষ কিছু জানায়নি। আন্দোলনরত শিক্ষকেরা ৬ জানুয়ারির পরে আরও বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। বাংলায় বিজেপি ৭৫ লক্ষ চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা তুলে নিয়েছে, হয়তো জল মাপা চলছে। কিন্তু প্রায় একইরকম প্রতিশ্রুতি যে আরও আসবে তা বলাই বাহুল্য। আপাতত আগরতলার খোলা আকাশের নীচে হাজারে হাজারে শিক্ষক যাঁরা জাতীর মেরুদন্ড, তাঁরা চাকরি হারিয়ে অন্ধকারে। সরকার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আন্দোলনের মাটি দীর্ঘ হচ্ছে, আগরতলার সিটি সেন্টার থেকে দিল্লির সিংঘু বর্ডার, কৃষক থেকে শিক্ষক, নির্বিকার সরকার। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ আপাতত ভূলুন্ঠিত।
- সৌরব চক্রবর্ত্তী লেখক ও সমাজকর্মী।