সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পুনরুত্থান/পুনরুজ্জীবন


  • December 9, 2020
  • (0 Comments)
  • 3529 Views

পুঁজিবাদের কাঠামোগত সঙ্কট এবং ক্রমবর্ধমান শ্রেণি-মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রের উত্থান যদি এতই প্রত্যক্ষ হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে: কী ধরনের সমাজতন্ত্র ? একুশ শতকের সমাজতন্ত্র ঠিক কোন কোন দিক থেকে বিশ শতকের সমাজতন্ত্রের থেকে আলাদা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যত্র সমাজতন্ত্র বলতে যা বোঝানো হয় তা অনেকাংশেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে স্থিত, সংসদীয় গণতন্ত্রনির্ভর সোশাল ডেমোক্রেসির রকমফের। তার মর্মার্থ উদারনৈতিক বামপন্থীদের সঙ্গে, এবং কাজেই, বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে জোট গঠন করে নয়া-উদারনীতিবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সমাজকল্যাণকে তুলে ধরার মাধ্যমে পুঁজিবাদকে দিয়ে ভালোভাবে কাজ করানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। লেখক: জন বেলামি ফস্টার। বাংলা অনুবাদ প্রসিত দাস

 

আজকের দিনে সমাজতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন সংক্রান্ত যে কোনও আন্তরিক আলোচনার সূচনা-বিন্দু হতে পারে একটিই বিষয় – পুঁজিবাদ দ্বারা আমাদের সামাজিক অস্তিত্বের সমস্ত ভিত্তির রীতিমতো সৃজনশীল ধ্বংস। ১৯৮০-র দশকের শেষভাগ থেকেই ‘বিপর্যয়’ পুঁজিবাদের (catastrophe capitalism) যুগ এই পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। বিপর্যয় পুঁজিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “পুঁজির সর্বনাশা রথের” নানান অপ্রত্যাশিত অভিঘাতের কারণে চারিদিকে আসন্ন বিপর্যয়ের পুঞ্জীভূত স্তূপ। আজকের দিনে, এই অর্থে বিপর্যয় পুঁজিবাদের প্রকাশ ঘটছে তিনটি বিষয়ের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে – (১) বিশ্বব্যাপী বাস্তুতান্ত্রিক/পরিবেশ সঙ্কট, (২) বিশ্বজোড়া মহামারির সঙ্কট এবং (৩) অন্তহীন বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমানের “বিশৃঙ্খলার সাম্রাজ্যের” (empire of chaos) প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি। তাদের মধ্যে অন্যতম, বিশ্বজোড়া পণ্য-শৃঙ্খল বা সাপ্লাই চেইন মারফত চরম সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ব্যবস্থা; নয়া-উদারনীতিবাদ ও নয়া-ফ্যাসিবাদের উত্থানের পাশাপাশি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল উদার-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৃত্যু; এবং বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের ক্ষেত্রে অস্থিরতার এক নতুন যুগের অভ্যুদয়, যার দোসর সীমাহীন যুদ্ধবিগ্রহের বিপদ বৃদ্ধি।

 

জলবায়ু সঙ্কটের বর্তমান অবস্থাকে বিশ্বের বৈজ্ঞানিকেরা সর্বসম্মতিক্রমে বলছেন “তুলনাহীন পরিস্থিতি”। অর্থ, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি কয়লা/তেল জাতীয় জীবাশ্ম জ্বালানির দহনজনিত কার্বন নিঃসরণের মোট পরিমাণকে শূন্যে নামিয়ে আনা না-যায়, তাহলে এই শিল্প-সভ্যতার, এবং আখেরে মানবজীবনেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এতদসত্ত্বেও, অস্তিত্বের এই সঙ্কট কিন্তু শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ব পরিবেশের অন্যান্য সীমানাগুলিও যথেচ্ছ লঙ্ঘিত হচ্ছে  প্রতিদিন। বিশ্বপ্রকৃতির যে ব্যবস্থা আমাদের পৃথিবীকে মানবজাতির পক্ষে নিরাপদ বাসস্থান করে তুলেছে, সীমানা লঙ্ঘনের ফলে সেই ব্যবস্থার বাস্তুতন্ত্রের বিন্যাসে চিড় ধরেছে। বিশ্বপরিবেশের ভারসাম্যের বিভিন্ন নির্দিষ্ট সীমানা যথেচ্ছ লঙ্ঘনের অন্যতম ফলাফল: (১) মহাসাগরের জলে অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি; (২) বিভিন্ন জৈব প্রজাতির অবলুপ্তি (এবং জিন বৈচিত্র্যের বিলোপ); (৩) অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয়; (৪) পরিষ্কার জলের মাত্রা হ্রাস; (৫) নাইট্রোজেন ও ফসফরাস চক্র ব্যাহত হওয়া; (৬) পরিবেশে (রেডিওনিউক্লাইড সহ) বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া; (৭) জিন-পরিবর্তিত (জেনেটিকালি মডিফায়েড) উদ্ভিদ ও প্রাণীর নিয়ন্ত্রণহীন সংখ্যা বৃদ্ধি।

 

পরিবেশের সীমানা লঙ্ঘন ব্যাপারটাই পুঁজিবৃদ্ধির/ পুঁজিসঞ্চয়ের ব্যবস্থার মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য – এই ব্যবস্থা তার কার্যত সীমাহীন ও ক্রমবর্ধমান বিস্তারের পথে কোনও বাধাকেই অলঙ্ঘনীয় বলে স্বীকার করে না। কাজেই, বর্তমানে পুঁজিবাদের হাতে অস্তিত্বের সামাজিক ও প্রাকৃতিক শর্তগুলি যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে, পুঁজিবাদের গণ্ডি থেকে বেরোতে না-পারলে সেই ধ্বংসযজ্ঞের পরিস্থিতি থেকে বেরোনোরও কোনও পথ খোলা নেই। এক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয় হল “প্রকৃতির সঙ্গে সমাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার (বা আন্তঃসম্পর্কের) পুনরুৎপাদন”-এর (social metabolic reproduction) একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। পরিভাষাটি ইস্তভান মেজারোস তাঁর বিয়ন্ড ক্যাপিটাল গ্রন্থে ব্যবহার করেছেন। এই ধারণাটি একুশ শতকে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী হিসেবে সমাজতন্ত্রের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, কিন্তু সেই সমাজতন্ত্রকে যেভাবে ভাবা হয়েছে তা সমাজতন্ত্রের বিশ শতকীয় তত্ত্ব ও প্রয়োগগুলিকে গভীর প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

 

শ্রেণি-ব্যবস্থার মেরুকরণ

 

বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একচেটিয়া অর্থপুঁজির প্রধান নিয়ামকদের মদতে মূলত শ্বেতাঙ্গ নিম্ন-মধ্যবিত্তদের বিভিন্ন অংশকে একটি জাতীয়তাবাদী, বর্ণবিদ্বেষি ও নারীবিদ্বেষি মতাদর্শের ছাতার তলায় জমায়েত করা গেছে। ফলস্বরূপ, একটা সদ্যোজাত নব্যফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এই শ্রেণির রাজনৈতিক মূলধন বলতে কি? এক,  দাসব্যবস্থা। দুই, আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের ছিন্নমূল নিশ্চিহ্ন করে সাদা-চামড়াদের বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশবাদ। এবং তিন, বিশ্বব্যাপী সমরবাদ/সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারজাত বর্ণবিদ্বেষ, যা রাষ্ট্ৰ বা শাসনব্যবস্থায় ওতপ্রোত। এই উদীয়মান নয়া-ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আগে থেকেই বর্তমান নয়া-উদারনৈতিক রাজনৈতিক ধাঁচার সম্পর্কটি “শত্রুপক্ষীয় ভ্রাতৃত্বের” – তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য যেনতেন প্রকারেন ক্ষমতা দখলের আগ্রাসী প্রচেষ্টা ও শ্রমিক শ্রেণির দমন। তথাকথিত কট্টর দক্ষিণপন্থীদের নেতার ভূমিকায় নিউ ইয়র্কের আবাসন শিল্পের রাঘব বোয়াল ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে এই পরিস্থিতিই। এরই জেরে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী নীতি ও একটি নতুন স্বৈরাচারী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাসক শ্রেণির নয়া-উদারনৈতিক অংশটি যদি আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতেও যায় এবং ট্রাম্পকে গদি থেকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় জো বাইডেন-কে আনতে সমর্থ হয়, সেক্ষেত্রেও, পুঁজিবাদী শ্রেণির একেবারেই ভিতরকার প্রয়োজনের কারণে, রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে থেকে যাবে একচেটিয়া অর্থপুঁজির অধীনস্থ এক নয়া-উদারনীতিবাদী-নয়া-ফ্যাসিবাদী জোট।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই নতুন প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের পাশাপাশি সমাজতন্ত্র-অভিমুখী আন্দোলনেরও পুনরুত্থান ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সে আন্দোলনের মূল ভিত্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণি এবং রাষ্ট্রীয় নীতি-বিরোধী বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্যের মৃত্যু ঘটেছে এবং সে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে উৎপাদন-ব্যবস্থার বিশ্বায়ন। শ্রমিক শ্রেণির কিছু সুবিধাভোগী অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদকে অবলম্বন করে যে শ্রমিক অভিজাততন্ত্র গড়ে উঠেছিল, এই ঘটনায় তা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সেই কারণেই সমাজতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের পুনরুত্থান ঘটছে। মাইকেল ডি. ইয়েট্‌স যাকে “বিরাট অসাম্য” নাম দিয়েছেন, সেই অসাম্যের মুখোমুখি হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, বিশেষ করে যুবসমাজ দেখতে পাচ্ছে যে তাদের সামনে যাবতীয় ভবিষ্যত সম্ভাবনা দ্রুত ফুরোচ্ছে। সম্ভাবনার জায়গা নিচ্ছে অনিশ্চয়তা এবং হতাশাময় এমন এক অবস্থা, যার ধাক্কায় “হতাশাজনিত মৃত্যু”-র সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে প্রায় তড়িৎগতিতে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এই যুবক-যুবতীদের কোনও আশার বাণী শোনায় না, তাই এই ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও বেশি বেশি করে বেড়ে চলেছে। এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি তাদের আকর্ষণ বাড়ছে, কারণ সমাজতন্ত্রই তাদের সামনে একমাত্র খাঁটি বিকল্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিটি যদিও অনন্য, তা সত্ত্বেও একই ধরনের বস্তুগত(অবজেক্টিভ) শক্তির উপস্থিতি পৃথিবীর অন্যত্রও দেখা যাচ্ছে এবং সেই শক্তিগুলিও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পুনরুত্থানের দিকে সমাজকে চালিত করছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির স্থবির দশা, অর্থপুঁজির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিশ্বজোড়া বাস্তুতান্ত্রিক অবক্ষয়ের এই যুগে একথা প্রাথমিকভাবে প্রযোজ্য বিশ্বের দক্ষিণ (Global South) বা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রে।

 

কিন্তু, পুঁজিবাদের কাঠামোগত সঙ্কট এবং ক্রমবর্ধমান শ্রেণি-মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রের উত্থান যদি এতই প্রত্যক্ষ হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে: কী ধরনের সমাজতন্ত্র? একুশ শতকের সমাজতন্ত্র ঠিক কোন কোন দিক থেকে বিশ শতকের সমাজতন্ত্রের থেকে আলাদা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যত্র সমাজতন্ত্র বলতে যা বোঝানো হয় তা অনেকাংশেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে স্থিত, সংসদীয় গণতন্ত্রনির্ভর সোশাল ডেমোক্রেসির রকমফের। তার মর্মার্থ উদারনৈতিক বামপন্থীদের সঙ্গে, এবং কাজেই, বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে জোট গঠন করে নয়া-উদারনীতিবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সমাজকল্যাণকে তুলে ধরার মাধ্যমে পুঁজিবাদকে দিয়ে ভালোভাবে কাজ করানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অথচ, এ পথ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন নয়া-উদারনীতিবাদ নিজেই নয়াফ্যাসিবাদের কাছে হারতে বসেছে। ইতিহাসের বর্তমান প্রেক্ষিতে এ জাতীয় আন্দোলন গোড়াতেই ব্যর্থ হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল ডেমোক্রেসির এই পথ ধরলে, আশার যে ঝিলিক দেখিয়ে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়। তার কারণ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির মূল ঝোঁক নিছক নির্বাচনী গণতন্ত্রের দিকে। সৌভাগ্যবশত, সত্যিকারের সমাজতন্ত্রের বৃদ্ধিও আজকের সময়ে আমাদের চোখে পড়ছে। তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে নির্বাচনের বাইরের সংগ্রামে, তীব্রতর গণ-উদ্যোগে এবং সমাজের সামগ্রিক পুনর্গঠনের জন্য বর্তমান ব্যবস্থার মাপকাঠি এবং সীমানাগুলিকে পেরিয়ে যাওয়ার আহ্বানের মধ্যে।

 

মার্কিন সমাজের মধ্যে সাধারণভাবে যে অস্থিরতার পরিস্থিতি প্রচ্ছন্ন ছিল তা প্রকট হয়ে ওঠে এ বছর মে মাসের শেষের দিকের এবং জুন মাসের গণ অভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থান ব্যাপক সংহতিমূলক প্রতিবাদের (solidarity protests) চেহারা নেয় – যা সেই মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত মার্কিন ইতিহাসে বাস্তবত অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। এই সময় শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার অপরাধে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণি ও শ্বেতাঙ্গ যুব সমাজ গণহারে রাস্তায় নেমে বর্ণ-বিভাজনের সীমারেখা (color line) অতিক্রম করেন। কোভিড-১৯ অতিমারি ও তার সঙ্গে সংযুক্ত অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই ঘটে যাওয়া এই ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেকে আনে বিক্ষোভতাড়িত জুন মাস।

 

বর্তমান পুঁজিব্যবস্থার “বর্বর প্রাণকেন্দ্র” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সমাজতন্ত্র-অ ভিমুখী আন্দোলন বিভিন্ন বস্তুগত শক্তির সৌজন্যে শেকড় গাঁড়ছে বটে, কিন্তু সে আন্দোলনে পর্যাপ্ত বিষয়ীগত(সবজেক্টিভ) ভিত্তির অভাব আছে। আজকের দুনিয়ায় সমাজতন্ত্রের রণণীতিগত লক্ষ্যগুলির পরিকল্পনা তৈরির পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় বিশ শতকের সমাজতন্ত্রের ইতিহাস। কার্ল মার্কস আদিতে যেভাবে কমিউনিজম বা সাম্যবাদের কল্পনাকে রূপ দিয়েছিলেন, সেই আদর্শকে বিশ শতকের সমাজতন্ত্র নিজেই পরিত্যাগ করেছে। এই সমস্যাটিকে বোঝার জন্য সাম্যবাদের অর্থকে নিছক দার্শনিক ভিত্তি থেকে দেখাবোঝার সাম্প্রতিক বামপন্থী চেষ্টাগুলির বাইরে বেরোতে হবে। এই দার্শনিক ভিত্তির প্রশ্নটিই গত দশকে দ্য কমিউনিস্ট আইডিয়া, দ্য কমিউনিস্ট হাইপোথিসিসদ্য কমিউনিস্ট হরাইজন জাতীয় লেখালিখিতে আলাঁ বাদিউ ও অন্যান্যদের বিষয়টিকে বিমূর্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার পথে চালিত করেছে। এক্ষেত্রে বরং প্রয়োজন অধিকতর বাস্তবমুখী একটি সূচনা-বিন্দু – যার ভিত্তি ইতিহাসের মধ্যে প্রোথিত এবং যার প্রত্যক্ষ কেন্দ্রবিন্দু মার্কসের ক্রিটিক অফ দ্য গোথা প্রোগ্রাম ও ভিআই লেনিনের দ্য স্টেট অ্যান্ড রেভোলিউশন থেকে উঠে আসা সমাজতান্ত্রিক/কমিউনিস্ট বিকাশের দুই পর্যায়ভিত্তিক তত্ত্ব। অর্ধ শতকেরও বেশি আগে ১৯৬৩ সালের অক্টোবরে মান্থলি রিভিউ-তে প্রকাশিত পল এম. স্যুইজি-র প্রবন্ধ “কমিউনিজম অ্যাজ অ্যান আইডিয়াল” আজ এ প্রসঙ্গে একটি ধ্রুপদী পাঠ্যবস্তু হয়ে উঠেছে।

 

সমাজতান্ত্রিক আদর্শ হিসেবে মার্কসের কমিউনিজম

 

মার্কস ক্রিটিক অফ দ্য গোথা প্রোগ্রাম লিখেছিলেন জার্মান সমাজ গণতন্ত্রের ফার্দিনান্দ লাসাল প্রভাবিত অর্থনীতিবাদী(ইকোনমিস্ট) ও শ্রমিকবাদী(ওয়ার্কারিস্ট) শাখাটির বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে। এই লেখাটিতে তিনি মুক্ত সমবায়ী উৎপাদকদের সমাজ(ফ্রি য়্যাসোসিয়েটেড প্রোডিউসারস) গড়ে তোলার সংগ্রামে দুটি ঐতিহাসিক “পর্যায়”-কে চিহ্নিত করেন। প্রথম পর্যায়টির সূত্রপাত ঘটাবে “সর্বহারার বিপ্লবী একনায়কত্ব,” এই পর্যায়টির মধ্যে দিয়ে পারি কমিউনের শ্রেণি সংগ্রামের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটবে এবং এটি শ্রমিক গণতন্ত্রের কালপর্বের প্রতিনিধিত্বসূচক। কিন্তু এই পর্যায়টি পুঁজিবাদী শ্রেণিবিভক্ত সমাজের “গলদগুলিকেও” বহন করবে। এই প্রাথমিক পর্যায়টিতে শুধু পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তিকেই বিলোপ করা হবে না, পুঁজিবাদের নির্দেশ-কাঠামো হিসেবে বিরাজমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেরও বিলুপ্তি ঘটানো হবে। এই পর্যায়টিতে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের চরিত্র সীমিত, তাই তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে এই পর্যায়ে উৎপাদন ও বন্টনের ধাঁচায় অবধারিতভাবেই প্রত্যেকে নিজের শ্রম অনুযায়ী পাবে । কাজেই অসাম্যের পরিস্থিতি বজায় থাকবে, কিন্তু সেই পরিস্থিতিকে অতিক্রম করার শর্তাবলিও গড়ে উঠবে। এর বিপরীতে পরবর্তী পর্যায়টিতে সমাজ পরিচালিত হবে প্রত্যেকে নিজের সাধ্য অনুযায়ী দেবে, আর প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে এই নীতি দ্বারা, এবং মজুরি-ব্যবস্থার বিলোপ ঘটবে। অনুরূপভাবে সমাজতন্ত্র/কমিউনিজম-এর প্রাথমিক পর্যায়ে বৈপ্লবিক সময়পর্বটিতে নতুন একটি রাজনৈতিক নির্দেশ-কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়বে, কিন্তু উচ্চতর পর্যায়টিতে লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রের বিলোপ। এই উচ্চতর পর্যায়ে সমাজের মাথার উপর এবং তার সঙ্গে বৈরিতামূলক অবস্থানে রাষ্ট্র নামক কোনও যন্ত্র আর দাঁড়িয়ে থাকবে না। তার জায়গা নেবে রাজনৈতিক সংগঠনের অন্য একটি ধাঁচা, যাকে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস বলেছেন “কৌম,” যা সমবায়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা উৎপাদন-ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত।

 

সমাজতন্ত্র/কমিউনিজম-এর পথে রূপান্তরের এই পরবর্তী ও উচ্চতর পর্যায়ে শুধু যে সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সমবায়ের হাতে থাকবে তা-ই নয়, উপরন্তু সমাজ যে অংশগুলিকে নিয়ে গঠিত সেগুলিকেও সমবায়ী ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা হবে এবং উৎপাদন-প্রক্রিয়া থাকবে উৎপাদকদের সমবায়ের হাতে। মার্কস বলেছেন যে এই পরিস্থিতিতে শ্রম আর নিছক “জীবনধারণের হাতিয়ার” হয়ে থাকবে না, বরং তা “নিজেই … জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজন” হয়ে উঠবে। যে সমাজে “সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত” হবে “প্রত্যেকের স্বাধীন বিকাশ,” সেই সমাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই উৎপাদনও পরিচালিত হবে ব্যবহার-মূল্যের জন্য, বিনিময়-মূল্যের জন্য নয়। পুঁজিবাদী শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বিলুপ্তি এবং সমবায়ী উৎপাদকদের সমাজ গঠিত হওয়ার ফলে শ্রেণি-শোষণের অবসান ঘটবে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক শ্রমের এবং শহর-গ্রামের বিভাজনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। গেরস্থালিতে মহিলাদের দাসত্বের উপর ভিত্তি গড়ে ওঠা একগামী ও পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের গণ্ডিও অতিক্রম করা সম্ভব হবে। মার্কসের এই সমবায়ী উৎপাদকদের সমাজের উচ্চতর পর্যায়ের গোটা কল্পনাটির অন্যতম মূলগত বৈশিষ্ট্য মানবসমাজ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি নতুন ধরনের সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক। এই নতুন সমাজ কী ধরনের বস্তুগত শর্তাবলি দ্বারা পরিচালিত হবে সে প্রসঙ্গে তাঁর সর্বাধিক সাধারণ মন্তব্যটিতে মার্কস বলেছেন: “এই ক্ষেত্রটিতে [প্রাকৃতিক প্রয়োজনের ক্ষেত্র] স্বাধীনতার শর্ত হতে পারে একটিই, সামাজিক মানুষ, সমবায়ী উৎপাদকরা প্রকৃতির সঙ্গে মানবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে যুক্তিসঙ্গত পথে পরিচালনা করবে … ন্যুনতম পরিমাণে প্রাকৃতিক শক্তি ব্যয় করে তারা কার্যসিদ্ধি করবে,” এটিই টিকে থাকার যোগ্য মানবিক বিকাশের পরিস্থিতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া।

 

দ্য স্টেট অ্যান্ড রেভোলিউশন-এ এবং অন্যত্র লেনিন উচ্চতর ও নিম্নতর পর্যায় সম্পর্কে মার্কসের যুক্তিগুলিকে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। এই পর্যায়গুলিকে সাম্যবাদের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করে লেনিন “সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের মধ্যে বৈজ্ঞানিক পার্থক্য” টানার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে এই পার্থক্যের মধ্যে দিয়েই দেখানো যায় যে, “সাধারণত যাকে সমাজতন্ত্র বলা হয়, তাকেই মার্কস কমিউনিস্ট সমাজের ‘প্রথম’ বা নিম্নতর পর্যায়ের আখ্যা দিয়েছেন,” আর কমিউনিজম পরিভাষাটির অর্থ “সম্পূর্ণ সাম্যবাদ,” যা সর্বাধিক জুৎসইভাবে প্রযুক্ত হয়েছে উচ্চতর পর্যায়টির ক্ষেত্রে। লেনিন এই পার্থক্যটিকে মার্কসের বিশ্লেষণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালের সরকারি মার্কসবাদে এই পার্থক্যটিকে দুটি আলাদা পর্যায়ের নিরিখে একটি কট্টর পার্থক্যে পরিণত করা হয়, যেখানে তথাকথিত কমিউনিস্ট পর্যায়টি সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ের থেকে এতই দূরবর্তী যে তা কার্যত আকাশকুসুম কল্পনায় পরিণত হয়, কাজেই কমিউনিজমকে আর ধারাবাহিক বা চলমান সংগ্রামের অংশ হিসেবে দেখাই হয় না। সমাজতান্ত্রিক পর্যায়কে এবং প্রত্যেকের শ্রম অনুযায়ী বন্টনের অন্তর্বর্তী নীতিটিকে জোসেফ স্তালিন একটি আঁকাড়া ধারণা হিসেবে দেখেছেন। আর সেই ধারণার ভিত্তিতে তিনি প্রকৃত সাম্যের আদর্শের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন, কারণ তাঁর মতে সেই আদর্শ “প্রতিক্রিয়াশীল, পাতি বুর্জোয়াসুলভ অর্থহীন, তা আদিম সন্তদের কোনও গোষ্ঠীর পক্ষে উপযোগী, কিন্তু মার্কসবাদী পন্থায় সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে নয়।” সোভিয়েত ইউনিয়নে মিখাইল গর্বাচভের আমল পর্যন্ত এই অবস্থানই কোনও-না-কোনওভাবে বজায় থেকেছে।

 

কাজেই, মাইকেল লেবোভিৎজ তাঁর দ্য সোশালিস্ট ইম্প্যারেটিভ-এ যেভাবে বলেছেন, “মার্কস যাকে পুঁজিবাদী সমাজ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ‘গলদ’ বলেছেন তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে,” মার্কসবাদের “পোশাকি ভাষ্য” ১৯৩০-এর দশকের শেষ থেকে ১৯৮০-র দশকের শেষাশেষি পর্যন্ত এই অর্ধ-শতকে “পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজকে দুটি পৃথক ‘পর্যায়ে’ ভাগ করার তত্ত্ব চালু করেছে,” আর সেখানে এই বিভাজন নির্ধারিত হয় অর্থনীতির ভিত্তিতে, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ কোন স্তরে রয়েছে তার নিরিখে। সমাজতান্ত্রিক পথের মর্মবস্তু হিসেবে মার্কস সামাজিক সম্পর্কের যে মূলগত পরিবর্তনগুলির উপর জোর দিয়েছিলেন, পুঁজিবাদী সমাজ থেকে বাহিত বিভিন্ন গলদের সঙ্গে বসবাস করার এবং সেগুলির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ধারাবাহিকতায় সেই পরিবর্তনগুলির ভাবনা পরিত্যক্ত হয়েছে। অথচ মার্কস জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে, সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের চলমান, এবং সম্ভবত অবধারিতভাবেই অসম, প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ এমন একটি প্রকল্প, যার লক্ষ্য “গোড়া থেকেই” সমবায়ী উৎপাদকদের কৌম গড়ে তোলা।

 

সাম্যবাদের উচ্চতর পর্যায় সম্পর্কে মার্কসের ধারণার সঙ্গে যুক্ত সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে পরিত্যাগ করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে বস্তুগত (এবং শ্রেণিগত) পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। এবং সোভিয়েত ধাঁচের সমাজগুলির চূড়ান্ত অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গেও বটে। পদ্ধতিটি জটিল। এই শেষোক্ত সোভিয়েত ধাঁচের সমাজগুলিতে চলমান বিপ্লবের কাজ থেমে যাবার পরপরই দেখা দিয়েছে স্থবিরতা, এমনকী নতুন শ্রেণির উদয়। নতুন এক প্রশাসনিক শ্রেণি বা নোমেনক্লেচুরা (Nomenklatura) গোটা ব্যবস্থাটিকেই পরিত্যাগ করায়, তা এই সমাজগুলির চূড়ান্ত ভাঙনকে ডেকে এনেছে। ১৯৭১ সালে স্যুইজি যেমনটি লিখেছিলেন: “টিকে থাকার উপযোগী যে সমাজতন্ত্র অধঃপতনের বিপদকে প্রতিরোধ করতে সমর্থ এবং বিকাশের গতির দ্বিতীয় পর্যায়ে কমিউনিজমের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম, সেই সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানা আর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়।” আরও কিছুর প্রয়োজন ছিল: প্রয়োজন ছিল সমকক্ষ মানুষদের সমাজ গড়ে তোলার জন্য ধারাবাহিক সংগ্রামের।

 

মার্কসের মতে সমাজতান্ত্রিক পন্থার মর্মবস্তুই হল সংযুক্ত উৎপাদকদের সমাজ গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হওয়া,  এবং সে মর্মবস্তু “সাম্যবাদী চেতনার” মধ্যে নিহিত। কিন্তু বিশেষ করে ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রকে অপেক্ষাকৃত সীমাবদ্ধ অর্থে ও অর্থনীতিবাদের নিরিখে সংজ্ঞায়িত করে দেওয়ার ফলে সেই ব্যবস্থায় কার্যত অসাম্যের পক্ষেই ওকালতি করা হয়েছে। এবং ‘স্বাধীনতা’ ও ‘প্রয়োজনে’র উপযুক্ত ভারসাম্য অর্জনের লক্ষ্যে যে দ্বিমুখী সংগ্রাম, তার সঙ্গে বিপ্লব-উত্তর সমাজের জীবন্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কাজেই সমাজতন্ত্রের যে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থেকে সেই সমাজ অতীতে তার নিজস্ব অর্থ ও সংহতি আহরণ করেছে, সেই লক্ষ্যের থেকেই সে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

 

এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একথা স্পষ্ট যে একুশ শতকে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার একমাত্র পথ হল সমাজতান্ত্রিক/সাম্যবাদী আদর্শের কিছু বিশেষ উপাদানকে গ্রহণ করা, অর্থাৎ ঠিক সেই উপাদানগুলিকেই গ্রহণ করা যেগুলি তত্ত্ব ও প্রয়োগকে বৈপ্লবিক হয়ে ওঠার ছাড়পত্র দেয় – এতদূর বৈপ্লবিক যে সেই তত্ত্ব ও প্রয়োগ বর্তমানের জরুরি প্রয়োজনগুলি মেটাতে সমর্থ হয় এবং তার পাশাপাশি ভবিষ্যতের প্রয়োজনগুলিও তার দৃষ্টি এড়ায় না। বিশ্বের বাস্তুতান্ত্রিক সঙ্কট থেকে আমরা যদি কোনও শিক্ষা পেয়ে থাকি, তা এই যে বর্তমানে প্রয়োজন পৃথিবীর সঙ্গে একটি নতুন ধরনের সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উপযোগী বাস্তুতন্ত্র এবং বাস্তব সাম্যের সমাজ। কিউবায় বাস্তুতান্ত্রিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে অসাধারণ অগ্রগতি ঘটেছে সেখানে এই শিক্ষাটি স্পষ্টই চোখে পড়ে। সম্প্রতি গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল চেঞ্জ পত্রিকায় প্রকাশিত “দ্য এফেক্ট অফ কিউবান অ্যাগ্রোইকোলজি ইন মিটিগেটিং দ্য মেটাবলিক রিফ্‌ট” শীর্ষক প্রবন্ধে মরিসিও বেটানকোর্ট তা দেখিয়েছেন। গেয়র্গ লুকাচ যাকে মানবিক সামাজিক সম্পর্কের এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের সম্পর্কের প্রয়োজনীয় “দ্বৈত রূপান্তর” আখ্যা দিয়েছেন, তার সঙ্গে এই ধারণাটি সঙ্গতিপূর্ণ। এহেন একটি মুক্তিকামী প্রকল্পকে অবশ্যই নানান ধরনের বিপ্লবী পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে – সেই পর্যায়গুলি কী তার আগাম পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও বিপ্লবকে যদি সফল হতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই একটি সুসংবদ্ধ ব্যবস্থাকে তুলে ধরার মাধ্যমে নিজেকে অপরিবর্তনীয় (ইরিভার্সিবল) করে তুলতে হবে, আর সেই ব্যবস্থার লক্ষ্য হবে মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন মেটানো। তার ভিত্তি হবে মূলগত সাম্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের উপর যুক্তিগ্রাহ্য নিয়ন্ত্রণ।

 

স্বাধীনতা যখন প্রয়োজনীয়তা

 

একথা সুবিদিত যে জি ডাবলু এফ হেগেলের দর্শনের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস অ্যান্টি-ডুরিং-এ মত প্রকাশ করেছিলেন, প্রকৃত স্বাধীনতার শেকড় প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে প্রোথিত। বৈপ্লবিক পরিবর্তন হল সেই বিন্দু যেখানে বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে স্বাধীনতা ও প্রয়োজনীয়তার মিলন ঘটে। একদা মানুষের জ্ঞানের সীমানার বাইরে অন্ধ, নির্বিচার প্রয়োজন বলেও কিছুর অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু মানুষ যখন বস্তুগত শক্তিগুলির অর্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হল তখন আর সে প্রয়োজন আর নির্বিচার থাকেনি, বরং তা মানুষের সামনে মানবিক কাজের ও স্বাধীনতার নতুন পথ হাজির করেছে। প্রয়োজন এবং স্বাধীনতা পরস্পরকে পুষ্ট করেছে। তার ফলেই সামাজিক পরিবর্তনের ও ইতিহাসের সীমানা-ডিঙোনো উত্তরণের বিভিন্ন নতুন কালপর্যায়ের দরকার হয়ে পড়েছে। বস্তুবাদী দ্বন্দ্বমূলক নীতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেনিনের নিবিষ্ট পর্যবেক্ষণ, “আবহাওয়ার বিষয়ে প্রকৃতির প্রয়োজন ঠিক কী তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু আমাদের জানা-না থাকলেও একথা আমরা জানি যে সেটির অস্তিত্ব আছে।” আমরা জানি যে আমাদের বিভিন্ন কাজ প্রভাবিত করতে সক্ষম এমন সব উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সাধারণ প্রক্রিয়াও অবধারিতভাবেই বদলায়।

 

আজকের দিনে মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু সঙ্কট এবং আবহাওয়ার চরম পরিস্থিতি সম্পর্কে যে জ্ঞান আমরা অর্জন করেছি তা মানুষকে নির্বিচার প্রয়োজনের ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। সময়ের দাবি, এই পৃথিবীর মানুষ স্বাধীনতার ও অস্তিত্বের চূড়ান্ত লড়াইয়ে বিপর্যয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেও চূড়ান্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হোক। উনিশ শতকে ব্রিটিশ উপনিববেশবাদের ফলস্বরূপ আয়ারল্যান্ডে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে যে তীব্র ভাঙন তৈরি হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মার্কস দেখিয়েছেন যে এক্ষেত্রে বাস্তুতান্ত্রিক সঙ্কট হাজির হয়েছিল “ধ্বংস অথবা বিপ্লব” এই আহ্বান নিয়ে। মানবকেন্দ্রিক এই ভূতাত্ত্বিক যুগে (য়্যানথ্রপসিন) পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিস্তারের ফলস্বরূপ পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে যে ভাঙন ধরেছে তার মাত্রা একমাত্র এই গ্রহের জীবমণ্ডলের জৈব-ভৌগোলিক-রাসায়নিক চক্রের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু এই সব বস্তুগত ঘটনাসম্ভূত জ্ঞান মানবসমাজের সঙ্গে পৃথিবীর সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিপ্লবী বদলের কথাও আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। এই প্রেক্ষিত থেকে দেখলে মার্কসের “সংযুক্ত উৎপাদকদের কৌম”-এর গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটিকে আদপেই আর নিছক এক অবাস্তব ধারণা বা বিমূর্ত আদর্শবাদ মনে করা যায় না, বরং তা হয়ে ওঠে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে মানবসমাজের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষার মর্মবস্তু, এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির টেকসই সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো সওয়াল।

 

কিন্তু এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে কাদের দ্বারা? এ প্রশ্নের উত্তর হল, একটি বিশেষ শ্রেণির আবির্ভাবের বস্তুগত প্রাকশর্তগুলি আমরা প্রত্যক্ষ করছি – সেই শ্রেণিটিকে বলা যেতে পারে বিশ্ব পরিবেশ সর্বহারা ( global environmental proletariat)। ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত এঙ্গেলসের কন্ডিশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড-এ তথাকথিত প্লাগ প্লট দাঙ্গার কিছুদিন পরে এবং জঙ্গি চার্টিস্টপন্থার চরম মুহূর্তে ম্যাঞ্চেস্টারে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা সম্পর্কে একটি বর্ণনা ও বিশ্লেষণ আছে। এঙ্গেলস শুধুমাত্র কারখানার ভেতরের পরিস্থিতির নিরিখেই শ্রমিক শ্রেণীর জীবনধারণের পরিবেশকে তুলে ধরেননি, বরং অনেক বেশি মাত্রায় নজর দিয়েছেন নগরোন্নয়ন, বাসস্থান, জলের জোগান, নিকাশি-ব্যবস্থা, খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ কিংবা শিশুদের বিকাশের মতো বিষয়গুলির। তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে ছিল পুঁজিবাদের দ্বারা গায়ের জোরে আরোপিত মহামারীর পক্ষে অনুকূল সাধারণ পরিবেশ (এঙ্গেলস একে বলেছিলেন “সামাজিক হত্যাকাণ্ড” এবং পরে নর্মান বেথুন একে “দ্বিতীয় অসুস্থতা” আখ্যা দিয়েছিলেন), তার সঙ্গে যুক্ত বিশেষ করে বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগের ফলে অসুস্থতা ও মৃত্যুর ব্যাপক হার। এঙ্গেলসের প্রত্যক্ষ প্রভাবে এবং পূর্বোক্ত বইটি প্রকাশিত হওয়ার বছর কুড়ি পরে ক্যাপিটাল লেখার সময় সামাজিক মহামারীবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ মার্কস প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের ভাঙনকে শুধুমাত্র ভূমির অবক্ষয়ের নিরিখেই দেখেননি, বরং তাকে সমানভাবেই বুঝেছেন, তাঁর নিজেরই ভাষায়, সমাজের নিজের দ্বারাই সৃষ্ট “পর্যায়ক্রমিক মহামারী”-র নিরিখেও।

 

রাশিয়া ও চিনের বিপ্লব থেকে শুরু করে আজকের দিনে বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধে ঘটে চলা বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্যেও এমন বিস্তর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এই সমস্ত কিছু আমাদের যা জানায় তা হল শ্রেণি সংগ্রাম ও বৈপ্লবিক মুহূর্ত, বস্তুগত প্রয়োজনীয়তার এবং বস্তুগত পরিস্থিতির মধ্যে থেকে উদ্ভূত স্বাধীনতার দাবির সমাহারের ফসল। আর সেই বস্তুগত পরিস্থিতি স্রেফ অর্থনৈতিকই নয়, বরং ব্যাপকতম অর্থে পরিবেশগতও বটে। সুতরাং যখন অর্থনৈতিক ও বাস্তুতান্ত্রিক পরিস্থিতির সমাহার সামাজিক পরিবর্তনকে প্রয়োজনীয় করে তোলে এবং যেখানে সামাজিক শক্তি ও সম্পর্কগুলি এই ধরনের পরিবর্তনকে সম্ভব করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট বিকশিতও বটে, তখন এবং সেখানেই বিপ্লবের পরিস্থিতি গড়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা। এই প্রসঙ্গে, আজকের বিশ্ব অবস্থান থেকে দেখলে, পরিবেশ সর্বহারার প্রশ্নটি বাস্তুতান্ত্রিক কৃষকসমাজ এবং কৌমসমাজের(ইনডাইজেনস) কাছে জীবনযাপনের সংগ্রামের প্রশ্নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তার থেকে অবিচ্ছেদ্যও বটে। অনুরূপভাবে, পরিবেশ-ন্যায়ের যে সংগ্রাম আজকে বিশ্বজোড়া পরিবেশ আন্দোলনের জীবনীশক্তি তা-ও মর্মবস্তুর দিক থেকে শ্রমিক শ্রেণির এবং জনগণেরই সংগ্রাম।

 

এই অর্থে গোটা বিশ্বজুড়েই বিশেষ একটি শক্তি হিসেবে পরিবেশগত সর্বহারার উত্থান ঘটছে। কোভিড-১৯-এর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং বাস্তুতন্ত্র ও মহামারীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংগ্রামের চলতি পর্যায়ে সেকথা অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে অদূর ভবিষ্যতে বৈপ্লবিক বাস্তুতান্ত্রিক পদক্ষেপের মূল কেন্দ্রস্থল হতে চলেছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি, তার কারণ এই দেশগুলি বর্তমান “য়্যানথ্রপসিন যুগের সাম্রাজ্যবাদ”-এর কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন। সামির আমিন তাঁর মডার্ন ইম্পিরিয়ালিজম, মনোপলি ফিনান্স ক্যাপিটাল অ্যান্ড মার্কসেজ ল অফ ভ্যালু বইয়ে জানিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপান এই ত্রয়ী ইতিমধ্যেই এই গ্রহের জৈব বা প্রাকৃতিক সম্পদ জোগান দেওয়ার ক্ষমতার আন্তর্জাতিক গড়ের চারগুণ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছে, যা সার্বিক বাস্তুতান্ত্রিক অবলুপ্তির দিকে ইঙ্গিত করছে। আর উত্তর গোলার্ধের প্রথম বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগের এই টিকিয়ে-রাখার-অযোগ্য স্তরটি বহাল রাখা যে সম্ভব হচ্ছে তার একমাত্র কারণ, তৃতীয় বিশ্বের সমাজের প্রাকৃতিক সম্পদ জোগান দেওয়ার মোট ক্ষমতার একটি বিরাট অংশ [উক্ত ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত] এই কেন্দ্রগুলি নিয়ে নিচ্ছে এবং তাদের স্বার্থে কাজে লাগানো হচ্ছে। অন্যভাবে বলতে গেলে পুঁজিবাদের চলতি বিস্তার এই গ্রহকে এবং মানবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই বিস্তারের যুক্তিসঙ্গত পরিণতি হয় দক্ষিণ গোলার্ধের মানুষদের – “অত্যধিক জনসংখ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করে  বাস্তবিক গণহত্যা, কিংবা নিদেনপক্ষে সদাবর্ধমান দারিদ্রের কারাগারে তাদের চিরবন্দি রাখা। বাস্তুতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের একটি বিশেষ চিন্তাধারা বেড়ে উঠছে, যা সমস্যার এহেন “চূড়ান্ত সমাধান”-কে বৈধতা জোগায়।

 

প্রকৃতির সঙ্গে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পুনরুৎপাদনের নতুন একটি ব্যবস্থা

 

সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের যে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য প্রয়োজন ও স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে সামাজিক পুনরুৎপাদনের একটি নতুন ব্যবস্থা নির্মাণ, সেই প্রক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদি রণনীতির মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে সামগ্রিক একটি “অভিমুখের নীতি” এবং “সম্পাদিত কর্মকাণ্ডের মাপকাঠি” – এগুলিকে বাদ দিয়ে এহেন বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গেই মেজারোসের চিন্তাধারা অনুসরণ করে বলা যায় যে প্রকৃত সাম্যের বা সমমানুষদের সমাজের, এবং তারই অংশ হিসেবে, প্রকৃত গণতন্ত্রের ধারণা আজকের সংগ্রামে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে। এই ধারনাসমূহ পুঁজির বর্বর অন্তঃস্থলের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তো বটেই, পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে যে কোনো আধাখ্যাঁচড়া ও চূড়ান্ত বিচারে নিরর্থক উদ্যোগেরও বিরোধিতা করে। ফরাসি বিপ্লবের কিছুকাল পরেই ইম্যানুয়েল কান্ট তাঁর এই মন্তব্যটিতে প্রধান লিবরেল দৃষ্টিভঙ্গিটি তুলে ধরেছিলেন: “কোনও রাষ্ট্রের প্রজা হিসেবে সমস্ত মানুষের সাধারণ ঐক্যের পাশাপাশিই অবস্থান করে সম্পত্তির উপর মানুষের মালিকানার মাত্রাগত অসাম্য…। কাজেই মানুষের সাধারণ সাম্যের সঙ্গেই সহাবস্থান করে বিশেষ বিশেষ অধিকারের বিরাট অসাম্য, সেই বিশেষ অধিকার নানান ধরনেরই হতে পারে।” এইভাবেই সাম্য নেহাতই পোশাকি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, এঙ্গেলস যেমনটি দেখিয়েছেন, তার অস্তিত্ব নিছকই “কাগজে-কলমে।” আর একথা শুধু পুঁজিবাদী আর শ্রমিকের শ্রম বিষয়ক চুক্তির ক্ষেত্রেই খাটে না, নারী-পুরুষের বৈবাহিক চুক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মার্কস দেখিয়েছেন যে এহেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় “অন্তর্বস্তুগতভাবে অসাম্যের অধিকার, আর পাঁচটা অধিকারের মতোই।” মার্কসের সাম্যবাদের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যে বাস্তবিক সাম্যের ধারণা তা এই সমস্ত কিছুর বিরোধতা করে। সমাজ যে অংশগুলিকে নিয়ে গঠিত, এই ধারণা সেগুলির মধ্যে পরিবর্তন আনার দাবি জানায়। এই ধারণা অনুযায়ী এই অংশগুলি আর ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যস্ত কাঠামোবিশিষ্ট (হায়ারার্কিক) রাষ্ট্রের অধীনে মালিকানাপ্রিয় ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তি-পুঁজি দ্বারা গঠিত হতে পারে না, বরং তার ভিত্তি হতে হবে সংযুক্ত উৎপাদকদের যৌথ এবং  সমাজরাষ্ট্র বা কমিউনাল স্টেট। ক্ষমতা সমাজের নীচের তলা থেকে গঠিত হলে তবেই প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও প্রকৃত গণতন্ত্রের সূচনা ঘটতে পারে। আর একমাত্র এই পথেই বিপ্লব হয়ে উঠতে অপরিবর্তনীয় একটি ঘটনা।

 

উগো শাভেজের নেতৃত্বাধীন ভেনেজুয়েলার বিপ্লব সে দেশের ক্ষমতাসীন ব্যবস্থাকে অভূতপূর্বের বিপদের সম্মুখীন করে তুলতে পেরেছিল। আর তা সম্ভব হয়েছিল একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা ও ঐতিহাসিক দায়কে পূর্বোক্ত নিরিখে প্রত্যক্ষভাবে চিনতে পারার ফলেই। বলিভারিয়ান প্রজাতন্ত্র পুঁজিবাদকে তার ভিতর থেকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে পেরেছিল কৌম ক্ষমতা এবং গণ-উদ্যোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে, একটি সুসংবদ্ধ সমাজ বা প্রকৃতির সঙ্গে সমাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একটি নতুন ব্যবস্থা হিসেবে বিপ্লবের ধারণাকে তুলে ধরার মাধ্যমে। মার্কসের ও মেজারোসের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এবং লেবোভিৎজের বিশ্লেষণের মধ্যস্থতায় শাভেজ হাজির করেছিলেন “সমাজতন্ত্রের মূলগত ত্রিভুজ”-এর ধারণা, অর্থাৎ (১) সামাজিক মালিকানা, (২) শ্রমিকদের দ্বারা সংগঠিত সামাজিক উৎপাদন এবং (৩) কৌমের চাহিদা পূরণ। এর অন্তর্নিহিত বার্তাটি হল, অসাম্যের সমাজকে নিশ্চিহ্ন করার মূলগত ভিত্তি বাস্তবিক সাম্যের লক্ষ্যে সংগ্রাম, বর্ণবিদ্বেষ ও লিঙ্গবৈষম্যের বিভাজনরেখা, সাম্রাজ্যবাদের বিভাজনরেখা এবং শোষণের অন্যান্য বিভাজনরেখার মধ্যে নিহিত অসাম্যের বিলোপ।

 

“কমিউনিজম অ্যাজ অ্যান আইডিয়াল” প্রবন্ধে স্যুইজি শ্রমের নতুন ধাঁচার উপর জোর দিয়েছেন – যে সমাজ মানুষের উৎপাদনশীলতার প্রাচুর্যকে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত পথে ব্যবহার করে সেই সমাজে এই নতুন ধাঁচা অবশ্যই গড়ে উঠতে বাধ্য। স্যুইজির লেখার ইঙ্গিত অনুযায়ী, অনেক ধরনের কাজই “সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হবে (যেমন কয়লা খনির কাজ ও গৃহ-পরিচারিকার পরিষেবা), আর সমস্ত কাজকেই হয়ে উঠতে হবে যথাসম্ভব চিত্তাকর্ষক ও সৃজনশীল, যা আজকের দিনে বিরল।” পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থা ও ভোগ-ব্যবস্থার অন্তর্গত যে অপব্যয় ও ধ্বংসযজ্ঞ, তা কমে আসার ফলে বাড়তি সময়ে অধিকতর সৃজনশীল কাজের পরিসর তৈরি হবে।

 

সমমানুষদের সমাজে – যেখানে উৎপাদনের উপকরণের সঙ্গে প্রত্যেকের সমান সম্পর্ক এবং প্রত্যেকের কাজ করার ও জনকল্যাণের দায়িত্ব পালন করার বাধ্যবাধকতা সমান – সেই সমাজে যে সমস্ত “প্রয়োজন” কিছু লোকের শ্রেষ্ঠত্বকে জাহির করে এবং অনেকের বশ্যতাকে ডেকে আনে সেগুলি স্রেফ লোপ পাবে, আর তার জায়গা নেবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার পরিবেশে সহাবস্থানকারী স্বাধীন মানুষদের প্রয়োজন… সমাজ এবং সমাজ গঠনকারী মানুষ একটি দ্বান্দ্বিক সমগ্রের অংশ: একটির পরিবর্তন ছাড়া অন্যটির পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর সাম্যবাদের আদর্শ নতুন সমাজ এবং নতুন [মানুষকে] গড়ে তোলে।

 

এহেন সাংগঠনিক নীতি অনুযায়ী সমাজতন্ত্র/সাম্যবাদের ধারণার প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রকৃত সাম্য এবং প্রকৃত গণতন্ত্র। তাই এই নীতি নিছক আদর্শের বেশি কিছু, তা শুধুমাত্র শ্রেয়তর ভবিষ্যতের অভিমুখে সমাজতান্ত্রিক পথ গড়ে তোলার জন্যই অপরিহার্য নয়, আজকের বিশ্বের যে জনগণ অস্তিত্বের লড়াইয়ে সামিল, তাদের প্রতিরক্ষার অত্যাবশ্যক অস্ত্রও বটে। দুঃস্বপ্নলোকের (ডিসটোপিয়া) কল্পনায় রাঙানো বইপত্র আর উপন্যাসের কথা বাদ দেওয়াই যায়। কারণ, পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ককে পুঁজিবাদ যেরকম সৃজনশীল পদ্ধতিতে ধ্বংস করে চলেছে, সেই প্রক্রিয়াকে যদি এই শতকের মাঝামাঝি নাগাদই থামিয়ে দেওয়া না-যায় সেক্ষেত্রে বিশ্বের জনগণ, বিশেষ সাম্রাজ্যবাদের ক্রমপর্যায়ের নিচের দিকে থাকা জনগণ যে মাত্রার পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে তা কল্পনা করাই অসম্ভব।

 

প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এ ২০২০ সালে প্রকাশিত “দ্য ফিউচার অফ দ্য হিউম্যান ক্লাইমেট নিশ” শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বর্তমান প্রবণতাগুলির ভিত্তিতে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, ২০৭০ সাল নাগাদ ৩২০ কোটি মানুষ মানবসমাজের পক্ষে সহনীয় মাত্রার জলবায়ুর বাইরে বেঁচে থাকার অযোগ্য তাপমাত্রায়, অর্থাৎ সাহারা মরুভূমির সঙ্গে তুলনীয় পরিস্থিতিতে বসবাস করবে। পুঁজিবাদ তার নিজের নিয়মে চলতে থাকলে আসলে অবস্থাটা যে কি দাঁড়াবে, তা ভাবাই যায় না। যে বাড়ি জ্বলছে তা ছেড়ে অন্য বাড়ি তৈরি ছাড়া দ্বিতীয় উপায় এই মুহূর্তে নেই।

 

শ্রমিক ও জনগণের আন্তর্জাতিক

 

গোটা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন নির্দিষ্ট অঞ্চলে অগণিত মানুষ পুঁজিবাদের অচলায়তনের বিরুদ্ধে অসংখ্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম্য ও শ্রেণিবিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই সহ প্রকৃত সাম্যের জন্য সমস্ত সংগ্রাম বিশ্বস্তরে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের উপর নির্ভরশীল। তাই মার্কসের প্রথম আন্তর্জাতিকের ধাঁচার উপর ভিত্তি করে শ্রমিকদের একটি নতুন বিশ্বজোড়া সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। একুশ শতকের জন্য এহেন একটি আন্তর্জাতিক শুধুমাত্র উত্তর গোলার্ধের একদল উচ্চবর্গীয় বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে গড়ে উঠতে পারে না – তাদের কাজই হল ওয়ার্ল্ড সোশাল ফোরাম গোত্রের আলোচনায় দিনাতিপাত করা, কিংবা তথাকথিত সোশালিস্ট অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল-এর ধাঁচে নিয়ন্ত্রণমূলক সমাজ-গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে প্রচার করে বেড়ানো। এহেন আন্তর্জাতিককে গড়ে তুলতে হবে শ্রমিক-ভিত্তিক এবং জনগণ-ভিত্তিক সংগঠন হিসেবে, আর তার শেকড়টি প্রোথিত হবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির একটি শক্তপোক্ত জোটের (South-South Alliance) মধ্যে – যাতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামকে পুঁজিবাদের বিপক্ষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একেবারে কেন্দ্রে স্থাপন করা যায়। শাভেজ ও আমিনের মতো মানুষেরা সেকথাই ভেবেছিলেন।

 

২০১১ সালে শেষবার অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে শাভেজ নয়া আন্তর্জাতিক (বিশেভাবে লক্ষনীয় যে পঞ্চম আন্তর্জাতিক নয়) গঠন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাঁর পরবর্তী নির্বাচনের পর সে সংগঠনের প্রকাশ্যে হাজির হওয়ার কথা ছিল। সেই সংগঠনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কথা ছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জোট গঠন এবং একুশ শতকের সমাজতন্ত্রকে বিশ্বজোড়া তাৎপর্যের মাত্রা দেওয়া। এ ঘটনা ঘটলে বলিভারিয়ান অ্যালায়েন্স ফর পিপল্‌স অফ আওয়ার আমেরিকা আন্তর্জাতিক স্তরে সম্প্রসারিত হত। কিন্তু শাভেজের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি এবং অকালপ্রয়াণের ফলে এ সংগঠনের পক্ষে আর দিনের আলো দেখা সম্ভব হয়নি।

 

ইতিমধ্যে কিন্তু পৃথক একটি ভাবনা গড়ে উঠেছিল ওয়ার্ল্ড ফোরাম ফর অল্টারনেটিভ্‌স-এর সঙ্গে কর্মরত আমিনের উদ্যোগের ফলে। পঞ্চম আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার ভাবনা আমিনের মাথায় দীর্ঘদিন ধরেই ছিল, সে ভাবনা তিনি এই সেদিন ২০১৮-র মে মাস নাগাদও হাজির করেছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর মাস খানেক আগে সেই ভাবনা তাঁরই ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছিল শ্রমিক ও জনগণের আন্তর্জাতিক (Internationale of Workers and Peoples)-এর ভাবনায়। অর্থাৎ এর মধ্যে দিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, পুরোদস্তুর শ্রমিক-ভিত্তিক যে আন্তর্জাতিক জনগণের পরিস্থিতিকে তার বিবেচনার মধ্যে আনে না, তা সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা করার পক্ষে অপ্রতুল। তিনি জানিয়েছিলেন যে এই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে একটি সংগঠন, নিছক একটি আন্দোলন নয়। এর লক্ষ্য হবে

 

যারা সর্বহারার প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য শুধুমাত্র তাদের নয়, বিশ্বের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের জোট… তার অন্তর্ভুক্ত আধুনিক পুঁজিবাদের দ্বারা শোষিত পরিষেবা ক্ষেত্রের সমস্ত মজুরি শ্রমিক, ছোট-মাঝারি কৃষক এবং জনগণ। তাছাড়া এই নির্মাণকার্যের ভিত্তি অবশ্যই হতে হবে বৈচিত্র্যের প্রতি স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা, তা সে বৈচিত্র্য পার্টি বা ট্রেড ইউনিয়নেরই হোক, কিংবা আন্দোলনের কোনও জনপ্রিয় সংগঠনেরই হোক – যাতে তাদের সকলের প্রকৃত স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হয়…। [এহেন বৈপ্লবিক] প্রগতি যদি উপস্থিত না-থাকে তাহলে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা, বর্বরসুলভ রীতিনীতি আর প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞের শাসন চলতেই থাকবে।

 

বলাই বাহুল্য যে এই নয়া আন্তর্জাতিক শূন্যস্থানের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে না। তাকে গড়ে তুলতে হবে বিভিন্ন ঐক্যবদ্ধ গণ সংগঠন নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এবং সে প্রক্রিয়ার ফসল হিসেবে। আর এই সমস্ত গণ সংগঠন গোটা বিশ্বজুড়ে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। আমিনের মতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পক্ষ থেকে ব্যাপকতর জোট গড়ে তোলার উদ্যোগ ছাড়া এহেন আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে ওঠা সম্ভব নয় – অর্থাৎ যেমন ধরনের উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনে সূচিত তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রাথমিক পর্যায়ের সংগঠিত সংগ্রামে এবং নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (New International Economic Order) গড়ে তোলার সংগ্রামে। এই তিনটি উপাদানই – অর্থাৎ তৃণমূল স্তরের আন্দোলন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং আন্তর্দেশীয়/আন্তর্মহাদেশীয় জোট – তাঁর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের ভাবনার একান্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজকের দিনে এর সঙ্গে বিশ্বজোড়া পরিবেশ আন্দোলনের প্রশ্নকেও যুক্ত করতে হবে।

 

আমিন জোর দিয়ে বলেছেন যে, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এহেন আন্তর্জাতিক সংগ্রামের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য অবশ্যই হতে স্পর্ধা এবং আরও বেশি স্পর্ধা। তাকে প্রতিটি কাজে এই ব্যবস্থার স্থানাঙ্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে এবং নিজের আদর্শ পথ খুঁজে নিতে হবে প্রত্যেকে নিজের সাধ্য অনুযায়ী দেবে, আর প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে এই নীতির মধ্যে – এই নীতিই তার কাছে মানব-সম্প্রদায়ের সংজ্ঞা। আজ আমরা যে সময়ে বাস করছি সেখানে স্বাধীনতার আর প্রয়োজনের জন্য সংগ্রামের নিখুঁত সমাপতন ঘটেছে এবং তা আমাদের চালিত করছে স্বাধীনতাই প্রয়োজনীয়তা এই লক্ষ্যে নতুন এক সংগ্রামের দিকে। আমাদের সামনে তাই অনিবার্য বিকল্প: ধ্বংস অথবা বিপ্লব।

 

 

  • জন বেলামি ফস্টার মান্থলি রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক এবং ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক।

 

  • ২০২০ সালের ১২ জুলাই সেভেন্থ সাউথ-সাউথ ফোরাম অন সাসটেনেবিলিটি: ক্লাইমেট চেঞ্জ, গ্লোবাল ক্রাইসেস, অ্যান্ড কমিউনিটি রিজেনারেশন শীর্ষক সম্মেলনের চূড়ান্ত অধিবেশনে জন বেলামি ফস্টার একটি বক্তৃতা দেন। বর্তমান প্রবন্ধটি সেই বক্তৃতার পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ। উক্ত সম্মেলন/ওয়েবিনারটির আয়োজক ছিলেন হংকং-এর লিংনান বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে লাউ কিন চি ও সিত সুই।

 

To read the original article click :

 

 

Share this
Leave a Comment