পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি এ রাজ্যে গুজরাট মডেল চালু করা নিয়ে যে বিপুল প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে অনেকেই হয়তো ‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্নে বিভোর হচ্ছেন। সম্প্রতি ‘অন্ন সুরক্ষা অভিযান’-এর যে রিপোর্ট সামনে এসেছে তা এই ‘গুজরাট মডেল’কে বড় প্রশ্নের সামনে ফেলে দিচ্ছে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
‘গুজরাট মডেল’। যা সারা দেশ জুড়ে চালু করার জন্য অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। অবশ্য এই মডেল চালু হয়ে গেলে দেশের কি হাল হতে পারে, তা দেশের নানা প্রান্তে শাসক দলের উসকানিতে সংঘটিত হিংসার মানচিত্র দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সেখানে যে ভয়াবহ হিংসা ও মানবনিধন চলেছিল তা স্মৃতি থেকে মোছার নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা তারই ইঙ্গিত। বিশেষত চলতি বছরের শুরুতে উত্তর দিল্লির ভয়াবহ দাঙ্গা ছিল এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তবে সব ছাপিয়ে ‘অন্ন সুরক্ষা অভিযান’-এর যে রিপোর্ট সামনে এসেছে তা এই ‘গুজরাট মডেল’কে আরও বড় প্রশ্নের সামনে ফেলে দিচ্ছে।
বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আরও বেশি করে সচেতন হওয়া প্রয়োজন এই কারণেই যে, আগামী বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি এ রাজ্যে গুজরাট মডেল চালু করা নিয়ে যে বিপুল প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে অনেকেই হয়তো ‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্নে বিভোর হচ্ছেন। অবশ্য এ রাজ্যে বর্তমান শাসক দলের ভূমিকাও মোটেই আশাপ্রদ নয়। বিশেষত এই সমীক্ষার পশ্চিমবঙ্গের রিপোর্ট যা ইতিমধ্যেই গ্রাউন্ডজিরো-তে প্রকাশিত, তাতে দেখা যাচ্ছে ক্ষুধার এই সমীক্ষাতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও লজ্জাজনক।
এবার আসা যাক গুজরাটে অন্ন সুরক্ষা অভিযান (এএসএএ) পরিচালিত ‘হাঙ্গার ওয়াচ’ নামের এই সমীক্ষাটির প্রসঙ্গে। সারা দেশের ১১টি রাজ্যে এই সমীক্ষার কাজ চলেছে, যার মধ্যে রয়েছে গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গও। কোভিড মহামারী চলাকালীন লকডাউন পরবর্তীতে দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষুধার অবস্থা কীরকম তাই নিয়েই চলেছিল এই সমীক্ষার কাজ। সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, গুজরাটে সমীক্ষাকৃত পরিবারে মধ্য ২০.৬% জানিয়েছন কোনও এক বেলার খাবার তারা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছন, আর ২১.৮% পরিবার জানিয়েছেন তারা এক বেলা না খেয়ে ঘুমোতে বাধ্য হয়েছেন। আহমেদাবাদ, আনন্দ, ভারুচ, ভাবনগর, দাহোদ, মোরবি, নর্মদা, পঞ্চমহলস্ ও ভদোদরা – গুজরাটের এই ন’টি জেলায় সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাস জুড়ে গ্রাম-শহর মিলিয়ে মোট ৪০৩টি সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা পরিবারে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল নাগরিকদের খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টির বিষয়টি এই মহামারী চলাকালীন সময়ে কী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তা বিশদে জানার জন্য। সেখান থেকে এই ভয়াবহ তথ্যটিও উঠে আসে যে বহু পরিবার অত্যাবশকীয় খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করাও বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৩৮% মানুষ জানিয়েছেন তাঁরা চাল/ভাত ও গম/রুটি জাতীয় খাবার খাওয়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, ৪০.৭% জানিয়েছিলেন তাঁরা ডাল খাওয়া কমাতে বাধ্য হয়েছেন ও ৫৭.৬% মানুষ জানিয়েছিলেন তাঁরা এমনকি সব্জি খাওয়াও কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। সমীক্ষা চালানো হয়েছে যাঁদের উপরে তাঁদের মধ্যে ৯১.১% গ্রামীণ এলাকার, ৪৯.৪% মহিলা, ৬৪.৫% দিনমজুরের কাজ করেন ও ৩৮.৭% কৃষক।
তবে সবচেয়ে মারাত্মক বিষয়টি ঘটেছে স্থানীয় তালুক বা জেলা স্তরে। রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সেখানে বহু রেশন কার্ডকে স্রেফ ‘সাইলেন্ট’ করে রেখে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সেগুলি আর ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। রেশন কার্ড যা না কি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলির সুলভে অত্যাবশকীয় খাদ্যদ্রব্য পেতে অত্যাবশক। এই রেশন ব্যবস্থা দরিদ্র মানুষদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্যে বিনা ঘোষণায়, কোনওরকম সঠিক তথ্য রাজ্য সরকারের তরফে রেশন কার্ড ব্যবহারকারীদের না জানিয়ে এরকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ পরিবারই আর্থিকভাবে চূড়ান্ত পিছিয়ে পড়া ও রেশনে প্রাপ্ত অত্যাবশকীয় খাদ্যদ্রব্যর উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তার উপরে কোভিড সংক্রমণের কারণে তালুক স্তরে মিটিং মিছিল বন্ধ থাকায় এই পরিবারগুলি তাদের খাদ্য সুরক্ষার দাবি নিয়ে সোচ্চারও হতে পারছেন না।
গুজরাটের সামগ্রিক চিত্রটি কী এবং কতটা অসহায় অবস্থায় সেখানকার দরিদ্র সম্প্রদায়কে দিন কাটাতে হচ্ছে তা বোঝার জন্য সমীক্ষায় প্রাপ্ত কয়েকটি তথ্যই যথেষ্ঠ – (ক) রোজগারের জন্য ৩২% মানুষকে একের বেশি কাজের উপর নির্ভর করতে হয়, (খ) ৩৫% মানুষ হয় গৃহহীন নতুবা বস্তিতে থাকেন, (গ) সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪০৩টি পরিবারের মধ্যে ৫০.৪% মাসে ৩০০০ টাকার কম রোজগার করেন, (ঘ) ৮৩% বাড়ি একক নারী দ্বারা চালিত হয়। এই সমীক্ষা থেকেই জানা গেছে এমন কিছু জনগোষ্ঠী, নির্দিষ্টভাবে বললে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া মানুষদের মধ্যে ১৩৫ জন যাঁরা জঙ্গলে গিয়ে শিকড়-বাকড় তুলে বা শিকার করে পেট চালান, তাঁদের মধ্যে ১৫.৫% জানিয়েছেন লকডাউনে এমনকি তাঁদের জঙ্গলে ঢোকার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। অর্থাৎ নানাভাবে রাজ্যের প্রান্তিকতম নাগরিকদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্তই করে ফেলা হয়েছে বিখ্যাত ‘গুজরাট মডেল’-এর অধীনে।
এই চরম বিপন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সমীক্ষার পক্ষ থেকে কিছু বিশেষ আবেদন জানানো বা বলা ভালো পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গুজরাট সরকারকে। যদিও তা সরকারের কান পর্যন্ত পৌঁছবে কি না বা পৌঁছলেও তা বাস্তবায়িত হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়ে যায় ও তা না হওয়ার সম্ভাবনাই শতকরা ৯৯ ভাগ। প্রথমত বলা হয়েছে, যেহেতু রাজ্যবাসীর জীবন-জীবিকা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তাই শহর-গ্রাম নির্বিশেষে দ্রুত এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পের অধীনে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজ্য সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে একটি সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে হবে, যার অধীনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আগামী ছ’মাসের জন্য ১০ কেজি খাদ্যশষ্য, মোট ১.৫ কেজি ডাল ও ৮০০ গ্রাম রান্নার তেল দিতে হবে। তৃতীয়ত, পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবার যারা রাজ্য সরকারের অন্ন ব্রহ্ম প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত তাদের পিডিএস দোকান থেকে খাদ্যশষ্য পাওয়া যেন আপাতত চলতে থাকে, যতদিন না অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।
এই হল ‘গুজরাট মডেল’, বিকাশ-এর নামে এই চূড়ান্ত অবনমন নিশ্চয়ই শুধু নিজের রাজ্য কেন দেশের কোথাওই দেখতে চাই না আমরা। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও তথৈবচ। খুব সংক্ষেপে বললে –
১) রাজ্যের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত অবস্থায় শুতে যান
২) এমন পরিবারের সংখ্যা সম্প্রতি দ্বিগুণ হয়েছে যেখানে পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে থাকতে বাধ্য হন
৩) সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৪৪% মানুষকে বর্তমানে শুধু খাবারের জন্য অনেক বেশি ঋণ করতে হচ্ছে
৪) সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ২৭% মানুষ মনে করেছেন তাঁদের খাদ্যের পরিস্থিতি দ্রুত আরও খারাপ হবে
পশ্চিমবঙ্গে ‘হাঙ্গার ওয়াচ’-এর সমীক্ষা রিপোর্ট পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় ‘দুয়ারে সরকার’ এনে নানা প্রকল্প ঘোষণা করে যতই নির্বাচনের আগে জনমোহিনী হয়ে ওঠার চেষ্টা করা হোক না কেন রাজ্যবাসীর খিদের প্রশ্ন মহামারী, লকডাউন, আর্থিক মন্দার বাজারে যেন আরও বেশি উঠে আসছে।
সামনে নির্বাচন। গদি দখলের লড়াই। ভোটের আগে মিঠে বুলি, প্রকল্পের ঘনঘটা সবই চলতে থাকবে। কিন্তু খিদের মুখে অন্ন যোগাতে হবে রাষ্ট্রকেই, সরকারকেই। নির্বাচনে যুযুধান সব পক্ষ যেন ক্ষুধার্ত মুখগুলিকে ভুলতে না পারে আর এই প্রতিটি মুখ যেন নিরন্ন দিন-রাতের উত্তর চাইতেই থাকেন, যতদিন না মুখে ভাত ওঠে।