পয়লা জানুয়ারি, ২০২১, ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘আলাপিনী মহিলা সমিতি ‘ যেটি দেশের প্রাচীনতম মহিলা সংস্থার একটি, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সেই অফিসটি দখল নেওয়ার লক্ষ্যে সেটি সিল করে দিয়েছেন। ১০৪ বছরের পুরানো এই সমিতি বিশ্বভারতীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বলাবাহুল্য, এই গোটা ঘটানাটা শুধুমাত্র অনভিপ্রেত নয়, বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্র ভাবধারার পরিপন্থী। অর্ণব সেনগুপ্ত-এর প্রতিবেদন।
প্রকৃতির মাঝে, প্রতিবেশীর সাথে সহাবস্থানের মাধ্যমে এক অখণ্ড বিশ্ব নীড়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ভাবধারার চর্চা-চর্যা ক্রমশই ক্ষীয়মান। সেই ক্ষীণ ধারাটিকে, বর্তমান উপাচার্যের নেতৃত্বে, আগ্রাসী পথে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বদলে দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য একটাই এক দেশ, এক জাতি, এক ইতিহাস, এক সংস্কৃতির শিকলে বিশ্বভারতীর গৈরিকিকরণ। সুচতুর নিপুণ পরিকল্পনায় একদিকে যেমন চলছে পুরনো চিহ্ন মুছে দেওয়ার কাজ, তেমনই জোর কদমে চলছে নতুন নির্মাণ। সে কারণেই ঘন্টাতলা ভেঙে পড়ে আছে কতকাল। বিশ্বভারতীর নানা পুরাতন স্থাপত্য যত্নের অভাবে জরাজীর্ণ। এসব চিহ্ন এখন গুরুত্বহীন। চলছে সারা শান্তিনিকেতন জুড়ে পাঁচিল তৈরির কাজ। পৌষ মেলার মাঠ পাঁচিলে আবদ্ধ জেলখানায় পরিণত হয়েছে। তৈরি হয়েছে বলাকা গেট, নতুন শপিং কমপ্লেক্স— ভারততীর্থ। এই নবরূপদান প্রকল্পের সাম্প্রতিক সংযোজন আশ্রম প্রাঙ্গণ থেকে আলাপিনী মহিলা সমিতির উচ্ছেদ।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠেছিল আলাপিনী মহিলা সমিতি ১৯১৬ সালে। নামকরণ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। যোগ দিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির মহিলারা আর আশ্রমিক শিক্ষকদের স্ত্রীরা। আলাপিনী-র নেতৃত্ব একদিকে সমাজকল্যাণ মূলক কাজ গড়ে ওঠে, যেমন— মেধাবী ছাত্রীদের বই পুরস্কার বিতরণ, রক্তদান শিবির, পৌষমেলায় দোকান দিয়ে হাতের কাজ ও খাবার বিক্রি, পাঠভবনের কিচেনে গিয়ে আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের খাবার সময় দেখাশোনা করা।সংঘটিত হয় সাংস্কৃতিক কাজ, যেমন— ‘শ্রেয়সী’ পত্রিকার প্রকাশ, শারদোৎসবে নাটক, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন। সমিতির সবথেকে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে শিশু শিক্ষার কাজে যুক্ত হওয়া। তৈরি হয় ‘আনন্দ পাঠশালা’। বর্তমানে ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’ নামে সেটি শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ১৯৫৬ সালে উপাচার্য শ্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী-র সাহায্যে ‘নতুন বাড়ি’ সংস্কার হওয়ার পর, আলাপিনী স্হায়ী চর্চা কেন্দ্র পায়।
বর্তমান উপাচার্য এখন সেই বাড়ি ব্যবহারের জন্য টাকা দাবি করেছেন। পয়লা জানুয়ারি, ২০২১, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সেই অফিসটি দখল নেওয়ার লক্ষ্যে সিল করে দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, এই গোটা ঘটানাটা শুধুমাত্র অনভিপ্রেত নয়, বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্র ভাবধারার পরিপন্থী। হাতে গুটিয়ে বসে নেই আলাপিনীর বর্তমান সদস্যরাও। বয়স আর শারীরিক বাঁধাকে উপেক্ষা করে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালার গেটের সামনে নিয়মিত অবস্থানের। সমস্ত সমমনভাবাপন্ন সংগঠন, শুভানুধ্যায়ীদের তাঁরা আহ্বান করেছেন, একত্রিত হয়ে এই প্রতিবাদে যোগ দিতে।