রাজধানীর রাজনৈতিক শীর্ষমহল ক্রমে কৃষকদের অনমনীয় লড়াইয়ের সামনে নতজানু হয়ে পড়ছেন এমনকি শর্তহীন আলোচনায় বসতে চাইছেন — এমন ইঙ্গিত মিলছে। কৃষক বনাম ক্রোনি কর্পোরেটের এ লড়াইকে ছোট করে দেখার অর্থ সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্রকে ছোট করে দেখা। কুরুক্ষেত্রে এ আর এক মহাভারতের যুদ্ধ। আরও এক মহাভারত সৃষ্টির লড়াই। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
প্রধানমন্ত্রী এখনও বলে চলেছেন, কৃষি আইন দেশের কৃষকদের হিতকারী। বিরোধীরা কৃষকদের ভুল বুঝিয়ে চলেছে। তাঁর দলের আইটি নেতা কিংবা দলের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ‘খালিস্তানি’ যোগ দেখছেন। ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ যোগ। না, বিরোধী উসকানির কথা কিংবা ‘দেশদ্রোহিতা’-র আখ্যান অন্তত এ ক্ষেত্রে বিশ্বাস্য হয়ে উঠল না। কথায় কথায় যে ‘দেশদ্রোহী’, ‘মাওবাদী’, ”আরবান নকশাল’ তকমা দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান, ভীমা কোরেগাঁও এবং আদিবাসী-দলিত নেতৃত্ব কিংবা প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ভাবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে, ছুড়ে ফেলা হচ্ছে কারাগারে — কৃষক বিদ্রোহীদের সামনে সেই অস্ত্র ভোঁতা হয়ে পড়েছে। এমনকি কৃষি আইনের সমর্থনকারী কর্পোরেট মিডিয়াও বলছে, এমন তকমা দেওয়া ঠিক নয়। তারা এও বলছে, কোনও আলাপ-আলোচনা ছাড়াই তড়িঘড়ি যেভাবে সংসদে বিল পাশ হয়েছে, তার ফলে কৃষকদের মনে গভীর আশঙ্কা ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। অতএব, কৃষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলুক সরকার। সম্পাদকীয় নিবন্ধেই এ কথা জানা যাচ্ছে।
এই বিভাজনের রাজনীতি কীভাবে বিজেপির উদ্দেশ্যকে চরম সফলায়িত করে তার এক চূড়ান্ত উদাহরণ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ। ২০১৩ সালের সঙ্ঘ পরিবারের ‘লাভ জিহাদ’ প্রচারে ভর করে মুজজফরপুর দাঙ্গা ও গণহত্যা এবং তারই রেশ ধরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ধারাবাহিক প্রচার চালিয়ে জাঠ চাষিদের মনে মুসলমান বিরোধী চরম ঘৃণার বীজ বুনে দেওয়া। ফল, জাঠ ও মুসলমানদের মধ্যে চরম অবিশ্বাস শুধু নয়। বহুবছর পাশাপাশি একই গ্রামে বাস করা দুই সম্প্রদায়ই নিজ নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। কৃষিজীবী হিসেবে তাঁদের সংহতি ও সমঝোতা অচিরেই শেষ হয়ে যায়। ২০১৭ সালের উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে তারই ফসল ঘরে তুলেছে বিজেপি। এবং এখনও এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পরও মুখ্যমন্ত্রী যোগী ‘লাভ জেহাদ’ বিরোধী অধ্যাদেশ আনতে পিছপা হননি। একই পথে হাঁটতে চলেছে, আরও চারটি বিজেপি শাসিত রাজ্য। হায়দরবাদ শহরের পুরসভা নির্বাচনেও কি আমরা এই ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতির আর এক রূপ দেখতে পাচ্ছি না? বিহার নির্বাচন বিজেপির এই রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিল। তবে, শেষ রক্ষা হয়নি।
আজ যে কৃষক আন্দোলন, বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে তা একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করেছে। সংঘবদ্ধ রূপ নিয়েছে। কৃষকের রক্তাক্ত পা, বিপুল জনসমাবেশে আমরা যতটা আবেগতাড়িত হয়েছি, ততটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনি — কোন মন্ত্রবলে পঞ্জাবের শত শত একর জোতের মালিক কৃষকের সঙ্গে আদিবাসী ভূমিহীন কৃষকরা একজোট হয়ে যায়। গো-রক্ষা আইনের জেরে কীভাবে গ্রামের কৃষক, গোপালক, গোয়ালারা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার খোঁজ আমরা রাখিনি। হাজারে হাজারে গবাদি পশু যা একরকম কৃষকদের দুঃসময়ের আয়ের উৎস। স্রেফ একের পর এক নির্মম আইনের জেরে সেই সম্পদকে তাঁরা চড়ে খাওয়ার জন্য হেলায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যে গবাদিপশু দুধ দেয় না, সে গবাদিপশু বিক্রি করে তাঁরা নতুন দুগ্ধবতী গরু কেনে। সে উপায় শুধু হাতছাড়া হল না, পাশাপাশি, শত শত গরু চাষজমিতে ঢুকে পড়ে আর এক চরম সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এই পশুধন চাষির মোট আয়ের ৩০ ভাগ। এই পশুধন ও লিঞ্চিংও ছিল চলমান কৃষক আন্দোলনের এক অন্যতম অ্যাজেন্ডা। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, হরিয়ানা, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকে কোথাও বিজেপির খারাপ ফল এবং কোথাও হেরে যাওয়ার জন্য এই সম্মিলিত কৃষক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সম্মিলিত আন্দোলন একদিনে গঠিত হয়নি। ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ সংশোধনী আইন বাতিলের সফল আন্দোলন থেকে ২০১৯ এর বনাঞ্চল থেকে আদিবাসী উচ্ছেদ এবং বনাধিকার আইন বাতিলের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দিল্লি অভিযান — ধারাবাহিক ভাবেই বড় কৃষক থেকে ছোট ও ক্ষুদ্র কৃষক, আদিবাসী, দিনমজুর একযোগে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। এই আন্দোলনেই জোরেসোরে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করেছেন মহিলা কৃষকেরা।
এ পথে যে দিল্লি একদিন অবরুদ্ধ হবে তার যাবতীয় লক্ষণ ছিলই। বিজেপি কোনও কথাই রাখেনি। কিন্তু, পুলওয়ামা নরেন্দ্র মোদীকে ফের ক্ষমতায় ফিরে আসতে ইন্ধন জোগাল। একচ্ছত্র ক্ষমতায় এসে মোদী ভাবলেন কৃষির কর্পোরেটীয়করণের এই সুবর্ণ সুযোগ। এতদিন তিনি ফসলের দাম বৃদ্ধি থেকে ফসল বীমা যোজনা বিষয়ে লাগাতার মিথ্যা বলেছেন। আর তলে তলে তৈরি রেখেছেন তিন তিনটি কৃষি আইন। লকডাউন এবং করোনাভাইরাসের সুযোগে গাজোয়ারির পথে ধ্বনি ভোটে পাস করিয়ে নেওয়া হল বিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দুর্বলতা, ফ্লোর ম্যানেজমেন্টে অদক্ষতাও এর জন্য দায়ী। এর পর বিরোধী শূন্য সংসদে পাশ হয়ে গেল আরও এক নির্মম বিল। শ্রম কোড।
তবু, শেষ কথা যে শাসক বলে না, তা আর একবার প্রমাণিত হল টানা পঞ্চাশ দিন পঞ্জাবের কৃষক আন্দোলন এবং এই ২৬ নভেম্বর দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। ২৬ রাত থেকেই চলেছে দিল্লি অভিযান। করোনা পরিস্থিতিতে পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের উপরই প্রাথমিক ভাবে ভার ছিল এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার। হাজারো অত্যাচার, রাষ্ট্রীয় অবরোধকে প্রবল ক্রোধে দলতে দলতে কৃষকেরা দিল্লির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। শুধু পঞ্জাব, হরিয়ানা নয়, উত্তরপ্রদেশের কৃষকরাও যোগীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এসেছেন। এসেছেন উত্তরাখণ্ড এমনকি মধ্যপ্রদেশের কৃষকরা। আর যাঁদের ট্র্যাক্টর দেখে আন্দোলনরত কৃষকদের শুধুই ‘কুলাক’ বলে মনে হয়েছিল, তাঁরা যদি কান পাততেন চোখ খোলা রাখতেন তাহলে দীর্ঘ পদযাত্রায় আড়াই একর থেকে পাঁচ একর জমির ছোট কৃষকের দৃঢ় পদচারণা কিংবা গভীর ক্ষোভ দেখতে ও শুনতে পেতেন।
রাজধানীর রাজনৈতিক শীর্ষমহল ক্রমে কৃষকদের অনমনীয় লড়াইয়ের সামনে নতজানু হয়ে পড়ছেন এমনকি শর্তহীন আলোচনায় বসতে চাইছেন — এমন ইঙ্গিত মিলছে। কৃষক বনাম ক্রোনি কর্পোরেটের এ লড়াইকে ছোট করে দেখার অর্থ সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্রকে ছোট করে দেখা। কুরুক্ষেত্রে এ আর এক মহাভারতের যুদ্ধ। আরও এক মহাভারত সৃষ্টির লড়াই।