মাত্র ক’দিন আগে ২০২০-র ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এনআরসি-র বর্তমান রাজ্য সমন্বয়ক (সিইও) হিতেশ দেবশর্মা হাইকোর্টে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ভুলে ভরা এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়া তালিকা দেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরূপ হয়ে উঠেছে। এই পুনর্বিবেচনার আর্জিসহ সুপ্রিম কোর্টেও যাবার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। তাঁদের দাবি অনুসারে শেষতম তালিকাটিও একটি সাপ্লিমেন্টারি লিস্ট। আদালতকে জানানো হয়েছে বহু নাম ভুলবশত তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন বিদেশীর তালিকা আরও বহু স্তরে বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হবার দিকে এ এক অশুভ পদক্ষেপ। লিখছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র।
এতদিনে সবাই বুঝে গেছে যে আসামে নাগরিকপঞ্জী-নবায়ন (এনআরসি) একটি বৃহৎ অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। বিজেপি এবং বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলি এই ঘটনাকে নিজেদের জয় এবং অন্যের পরাজয় হিসেবে দেখাতে চাইছেন। বিশেষ করে এমন একটা প্রেক্ষাপটে, যখন সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক গোষ্ঠী, ব্যক্তি, সরকার, নাগরিক ও অনাগরিক, ভারতীয়, বিদেশী, ভূমিপুত্র, বহিরাগত, প্রত্যেকে এনআরসি তালিকাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মনে রাখতে হবে আসামের প্রেক্ষাপটে হিন্দুত্ববাদী এবং ঐস্লামিক শক্তিগুলি এদেরই লেজ ধরে ঝুলে থেকে নিজেদের পতনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এমনকি সংসদীয় বামপন্থীরাও। কেননা ভোট এবং ক্ষমতা বড় বালাই। আত্মরক্ষা এবং বংশবৃদ্ধি জীবের মূল ধর্ম। তাই যে বামপন্থী, কংগ্রেস ইত্যাদিরা পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি-র প্রবল বিরোধী, তাঁরাই প্রত্যেকে আসামে এনআরসি-র সমর্থক। এমনকি যখন এনআরসি সিএএ বিরোধী আন্দোলনে কাঁপছে সারা ভারত, তখনো আসামে হিন্দুরা এনআরসি সিএএ সমর্থক আর মুসলিমরা এনআরসি সিএএ বিরোধী। এই টলটলায়মান পরিবেশে রাজনৈতিক দলগুলির ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হল কোভিড-আতঙ্ক। প্রত্যেকে নিজেদের অবস্থানকে একটু গুছিয়ে নেবার অবকাশ পেল। এতদিন গৃহবন্দী থেকে আন্দোলনেরও ধ্বস্তপ্রায় অবস্থা। জীবনের ভয় এত তীব্রভাবে ঢুকে গেছে মানুষের মধ্যে, যার সামনে যৌথ বিতাড়নের আশঙ্কাও তুচ্ছ। হিন্দু নেতারা ভগবানকে, মুসলিম নেতারা আল্লাহকে আর কমিউনিস্টরা সকাল বিকেল নিয়ম করে কার্ল মার্কসকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন।
একবছর শীতঘুমে কাটানোর পর দেখা যাচ্ছে, ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাবার ফলে এ দেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও করোনা ভীতি কেটে যাচ্ছে দ্রুত। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে থিতিয়ে পড়া এনআরসি আতঙ্ক। যেখানে ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকেই শুরু হয়ে গেছে নতুন করে এনআরসি আতঙ্ক ছড়ানো। ২০১৯-এর মাঝামাঝি সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক গোষ্ঠী প্রভৃতি প্রত্যাশা করছিল বা আশঙ্কা করছিল যে, তালিকাচ্যুত মানুষের সংখ্যা পঞ্চাশ বা ষাট লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে; সেসময় চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেল তালিকাছুটের সংখ্যা উনিশ লক্ষের সামান্য বেশী। মানে চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা, যা ৩১ অগাস্ট ২০১৯-এ প্রকাশিত হয়েছিল, তার থেকে ১৯,০৬,৬৫৭ জনকে বাদ দিয়ে ৩,৩০,২৭, ৬৬১ জন আবেদনকারীর মধ্যে ৩,১১,২১,০০৪ জনের নাম তখনই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, এবং তখন বলা হয়েছিল এটাই চূড়ান্ত তালিকা। এতে কেউ উল্লসিত, কেউ হতাশাগ্রস্ত, কেউ আতঙ্কিত, কেউ আশ্বস্ত। একথা এখন রাষ্ট্রনিনাদিত যে, এই তালিকায় প্রচুর পরিমাণে প্রকৃত ভারতীয় মানুষের নাম বাদ গেছে এবং অসংখ্য প্রকৃত বিদেশীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অভিযোগ এই যে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় হাজার হাজার আদিবাসিন্দার (অরিজিনাল ইনহ্যাবিট্যান্টস) নাম এনআরসি তালিকার বাইরে রয়ে গেছে।
মাত্র ক’দিন আগে ২০২০-র ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এনআরসি-র বর্তমান রাজ্য সমন্বয়ক (সিইও) হিতেশ দেবশর্মা হাইকোর্টে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ভুলে ভরা এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়া তালিকা দেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরূপ হয়ে উঠেছে। এই পুনর্বিবেচনার আর্জিসহ সুপ্রিম কোর্টেও যাবার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। তাঁদের দাবি অনুসারে শেষতম তালিকাটিও একটি সাপ্লিমেন্টারি লিস্ট। আদালতকে জানানো হয়েছে বহু নাম ভুলবশত তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন বিদেশীর তালিকা আরও বহু স্তরে বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হবার দিকে এ এক অশুভ পদক্ষেপ। রাজ্যের তেত্রিশটি জেলার মধ্যে পঁচিশটি জেলার জেলাশাসক এবং ডিআরসিআর-রা এনআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট দিয়ে, ঘোষিত বিদেশী ডি-ভোটার এবং কেস পেন্ডিং মানুষ ও তাঁদের পরিবার, যাদের নাম এনআরসি তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এমন ১০৩২ জন কে চিহ্নিত করেছে। অন্যান্য আরও কিছু কারণে আরও ৩,৭৬৩ জন আবেদনকারীর নাম ইতিমধ্যেই বাদ গেছে।
হিতেশ দেবশর্মা হলফনামায় আরও বলেছেন যে, শুনানির সময় ডিসপোজিং অফিসাররা এইসব ক্যাটেগরি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি, তার একটা কারণ হল, সার্কল অফিসার, একজন মেম্বার, নির্বাচনী আধিকারিক, এলআরসিআর, এইআরও এবং সীমান্ত পুলিশের প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি হওয়া সার্কল লেভেল কমিটি (সিএলসি) পূর্ণাঙ্গ তথ্য ডিসপোজিং অফিসারদেরদের দিতে পারেননি। দ্বিতীয় কারণ হল, বংশবৃক্ষ যাচাই করার সফ্টওয়ারটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সফ্টওয়ারটি তৈরি হয়েছিল এমনভাবে, যাতে ডেটা আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গে ভেরিফিকেশন অফিসারের ল্যাপটপ স্ক্রীন থেকে সে ডেটা মুছে যায়। পরবর্তীতে চেক করার কোনও উপায় থাকে না। এই ডেটা সরাসরি এনআরসি ডেটাবেসে চলে যায়। এই সামান্য বিষয়টি আবিষ্কার করতে এতগুলি বছর, এতগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হল? আসল কথাটি হল, সিস্টেমটি করাই হয়েছিল যাতে কাঙ্ক্ষিত নাম অন্তর্ভুক্ত করা আর অনাকাঙ্ক্ষিত নাম বাতিল করার পর শুনানি পর্যায়ের কোনও ডকুমেন্টারি এভিডেন্স বা মন্তব্য ডিও-র ল্যাপটপে থেকে না যায়। আজ এতদিন পর সেই ইচ্ছাকৃত ত্রুটিকেই নতুন করে কারণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে, কারণ গোটা প্রক্রিয়াটি বুমেরাং হয়ে যাবে তা আগে মাথায় আসে নি। লিঙ্কেজ ভেরিফিকেশন রেজাল্ট রিভিউ সিস্টেম(এলভিআরআরএস)-এর সফ্টওয়্যারে ত্রুটি রাখাই হয়েছিল, যাতে প্রমাণ লোপাট করে লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দেওয়া যায়।
এখানেই না থেমে হিতেশ দেশশর্মা হাইকোর্টে হলফনামায় বংশবৃক্ষ যাচাই অসফল হওয়ার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ জানিয়েছে। তা হল, একাংশ ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের অসততা (অনেকদিন ধরেই আসাম বিজেপি, সীমান্ত জেলাগুলিতে শুধুমাত্র মুসলিম ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের দিকে ইঙ্গিত করে আসছে)। বলা হচ্ছে, নিয়োগের সময় এদের নাগরিকত্ব, আনুগত্য এবং সততা নাকি যাচাই করা হয়নি। ঐ পর্যায়ে কী করে নাগরিকত্ব, আনুগত্য এবং সততা যাচাই করা যেত, তা অবশ্য বলা হয়নি। বলা হয়েছে, রুটিন পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে এঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। শুধুমাত্র অপরাধমূলক কাজকর্মের রেকর্ড না থাকলেই যোগ্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
হলফনামায় আরও বলা হয়, ৩১ অগাস্ট ২০১৯-এ প্রকাশিত তালিকা থেকে ২৭ শতাংশ নাম নতুন করে স্ক্রুটিনি করার পর দেখা গেছে, প্রায় ১০২৪৬২ নাম ভুলভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁরা মনে করছেন যে, কমপক্ষে ২.৭৭ লক্ষ নাম বাদ পড়বে। ৩১ অগাস্ট ২০১৯ তারিখে এলআরসিপি-র মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও তা ছিল আরও একটি সাপ্লিমেন্টারি তালিকা মাত্র। চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়াই প্রকাশ করতে পারেন, ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব শিডিউলের (নাগরিক নিবন্ধীকরণ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু-করণ) ৭ নং ধারা অনুসারে। এছাড়াও বিজেপি এবং এজিপি (অর্থাৎ কিনা আসাম সরকার), যাদের উপর এই নবায়নের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল, তারাও এখন সুপ্রিমকোর্টের কাছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে ২০ শতাংশ এবং অন্যত্র ১০ শতাংশ রিভিউয়ের দাবি তুলেছেন।
- লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক।
Either of the Government or the NRC machinery does not seem to be serious to draw out an action plan to include the genuine Indian citizens who have been left over from the final list.