ফাদার স্ট্যান স্বামী এই মুহূর্তে কারারূদ্ধ। ৮৩ বছর বয়স্ক মানুষটি ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’র নামে এ দেশের বিচারব্যবস্থার কাছ থেকে আর মুক্তি প্রত্যাশা করেন না। আদালতের কাছে তাঁর একটি মাত্র অনুরোধ ছিল বয়সজনিত শারীরিক সমস্যার কারণে তরল পানীয় পানে অসুবিধার জন্য তাঁকে যেন একটি স্ট্র ও সিপার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় আদালত এই আবেদনের গুরুত্ব অবজ্ঞা করে এনআইএ-কে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে উত্তর দেওয়ার জন্য। এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দ্য ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ ডিসএবেলড্ (এনপিআরডি) জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর কাছে একটি পিটিশন দাখিল করেছে যাতে ফাদার স্ট্যান স্বামী-র জন্য যথাযথ বসবাসের ব্যবস্থা করা হয় এবং এই বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপের অনুরোধ করা হয়েছে। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
অশীতিপর মানবাধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামী বর্তমানে মহারাষ্ট্রের তালোজা জেলে বন্দি। এই সেই তালোজা জেল যেখানে বর্তমানে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগে বন্দি এ দেশের অন্তত ১৯জন মানবাধিকার কর্মী, সমাজ ও আন্দোলনকর্মী। দেশের সরকার এবং দেশের সর্বোচ্চ বিচারব্যবস্থা অসুস্থতা, বয়সজনিত নানা জটিলতা এমনকি রোগজনিত কারণে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলেও বাস্তবিকই মিথ্যা অভিযোগে ও বিনাবিচারে আটক এই মানুষদের কোনওরকম শুনানি ছাড়াই বছরের পর বছর, দিনের পর দিন আটক করে রেখেছে। কারণ একটাই। হিন্দুত্ববাদী, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরূদ্ধে তাঁদের দৃঢ় ও অনমনীয় বিরুদ্ধ স্বর।
ফাদার স্ট্যান স্বামী এই মুহূর্তে কারারূদ্ধ মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে বয়োঃজ্যেষ্ঠ। ৮৩ বছর বয়স্ক মানুষটি ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’র নামে এ দেশের বিচারব্যবস্থার কাছ থেকে আর মুক্তি প্রত্যাশা করেন না। সম্প্রতি হাতে আসা একটি চিঠিতেই তিনি বর্ণনা করেছেন নিজের প্রতিদিনের জেলযাপন। কোনও অভিযোগ-অনুযোগ-সাহায্য প্রার্থনা নেই সেখানে। শুধু সেই চিঠির প্রতিটি শব্দ বুঝিয়ে দেন কতটা অসহনীয় পরিস্থিতি, শারীরিক সমস্যা ও মানসিক চাপের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে এই বৃদ্ধ মানুষটিকে। আদালতের কাছে তাঁর একটি মাত্র অনুরোধ ছিল বয়সজনিত শারীরিক সমস্যার কারণে তরল পানীয় পানে অসুবিধার জন্য তাঁকে যেন একটি স্ট্র ও সিপার ব্যবহারের অনুমতি দেয়। অবাক হওয়ার কিছুই নেই, ফ্যাসিস্ত সরকারের বর্তমান ব্যবস্থায় তাঁর সেই আর্জি নাকচ হয়ে গেছে।
এই সম্পূর্ণ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দ্য ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ ডিসএবেলড্ (এনপিআরডি) জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর কাছে একটি পিটিশন দাখিল করেছে যাতে ফাদার স্ট্যান স্বামী-র জন্য যথাযথ বসবাসের ব্যবস্থা করা হয় সে বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপের অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি এখন পার্কিনসনস রোগে আক্রান্ত। রাইটস অফ পার্সনস উইথ ডিসএবিলিটিস (আরপিডি) অ্যাক্ট, ২০১৬ বা প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অধিকার আইন অনুযায়ী এই রোগ এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা, ‘স্পেসিফায়েড ডিসএবিলিটি’ হিসাবেই চিহ্নিত। প্রতিবন্ধী অধিকার সংক্রান্ত নানা আইন ও কনভেনশন যেখানে ভারত স্বাক্ষরকারী দেশ, সেই আইন অনুযায়ী পার্কিনসনস রোগাক্রান্ত হিসাবে বয়স ও প্রতিবন্ধকতা-নির্দিষ্ট সঠিক থাকার ব্যবস্থা, স্ট্র ও সিপারসহ নানা আনুষঙ্গিক সহায়ক ব্যবস্থা ও একজন সহায়ক ব্যক্তি ফাদার স্ট্যান স্বামী-র বন্দি অবস্থাতেও পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যা থেকে বেআইনিভাবে তিনি এখন বঞ্চিত।
এনপিআরডি-র সাধারণ সম্পাদক মুরলিধরনের স্বাক্ষরিত যে চিঠিটি ১৬ নভেম্বর ২০২০ তারিখে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান জাস্টিস এইচ এল দাত্তু-র কাছে পাঠানো হয়েছে তার বক্তব্য সংক্ষেপে এখানে দেওয়া হল –
প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বন্দিদের অধিকার যাতে সুনিশ্চিত হয় এবং তাঁদের থাকার ব্যবস্থা যাতে যথাযথ হয় সে বিষয়ে কমিশনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এর আগে নাগপুর সেন্ট্রাল জেলে কারাবন্দি ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত প্রফেসর সাইবাবা-র বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্যও কমিশনের কাছে আর্জি জানানো হয়েছিল। যেখানে আরও বহু বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী বন্দিদের জন্য চূড়ান্ত অসুবিধাজনক অগম্য জেল পরিসর ও অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।
বর্তমান পিটিশনটি করা হচ্ছে পার্কিনসনস্ আক্রান্ত স্ট্যান স্বামী-র কারাবন্দি অবস্থার জন্য। পার্কিনসনস ক্রমশ বাড়তে থাকা স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাধি যাতে একটা সময়ে হাঁটাচলাও আক্রান্ত হয়। পার্কিনসনস আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়শই কাঁপুনি দেখা দিতে পারে। যা এক ধরনের অনিচ্ছাকৃত, অনিয়ন্ত্রিত পেশি সংকোচন, যার ফলে অধিকাংশ সময়েই হাত বা শরীরের অন্যান্য অংশ কাঁপতে থাকে।
স্ট্যান স্বামী-র দু’হাতেই এরকম কাঁপুনির সমস্যার জন্য তিনি জল ও অন্য কোনও তরল পানীয় পানের জন্য স্ট্র ও সিপার ব্যবহার করেন। এনআইএ যখন তাঁকে গ্রেফতার করে তিনি এইগুলি সঙ্গে নিয়েছিলেন। এনআইএ এগুলি তাঁকে দিতে অস্বীকার করে এবং জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই অতি প্রয়োজনীয় সহায়ক বস্তুগুলি দিতে অস্বীকার করে। এই হাত কাঁপার সমস্যার জন্য তাঁর খেতে অসুবিধা হয়। তিনি নিজে স্নান করতে, জল আনতে বা নিজের পোশাক কাচতে পারেন না। কানে শুনতে না পারার সমস্যার জন্য তাঁকে দু কানেই শোনার যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। তাঁকে নিয়মিত গরম জলের ভাপও নিতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যেই তাঁর দু’বার হার্নিয়ার জন্য অস্ত্রোপচার হয়েছে, যার ফলে জেলের ভেতরে যে শ্রমসাধ্য সময়সূচি মেনে চলতে হয় তাঁর পক্ষে অতীব কষ্টকর।
এই পিটিশনের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে এই বিষয়টির দিকে যে, বর্তমানে যে অবস্থায় স্ট্যান স্বামী রয়েছেন তা তাঁর স্বাস্থ্যের অধিকার এবং জীবন-সম্মান-সমতার অধিকার, নির্যাতন-নিষ্ঠুর-অমানবিক ও নিম্নমানের ব্যবহারে থেকে সুরক্ষা পাওয়ার যে অধিকার, বৈষম্যহীনতার অধিকার – তাকে লঙ্ঘন করছে। সুপ্রিম কোর্ট বহু মামলার ক্ষেত্রেই বলেছে বন্দিদেরও কিছু নির্দিষ্ট মৌলিক অধিকার রয়েছে, যার মধ্যে উল্লিখিত অধিকারগুলিও রয়েছে, যা এক্ষেত্রে কার্যতই লঙ্ঘিত। মনে রাখা দরকার ভারত স্বাক্ষর করেছে – ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস্ (আইসিসিপিআর) ও রাষ্ট্রপুঞ্জের রেজোলিউশন ৭০/১৭৫ স্ট্যান্ডার্ড মিনিমাম রুলস ফর দ্য ট্রিটমেন্ট অফ প্রিজনার্স -এ (অর্থাৎ কারাবন্দিদের প্রতি ব্যবহারের ন্যূনতম নিয়মের মাপকাঠি), যা নেলসন ম্যান্ডেলা রুলস নামেও পরিচিত। এই সবগুলিই কারাবন্দিদের সম্মানজনক জীবনের অধিকার সুনিশ্চিত করে। আরপিডি অ্যাক্ট, ২০১৬ সেকশন ৬-এ নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক ব্যবহারের থেকে সুরক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কারাবন্দিদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা রুলস-এ নির্দিষ্টভাবে বলা রয়েছে — ধারা ২২অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো পরিমাণ মতো পুষ্টির সরাবরাহ করা যাতে বন্দির স্বাস্থ্য ও শক্তি বজায় থাকে এবং ধারা ২৪ অনুযায়ী রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হল বন্দিদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য কোনওরকম বৈষম্য ছাড়া প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা। ধারা ২৪(২) অনুযায়ী বন্দিদের যদি কোনও চিকিৎসা চলে তাহলে তা চালিয়ে যাওয়া ও যত্নের ব্যবস্থাও করতে হবে।
একজন পার্কিনসনস রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, যিনি এই রোগের জন্য তাঁর দু’টি হাত ব্যবহারে অপারগ, তাঁর অতি প্রয়োজনীয় একটি সহায়ক বস্তু দিতে অস্বীকার করা ‘নিষ্ঠুর ও অমানবিক ব্যবহার’-র পর্যায়েই পড়ে, তাঁর সম্মান লঙ্ঘন করছে ও এক প্রকার নির্যাতন তো বটেই। সুপ্রিম কোর্টের পিইউসিএল ভার্সেস ইউওএল মামলায় ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ২১ অনুযায়ী খাদ্যের অধিকারকে জীবনের অধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত একটি বিষয় হিসাবে দেখানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়েছে যে সম্মানের অধিকারকে অবশ্যই জীবনের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে এবং এক্ষেত্রে ৮৩ বছরের এই বৃদ্ধ মানুষটির ক্ষেত্রে তাই অস্বীকার করা হচ্ছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ফাদার স্ট্যান স্বামী ৬ নভেম্বর মুম্বইয়ের একটি বিশেষ আদালতে তাঁর জন্য স্ট্র ও সিপারের ব্যবস্থা করার আবেদন জানান। সেই আদালত অসংবেদনশীল, অবিবেচকের মতো আচরণ করে, এই আবেদনের গুরুত্ব অবজ্ঞা করে এনআইএ-কে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে এর উত্তর দেওয়ার জন্য। এই সহায়ক বস্তুগুলো জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে অতি দ্রুত দেওয়া প্রয়োজন কারণ স্ট্র ও সিপার ফাদার স্ট্যানের অতি প্রয়োজনীয় বস্তুগুলির মধ্যে পড়ে কারণ এগুলি ছাড়া জল ও যেকোনও পানীয় পান করতে তিনি অপারগ, ফলত তাঁর শরীর আরও অসুস্থ হয়ে খারাপ হয়ে পড়বে।
এই কারণেই এনআরপিডি থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে পিটিশন দেওয়া হয়েছে যাতে ফাদার স্ট্যানকে বয়স ও প্রতিবন্ধকতাজনিত সঠিক বসবাসের ব্যবস্থা, স্ট্র ও সিপারসহ সহায়ক সামগ্রী ও একজন সহায়কের ব্যবস্থা করা হয়। অনুরোধ করা হয়েছে যাতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক অনুসন্ধানী দল গিয়ে তালোজা জেল পরিদর্শন করে দেখে সেখানে জেল পরিসর সুগম্য কি না ও স্ট্যান স্বামীকে কী ধরনের পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। যদি দেখা যায় জেলের ভেতরে এই ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় ও একটি সুগম্য পরিবেশ তৈরি করা যাচ্ছে না, তাহলে অনুরোধ করা হয়েছে কমিশন যেন নির্দেশ জারি করে যাতে তাঁকে দ্রুত কোনও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে উপযুক্ত পরিষেবা পাওয়া সম্ভব।
এখন দেখার এনপিআরডি-এর এই পিটিশনের পরে জরুরি ভিত্তিতে অর্ণব গোস্বামীকে বিদ্যুৎগতিতে জামিন দেওয়া এ দেশের বিচারব্যবস্থা একজন অশীতিপর, প্রতিবন্ধী মানবাধিকার কর্মীকে অতি প্রয়োজনীয় সহায়ক বস্তু ও উপযুক্ত পরিবেশ দিতে কত দেরি করে? আদৌ দেয় কি না? না কি ফ্যাসিস্ত সরকারের বশংবদের মতো আচরণই চালিয়ে যায়!
লেখক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক।