রাষ্ট্রনির্ভরতা ও নির্বাচনী রাজনীতিতে আটকা পড়ে যাওয়া, বামপন্থীদের পুরোনো সমাজমুখী সংগঠনকে সমাজবিমুখ, বস্তুত সমাজবিচ্ছিন্ন করে তোলে। সমাজে সম্পৃক্ত থাকেন না বলে রাষ্ট্রনির্ভর বামপন্থীরা বুঝতে পারেন না, পুঁজিতন্ত্র কোথায় কিভাবে চেহারা বদলাচ্ছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ কত গভীর ও সুদূরপ্রসারী, এবং রাষ্ট্র ও পুঁজির নিওলিব যুগলবন্দী কিভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের গোটা প্রকল্পকে বিপর্যস্ত করে, করতে করতে যায়, ফলে ফ্যাসিবাদের বিপদ কখনোই খুব দূরের বস্তু থাকে না, ঘরে ঢুকে আসে। লিখেছেন সৌমিত্র ঘোষ।
গণতন্ত্র ও অ-গণতন্ত্র
এ বছরের গোড়ার দিকে নিউ লেফট রিভিউ পত্রিকায় মাইকেল ডেনিং-এর একটা লেখা প্রকাশিত হয়। আমাদের সময়ের ট্রাম্প ও উনিশ শতকের মাঝামাঝি ফ্রান্সে লুই বনাপার্তের উত্থানের তুলনামূলক আলোচনা করে সে লেখায় ‘জনপ্রিয়তন্ত্র’ বা পপুলিজমের মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে। সে সময়ের ফ্রান্স নিয়ে মার্ক্সের বিভিন্ন লেখার কথা সবাই জানেন। সেই সব লেখার পাঠের মধ্য দিয়ে ডেনিং যা বলছেন তা মোটামুটি এইরকম: ১৮৪৮-এর ব্যর্থ বিপ্লব-প্রচেষ্টার পর তৎকালীন প্রজাতন্ত্রবাদী ডেমোক্রাটরা সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে থাকেন। মার্ক্স বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা যেকোন সময়ে বিগড়ে যেতে পারে, তার মাথায় যে এমন কোন শাসক এসে বসতে পারেন যিনি গণতন্ত্রের বুনিয়াদি শর্তগুলোকে অবলীলায় লঙ্ঘন করতে পারেন, করার পরেও দেশের মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন তাঁর সঙ্গে থাকতে পারে – ডেমোক্রাটরা সে বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেন নি। ফলে লুই বনাপার্ত ভোটে জিতে শাসনক্ষমতায় এলেন, এসে সংবিধানের দোহাই দিয়ে সংবিধানকে নষ্ট করলেন, সংসদকে খারিজ করে বিরোধীদের ওপর অত্যাচার শুরু করলেন। ‘লুই বনাপার্তের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’ থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন ডেনিং। সে উদ্ধৃতির মূল প্রতিপাদ্য, ডেমোক্রাটরা যে ‘পিপল’ বা ‘জনগণের’ কথা বারবার বলে এবং মনে করে তারা সেই জনগণেরই প্রতিনিধি, তা আসলে সোনার পাথরবাটি, ওইরকম অবিভাজিত ও ‘এক’ জনগণ বলে কিছু হয় না। মার্ক্স মন্তব্য করছেন, ডেমোক্রাটরা নিজেদের ভোলাতে পটু, তারা ভেবেছিলো তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করবে। মার্ক্স প্রশ্ন করছেন, কেন করবে? সেনাবাহিনী কাদের নিয়ে তৈরি হয়? কাদের স্বার্থরক্ষা করে? মার্ক্সের লেখা তুলে ডেনিং মনে করিয়ে দিয়েছেন বনাপার্তকে ইমপিচ বা বাতিল করানোর চেষ্টা হয় ফ্রান্সের সংবিধান সভায়। সে চেষ্টা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
আজকের ভারতবর্ষ বা বাংলার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ কি? কারণ (বা প্রধান প্রশ্ন) মোটামুটি তিনটে। এক, উনিশ শতকের ফ্রান্স হোক আর একুশ শতকের আমেরিকা বা ভারত, জনগণ বা পীপল ব্যাপারটা একইরকম গোলমেলে। প্রত্যেক ভোটের পর এই যে বলা হয়, জনগণ মত দিয়েছেন কিম্বা জনগণ কথা বলেছেন (পিপল হ্যাভ স্পোকেন), এতদ্বারা কী বোঝানো হয়? জনগণ আর নির্বাচকমন্ডলী কি এক ও সমার্থক? যাঁরা ভোট দেন না, কিম্বা নানা কারণে দিতে পারেন না, তাঁরা জনগণ কি জনগণ নন? ভোট প্রক্রিয়ার বাইরে ‘জনগণের’ অস্তিত্ব আছে না নেই? দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা বুঝে শাসন, যা জনপ্রিয়তন্ত্র বা পপুলিজমের মূল কথা। জনগণের ইচ্ছা কে বা কারা বোঝেন? কী পদ্ধতিতে বোঝেন? শাসক আর শাসিতের মধ্যে যে ঐতিহাসিক ব্যবধান, সংসদীয় গণতন্ত্রের চালু ধাঁচায় কি তা দূর হয়ে যায়? তিন, জনগণের রায় শিরোধার্য করে যে শাসক মসনদে বসছেন, তিনি দুদিনের মাথায় যে সংসদীয় ব্যবস্থার যাকে বলে ধজিয়া উড়িয়ে দেবেন না, তার কি নিশ্চয়তা আছে? জনগণের ইচ্ছার দোহাই দিয়ে ট্রাম্প সাহেব গত চার বছরে যা যা করেছেন, এখানে গত সাত বছর ধরে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখন্ড ভারত ও হিন্দু উত্থানের নামে যা যা চলছে, তার সঙ্গে ১৯৩০-এর হিটলার এমনকি উনিশ শতকের লুই বনাপার্তের আচরণের মৌলিক পার্থক্য কিছু আছে কি?
বাংলার একুশে ভোট ও ফ্যাসিবাদী হানা
এই প্রশ্নগুলো তলিয়ে বোঝা দরকার। গণতন্ত্র বলতে আজকের সময়ের বামপন্থীরা ঠিক কী বোঝেন সেটা পরিষ্কার হওয়া আরো দরকার। বাংলায় আর একটি নির্বাচন আসন্ন, জনগণ কী চান বা চান না তাই নিয়ে তর্জা বহুদিন শুরু হয়ে গেছে, কোটি কোটি টেলিভিশনপর্দা ও ফোনপর্দা জুড়ে গণপ্রতিনিধি নেতারা প্রায়শই কুৎসিত চিৎকার দিচ্ছেন, তাদের দিকে তাকালে দিব্য বোঝা যায় কী হতে চলেছে। ভোটের ফলের কথা বলা হচ্ছে না। প্রাকভোট প্রক্রিয়াটার কথা বলছি। জনগণের নামে এন্তার মিথ্যার চাষ চলবে, পয়সার বন্যা বইবে এবং যেহেতু দেশটা বাংলা, খইফোটার মতো বোমা পড়বে ও লাশ পড়তেই থাকবে। অনেক বছর ধরে এই চলছে, এবছর অন্য কিছু হবে ভাববার কারণ নেই। এতদসত্বেও, অন্য অনেকের মতো এই লেখকও মনে করে, এবছরের বাংলার ভোট অন্য যে কোন ভোটের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এই ভোটে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের হাত ধরে এবং ‘জনগণের’ অমোঘ ইচ্ছায় ফ্যাসিবাদী শাসন বাংলায় ঢুকতে উদ্যত, না পাসারন বলে তার পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারেন, এমন ডলোরাস ইবারুরির দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না। বিজেপি-সঙ্ঘ মার্কা ফ্যাসিবাদ ঠিক কতটা আগমার্কা, ঐতিহাসিক নাজিবাদ থেকে তার ফারাক কোথায় কোথায় সে চুলচেরা বিচারে গিয়ে লাভ নেই। গেলেও দেখা যাবে, কাজকর্মের ধরনধারণ এবং চারিত্র্যের নিরিখে সঙ্ঘ-বিজেপি পুরোদস্তুর ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের তন্নিষ্ঠ অনুগামী। গ্রাউন্ডজিরোয় ইতিপূর্বে প্রকাশিত অন্য একটি লেখায় (বাংলা এখন – করোনাসময় এবং একরাষ্ট্র ও বহুরাষ্ট্রের রাজনীতি) সে প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে।
সঙ্ঘ-বিজেপি মার্কা দিশি ফাসিবাদ-বিরোধী যে প্রচার বাংলায় নজরে পড়ছে, তার প্রায় সবটাই কতগুলো খুব চেনা ছক বা ট্রোপের মতে ঢুকে আছে। বাংলার জনগণ এই, ওই, এই, তাঁরা বুঝবেন এবং বুঝে ফাসিবাদী গণতন্ত্র-বিরোধী বিজেপিকে ঢুকতে দেবেন না। এই বোঝাবুঝির অনেকটাই রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস-প্রসূত, বাকিটা দলীয় ও অদলীয় বামেদের, বিশেষত যাঁরা সিপিআইএম পন্থী। ফাসিবাদের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠা উচিত, দরকার, বলা বাহুল্য এই গোলা কথাবার্তা দিয়ে তা সম্ভব নয়। শুধু কথাবার্তার কথা নয়, মেঠো ও কেজো সংগঠন দিয়ে প্রতিরোধের কথাটাও ভাবা দরকার ছিলো। কে ভাববে? কে করে প্রতিরোধ? সর্বময় প্রবল পরাক্রান্ত নেত্রীর ছায়ার বাইরে তৃণমূল দলটির অস্তিত্ব কি? কিছু লুম্পেন, কিছু পুরোনো কংগ্রেসী, কিছু সিপিআইএম ও এদল ওদল থেকে ভাঙিয়ে আনা লোকজন। আমাদের সামূহিক সৌভাগ্যের বিষয়, সঙ্ঘ-সংগঠন এখনো রাজ্যের সর্বত্র একইভাবে শিকড় গাঁড়তে পারেনি, ফলত বিজেপিকেও নির্ভর করতে হচ্ছে দলভাঙাদের ওপর। এমতাবস্থায় জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়, আসন্ন ভোটে বিজেপি জিতবেই। এটাও বলা সম্ভব নয় যে তৃণমূল নিশ্চিত জিতছে। ভোটের অঙ্ক কষা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, সুতরাং ওই আলোচনায় কালক্ষেপ না করাই বিধেয়।
প্রধান শত্রু কে: সিপিএম-এর ভোট রাজনীতি
ভোটের অঙ্ক না কষলেও, ভোট ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ভোটে বিজেপি জিতলে রাজ্যের শাসনক্ষমতায় সঙ্ঘ আসবে, অর্থাৎ পুলিশ এবং আমলাদের ওপর সঙ্ঘ-শাসন জারি হবে। যে বা যারা সঙ্ঘসমর্থক বা বিজেপিপন্থী নয়, তাদের জীবন কোন নরকে ঢুকবে, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং ঘরের কাছের আসাম ও ত্রিপুরা দেখলে তা মালুম হয়। ভোট মানে রাষ্ট্রক্ষমতা, ফলে তা অগ্রাহ্য করা যায় না, কোনমতেই না। প্রশ্নটা হল, আজকের পরিস্থিতিতে ভোটে বামপন্থীদের কিছু করণীয় আছে কিনা, তাঁরা কী অবস্থান নেবেন, কেন নেবেন। বিহার নির্বাচনে বামপন্থীদের, প্রধানত সিপিআই এমএল-লিবারেশন দলের সাফল্যে এই প্রশ্নগুচ্ছ স্বভাবতই বারবার সামনে আসছে। লিবারেশন দলের পক্ষ থেকে তাঁদের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, বাংলার নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রধান রাজনৈতিক কাজ সঙ্ঘ-বিজেপির বিরোধিতা করা। দীপঙ্কর আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। দলীয় বামপন্থীদের কাছ থেকে এহেন স্পষ্ট কথাবার্তা এ প্রসঙ্গে এর আগে এভাবে শোনা যায়নি, ফলে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। রাজ্যে তৃণমূল প্রধান শত্রু, ফলে আগে তৃণমূল হটাও বলে সিপিআইএম ও তৎসঙ্গী বামেদের যে একমাত্রিক ঝিঁঝিঁরব, সেটিকে আপাদমস্তক খারিজ করে দীপঙ্কর বলছেন, বিজেপি শুধুমাত্র নির্বাচনী রাজনীতিতে সীমিত দলমাত্র নয়, ফলে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। বিজেপির ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের মিল অমিল নিয়ে তর্ক না করে বরং এটা বোঝা দরকার, ভারতবর্ষে সঙ্ঘ-বিজেপির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ এই ফ্যাসিবাদের নিতান্তই দিশি একটা ধরণ আছে।
মনে হল, দীপঙ্কর বলতে চাইছেন, নির্বাচনী রাজনীতির বাইরেও সঙ্ঘ-বিজেপির সামাজিক রাজনীতি প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর। এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধও গড়ে তোলা দরকার। এই লেখক বা তার মতো কয়েকজন দলছুট বেশ কিছুদিন যাবৎ এই কথাটা বলে আসছে, ভবিষ্যতেও বলবে। সংগঠিত বামপন্থী যৌথগুলোর কাছ থেকে সঙ্ঘ-বিজেপির বিরুদ্ধে সার্বিক বিরোধিতার এই আহ্বান বহু আগেই প্রত্যাশিত ছিল, অথচ ঘটে উঠছিল না। দেরি হলেও লিবারেশন পরিষ্কার করে একটা কথা বলেছেন, অবস্থান নিয়েছেন, অন্যদের অবস্থান নেওয়ার ডাক দিয়েছেন, এই উদ্যোগ স্বাগত।
সঙ্ঘ-বিজেপির বিরুদ্ধে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার, এ নিয়ে তর্ক নেই। এমনকি সিপিআইএম-ও এ নিয়ে তর্ক তুলবে বলে মনে হয় না। খটকাটা লাগছে অন্যত্র। দীপঙ্কর ও লিবারেশন দলের পক্ষ থেকে এই অবস্থান ঘোষণার পর থেকেই সিপিআইএম দল ও তার ছোটবড় নেতারা বিভিন্ন বিবৃতি দিচ্ছেন। তার নিগলিতার্থ, বিজেপি-সঙ্ঘ বড় বিপদ, খুব বড় বিপদ, সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা দেশে, ‘অল-ইন্ডিয়ায়’। রাজ্যে তৃণমূল বিপদ নাম্বার এক, আগে তাকে ভাগাও, পরে বিজেপি দেখা যাবে, সে লড়াই তো আছেই। পার্টির বড় নেতা সীতারাম ইয়েচুরি উদ্ভট হিসেব দিয়ে বলছেন, তৃণমূলের ওপর বাংলার জনগণের তীব্র রাগ, সেই রাগ ভোট হয়ে তাঁদের (মানে বাম-কংগ্রেস জোটের) পক্ষে ইভিএমবন্দী হবে, যদি তাঁরা তৃণমূল বিরোধিতা না করেন, ওই রাগী ভোট গোঁৎ খেয়ে বিজেপির কাছে চলে যাবে। এইসব অঙ্ক নিয়মিত এ রাজ্যের কুচোবড় নেতারা বলছেন, গণশক্তির প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছে।
দীপঙ্কর ও লিবারেশন সম্ভবত সদর্থেই এখনো প্রত্যাশা করেন, বঙ্গীয় সিপিআইএম-এর লোকজন তৃণমূলের ওপর তাঁদের সহজাত জাতিক্রোধ ছেড়ে বড় রাজনীতির কথা খানিক ভাববেন। ২০১১-য় সিপিআইএম ক্ষমতাচ্যুত হবার পর থেকেই শুধু লিবারেশন কেন, প্রায় যাবতীয় বঙ্গীয় বামেরা এই ভাবনায় স্থিত। কেন, সেটা বোঝা শুধু মুশকিল নয়, অসম্ভব। ১১ থেকে এক দশক কেটে গেল, তৃণমূল এবং তার নেত্রীকে নানান রকম গাল পাড়া ছাড়া অন্য কোন ‘রাজনীতি’তে সিপিআইএম যে উৎসাহী, তা বিন্দুমাত্র বোঝা যায়নি। মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে বন্ধ বা মিছিল হয়েছে, ওই পর্যন্ত। গ্রাম-শহর-ঘর-দুয়ার-হাটবাজার-কারখানা-মল, রাজ্যের সর্বত্র ওই দলের যে সাংগঠনিক মাকড়শাজাল ছড়ানো ছিল, যার সুতো অবধি এখন দেখা যায় না, সে জাল না হোক সংগঠনটা যে নতুন করে তৈরি করতে হতো, সে বিষয়েও বঙ্গ সিপিএমের নেতৃত্ব কি সচেতন? যে সংগঠনটা ছিল, প্রধানত যার দৌলতে তাঁরা ৩৪ বছর রাজ্যের মাথায় ছিলেন, সেটা তৈরির পিছনে প্রায় পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ পরিশ্রম ছিল, বহু মানুষের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ছিল। সবচাইতে বড় কথা, সমাজমুক্তির রাজনীতি ছিল, বৈষম্যহীন নতুন সমাজ গঠনের অভীপ্সা ছিল। সে রাজনীতি সিপিআইএম দল কার্যত পরিত্যাগ করেছে দীর্ঘকাল, নতুন সমাজ বলে কিছু যে আদৌ হয় সেটাও সে দলের লোকজন বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। ২০১১-র নির্বাচনী বিপর্যয়ের পিছনে সিপিআইএম দলের পুঁজিপন্থী, পুঁজিতন্ত্রপন্থী অবস্থানের প্রতি রাজ্যের এক গরিষ্ঠ অংশের মানুষের সচেতন অনাস্থা যে দায়ী ছিল, সেই সত্য অদ্যাবধি দলের নেতারা বুঝে উঠতে পারেননি। পুঁজি যখন ঐতিহাসিকভাবে চরিত্র ও চলন বদলাচ্ছে, শ্রমনির্ভর ‘শিল্প’ থেকে নিওলিব পুঁজি যে ক্রমশ বিশিল্পায়িত লগ্নিক্ষেত্রে ঢুকছে ক্রমশ, বাংলার সিপিআইএম নেতারা সেসবে চিন্তিত নন। টাটা কোম্পানি কেন গাড়ি কারখানা সিঙ্গুরে করতে পারল না, তৃণমূল বাংলার ‘প্রবল’ শিল্প-সম্ভাবনা যে স্রেফ টিপে মেরে দিল, গত প্রায় পনেরো বছর ধরে রাজনীতি বলতে সিপিএম নেতারা এর বাইরে কিছু বোঝেন না, বলেনও না।
ভোট, গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ
এই না বোঝা, না বুঝতে চাওয়া বা না বুঝতে পারাটা আলটপকা কিছু নয়। যে মুহূর্তে ‘জনগণ’ বামপন্থীদের কাছেও ভোটবাক্সের সংখ্যামাত্র হয়ে ওঠে, ভোট এবং ভোটের বাইরে ‘জনগণের’ নামে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানের শাসন সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, সে কাজে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার হতে থাকে, বামপন্থা ব্যাপারটাই থাকে না। রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে সমাজকে যে দেখা যায়, না দেখলে যে পুঁজিতন্ত্রের বাইরে বেরুনো যায় না, এই সহজ সত্যও মনে থাকে না। রাষ্ট্রনির্ভরতা ও নির্বাচনী রাজনীতিতে আটকা পড়ে যাওয়া, বামপন্থীদের পুরোনো সমাজমুখী সংগঠনকে সমাজবিমুখ, বস্তুত সমাজবিচ্ছিন্ন করে তোলে। সমাজে সম্পৃক্ত থাকেন না বলে রাষ্ট্রনির্ভর বামপন্থীরা বুঝতে পারেন না, পুঁজিতন্ত্র কোথায় কিভাবে চেহারা বদলাচ্ছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ কত গভীর ও সুদূরপ্রসারী, এবং রাষ্ট্র ও পুঁজির নিওলিব যুগলবন্দী কিভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের গোটা প্রকল্পকে বিপর্যস্ত করে, করতে করতে যায়, ফলে ফ্যাসিবাদের বিপদ কখনোই খুব দূরের বস্তু থাকে না, ঘরে ঢুকে আসে। একটা নির্বাচনে বিজেপি হারল কিনা, একজন ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে থাকলেন কি থাকলেন না, তা দিয়ে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে জয়পরাজয় নির্ধারিত হবে না। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াই এ রাজ্যে গড়ে ওঠার প্রাথমিকতম পূর্বশর্ত, তৃণমূল-বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস এবং অধুনা মিম, নির্বাচনী রাজনীতির এই চেনা বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে থাকা চলবে না, সঙ্ঘ-বিজেপির উত্থানকে দেখতে-বুঝতে হবে তার সামাজিক উৎসে পৌঁছে, রাজনৈতিক চরিত্রে। হে পাঠক, ভুল বুঝবেন না। এতদ্বারা ভোট বয়কট করার বা ভোট-বিরোধী রাজনৈতিক জেহাদের ডাক দেওয়া হচ্ছে না। ভোট একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, প্রক্রিয়া, যাকে রাষ্ট্রবাদী ফ্যাসিস্ট ও না-ফ্যাসিস্ট শাসককূল এবং মূলে রাষ্ট্রবিরোধী বামপন্থীরা, উভয়েই ব্যবহার করতে পারেন, করেনও। যেটা বলতে চাইছি, নিছক ভোটপ্রক্রিয়া বা ভোটের ফলাফল দিয়ে রাজনীতির জটিল অন্দরমহলের লক্ষ গোলকধাঁধার সবটা বুঝে ফেলা যায় না। দেশে কিম্বা রাজ্যে ভোট ফলাফল কী দাঁড়াল, তা দিয়ে সামাজিক এবং সে কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা-সম্পর্কের যে জটাজাল আমাদের প্রাত্যহিক সমাজজীবনে ছড়িয়ে থাকে, পুরো বোঝা তো দূরস্থান, হয়তো তার কূলকিনারাও পাওয়া যায় না। সঙ্ঘ-বিজেপির ফ্যাসিবাদ ঘরে ঢুকছে সেই সব ক্ষমতাসম্পর্ক ও দৈনন্দিন আধিপত্যনির্মাণের গলিঘুপচি দিয়ে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রের মহাসড়ক দিয়ে নয়। সঙ্ঘ সামাজিক ভাবে যা করে, করতে চায়, বিজেপির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, সে কারণে নির্বাচনী রাজনীতিকে চূড়ান্ত বা অপ্টিমাম স্তরে ব্যবহার করা, সেই কাজটাকে সহজ ও দূরসঞ্চারি করে তুলছে। সঙ্ঘ কী চায়? ‘শত্রু’ ও বিদেশি মুসলমানদের (এবং অন্য ‘অহিন্দু’দের) ওপর দিশি ‘হিন্দু জাতি’র আধিপত্য, অনার্য দ্রাবিড় ও আদিবাসীদের ওপর আর্য ভারতের আধিপত্য, শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের ওপর সবর্ণদের আধিপত্য, শেষত, নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য। আধিপত্যের এই বহুস্তরীয় স্থাপত্য নির্মিত হচ্ছে রাষ্ট্রের সক্রিয় তত্বাবধানে। রাষ্ট্র অর্থাৎ পুঁজি ও রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের মতো, দিশি ফ্যাসিবাদও নিরন্তর পুঁজিতন্ত্র থেকে শক্তিসঞ্চয় করে, পুষ্ট হয়। সঙ্ঘ-বিজেপি-র ভারতজয়ের অভিযানে পুঁজিতন্ত্রের সক্রিয় ভূমিকা আছে। নির্বাচনী বন্ড মারফত ‘অজ্ঞাত’ দাতাদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমান টাকা তোলা, কোভিডকালে পিএম কেয়ার ফান্ডের হিসাব-বহির্ভুত তহবিল, এসবের কথা সবাই জানেন। তদুপরি, স্থানীয়ভাবে বিজেপি দলের পক্ষ থেকে বিস্তর নগদ লেনদেন করা হয়, বিশেষত ভোট এলে।
নির্বাচনী রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিলগ্নির ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, কি দেশে কি বিদেশে। সে আলোচনার পরিসর বা অবকাশ নেই। দু একটা কথা সবার জানা, সেগুলোই আবার বলা যায়। ২০১৪-র নির্বাচনে সঙ্ঘ-বিজেপি আধুনিক সাংখ্য (ডিজিটাল) প্রযুক্তির যে বিপুল প্রয়োগ করে, তা ভারতীয় ভোট রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে দেয়, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে দাঁড়ায় মিডিয়াওলাদের ভাষায় গেম-চেঞ্জার। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সঙ্ঘ-বিজেপি হিসেব করে সম্বৎসর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যাচ্ছে। এই নিয়ে ইতিপূর্বে বিস্তারিত বলা হয়েছে (ফেসবুক, ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী রাজনীতি)। কিছু কথা পুনর্বার বলি। এক, ফ্যাসিবাদ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শক্তিবৃদ্ধি করে। অযুক্তি-কুযুক্তি বা আনরিজন, অপবিজ্ঞান এবং মিথ্যার যে সুসংহত প্রচার ফ্যাসিবাদী আধিপত্যনির্মাণের পক্ষে অপরিহার্য, প্রযুক্তি তা প্রথমত সম্ভব করে তোলে, দ্বিতীয়ত তার সামাজিক বিস্তার বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। এক বাংলাতেই গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৭০০০০ হোয়াটসয়্যাপ গ্রুপ খুলেছিল। এবার বিজেপি আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবিয়াকে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি কী করবেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
ফ্যাসিবাদী প্রচার ও মগজ দখল
সাংখ্য প্রযুক্তিতে বলীয়ান, পুঁজিপুষ্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে দড় ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে, রাষ্ট্রের মাধ্যমে জনসমক্ষে আসে। ফ্যাসিবাদের সামাজিক উৎস হিসাবে ঘৃণা ও মিথ্যার যে ছেদহীন বিরামহীন প্রচারকে সহজে চিহ্নিত করা যায়, প্রযুক্তির দৌলতে ও মাহাত্ম্যে তা জ্ঞান নির্মাণের দীর্ঘ সামাজিক প্রক্রিয়াকে সরাসরি উচ্ছেদ করে। যা নেই, কোনকালে ছিল না, তা অস্তিত্ববান হয়ে থাকতে শুরু করে, মানুষের মগজে শিকড় গাড়ে। যা বিপদ নয়, প্রযুক্তিসৃষ্ট নানান নতুন মিডিয়া মারফত তা বিপদ হয়ে দাঁড়ায়, যা প্রকৃত বিপদ তা জনচিত্তে নেহাতই বদ লোকের ষড়যন্ত্র হয়ে দেখা দেয়। সঙ্ঘ-বিজেপির কথা নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর ব্রিটেন কিম্বা পীঠস্থান আমেরিকার কথা ধরুন। পঞ্চাশের দশক থেকে লাল ষড়যন্ত্রের ভূত দেখছেন আমেরিকার মানুষ। প্রথমে কমিউনিস্ট ঠেকাতে ও পরে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে একগাদা যুদ্ধ হয়ে গেল, বহু প্রাণহানি হল। একুশ শতকের শুরু থেকে এই চলছে। পশ্চিমী গণতন্ত্রের প্রকল্পটা দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা, অযুক্তি ও অ-গণতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে। হবার কথাও। যে ব্যবস্থার মূলে পুঁজিতন্ত্রের মতো অযৌক্তিক ও অন্যায় প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল, তা থেকে মিথ্যা ও আরো অন্যায় ছাড়া কিই বা তৈরি হতে পারে? যে ব্যবস্থা মুষ্টিমেয়ের লাভ বাড়ানোর জন্য গোটা পৃথিবীর প্রাণব্যবস্থা, ঋতুচক্র ও জলবায়ুকে ধংস করে দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা কি জাদুমন্ত্রে যৌক্তিক ও ন্যায় হয়ে উঠবে? আমেরিকার ট্রাম্প, তুরস্কের এরদোগান, ব্রাজিলের বলসানারো, ভারতের মোদি-শা, এরা স্বৈরাচারী ও মিথ্যাবাদী, বাকি ব্যবস্থাটা ভালো ও সত্য? পুঁজিতন্ত্রের মধ্যে যদি কোন সত্য থেকে থাকে তা মুনাফার ও পুঁজির, নির্বিচার শ্রমশোষণের ও লুন্ঠনের, এটা না বুঝে ফ্যাসিবাদকে কি বোঝা যায়? পুঁজিতন্ত্রের বিরোধিতা না করে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠবে কী করে? বিশেষত আজকের অবস্থায়, যখন আধিপত্য নির্মাণের জন্য গণহত্যা করার দরকার হয় না, গণতন্ত্র দিয়েও দিব্যি কাজ চলে যায়?
আমেরিকা-য়ুরোপ ও ষড়যন্ত্রপন্থা: কিউয়্যাননের অভ্যুদয়
মিথ্যা ও অযুক্তি কিভাবে তথাকথিত গণতন্ত্রের মধ্যে অ-গণতন্ত্র নির্মাণ করে, তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ কিউয়্যানন । গণতন্ত্রে ‘জনগণের মত’ এখন ঠিক কিভাবে তৈরি হচ্ছে, তা বোঝার জন্যও কিউয়্যানন বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার।
ট্রাম্পের শাসনসময়ে আমেরিকাতে কিউয়্যানন নামের একটি নতুন সামাজিক যৌথ বা আন্দোলন তৈরি হয়েছে। আমাদের সময়কার অন্য আর দশটি যৌথের মতো, এটিও অর্ন্তজাল বা নেটনির্ভর। এর নেতা বা প্রধান চরিত্রের নাম কিউ। তার পরিচয় জানা যায় না বলে তা য়্যানন বা য়্যাননিমাস। আমেরিকাতে শুরু হয়ে এই আন্দোলন হালের কোভিদকালে ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। পরে কখনো এ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। আপাতত যেটুকু বলার, মূলত শ্বেতাঙ্গ ট্রাম্প সমর্থকদের নিয়ে তৈরি কিউয়্যানন গোষ্ঠীর লোকজন মনে করে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সারাপৃথিবীর ক্ষমতাবান তলরাষ্ট্র বা ডিপস্টেট একত্র হয়েছে। তারা শুধু ট্রাম্পসাহেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তা নয়, দেশের শিশুদের ওপর নারকীয় যৌন অত্যাচার (পেডোফিলিয়া) চালাচ্ছে, শিশু পাচার করছে এমনকি তাদের রক্ত শুষে খাচ্ছে। কোভিদকালে কিউবাণী–কোভিড ট্রাম্প বিরোধী ডিপ স্টেট ও পেডোফিলদের নতুন চক্রান্ত, যার নেতৃত্বে বিল গেইটস ও জর্জ সোরসের মতো বদ ধনকুবেররাও আছেন। আমেরিকার লক্ষ লক্ষ কিউয়্যাননবাদীরা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে কোভিদ ছড়াচ্ছেন, ট্রাম্পকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন, ট্রাম্পের সমর্থনে এবং বদ লোকজনের (যাদের ভিতর লাল কমিউনিস্ট, শয়তান সন্ত্রাসবাদী, খারাপ বিদেশি মাইগ্রান্ট এবং হতচ্ছাড়া কালোগুলো রয়েছে) কুচক্রান্তের বিরুদ্ধে নিয়মিত পথে নামছেন। ইউরোপের কিউয়্যাননবাদীরা মনে করে যে কোভিদ ঘোর ষড়যন্ত্র, মুখোস না পরাটা পবিত্র গণতান্ত্রিক অধিকার। এদের ভিতরে নয়ানাজি এবং নানান কিসিমের বর্ণবৈষম্যবাদী এবং মাইগ্রান্ট বিরোধী ডানপন্থীরা তো আছেই, কিছু বাম ও লিবরল জনতাও আছে। দেশে দেশে মিছিলের পর মিছিল চলছে। কিউয়্যানন ছাড়া আরো অন্য দলও তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান এক গোষ্ঠীর সমর্থকদের দৃঢ় বিশ্বাস, কোভিড চক্রান্তের পিছনে ভিনগ্রহের লোকজনের সবুজ আঁশওলা হাত (কিম্বা লেজ) রয়েছে।
এখানে খানিক হাল্কা করে বলা হলো বটে, তবে ব্যাপারটা ইয়ার্কির নয়। যুক্তি ও বিজ্ঞানের পিতৃভূমি পশ্চিমী দুনিয়ার, অর্থাৎ ধনে, বিদ্যায়, প্ৰযুক্তিতে শ্রেষ্ঠ পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের দেশে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোক এইসব বিশ্বাস করে দিনরাত ফোনপর্দায় আর কম্পিউটারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকছেন, রাস্তায়ও নামছেন, পুলিশের সঙ্গে মারপিট করছেন। কোভিদকালে বহু মানুষ চিকিৎসার অভাবে, কিম্বা রোগের প্রকোপে মারা যাচ্ছেন, দারিদ্র ও কর্মহীনতা বাড়ছে পৃথিবী জুড়ে। একইসঙ্গে, বহু মানুষ যুক্তিবুদ্ধি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে মিথ্যা, অযুক্তি ও ঘৃণা ছড়িয়ে যাচ্ছেন দিনরাত। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্প হারলেন, বাইডেন জিতলেন। ট্রাম্প বলতে থাকলেন, তিনি আদৌ হারেননি, সব চক্রান্ত। তার সমর্থক কিউয়্যাননবাদীরা রাস্তায় নেমে পড়লেন, কোথাও কোথাও বন্দুক নিয়ে। পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রে’ এসব ঘটছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে যা ভোট পড়েছে তার অর্ধেকের কাছাকাছি ট্রাম্প পেয়েছেন। মানে গণতন্ত্রের মধ্যে বা গভীর অন্তঃস্থলে, অযুক্তি-কুযুক্তি, কুসংস্কার, ডাহা নির্জলা মিথ্যা এবং দুর্গন্ধ ডানপন্থী প্রতিক্রিয়া অবলীলায় বাস করতে পারে, করে থাকে। মনে রাখা দরকার, ট্রাম্পসাহেব নিজে হাত পা ছুঁড়ে, মুখোস-টুখোস খুলে ফেলে কিউয়্যাননওলাদের মদত দিয়ে গেছেন বরাবর। আরো মনে রাখা দরকার, ট্রাম্প সাহেব জলবায়ু পরিবর্তনে ‘বিশ্বাস’ করেন না। যেন জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটা ভয়ঙ্কর সার্বিক বিপর্যয়, বা কোভিদের মতো মারি ট্রাম্প বা তাঁর সমর্থকদের ‘বিশ্বাসের’ উপর নির্ভর করে।
বিশ্বাস বা অবিশ্বাসে মিলায় বস্তু। যাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন বা কোভিদে বিশ্বাস করেন না, নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারেন যে ট্রাম্পের মতো মহান রাষ্ট্রনায়ক দ্বিতীয় জন্মাবে না। কিম্বা ভারতের কথা ধরি, কোভিদের আগে থেকে দেশের অর্থনীতি তছনছ, লোকে কাজ হারাচ্ছেন তো হারাচ্ছেনই, কোভিদের ধাক্কায় দেশের নামমাত্র স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। মোদি-শা এবং সঙ্ঘ-বিজেপি বলে যাচ্ছেন, সব ঠিক হ্যায়, অর্থনীতি খুব ভালো অবস্থায় আছে, কোভিদে লোকে মরছে না, পৃথিবীতে ভারত একনম্বর। সঙ্ঘ-বিজেপির সমর্থকরা বিশ্বাস করছেন, সব ঠিক আছে, এবং দেশের প্রধান সমস্যা লাভ জিহাদ ঠেকানো, প্রধান কাজ গোমাতার সংরক্ষণ ও বিশেষ মার্বেল পাথরে রামলালার মন্দির তৈরি। এই সমস্তটা গণতন্ত্রের প্রত্যক্ষ দায়রায় ঘটছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজেপি নিয়ম করে জিতছে। গণতান্ত্রিক সংসদ ও বিধানসভা থেকে একের পর এক অগণতান্ত্রিক, পুঁজিবৎসল ও মৌলবাদী আইন পাশ হয়ে চলেছে।
গণতন্ত্র কী ও কেন
এদেশীয় ও বিদেশীয় বামপন্থীদের গরিষ্ঠাংশের কথাবার্তা শুনে বোধ হয়, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের প্রবল আস্থা আছে। আস্থা অর্থে বিশ্বাস। বিশ্বাসে বস্তু মিলায়, তর্ক চলে না, ফলে এ প্রশ্নটা উহ্য থেকে যায়, গণতন্ত্র বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে। বাম এবং গণতান্ত্রিক, বাম-গণতান্ত্রিক এই দুই শব্দবন্ধ আকছার কানে আসে। বাম মানেই বা কী? গণতান্ত্রিক মানেই বা কী? প্রশ্ন এবং সেই অনুষঙ্গে আসা তর্কগুলো বহু পুরোনো, প্রথম ও দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আর্ন্তজাতিকে, তার পরের বিভিন্ন অঞ্চলের বা দেশের বাম আন্দোলনে ঘুরেফিরে এসেছে। আমাদের দিশি বামদেরও স্মরণে থাকা দরকার, এখানকার কমিউনিস্ট দল এবং আন্দোলন শুধুমাত্র এই প্রশ্নে বারবার টুকরো হয়েছে। সে প্রশ্ন কি মীমাংসিত হয়ে গেছে? সে প্রশ্ন এইমুহূর্তের পৃথিবীতে আর প্রয়োজনীয় নয়? বিশ্বাসের (এবং অবিশ্বাসের) যুক্তিহীন ভূমি থেকে নেমে আমরা যদি ইতিহাস, যুক্তি ও বিজ্ঞানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি, পুরোনো প্রশ্ন মীমাংসিত তো হয়ই না, বরং নতুন প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে। ফলত গণতন্ত্র ও বামপন্থার আর্ন্তসম্পর্ক নিয়ে, বিশেষত বামপন্থীরা গণতন্ত্র বলতে কী বোঝেন তা নিয়ে পুরোনো প্রশ্নগুলো আবার, বারবার নতুন করে করতে হবে। না করলে বাম রাজনীতি পুঁজিরাষ্ট্রের মহাগাড্ডায় মাথা পর্যন্ত ডুবে থাকবে, উঠতে পারবে না।
কথাটা কী দাঁড়াল তাহলে? অনেকগুলো আপাত আলাদা অথচ পরস্পর-সংলগ্ন কথা এসে পড়ছে।
এক, ঐতিহাসিক বা দিশি, ফ্যাসিবাদ তৈরি হচ্ছে গণতন্ত্রের গর্ভ থেকে, গণতন্ত্রের অস্থি-পঞ্জরে।
দুই, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, বিশেষত বামেদের। আজকের গণতন্ত্র কোন পর্যায়ে গিয়ে আধা বা পুরো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠবে, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের চালু ব্যবস্থায় নির্ধারিত হয় না।
তিন, হয় না তার কারণ, এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বস্তুত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তা শেষাবধি পুঁজির সেবা করে, পুঁজির স্বার্থে পরিচালিত হয়। বামপন্থীরা সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেন, হয়তো কোথাও কোথাও রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক হতে পারেন, যেমন বাংলায় ঘটেছিল।
চার, কিন্তু এ থেকে সিদ্ধান্তে আসা আদৌ যায় না যে বামপন্থীদের প্রভাবাধীন রাষ্ট্রযন্ত্রটি পুঁজিবিরোধী হয়ে উঠবে।
পাঁচ, রাষ্ট্রযন্ত্রকে বামপন্থীরা যত না নিয়ন্ত্রণ করেন, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে পুঁজি, বামপন্থী প্রকল্পের শিরায় শিরায় ঢুকে পড়ে, সমাজমুক্তির বাম রাজনীতি উপায়হীন রাষ্ট্রবাদে পরিণত হয়। ফলে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় আসা মূল রাজনৈতিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের বাইরে চোখ যায় না।
ছয়, যেহেতু রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংসদীয় গণতন্ত্র বামপন্থী রাজনীতিকে তার সামাজিক, অর্থাৎ শ্রেণীউৎস থেকে ক্রমাগত উল্টোদিকে নিয়ে যায়, তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের’ অনুশীলন কার্যত বামপন্থাকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিহীন করে তোলে।
সাত, বামপন্থা যখন রাজনৈতিকভাবে শক্তি হারায় এবং পুঁজিতন্ত্র সংকটে পড়ে, ফ্যাসিবাদের উত্থানের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আট, সংসদীয় গণতন্ত্রের চৌহদ্দিতে আটকা পড়ে থাকা বামপন্থা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। পারে না, অথচ ইতিহাসের কী অমোঘ মায়া, ফ্যাসিবাদের মূল প্রতিপক্ষ বামেরা, তাঁরা লড়াইতে না থাকলে ফ্যাসিস্টদের অগ্রগতি আটকানোও যায় না দীর্ঘকাল।
ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াই ও অন্য গণতন্ত্র
অর্থাৎ, বলতে চাইছি ফ্যাসিবাদকে আটকাতে গেলে সমাজে বামপন্থার রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা একমাত্র রাস্তা। বামপন্থার রাজনৈতিক আধিপত্য বলতে পুঁজিরাষ্ট্রের অধীনে থাকা চালু সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্য, প্রকৃত গণতন্ত্রের কথা বলা। দীপঙ্কর মনে করিয়ে দিয়েছেন স্বাধীন ভারতের সংবিধানের কথা, আম্বেদকরের কথা। সংবিধান কাগজ মাত্র, রাষ্ট্র তা মানবে কিনা, মানলেও কিভাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ভুললে চলবে না, ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক বহুত্বের সঙ্গে মাথাভারী আমলাশাসিত রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব বহুদিনের। দিশি ফ্যাসিবাদ তাঁর নিজের প্রয়োজনে সে দ্বন্দ্বকে যেমন ব্যবহার করছে, তেমনই করছে আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে। সংবিধান বিষয়টাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে ক্রমশ। ফ্যাসিবিরোধী রাজনৈতিক লড়াইয়ে সংবিধান ও ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের’ কথা বলা যেতে পারে, হয়তো বলতে হবেও। কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি দরকার অন্য গণতন্ত্রের কথা বলা, যা পুঁজির ও রাষ্ট্রের অধীন নয়। ভারতীয় সমাজে এহেন গণতন্ত্র অনুশীলনের বহু ঐতিহাসিক নজির আছে। সেই ইতিহাসের সবটা বা গণতন্ত্রের জন্য সামাজিক আকাঙ্খা এখনো, এই নিওলিব সময়েও মরে যায়নি। আধুনিক ভারতের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বলুন বা আদিবাসী স্বশাসনের সাংবিধানিক উপায়, তৃণমূলস্তরের গণতন্ত্র বা গ্রাসরুটস ডেমোক্রাসি বিষয়টাকে একেবারে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। গত তিন-চার দশকে এই দেশে যে সব সামাজিক আন্দোলন তৈরি হয়েছে তার প্রায় সবটাই স্বশাসন বা অটোনমির দাবিতে। শেষ বড় আন্দোলন, ঝাড়খন্ড-উড়িষ্যা-ছত্তিসগড়ের পাত্থলগড়ি, সেখানে আদিবাসীরা গ্রামের পর গ্রামে রাষ্ট্রপ্রতিনিধিদের ঢোকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সংবিধান ও দেশের আইন তুলে তুলে। ঝাড়খন্ডের বিজেপি সরকার কর্পোরেটদের কাছে জমিজঙ্গল বিক্রি করে দিতে চাইছিল, তার বিরুদ্ধে পাত্থলগড়ি। বাংলার বাইরে বামপন্থীরা এই ধরণের আন্দোলনগুলিকে সমর্থন করছেন, দেখা গেছে। বাংলায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালুর প্রথম দিকেও স্বশাসনের কথা এসেছে বারবার। শুধু বাংলা বা ভারতের কথা নয়, স্বশাসন এবং সামাজিক গণতন্ত্রের (সোশ্যাল ডেমোক্রেসি নয়, সমাজে প্রোথিত ও অনুশীলিত গণতন্ত্র) দাবিতে সারা পৃথিবীতে পুঁজিরাষ্ট্র বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। এই লেখক যে আন্দোলনের সঙ্গে বহুবছর ধরে যুক্ত, সেখানে আপাত-অসহায় বনশ্রমিক ও বনবাসীরা গ্রামে গ্রামে গ্রামসভা তৈরি করে বনজঙ্গলনদীপাহাড়ের ওপর নিজেদের যৌথ অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। এই সব আন্দোলনের সমান্তরালে, দক্ষিণ আমেরিকার কোন কোন জায়গায় এবং আজকের আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থীরা সংসদীয় গণতন্ত্রের চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে পুঁজিরাষ্ট্র বর্জিত অন্য সমাজ তৈরির কথা বলছেন। কোথাও সে দাবি স্থানিক/আঞ্চলিক, যেমন জাপাতিস্তাদের, কোথাও পুরো দেশ ধরে, যেমন আমেরিকার তরুণ বাম শক্তি ডিএসএ (গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী)-র। বহু দেশে স্থানীয় ও বিকেন্দ্রিত শাসনের দাবিতে সক্রিয় হচ্ছেন অ্যানার্কিপন্থীরা।
চলমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আন্দোলনের শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশে সার্বিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক দাবি কি তুলতে পারেন না এখানকার বামপন্থীরা? তাঁরা কি বলতে পারেন না স্বশাসন ও গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়, একদম নিচ থেকে মানুষ স্ব-অধিকার অর্জন না করলে গণতন্ত্র বিষয়টাই ওপরচালাকি ও শয়তানির নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ দিল্লির সরকার কিম্বা নবান্নের সরকার ঠিক করে দেবেন কোথায় জমি নেওয়া হবে, কোথায় রাস্তা বা গুদাম বা কারখানা হবে, তা চলবে না। রাজ্য, জেলা, পুরসভা, পঞ্চায়েত, গ্রাম, প্রত্যেক স্তরে মানুষের স্বাধীন মতামত দেওয়া ও স্বশাসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বন্ধ হয়ে থাকা এবং রুগ্ন চটকল ও চা বাগানগুলো চালাবেন স্থানীয় শ্রমিক কমিটি, কোন এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্হ্যের প্রয়োজন কি, বাজেটবরাদ্দ কত, তা নির্ধারণ করবেন গ্রামসভা বা মহল্লাসভা। এসব দাবি সামনে রেখে নতুন আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না বাংলায়? বলা যায় না, পুকুর বুজিয়ে, মাঠ নষ্ট করে জমিবাড়ির ব্যবসা বাড়ানোটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা নয়? বা, জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে নতুন কয়লাখনি খোলাটা কর্মসংস্থান নয়, অপরাধ? পুঁজি যা যা দখল করেছে, করতে চাইছে, প্রকৃতি থেকে শুরু করে আমাদের প্রত্যেকের চিন্তাচেতনা ও অনুভূতি, তার প্রত্যেকটি জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন না বামপন্থীরা?
যদি না পারেন, ফ্যাসিবাদকে আটকানো যাবে কি? সঙ্ঘ-বিজেপি বাংলার ভোটে জিতবে কি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর প্রশ্ন। কিন্তু আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাম রাজনীতির নষ্ট হয়ে যাওয়া সামাজিক ভিত পুনরুদ্ধার করা, সেই উদ্দেশ্যে কাজ করা। সম্প্রতি, আমেরিকার নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর মান্থলি রিভিউ পত্রিকায় জন বেলামি ফস্টার একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর বক্তব্য, আমেরিকার বামপন্থীদের সামনে দীর্ঘ লড়াই। পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষে। ট্রাম্প ও ট্রাম্প-গোত্রীয় লোকেদের ফস্টার বলছেন নিওফ্যাসিস্ট। নিওলিব ব্যবস্থা অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাইরে যে অন্য এক পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্ভব, তা প্রমাণ করার ঐতিহাসিক দায় বামপন্থীদের ওপর। পুঁজিতন্ত্র থাকবে অথচ জলবায়ু পরিবর্তন হবে না, কোভিড জাতীয় মহামারী আর ঘটবে না, ট্রাম্প গিয়ে বাইডেন এলে ফ্যাসিবাদের বিপদ দূর হয়ে যাবে, এগুলো খোয়াব, এবং বিপজ্জনক। এই লেখক এ প্রসঙ্গে একশো ভাগ একমত। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াইকে যদি সমাজমুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে না মেলানো যায়, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিস্টদের আধিপত্যকে প্রশ্ন করতে যদি না শেখা যায়, ভোটের রাজনীতির পুঁজিশাসিত পরিসরে যদি বামপন্থীদের কাজ ঘুরপাক খেতে থাকে, এক ফ্যাসিবাদ অন্য ফ্যাসিবাদ ডেকে আনবে, গণতন্ত্র চির-অধরা থেকে যাবে।
- লেখক বামপন্থী ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী।
লেখাটি অসম্ভব ভালো,