মহামারি-তাড়িত শ্রমিকদের ঘরে ফেরা এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া


  • November 15, 2020
  • (0 Comments)
  • 1913 Views

লকডাউন ও মহামারির তাড়নায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বাংলায় ফিরে এসেছেন। তার বহু মর্মান্তিক কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন অসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা, সমাজমাধ্যম এবং অগণিত স্বেচ্ছাসেবীদের নিঃস্বার্থ সেবার দলিলহীন আত্মত্যাগে। গ্রাউন্ডজিরো দীর্ঘ লকডাউন সময়কালে ধারাবাহিক ভাবে এই অতিমারি-তাড়িত সহনাগরিকদের কথা তুলে ধরেছে। দেবাশিস আইচ-এর বর্তমান রিপোর্টটি সেই অনেকানেক প্রচেষ্টার একটি অংশ। এবং গবেষণা ও সারস্বত কেন্দ্র ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের আনুকুল্যে, জুলাই ও অগস্ট মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতার আশিনা এবং কুলতলির পূর্ব গুড়গুড়িয়া; মুর্শিদাবাদের ডোমকল এবং হাওড়ার চেঙ্গাইলে ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে প্রস্তুত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনের সংক্ষেপিত অংশ। সিআরজি-র অনুমতিক্রমে তা প্রকাশিত হলো। গ্রাউন্ডজিরো সম্পাদকমণ্ডলী। 

    

এক

বন্দরের কাল হলো শেষ

 

আবারও ভেসে পড়ছেন শ্রমিকরা। ফিরে যাচ্ছেন। নিজ রাজ্যে কাজ নেই অগত্যা ফিরে যাওয়া ভিন রাজ্যে। যেমন ফিরে গেলেন মুর্শিদাবাদ জেলার রানিনগরের  মহিবুল বিশ্বাস। ১৮ বছর বয়সেই সংসারের জোয়াল কাঁধে চড়িয়েছেন। লকডাউনের চার মাস আগেই গিয়েছিলেন কেরালায়। এককাঁড়ি অর্থদণ্ড দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন ৭ মে।

 

মহিবুলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডোমকল শহরে। সেদিন ছিল ৩ অগস্ট। কেরালায় বাস নিয়ে যাচ্ছেন ডোমকলের নুর ইসলাম মণ্ডল। নুর হ্যান্ডবিল ছড়িয়েছেন, ছাপানো পোস্টার সাঁটিয়ে জানিয়েছেন — “প্রিয়, ভাই ও বন্ধুগন আগামী ৬ই আগষ্ঠ ২০২০ বৃহস্পতিবার লষ্করপুর হইতে কেরল যাবার গাড়ি ছাড়বে। সঙ্গে ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড রাখতে হইবে। আজই টিকিট বুকিং করার জন্য যোগাযোগ করুন এই নম্বরে…।” (বানান অপরিবর্তিত)।

 

রঙিন বিজ্ঞাপনের উপরের বয়ানের মাঝে একটি ঝাঁ চকচকে লাক্সারি বাসের ছবি আর বেশ বড় আর আকর্ষিত করার ভঙ্গিতে লেখা ‘কেরল যাইবেন’ তার ঠিক নীচেই ‘টিকিট মূল্য 6500 টাকা’।

 

মহিবুল এসেছিলেন বুকিং করতে। তিন মাস কেটেছে প্রায় বিনা কাজে। বাবা হাতে গোনা কয়েকদিনের জন্য এমজিএনআরইজিএ বা ১০০ দিনের কাজ পেয়েছিলেন। জমানো টাকা শেষ। “না গেলে হবে না। মায়ের আলসার, রক্ত পড়ে। ভাই-বোনগুলোর জন্য যেতে হবে।”

 

ফিরে গেছেন ডোমকলের লস্করপুর গ্রামের মুস্তাকিন মণ্ডল কিংবা জলঙ্গির সাহেবরামপুরের এনামুল মালিথা। গ্রামে কাজ নেই। এই দুর্দিনে পাটকাটার কাজ করেছেন মুস্তাকিন। মজুরি ২৫০ টাকা। মাটি কেটে পেয়েছেন ২০০ টাকা। ৭০০ টাকা রোজ পান কেরালায়। এনামুল রবার কারখানায় কাজ করেন। মাসে হাজার ১৫ টাকা রোজগার। মালিকের ডাকে তিনিও ফিরে গেলেন।

 

শুধু নুর ইসলাম মণ্ডল কিংবা তাঁর তরুণ ব্যবসায়িক সহযোগী মহম্মদ মইনুল হাসান নন। নানা রাজ্য থেকেই এ-রাজ্যের নানান জেলায় শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাস পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন সংস্থার এজেন্ট কিংবা ঠিকাদাররাও। কখনও সংস্থা নিজেরাই বাস ভাড়া করে পাঠাচ্ছে কিংবা ট্রেনের টিকিট পাঠিয়ে দিচ্ছে। বড় নির্মাণ সংস্থা বা তাদের ঠিকাদাররা প্লেন ভাড়া দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের নির্মাণ শ্রমিকদের। আবার গাঁটের কড়ি খরচ করেও যাচ্ছেন শয়ে শয়ে নিরুপায় শ্রমিক। কিংবা স্পেশাল ট্রেনে ফিরছেন নিয়মিত হারে। যাওয়ার আগে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার দেখিয়ে সংগ্রহ করছেন সুস্থতার শংসাপত্র।

 

২৫ জুনের আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবর থেকে জানা যাচ্ছে, “সরকারি সূত্রের খবর প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী সাড়ে ১২ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফিরে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ভিন রাজ্যে ফিরে যেতে চাইছেন না।” ২৬ জুলাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতা ব্লকের আশিনা এবং ২৭ ও ২৮ জুলাই কুলতলি ব্লকের পূর্ব গুড়গুড়িয়া, ২ ও ৩ অগস্ট মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল, ১৯ অগস্ট হাওড়া জেলার চেঙ্গাইলে  শ্রমিক ও কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়নি তাঁদের ‘৮০ শতাংশই ভিন রাজ্যে ফিরে যেতে চাইছেন না’। বরঞ্চ ফিরছেন। বড় নিঃশব্দে ফিরছেন।

 

দুই

রাজ্যে রাজ্যে লকডাউনপরিযাণের শুরু

 

“আজ রাত বারা বাজে সে, পুরে দেশ মে, ধ্যান সে শুনিয়ে পুরে দেশ মে, আজ রাত বারা বাজে সে, সম্পূর্ণ দেশ মে সম্পূর্ণ লকডাউন হোনে যা রহা হ্যায়। দেশ মে যাহা ভি হ্যায় ওহি রহে। কোভিড কো হালাত কো দেখতে হুয়ে দেশ কে লকডাউন এক্কিশ দিন হোগা তিন সপ্তাহ হোগা।”

— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দূরদর্শন, রাত আটটা, ২৪ মার্চ ২০২০।

 

২৫ মে নিজের সংসদীয় কেন্দ্র বারাণসীর মানুষের উদ্দেশে আর এক টেলিভিশন ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আরও একটি কথা বলেছিলেন, যেমন যে কোনও ভাষণেই বলে থাকেন, সমালোচকরা যাকে বলেন ‘মনভোলানো চটকদারি কথা’ — বলেছিলেন, কথাটা এরকম — মহাভারতের যুদ্ধে ১৮ দিনে জয় এসেছে, আর একুশ দিনে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার চেষ্টা করতে হবে।

 

১৯ মার্চ, টেলিভিশনে এক বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদী ২২ মার্চ দেশজোড়া ‘জনতা কার্ফু’ জারির কথা ঘোষণা করেছিলেন এবং কার্ফু শেষে থালা-বাটি-ঘটি বাজানোর পরামর্শও দিয়েছিলেন। তার মাত্র এক সপ্তাহ আগে, ১৩ মার্চ, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব লভ আগরওয়াল দাবি করেছিলেন, “এটা (কোভিড- ১৯) কোনও জরুরি স্বাস্থ্য-পরিস্থিতিই নয়।” অথচ, ১১ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট, ১৮৯৭ জারির পরামর্শ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের সচিব প্রীতি সুদান কোভিড-১৯ অতিমারি উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গঠিত মন্ত্রীগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের  সে-কথা জানিয়েছিলেন।

 

এমন এক পরিস্থিতিতে ১৬ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। ২২ মার্চ ইউনিয়ন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি  এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজ্যগুলির মুখ্যসচিবদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যই লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একমত হয়। এর পরপরই কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ৭৫টি জেলায় পূর্ণ লকডাউনের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে পরামর্শ দেয়। এ-রাজ্যের ক্ষেত্রে কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় পূর্ণ লকডাউনের পরামর্শ দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার সে পরামর্শ শুধু মান্য করেনি, কয়েকশো যোজন এগিয়ে, ২৩ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ  কলকাতা-সহ রাজ্যের ছোট-বড় সমস্ত শহর এবং প্রত্যেকটি জেলার বেশ কিছু অংশ জুড়ে চারদিনের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা — যাকে ‘মিনি লকডাউন’ বলা যেতে পারে — জারি করে বলে ‘ঘরে থাকুন’। একরাত কাটতে- না-কাটতেই, ‘পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ওইদিন অর্থাৎ, ২৩ মার্চ বিকেল পাঁচটা থেকে সারা রাজ্যকেই লকডাউনের আওতায় আনা হলো এবং ২৭ তারিখের বদলে তা বাড়িয়ে দেওয়া হয় ৩১ মার্চ পর্যন্ত।

 

শুধুমাত্র এ-রাজ্য নয় দেশের ৩২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ততদিনে পূর্ণ লকডাউন কিংবা রাজ্য জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২২ মার্চ থেকে পঞ্জাব, ২৩ মার্চ থেকে তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি, কেরালা ৩১ মার্চ অবধি পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেছিল। এই ধারাবাহিকতায় ২০ মার্চ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে ঘোষণা করেন ৩১ মার্চ পর্যন্ত অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব বন্ধ থাকবে। নাগরিকদের ঘরবন্দি থাকারও পরামর্শ দেওয়া হয়। আর সেদিনই সন্ধে থেকে পুণে, কল্যাণ, মুম্বাইয়ের লোকমান্য তিলক স্টেশনে ভিড় উপচে পড়তে থাকে। পরিস্থিতি এমন হয় যে নির্ধারিত ৪৭টি ট্রেন ছাড়াও আরও ১৭টি স্পেশাল ট্রেন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেন্ট্রাল রেলওয়েজের কর্তাদের।

 

অর্থাৎ, মহামারি-তাড়িত ও কর্মহীন শ্রমিকদের মহাপরিযাণ শুরু হয়ে গিয়েছিল অন্তত দু’সপ্তাহ আগে থেকেই। সমীক্ষাকৃত আন্তঃরাজ্য শ্রমিকদের মধ্যে ১৩ মার্চ তেলেঙ্গানা থেকে পাঁচ হাজার টাকা বাস ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন ফলতার আশিনা গ্রামের আশরাফ মণ্ডল। এবং ১৫ মার্চ কেরালা থেকে ফেরেন মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির এনামুল মালিথা। প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের আরোপিত স্বাভাবিক জনজীবন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য এবং অবশ্যই ‘ছোঁয়াচে ভাইরাস’ করোনাজনিত আতঙ্কও ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে কর্মরত দৈনিক মজুরির ও অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক, রোগী, তীর্থযাত্রী কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের এই মহাপরিযাণ শুরু হয়।

 

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকেই ক্রমে ক্রমে রাজ্যে রাজ্যে সীমান্ত এলাকায়, হাইওয়েতে তাদের আটক করা শুরু হলো। ট্রেন স্টেশনে আটকে পড়লেন অনেকেই। যেমন কুলতলির পূর্ব গুড়গুড়িয়ার মজিদ আলি মোল্লা এবং এ-রাজ্যের আরও তিনশোরও বেশি মানুষ। মজিদরা কেরালা থেকে লকডাউন ঘোষণার আগেই রওনা দিয়ে ২২ মার্চ চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছে দেখেন ট্রেন নেই। একই গ্রামের অমলেশ ভুঁইয়া অবশ্য বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। ২১ মার্চ তেলেঙ্গানা থেকে ট্রেনে রওনা দিয়েছিলেন অমলেশ। অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে বাড়ি ফেরেন ২৩ মার্চ। একই ভাবে মহারাষ্ট্রের ওয়াসিম থেকে বাড়িতে ফিরেছেন পূর্ব গুড়গুড়িয়ার মনসাতলার বাসিন্দা বাসুদেব বসন্ত। মহারাষ্ট্রের ওয়াশিম থেকে আকোলা স্টেশনে এসে ১৯ তারিখ ট্রেন ধরেন, সঙ্গে ছিলেন এ-রাজ্যের আরও পাঁচ জন। দিল্লির বদরপুরে এক কারখানায় ছোটদের জিনসের প্যান্ট সেলাই করতেন ফলতার রফিকুল শেখ (২৮) লকডাউনের চারদিন আগে বন্ধ হয়ে যায় কারখানা। ৩০০০ টাকা মজুরি বাকি ছিল। “হাতেপায়ে ধরেও টাকা পাইনি। চালু টিকিট কেটে আনরিজার্ভে চলে এসেছি।” জানিয়েছিলেন রফিকুল। ২৪ মার্চ বাড়ি ফেরেন রফিকুল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতার দোস্তগির শেখ (৩২) অবশ্য ফেরার আগে পুরো মজুরি নিয়েই ফিরেছেন। ২২ মার্চ চেন্নাই থেকে জেনারেলের টিকিট কেটে ফিরে আসেন। কেন চলে এলেন প্রশ্ন করাতে বললেন, “শুনতে পাচ্ছি ভাইরাস আসছে…ছড়িয়ে যাচ্ছে…ছোঁয়াচে রোগ। মজুরি নিয়ে ওস্তাগরকে বলে চলে এলাম।”

 

সারা দেশে ঠিক কত শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার এই প্রাক-২৫ মার্চ পরিযাণের অংশ তা নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্য গণপরিসরে নেই। সারা দেশ যখন পথে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের শ্রমিকরা যখন ছ’শো-সাতশো, হাজার কিলোমিটারে পায়ে হেঁটেই পাড়ি দেবেন বলে বেরিয়ে পড়েছেন। দিল্লির বাস টার্মিনাসে যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ আর গুটি কয়েক অপেক্ষারত বাস, তখন চারদিন পর সংবিৎ ফিরল কেন্দ্রের, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল সরকারের, উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের। শনিবার ২৯ মার্চ উত্তরপ্রদেশ সরকার রাজ্যের শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক হাজার বাস মঞ্জুর করল, দিল্লি সরকার ২০০। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ চেতাবনি দিলেন শ্রমিকরা যেন রাজ্যের সীমান্ত পার করতে না-পারে। হাইওয়েতেই আটকাও এবং শিবিরে পোরো।

 

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই নিষ্ঠুর লকডাউন নিয়ে এ-রাজ্যেও কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো এক চিঠিতে অনুরোধ করেছিলেন, যেহেতু রাজ্য সরকারের পক্ষে “কোনও সাহায্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়’, বাংলার শ্রমিকদের যেন থাকার জায়গা, খাবার, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়।”

 

তিন

শ্রমিক স্পেশাল: কেন্দ্ররাজ্য, রাজ্যরাজ্য বিতর্ক

 

আয় শূন্য, অস্থায়ী সরকারি-বেসরকারি আশ্রয় শিবির বাসযোগ্য নয়, লঙ্গরখানার খাবার হয় মুখে রোচে না, না-হয় পেট ভরে না। নির্মাণস্থানে, কারখানায় একই দুরবস্থা। মজদুর বস্তিতে একই ঘরে গাদাগাদি করে থেকেও ভাড়া গুনতে হচ্ছে। জমি-ধান-গয়না বিক্রি কিংবা বন্ধক রেখে টাকা পাঠাতে হচ্ছে সেই মানুষদের যাঁরা প্রতিমাসে সব সাধ-আহ্লাদ ভুলে মুখে রক্ত তোলা পরিশ্রম করে বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। অথচ, খাওয়া-থাকা-ফেরার গাড়ি ভাড়া তাঁদের অনেকেরই কাছে নেই। আন্তঃরাজ্য এই রেমিট্যান্স মার্কেটটির আর্থিক পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার বা ১৪, ৭৩,৯৯,০০,০০,০০০ টাকা। যার শতকরা ৮০ ভাগ পৌঁছয় গ্রামে। অথচ তাঁদের কথা মনেই রাখেনি কোনও সরকার।

 

স্বাভাবিক ভাবেই বিপন্ন শ্রমিকরা লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই মরিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।
২৯ মার্চ থেকে ৯ মে পর্যন্ত এক সুরাতেই ন’টি শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স সলিডারিটি নেটওয়ার্ক, মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স রেজিস্টান্স ম্যাপ তৈরি করে, মে মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে ঘটে যাওয়া এমন ১৫৮টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। https://www.mwsn.in/resistancemap/
লকডাউনের ঘোষণার আটদিনের মধ্যে wbtrackmigrants.com ৫০,১৭২জন  সাহায্যপ্রার্থী পরিযায়ী শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত করে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’ (বিএমএস) এই সময়ে নথিভুক্ত করেছিল ২০,০০০ শ্রমিকের নাম। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ  জানায় ১৭ এপ্রিল ভিন রাজ্যে আটক থাকা বাংলার ৩৪,০০০ আন্তঃরাজ্য শ্রমিকের বিস্তারিত তথ্য মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে তাঁদের ফিরিয়ে আনা এবং খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন জানানো হয়। এবং ২৫ এপ্রিল ও ৮ মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভাল্লাকে যথাক্রমে ৪৫,০০০ ও ৭০,০০০ শ্রমিকের তালিকা পাঠিয়ে একই আবেদন জানানো হয়। সংগঠনের সভাপতি সামিরুল ইসলামের অভিযোগ কোনও তরফ থেকেই তাঁদের এই উদ্যোগকে স্বীকার করা হয়নি।

 

কতটা মরিয়া ছিলেন শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার জন্য? ৩ মে টাইমস অফ ইণ্ডিয়ার রিপোর্ট জানাচ্ছে, গুজরাত থেকে বাড়ি ফেরার জন্য ২৫টি রাজ্যের ২০,৯৫,৪২৮ জন নাম লিখিয়েছেন। তার মধ্যে এ-রাজ্যে ফিরতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন ৫১,৯৪৩ জন। রাজ্য প্রশাসনের হিসেব, ট্রেন চালু হতেই ২ মে শনিবার থেকে ৫ মে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ২৩টি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে ২৮ হাজার শ্রমিক ওড়িশা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে ফিরে যান। এখান থেকে স্পষ্ট অন্যান্য রাজ্যের শ্রমিকদের মতো বাংলার শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার জন্য কতটা ব্যাকুল ছিলেন। কিন্তু, প্রথম অবস্থায় বাংলার জন্য কোনও ট্রেনের অনুমোদন পশ্চিমবঙ্গ সরকার দেয়নি।

গ্রাফিক্স: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৩ মে, ২০২০।

২১ দিন পর ১৫ এপ্রিল ফের দ্বিতীয় দফার লকডাউন শুরু হয়। ২৭ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ভিন রাজ্যে আটক থাকা মানুষদের ফিরিয়ে আনতে রাজ্য সরকার ‘সম্ভাব্য সমস্ত পদক্ষেপ শুরু করবে’।  বললেন বটে তবে সে ‘পদক্ষেপ করতে’ করতে বেলা বইয়ে দিয়েছিলেন অনেক। শেষ পর্যন্ত দেশজুড়ে ফুঁসতে থাকা শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাতে ২৯ এপ্রিল ও ১ মে নির্দেশ জারি করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। https://mobile.twitter.com/PIBHomeAffairs/status/1255471592798330888

২৯ এপ্রিলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশ।

১ মে থেকেই চালু হয়ে গেল শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন। ৩ মে শ্রমিকদের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আর একদফা নির্দেশ জারি করে বসল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। প্রথম দুটি নির্দেশের নিরিখে জারি করা এই নির্দেশ কেন্দ্রীয় সরকার ও শিল্পপতিদের গোপন বোঝাপড়াকেই যেন সামনে নিয়ে এল। নির্দেশের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে প্রথম দুই নির্দেশের ব্যাখ্যা করে বলা হয়: “প্রথম দুই নির্দেশের লক্ষ্য সেই সমস্ত আটকে পড়া শ্রমিকদের সাহায্য করা যাঁরা লকডাউনের মুখে তাঁদের বাসস্থান/ কাজের জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন কিন্তু লকডাউনের জন্য গাড়ি চলাচল এবং সাধারণের যাতায়তে বাধানিষেধের ফলে নিজ নিজ বাসস্থান বা কাজের জায়গায় ফিরে যেতে পারেননি। কিন্তু, (ওই নির্দেশ) তাঁদের জন্য নয় যাঁরা আদি বাসস্থানের বাইরে কর্মসূত্রে স্বাভাবিক ভাবে কোথাও বসবাস করেন এবং স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ি ফিরতে চান।”

৩ মে রাজ্যের মুখ্যসচিবদের কাছে পাঠানো স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভাল্লার চিঠি।

মোদ্দা কথাটি কী দাঁড়ালো? সত্যিই গোলমেলে। সন্দেহ হয়, এই নির্দেশের লক্ষ্য ছিল, যত বেশি বেশি সংখ্যক শ্রমিকদের আটকানো সম্ভব, আটকাও। কেন এই সন্দেহ? এই ‘সংশোধিত’ নির্দেশ বেরলো ৩ মে এবং সব ব্যবসা খুলে দেওয়ার দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো বণিকসভার ‘স্ট্রাটেজিক নোট অন রিজাম্পশন অফ ইকনমিক অ্যাক্টিভিটিজ ইন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াজ’ শীর্ষক রিপোর্ট সকলের গোচরে এল ৪ মে। এর মধ্যে কি কোথাও কোনও যোগ রয়েছে? আপাতদৃষ্টিতে না। কিন্তু, যোগসাজশটি উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেল কর্নাটক সরকারের এক সিদ্ধান্তে। কনফেডারেশন অফ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্রেডাই) সঙ্গে এক বৈঠকের পর পরই  বি এস ইয়েদুরাপ্পা সরকার ৬ মে থেকে বিভিন্ন রাজ্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন বাতিল করে। ৫ মে এক চিঠিতে কর্নাটক সরকারের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি এন মঞ্জুনাথ প্রসাদ সাউথ ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারকে লেখা এক চিঠিতে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকদের প্রবল বিক্ষোভ, কর্নাটক তো বটেই সারা দেশে প্রবল সমালোচনার জেরে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসেন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা।

রেলকে পাঠানো এন. মঞ্জুনাথ প্রসাদের চিঠি।

প্রথম যে ট্রেনটি এ-রাজ্যে পৌঁছেছিল সেটি আসে রাজস্থানের আজমির থেকে। ৫ মে সেটি ডানকুনি জংশনে পৌঁছয়। দ্বিতীয় ট্রেনটি কেরালার এর্নাকুলাম থেকে রওনা দিয়ে বহরমপুর জংশনে পৌঁছয় ৬ মে। দুটি ক্ষেত্রেই রাজস্থান ও কেরালা সরকারের অনুরোধে রাজ্য সরকার অনুমতি দিয়েছিল। ২ মে রাজস্থান সরকার ২ তারিখ ট্রেন ছাড়বে জানিয়ে অনুমতি চায়। ওইদিনই রাজ্য সরকার জানায় ২ তারিখ নয়, তিন তারিখে ছাড়ুন। কেরালা রাজ্যের নোডাল অফিসার ও রাজ্যের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ১ মে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবকে বাংলার জন্য শ্রমিক স্পেশাল ছাড়ার জন্য রাজ্যের মুখ্য সচিবকের কাছে লিখিত ভাবে অনুমতি চান। রাজ্যের উত্তর পৌঁছয় ৩ মে। অবশেষে এর্নাকুলাম থেকে ট্রেন ছাড়ে। ৪ মার্চ হিন্দুস্তান টাইমস লিখছে, বাংলা কোনও শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের জন্য আবেদন জানায়নি। মাত্র দুটি ট্রেনকে রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। ৪ মে কর্নাটক সরকার অভিযোগ জানায়, পশ্চিমবঙ্গ অনুমতি দিতে অস্বীকার করছে। এই অভিযোগের উত্তরে রাজ্যের পক্ষ থেকে বলা হয়, “আমরা কর্নাটককে বলেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলার উদ্দেশে যাত্রা স্থগিত রাখতে। শ্রমিকদের গ্রহণ করার জন্য পরিকাঠামো প্রস্তুত করতে হবে।” একই জাতীয় অভিযোগ শোনা গিয়েছে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট সরকারের কাছ থেকে, না তারা উত্তর পেয়েছে, না পেয়েছে অনুমতি।

 

রাজ্য সরকার যখন পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যস্ত, তখন ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, গুজরাটে আটকে থাকা এ-রাজ্যের শ্রমিকরা ক্রমে মরিয়া হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। ব্যাঙ্গালোরে থানায় থানায় ঘুরে মাথাপিছু ১০০টাকা খরচ করে ট্রেনে ওঠার ফর্ম পূরণ করে জানতে পারছেন ট্রেন বাতিল আবার ২০০ টাকা খরচ করে ডাক্তারের সার্টিফিকেট জোগাড় করে শুনছেন ট্রেন নেই। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রাজ্য সরকারকে শ্রমিকদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার পরেও কোনও সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।

 

১ মে ট্রেন চালু হয়ে গেল, অথচ রাজ্যের তরফে কেন কোনও পদক্ষেপ দেখা যায়নি? মনে করা হচ্ছে এর একটি প্রধান কারণ হলো একদিকে সংক্রমণের ভয়,অন্যদিকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাব ও প্রস্তুতিহীনতা। যেহেতু, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, দিল্লি, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলিতে সংক্রমণের মাত্রা তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল, তাই গ্রাম বাংলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকার শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ৪ মে রাজ্যের মুখ্যসচিব  বক্তব্যে তার সমর্থন পাওয়া যায়।  ট্রেন না-মিললেও শ্রমিকরা দলে দলে নিজেদের উদ্যোগেই বাস-লরি করে ফিরতে শুরু করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের দ্বিধাগ্রস্ততা, বিভিন্ন রাজ্যের অভিযোগের পর ৯ মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সরাসরি অভিযোগ জানিয়ে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনগুলিকে রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ফলত শ্রমিকদের আরও দুর্দশায় পড়তে হচ্ছে।”  তার তীব্র বিরোধিতা করেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যকে ‘মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যার ঝুড়ি’ বলে বর্ণনা করেন।

 

১৪ মে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সরকার রাজ্যের শ্রমিকদের জন্য ‘অতিরিক্ত ১০৫টি বিশেষ ট্রেনের’ ব্যবস্থা করেছে।  বিভিন্ন মাধ্যমের খবর অনুযায়ী এই ১৪ তারিখ পর্যন্ত রাজ্য মাত্র ১০টি ট্রেনের অনুমতি দিয়েছিল। এই ১০৫টি ট্রেন ১৭ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত একমাস সময়কাল ধরে ১৬টি রাজ্য থেকে এ-রাজ্যের মানুষদের ফিরিয়ে আনবে। স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়  দ্য হিন্দুকে জানিয়েছিলেন ২ লক্ষ ৯০ হাজার অসহায় মানুষ বাড়ি ফেরার যানবাহনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে একটি ট্রেনে ১২০০ যাত্রী বহনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১১ মে নতুন সার্কুলার জারি করে রেলমন্ত্রক জানায় প্রতিটি ট্রেন ১৭০০ যাত্রী বহন করবে। অর্থাৎ, রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একমাসে রাজ্যে ফিরতে পারবেন ২৫৫,০০০ যাত্রী। যা মোট আবেদনের থেকে ৩৫ হাজার কম। আর ডেটা বেসের ১৭ লক্ষ মানুষকে যদি সরকার ফেরাতে চাইতেন তবে অন্তত ১০০০টি ট্রেনের প্রয়োজন পড়ত।

 

এই পরিকল্পনা রূপায়ন, সতর্কতামূলক ‘ধীরে চলো’ নীতি ফের ধাক্কা খায় কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রকের এক একতরফা ঘোষণায়। যদিও শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওডিশা, কেরালা, তামিলনাড়ু, ছত্তিশগড়, বিশেষ করে মুম্বাই, গুজরাত, দিল্লি থেকে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতিই গ্রহণ করে চলছিল। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯ মে কেন্দ্র ঘোষণা করে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের ক্ষেত্রে গন্তব্য-রাজ্যের কোনও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। অভিযোগ ওঠে এর পর যথেচ্ছে ভাবে গন্তব্য রাজ্যের উদ্দেশে ট্রেন রওনা দিতে শুরু করে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিন্নারাই বিজয়ন এই পরিস্থিতির তীব্র বিরোধিতা করেন।  মে মাসের ২৭ ও ২৮ তারিখ যথাক্রমে ১১টি ও ১৭টি ট্রেন রাজ্যে চলে আসার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজনৈতিক ভাবে বিরক্ত” করার জন্য কেন্দ্র ‘র‍্যান্ডম’ ট্রেন পাঠিয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আমরা এত মানুষকে স্ক্রিন করব কীভাবে?” “আগে গ্রামে কোনও কোভিড-১৯ রোগী ছিল না” একথা জানিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘রাজনীতি’ না-করার জন্য সতর্ক করে আরও বলেন, রাজ্যে ফেরা শ্রমিকদের মধ্যে “২৫ শতাংশ কোভিড পজিটিভ”। পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, পাঁচ রাজ্য থেকে ফেরা শ্রমিকদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থাকতে হবে। এই রাজ্যগুলি ছিল, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু। এই শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন বিদ্যালয়ে থাকার ব্যবস্থা করা ছাড়াও তাঁদের দেখভালের জন্য প্রত্যেক কমিউনিটি ব্লকে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠনের কথাও জানান তিনি।

 

শেষ পর্যন্ত কত মানুষ ঘরে ফিরেছেন? ৬ জুন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনোদ কুমার যাদব সংবাদসংস্থা এএনআই-কে জানান, ১ মে থেকে ৬ জুন পর্যন্ত ৪২৮৬টি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে ৫৮ লাখের বেশি পরিযায়ী শ্রমিককে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ১০ জুলাই  রেলমন্ত্রককে উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায় ওই সময় পর্যন্ত, ৪৬১১টি ট্রেনে ৬৩.০৭ লক্ষ শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্যে ফিরেছেন। শ্রমিকদের এই ফিরতি পরিযাণকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। এক, প্রাক লকডাউন পর্ব। দুই, লকডাউন পর্বের প্রথম সপ্তাহ। তিন, ২৯ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের পথে বেরিয়ে পড়া এবং এর মধ্যে ট্রেন-বাস ছাড়াও অন্যান্য নানা যানবাহন এমনকি সাইকেল ও হেঁটে ঘরে ফেরাও রয়েছে। এই তিন ভাগে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের পূর্ণ হিসেব এখনও অধরা।

 

কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী জানিয়েছেন, মোট ১০৪৬৬১৫২ জন পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন। এ-ও পূর্ণ তথ্য নয়। কেননা তালিকায় নেই ছত্তিশগড়, ওড়িশা, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ সহ ন’টি রাজ্যের হিসেব। কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদাসীনতাই প্রমাণ করে, দেশের সরকারের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন কতটা মূল্যহীন, কতটা তুচ্ছ। যুগ যুগ ধরেই তাঁরা কী নিজ রাজ্যে কী গম্যরাজ্যের সরকার, নিয়োগকর্তাদের কাছে একইরকম অবহেলার শিকার।

 

চার

পর্যবেক্ষণ মতামত

 

(১) মুখ্যমন্ত্রীর সদভাবনা ও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া অব্যাহত। সাধারণ ভাবে শ্রমিকরা ফের ফিরে যেতেই চান। প্রথম কারণ মজুরি। নির্মাণ কর্মীই হোন কিংবা জরির কারিগর ভিন রাজ্যে তাঁরা কমপক্ষে দ্বিগুণ মজুরি পান। এছাড়া ১০০ দিনের কাজে, বিশেষ করে মাটি কাটা, পুকুর-খাল সংস্কারের মতো কাজে অনীহা রয়েছে কারিগরদের। বংশানুক্রমে যাঁরা সূক্ষ্ম হাতের কাজ রপ্ত করেছেন, তাঁরা মাটি কাটা কিংবা চাষবাসের মতো কাজে আদৌ সাবলীল নন। তবে, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না-হওয়ায় এবং দেশজোড়া নির্মাণ, ম্যানুফ্যাকচারিং, হোটেল ব্যবসা-সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্দার কারণে একটি বড় অংশই ফিরে যেতে পারছেন না। শ্রমিক বা কারিগররা কেন ফিরে যেতে চান এমন প্রশ্নের উত্তরে হাওড়ার চেঙ্গাইলের জরি কারিগর শেখ নাজবুল হাসান জানিয়েছিলেন, “যে কাজ করি, সে কাজ এখানে নাই। কী করব?”

 

(২) শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়ার অন্যতম কারণ যেমন মজুরি, তেমনি নিয়মিত কাজ। জরি কারিগররা জানিয়েছেন, হায়দরাবাদ, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোরের আট ঘণ্টা বুটিকের কাজ করলে ৫০০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। ওই এক মজুরি পেতে গেলে কলকাতায় দ্বিগুণ সময় কাজ করতে হবে। এখানে মজুরি গড়ে ২০০ টাকা। তাও সারা বছর কাজ থাকে না। নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি ও কাজের মেয়াদ ও ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

 

(৩) গ্রামের সঙ্গে যুক্ত কোনও ঠিকাদার কিংবা ভিন রাজ্যে কর্মরত গ্রামের কোনও পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমেই প্রধানত শ্রমিকরা নিয়োজিত হন। ঠিকাদারদের বিষয়ে সাধারণ ভাবে তাঁরা কোনও অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। কোম্পানি ও শ্রমিকদের আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন, নির্মাণ শ্রমিক বিষয়ক আইন কিংবা অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা আইন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁরা একবাক্যে জানান “এমন আইনের কথা তাঁরা এই প্রথম শুনছেন।” একই উত্তর দিয়েছেন এ-রাজ্যের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বিষয়েও।

 

(৪) শ্রমিকদের অজ্ঞতার চরম নমুনাটি হলো, কর্মক্ষেত্রে ঠিকাদার বা ছোট জরি কারখানার ওস্তাগর ছাড়া তাঁরা আর কারও সঙ্গেই প্রায় পরিচিত নন। ভাষা ও সংস্কৃতিগত পার্থক্যের জন্য সামাজিক মেলামেশাও তাঁদের নেই বললেই চলে। একজন শ্রমিক/কারিগরও বলতে পারেননি তাঁদের সংস্থার পুরো নাম কিংবা পূর্ণ ঠিকানা। সংস্থার নাম যতটুকু জানেন তাও তাঁদের উচ্চারণে বিকৃত হয়ে পড়ে। সমীক্ষাকৃত শ্রমিকরা একমাত্র বড় শহর ও রাজ্যের নামটুকুই সঠিক ভাবে জানাতে পারেন। দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে হায়দরাবাদ, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোরের মতো রাজধানী শহর ছাড়া স্পষ্ট ও সঠিক ভাবে ছোট শহর, জেলা, থানা বা ট্রেন স্টেশনের নাম স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি।

 

(৫) ডোমকলের দূরপাল্লার ট্যুরিস্ট বাস চালক নুর ইসলাম মণ্ডল কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, “কেরল-খাটা মানুষদের বাড়িঘর দেখলে তাজ্জব হয়ে যাবেন। ওদের জন্যই গ্রামে উন্নতি হয়েছে। পাকাবাড়িতে টাইলস লাগাবে আর বাইক আপ্যাচে কিনবেই।” অর্থাৎ, কেরালায় কাজ করা শ্রমিকদের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধি পাওয়ার কথাই বলতে চেয়েছিলেন নুর। তবে এটা আদৌ সাধারণ সর্বজনীন চিত্র নয়।

 

শ্রমিক বা কারিগররা যথাসম্ভব কৃচ্ছসাধন করে তাঁদের আয়ের কমপক্ষে অর্ধেক টাকা নিয়মিত বাড়িতে পাঠান। কেউ কেউ অন্তত আয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অর্থও পাঠিয়ে থাকেন। বিনোদন বলতে মোবাইল, এছাড়া ভিন রাজ্যে আমোদ-আহ্লাদ, বেড়ানোর কোনও সুযোগ নেই বলেই শ্রমিকরা জানিয়েছেন। নেই সামাজিক মেলামেশার সুযোগও। মাত্র চারমাস কেরলে নির্মাণ কাজে যোগ দেওয়া মহিবুল বিশ্বাস মাসে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা রোজগার করতেন। এবং বাড়ি পাঠাতেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। পূর্ব গুড়গুড়িয়ার বাসুদেব বসন্ত মহারাষ্ট্রে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁর থাকা-খাওয়ার খরচ লাগত না। ফলত, হাতখরচের কিছু টাকা রেখে তিনি পুরো টাকাটাই বাড়িতে স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিতেন। পূর্ব গুড়গুড়িয়া, আশিনা কিংবা চেঙ্গাইলের সমীক্ষাকৃত শ্রমিক/কারিগরদের বাইক কিংবা ‘তাজ্জব’ হওয়ার মতো ঘরবাড়ি নেই। কেউ কেউ এখনও মাটির, ছিটেবেড়ার বাড়িতে বাস করেন। কিন্তু, সকলেই যে বিষয়টি জানিয়েছেন, তা হলো, বাইরে কাজ করার ফলে, তাঁদের খাওয়াদাওয়ার পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ, আমিষ কিংবা অপেক্ষাকৃত দামি খাবার, একাধিক সব্জি, ডাল এবং পুষ্টিকর খাবার তাঁরা খেতে পারেন। দুই, অসুখ হলে ডাক্তার দেখানো, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, টিউশন দিতে পারেন তাঁরা। উৎসব-পরবেও ছেলেমেয়ে, স্ত্রীরা নতুন পোশাক পরার সুযোগ পান। অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলে ধার নিতে পারেন, কাজ ও আয় নিশ্চিত বলে।

 

(৬) কাজ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য তালিকা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি দামি ও পুষ্টিকর খাদ্য। এ-বিষয়ে একাধিক সমীক্ষা হয়েছে। আদিবাসী কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই খাদ্যসঙ্কটের গভীরতা বেশি। ২৮ এপ্রিল থেকে ২ মে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের ১২টি রাজ্যের ৪৭টি জেলায় ৫০০০ পরিবারের মধ্যে করা এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে — সমীক্ষাকৃত পরিবারগুলির ৫০ শতাংশ প্রাত্যহিক মিলের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে। ৬৮ শতাংশ কমিয়েছে পদের সংখ্যা। ৮৪ শতাংশ গণবণ্টন ব্যবস্থা এবং ৩৭ শতাংশ ‘টেক হোম’ রেশনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, ২৪ শতাংশ গ্রামের তুলনামূলক ভাবে স্বচ্ছল পরিবারগুলির কাছ থেকে খাদ্যশস্য ধার করেছে, ১২ শতাংশের মিলছে লঙ্গরখানা কিংবা স্বেচ্ছাসেবীদের বিতরণ করা খাদ্য। অর্থাৎ, কম বার ও কম খাবার খাচ্ছে গ্রামীণ ভারত। বর্তমানে ফের সমীক্ষা করলে দেখা যাবে পরিস্থিতির কোনও বড় বদল ঘটেনি। বর্তমান প্রতিবেদনের জন্য সমীক্ষাকৃত শ্রমিক ও কারিগরদের বয়ানে প্রায় একই কথা উঠে এসেছে।

 

(৭) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০ মার্চ ঘোষণা করেন বিনামূল্যে ছ’মাস খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। ১ এপ্রিল থেকে এ-রাজ্যে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকারও তিন মাস বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু, প্রয়োজনীয় চাল এ-রাজ্যে পৌঁছেছিল এপ্রিল মাসের প্রায় শেষ নাগাদ। আমাদের সমীক্ষাকৃত ব্যক্তিদের রেশন পাওয়া নিয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না। এছাড়া কিছু আগে কিছু পড়ে হলেও পরিযায়ী শ্রমিকরা অন্তত একবার অতিরিক্ত রেশন পেয়েছেন। রাজ্য সরকারের বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার দ্রুত ও আগাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা কার্যকর করার ফলে অন্তত আট কোটি গ্রাহক উপকৃত হয়েছেন।

 

ভিন রাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রাজ্য সরকার ‘স্নেহের পরশ’ নামে এককালীন ১০০০ টাকা আর্থিক অনুদানের এক প্রকল্প ঘোষণা করেন। রাজ্য সরকারের এই প্রকল্পে ৪ লক্ষ ৫৭ হাজার শ্রমিক উপকৃত হয়েছেন বলে ৩ জুন মুখ্যমন্ত্রী জানান। আমাদের সমীক্ষাকৃত ২৬ জনের কেউ-ই অবশ্য এই প্রকল্পে উপকৃত হননি। অনেকে প্রকল্পের কথা জানতেও পারেননি। পূর্ব গুড়গুড়িয়ার মজিদ মোল্লা অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি উদ্যোগ নিয়ে ৩০ জনকে অনলাইন ফর্ম পূরণে সাহায্য করেছিলেন কিন্তু ২৭-২৮ জন পেলেও তিনি নিজে ওই অনুদান পাননি। আশিনার জিয়ারুল শেখ জানান, তিনজন ওই প্রকল্পের টাকা পেয়েছেন। তবে, তিনি পাননি। যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলা কিংবা এই তথ্য খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি।

 

লকডাউনের পাশাপাশি ২০ মে সাইক্লোন আমপানের প্রকোপে রাজ্যের, বিশেষ করে উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে, ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে। এই জেলাগুলিতে ফিরে আসা শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের দুর্গতি যেন চতুর্গুণ হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে যাঁদের কাঁচা বাড়ি তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সমীক্ষাকৃত দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুটি গ্রামের ১৯ জনের মধ্যে ৯জনই কোনও-না-কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্য মজিদ আলি মোল্লার কাঁচা বাড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলেও সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কোনও ক্ষতিপূরণ মেলেনি। যাঁদের খোলা কিংবা এসবেস্টাসের চাল উড়ে গিয়েছে তাঁদের কেউ কেউ একটি করে ত্রিপল পেয়েছেন কিন্তু অনেকেই পাননি বলে অভিযোগ করেন।

 

(৮) অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একটি বিষয়ে একমত যে, দরিদ্র, অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এই অসংগঠিত শ্রমিকরা দেশের বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এক অদৃশ্য শক্তি হিসেবে রয়ে গিয়েছেন। তাঁদের জন্য আইন থাকলেও তাঁরা আইন-বহির্ভূত অতএব অধিকারহীন। সরকারি নীতি থাকলেও তা নিছকই কাগজ-কলমে। প্রাথমিক ভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে তাঁদের বাড়ি ফেরা আটকানো হলেও, পরবর্তীতে সস্তা পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতির উপর অভিঘাতের ভয়েই তাঁদের থেকে যাওয়ার জন্য বলা হতে থাকে। কিন্তু এক বিপুল পরিমাণ শ্রমিক, সরকারি হিসেবে যা প্রায় ১ কোটি, বাড়ি ফিরে গিয়েছেন।

 

লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ফিরে এলে গ্রামে গ্রামে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা যে অমূলক ছিল তা নয়। কিন্তু, ‘ধীরে চলো’ নীতি, পরিকাঠামো প্রস্তুত করা ও সার্বিক পরিকল্পনা স্থির করতে অমূল্য সময় রাজ্য সরকার ব্যয় হয়েছে। পাশাপাশি, কোয়ারেন্টিন সেন্টার গড়ে তোলা, নার্সিংহোমকে কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বহু অন্যায় বাধা অতিক্রম করে সতর্ক পদক্ষেপ করতে হয়েছে। আলিপুরদুয়ারের ধূপগুড়িতে নির্দিষ্টস্থানে কোয়ারেন্টিন সেন্টার স্থানীয় মানুষদের চাপে বন্ধ করে বিডিওর কার্যালয়ে সেন্টার করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। যথাসময়ে যথেষ্ট কেন্দ্র গড়ে তুলতে না-পারার জন্য এই অন্যায় বাধাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

 

এই সবকিছুর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে শ্রমিকদের। দু’বার টিকিট কাটবার পর ট্রেন বাতিল হওয়ায়, এবং গভীর অবসাদে যেমন কেরালায় কর্মরত মুর্শিদাবাদের আসিফ ইকবাল মণ্ডল ৯ মে আত্মহত্যা করেছেন, তেমনি লরি বোঝাই হয়ে ফিরতে গিয়ে ১৬ মে উত্তরপ্রদেশের আউরাইয়ায় এক দুর্ঘটনায় বাঁকুড়ার তিন/চারজন শ্রমিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এই দুর্ঘটনায় মোট ২৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। হায়দরাবাদ থেকে ১০ দিন ধরে হেঁটে কখনো বাসে-লরি চেপে বাড়িতে ফেরার পথে ওড়িশার বালেশ্বরে পথক্লান্ত হয়ে মারা যান বীরভূমের ইয়ার মহম্মদ (৫২)। এছাড়াও অশেষ কষ্ট সহ্য করে, ধারদেনা করে অতিরিক্ত ভাড়া গুনে অধিকাংশ শ্রমিককে ঘরে ফিরতে হয়েছে। পশ্চিমে গুজরাত, দক্ষিণে তামিলনাড়ু থেকে ১৬০০/১৭০০ কিলোমিটার সাইকেলে পাড়ি দিয়ে ফিরেছেন এ-রাজ্যের যুবকরা। শত শত শ্রমিক হেঁটে এ-রাজ্যে ফিরতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা কিংবা বিহার সীমান্তে হেনস্থার শিকার হয়েছেন এ-রাজ্যের পুলিশের হাতে। এমন বহু অভিযোগ গাঁথা আছে সমাজমাধ্যমে।

 

(৯) লকডাউন পর্বে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এ-রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রী, নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন। কোনও কোনও সংগঠন গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র লকডাউনে প্রান্তিক মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকদের নানা উপায়ে সাহায্য করার জন্যই। এখনও এ-জাতীয় সংগঠনগুলি নানাভাবে সচল রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের গ্রন্থাগার থেকে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় শ্রমজীবী ক্যান্টিন গড়ে তোলা, আমপান-বিধ্বস্ত অঞ্চলে লাগাতার ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া থেকে লঙ্গরখানা চালানোর মতো পদক্ষেপ করেছে। একটি হিসেব অনুযায়ী সারা রাজ্যে এমন ৭০০ শ্রমজীবী ক্যান্টিন বর্তমানে চালু। প্রধানত বামপন্থী ছাত্র-যুবকরা এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা নিলেও, অ-রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী, এবং অসংখ্য সাধারণ নাগরিক খোলা মনে, দু’হাতে সাহায্য না-করলে এই উদ্যোগগুলি কাম্য সার্থকতা লাভ করত না।

 

এই উদ্যোগগুলির উল্লেখ জরুরি এই কারণে যে, সারা দেশব্যাপী এমন নাগরিক উদ্যোগ না-থাকলে পরিযায়ী এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের চূড়ান্ত দুর্দশার প্রকৃত অবস্থা এবং এ-সম্পর্কিত তথ্য জনপরিসরে কোথাও থাকত না। পাশাপাশি, এই উদ্যোগগুলির ফলে তাঁদের একটি অংশ খাদ্য, আর্থিক সাহায্য ছাড়াও এই দুর্দিনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ সহমর্মিতা, সহানুভূতির স্পর্শ পেয়েছেন। ইতিমধ্যেই প্রমাণিত এই বিষয়ে কোনও অস্বস্তিকর তথ্য কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলি প্রকাশ করবে না।অন্যদিকে, রাজ্যব্যাপী এই নাগরিক গণউদ্যোগগুলি না-থাকলে সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন কেন্দ্রিক তাবৎ উদ্যোগ অনেকাংশেই ব্যর্থ হতো। মানুষ আরও অনেক বেশি দুর্দশার শিকার হতেন। এই গণউদ্যোগগুলির যথাযথ পঞ্জিকরণ এবং স্বীকৃতি আবশ্যক।

 

 

বর্তমান প্রতিবেদনটি মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি) আইডব্লিউএম,ভিয়েনা দ্বারা পরিচালিতরিপোর্টিং দ্য মাইগ্রেন্টস ইন দ্য টাইম অফ এপিডেমিকশীর্ষকমিডিয়া ফেলোশিপ প্রোগ্রাম‘-এর অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান নিবন্ধটি মূল বিশেষ নিবন্ধটির সংক্ষিপ্ত অংশ। সিআরজি অনুমতিক্রমে তা প্রকাশিত হলো।

 

Share this
Leave a Comment