ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটীকরণ যদি আমাদের কৃষিব্যবস্থার নবীনতম প্রবণতা হয়ে থাকে তাহলে কর্পোরেটদের চরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতায় প্রবীন পাঞ্জাবের কৃষকরাই যে এই আধুনিক দ্বন্দ্বকে সর্বোত্তমরূপে উপলব্ধি করে এ আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠবেন তাতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই। টিকরি সীমান্ত থেকে শংকর দাস-এর প্রতিবেদন।
স্বাধীন দেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ কৃষক আন্দোলন, যা আমরা দেখছি চোখের সামনে, তাকে কালিমালিপ্ত করার জন্য, ছোট করার জন্য মোদি সরকার, আর.এস.এস-বিজেপির আর গোদি মিডিয়ার কতই না প্রয়াস! একটা কথা বলা হচ্ছে যে এই আন্দোলন মূলত পাঞ্জাবের আন্দোলন। MSP বা সরকারের দেওয়া সর্বোচ্চ সাহায্য মূল্য বাতিল হয়ে যাবার ভয়ে ওখানকার কৃষকরা এই আন্দোলন করছে।
প্রথমত, একথা বলে সরকার নিজেই প্রমাণ করছে যে, তারা এমন কিছু একটা ঘটিয়েছে যাতে সাহায্য মূল্য বাতিল হয়ে যাবার ভয়টা কৃষকদের মনে ঢুকেছে। অথচ, আবার তারাই কৃষকদের প্রবোধ দিতে চাইছে, MSP বহাল থাকবে। এদিকে কৃষক নেতারা যখন বলছেন, মুখের কথায় হবে না, আইন করো, পার্লামেন্ট ডাকো। তখন কিন্তু তারা তা মানতে রাজি হচ্ছে না।
যাই হোক না কেন, এই আন্দোলন কিন্তু শুধুমাত্র পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলন নয়। সিঙ্ঘু এবং বিশেষ করে টিকরি বর্ডারে ভালো রকম উপস্থিতি রয়েছে হরিয়ানার কৃষকদের। হরিয়ানায় কৃষকদের পক্ষে জনমত কতটা তীব্র হয়ে উঠেছে তা বোঝা যাচ্ছে খাপ পঞ্চায়েতের আচরণে। এই খাপ পঞ্চায়েতের কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু সামাজিকভাবে বিজেপির কাছাকাছি, তাদেরই সমর্থক। কিন্তু হৈ হৈ করে তারা নেমে পড়েছে কৃষকদের সমর্থনে। রাজস্থানে এনডিএ-তে ফাটল ধরেছে। রাজস্থান সীমান্তে সেখানকার কৃষকদের জমায়েত দমনপীড়ন উপেক্ষা করে বাড়ছে। গাজিপুরে উত্তরপ্রদেশ সীমান্তেও সেখানকার কৃষকরা বেশ জমিয়ে বসেছেন। মনে রাখতে হবে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি বিজেপি শাসিত দিল্লির সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির পুলিশ কিন্তু ভয়ংকর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে কৃষক আন্দোলনের ওপর। সে সব উপেক্ষা করেই কিন্তু এগোতে হচ্ছে।
সর্বভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি প্রথম যখন দিল্লি অভিযানের পরিকল্পনা করে তখনই ঠিক হয়েছিল দিল্লিকে ঘিরবে কাছাকাছি রাজ্যগুলির কৃষকরা। অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী অঞ্চলের কৃষকরা নিজ নিজ রাজ্যে সংহতিমূলক কর্মসূচি নেবে। এই পরিকল্পনা দারুনভাবে সফল হয়েছে। তাই, উত্তরভারতীয় রাজ্যগুলির কৃষকদেরই এই ঘেরাবন্দীর সৈনিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু ফসলের ন্যয্যা এবং উচিত দাম পাওয়ার বিষয়টা একটা সর্বভারতীয় সমস্যা। পাঞ্জাব, হরিয়ানার মত পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারের কৃষকদের কাছেও এটি আক্ষরিক অর্থেই জীবনমরণের প্রশ্ন। কৃষক আত্মহত্যা সব রাজ্যেরই বৈশিষ্ট্য, পশ্চিমবঙ্গেরও। আর সেটা কিন্তু ‘বউ-এর সাথে ঝগড়া করে’ হয় না, যা বোঝাতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা।
কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও এই আন্দোলনে পাঞ্জাবের কৃষকদের মধ্যে৷ যে একটা অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যাছে তা কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। বিপুল অংশগ্রহণ, সঙ্গে চমৎকার সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের একটা বিশিষ্টতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার মধ্যে পাঁচশোর বেশি কৃষক সংগঠন রয়েছে। তার মধ্যে যে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশটা অগ্রগামী বলে চিহ্নিত তার বেশিরভাগটাই পাঞ্জাবের। সচেতনাতেও তাঁরা অত্যন্ত এগিয়ে। পাঞ্জাবের জমায়েত থেকে যেভাবে কর্পোরেট-বিরোধী স্লোগান উঠছে তাতে বোঝা যাচ্ছে বর্তমানে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট বনাম কৃষক দ্বন্দ্বটিকে তাঁরা অতি স্পষ্টতায় চিনে নিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা কর্পোরেট চিনেছেন এই সেদিন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে। কিন্তু পাঞ্জাব কি সেই “সবুজ বিপ্লব”-এর সময় থেকেই কর্পোরেট চিনতে শেখেনি? সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতির ওপর দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের একচেটিয়া আধিপত্য কি ইতিমধ্যেই নরক বানিয়ে তোলেনি? আর এখন, কৃষি উৎপাদের ওপর বহুজাতিকদের একচেটিয়া দখলদারি যে সেই নরককে আরও ভয়াবহ করে তুলবে তা বুঝে নিতে তাঁদের ভুল হয়নি। ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটীকরণ যদি আমাদের কৃষিব্যবস্থার নবীনতম প্রবণতা হয়ে থাকে তাহলে কর্পোরেটদের চরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতায় প্রবীন পাঞ্জাবের কৃষকরাই যে এই আধুনিক দ্বন্দ্বকে সর্বোত্তমরূপে উপলব্ধি করে এ আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠবেন তাতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই।
কিন্তু তার পরেও আরও কিছু কথা থাকে। শুধু এইটুকু দেখলেই ‘ভারত দর্শন’ সম্পূর্ণ হয় না। সিঙ্ঘু সীমান্তে একটা স্টলের ব্যানারে আমার চোখ আটকে গেল যথারীতি। সেখানে লেখা, ‘আর্য হোমিওপ্যাথিক ক্লিনিক’। সাথে সাথে আমার চোখে ভেসে উঠল সপ্তসিন্ধুর দেশের মহাকাব্যিক ইতিহাস। কতই না কান্ড ঘটেছে এই সিন্ধু, বিপাসা, পারুষনি অথবা শতদ্রুর তীরে। সুদাসের নেতৃত্বে আর্য বাহিনী দখল নিয়েছিল এই বিস্তীর্ণ জনপদের। এখানে বসেই ঋগ্বৈদিক ঋষিরা রচনা করেছেন বেদ। বৈদিক সভ্যতার পীঠস্থান এই অঞ্চল। বৈদিক দর্শন এবং ধ্যানধারণারও। কিন্তু মধ্যকালীন সময়ে এসে সহসা ভাবনা-চিন্তা, দর্শনের পাশা ঘুরিয়ে দিলেন মহাগুরু নানক। গাঙ্গেয় উপত্যকায় যা বহু আগেই ঘটিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। বৈদিক ধ্যানধারণায় ইতিমধ্যে জাঁকিয়ে বসা জাতি-বর্ণের ভেদবিচার আর অসমানতার বিরুদ্ধে নানকের সমানতা, সৌভ্রাতৃত্ব আর সেবার বাণী পাঞ্জাবকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আদি-বৈদিক সমানতা আর সৌভ্রাতৃত্ব যেন নেতির নেতি হয়ে ফিরে এল নানকের হাত ধরে। শিখরা আজ তাই বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, তাঁদের উপার্জনের একটা অংশ নিয়ম করে গুরুদুয়ারাতে দান করে থাকেন। আর প্রতিটি শিখকে, তিনি যত বড় ব্যাপারী বা শিল্পপতিই হোন না কেন, মাসে একদিন গুরুদুয়ারাতে কায়িক শ্রম বিনা বিনিময়ে দান করতেই হয়। আজ সিঙ্ঘু বা টিকরি সীমান্তে যে অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা দেখা যাচ্ছে তা কিন্তু একদিনে অর্জিত হয় নি। দশম গুরু গোবিন্দ সিং এর মধ্যে প্রবিষ্ট করে দিয়েছিলেন বীরত্ব, সাহস আর আত্মত্যাগের ধারণা। তৈরি হয়েছিল ‘খালসা’, অর্থাৎ যোদ্ধাবাহিনী। খালসাতে কিন্তু শুধুমাত্র পুরুষই নয়, মহিলারাও আছে। খালসার পুরুষ সদস্যরা নিজেদের “সিং” বলে অভিহিত করে, মহিলারা “কাউর”। তৈরি হল হার না মানার মনোভাব, যে কোন ধরণের পরাধীনতাকে ঘৃণার মনোভাব। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে, বা পরবর্তীকালের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে পাঞ্জাব যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছিল তা তো এমনি এমনি নয়!
আর এ সবের সঙ্গেই কোথাও যেন ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে কৃষক হিসাবে এক প্রবল গর্ববোধ। বঙ্গদেশে যেমন আমরা “চাষাভুষো” বলে বেশ খানিকটা নিচু নজরেই দেখেছি কৃষক বা কৃষিকাজ, পাঞ্জাবে কিন্তু তা হয়নি। শিখবাদের সঙ্গে প্রবল কৃষক-অস্মিতার উপস্থিতি এবং তারই সঙ্গে বহুজাতিক এবং কর্পোরেটদের প্রকৃত স্বরূপ চিনে নেওয়ার সৌভাগ্য —- এই ত্রহ্যস্পর্ষই বোধহয় আজ পাঞ্জাবকে আজকের লড়াইয়ের নেতা করে তুলেছে।
ওয়াহে গুরুজী কী খালসা
ওয়াহে গুরুজী কী ফতে!
- লেখক রাজনৈতিক কর্মী।