দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির ধারাবাহিকতায় এবারে অন্যতম লক্ষ্য ভারতীয় জীবন বিমা নিগম (এলআইসি নামেই যার অধিক পরিচিতি)। ২০২০-২০২১ আর্থিক বর্ষে দেশ বেচার কারিগরদের লক্ষ্যমাত্রা ২.১ লক্ষ কোটি টাকা। সরকারের আশা যদি এলআইসির দশ শতাংশ মালিকানার বিলগ্নিকরণ করা যায় ৯০,০০০ কোটি টাকায়, তাহলে উপরিউক্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব। স্বাভাবিকভাবে লক্ষ লক্ষ পলিসি হোল্ডার (যারা তাদের শ্রমার্জিত টাকা জীবন বিমা ও বিভিন্ন পেনশন ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন) উদ্বিগ্ন, তাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। ক্ষুব্ধ এলআইসি-র কর্মচারী তথা এই প্রতিষ্ঠানকে ভিত্তি করে বেঁচে থাকা দশ লক্ষ এজেন্ট – এলআইসি-র অর্থনৈতিক সাফল্য যাদের ভূমিকা অপরিসীম। এই কারণে এলআইসি-র প্রস্তাবিত বিলগ্নিকরণের আইনি সম্ভাব্যতা, নৈতিকতা, যথার্থতা, গ্রাহকের স্বার্থ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সুমন কল্যাণ মৌলিক-এর এই লেখা সেই প্রশ্নগুলিকে স্পর্শ করার এক প্রয়াস মাত্র।
যদিও নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থকদের কাছে দেশের তথা জনগনের স্বার্থের বদলে কর্পোরেটদের স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়, তবু এলআইসি-র গঠনতন্ত্র কিছু আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন তুলেছে, যার মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। মনে রাখতে হবে এলআইসি একটি বিশেষ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার তুলনা বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়, এমন কি পুঁজির এই বিশ্বায়নের যুগে কোথাও নেই। কোনো সরকারই সোজাসুজি এলআইসি-কে বিক্রি করে দিতে পারবে না, কারণ এটা কোম্পানির আকারে তৈরি হয়নি। বরং এটা তৈরি হয়েছে কর্পোরেশনের আকারে, যেখানে মোট মুনাফার ৫ শতাংশ সরকারকে ডিভিডেন্ট হিসাবে দিতে হয় এবং বাকিটা বোনাস আকারে পলিসি হোল্ডারদের মধ্যে বন্টিত হয়। ১৯৫৬ সালে এলআইসি-র জন্মের সময় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের পর আজ পর্যন্ত সেখানে সরকারি বিনিয়োগ শূন্য। অথচ সেই সরকার আজ তার সম্পদ ও মুনাফার মালিকানা দাবি করছে। এমনকি ইন্সুরেন্স রেগুলেটরি অথরিটির দাবি মেনে যখন সরকার ইকুইটির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনও এলআইসি সেই টাকাটা অভ্যন্তরীণ ভাবে সংগ্রহ করে। ভারত সরকার এলআইসি-কে যা দেয়, তা হল পলিসির ক্ষেত্রে সার্বভৌম গ্যারান্টি (Sovereign Guarantee)। এই পরিস্থিতিতে সরকারের বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত কিছু আইনি জটিলতা কে সামনে আনে।
- প্রথমত, বর্তমান পলিসিগুলিতে যে sovereign guarantee রয়েছে তার ভবিষ্যত কী হবে?
- দ্বিতীয়ত, সরকার কি পারে মাঝপথে পলিসির শর্ত পরিবর্তন করতে?
- তৃতীয়ত, এল আই সি-র পেনশন স্কিমে সঞ্চিত টাকার ভবিষ্যত কী?
অর্থ দপ্তরের আমলারা আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, বর্তমান অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে সম্ভবত এইসব আইনি প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু সাধারণভাবে মনে হচ্ছে যে এলআইসি-র গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন না করে তা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এলআইসি বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হল বিলগ্নিকরণ। এই লক্ষ্যকে সফল করতে হলে এলআইসি অ্যাক্টের পরিবর্তন করতে হবে যাতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে লভ্যাংশের ৯৫ শতাংশ পলিসি হোল্ডারদের মধ্যে বন্টিত হবে।
এলআইসি-র ইতিহাস জানতে হলে অবশ্যই আমাদের বেশ কিছু সময় পিছিয়ে যেতে হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারতে তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করছে, তখন কলকাতায় ১৮১৮ সালে ব্রিটিশ মালিকানায় প্রথম বিমা কোম্পানি তৈরি হয় যার নাম ছিল ওরিয়েন্টাল ইন্সুরেন্স কোম্পানি। ধীরে ধীরে ভারতে কোম্পানির ব্যবসা যেমন বাড়ে, তেমনি আরও নতুন নতুন বিমা কোম্পানি খুলতে শুরু করে। এই কোম্পানিগুলির ব্যবসা একটা আইনে বাঁধতে ও গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে ১৯১২ সালে পাস হয় Insurance Company Act। ভারতে স্বাধীনতার লড়াই গতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নটিও আলোচনার মধ্যে আসতে থাকে। ১৯২৯ সালের পুণা অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেস প্রথম পূর্ণ স্বরাজের দাবি তোলে। এই পটভূমিকায় ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে বলা হয় – “In order to end exploitation of the masses political freedom must include real economic freedom of the starving millions”। তবে বিমা শিল্পের ক্ষেত্রে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধান সভায়। টি টি কৃষ্ণমাচারি ও অন্যদের উত্থাপিত এই প্রস্তাবে বলা হয় – “The assembly is of the opinion that steps should be taken as early as possible to initiate legislation to transfer to state ownership control and management of the business of insurance; life, accident, marine and all other aspects of the said business”। ১৯৫৩ সালে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে লিখিত একটি পত্রে ব্যাঙ্ক, বিমা ও খনি শিল্পকে জাতীয়করণের দাবি তোলেন। এই সামাজিক সক্রিয়তার পরিণতি বিমা শিল্পের জাতীয়করণ। এ প্রসঙ্গে আলোচনার সময় পন্ডিত নেহেরু সংসদে বলেন – “The nationalisation of life insurance is an important step in our march towards a socialist society…Its objective will be to serve the individual as well as the state.”। তবে বিমা শিল্পের জাতীয়করণের কাজটা খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না। ১৫৪টি ভারতীয় বিমা সংস্থা, ১৫টি বিদেশি বিমা কোম্পানি এবং ৭৫টি প্রভিডেন্ট ফান্ড সোসাইটিকে “Life Insurance Corporation Act of 1956” নামক আইনে একত্রীভূত করা হয়। ১৯৫৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এলআইসি তার যাত্রা শুরু করে।
১৯৫৬ থেকে ২০২০ – এই ৬৪ বছরের সময় পর্বে এলআইসি-র পারফরম্যান্স কেমন? প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা জরুরি, বিশেষ করে ৯০-এর দশক থেকে যখন শুরু হল সমস্বরে এ কথা বলা যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মানেই তারা অদক্ষ, মুক্ত বাজারে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হলে যারা নিশ্চিতভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। এলআইসি সম্পর্কে যদি বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার ভাষা ব্যবহার করি, তা্হলে প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত এলআইসি সংশয়াতীতভাবে মার্কেট লিডার। এমনকি বেসরকারী ও অন্যান্য বিদেশী প্রতিযোগীরা তার ধারেকাছে আসতে পারেনি। ১৯৫৬ সালে তৈরি হওয়া এই কর্পোরেশন অবশ্যই দেশের কাছে এক ভরসা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক। এই সংস্থা সম্পর্কে যেটা সহজেই বলা যায় তা হল ‘A Corporation too good to fail’। এই বিশ্বাসযোগ্যতা আছে বলেই সে মধ্যবিত্ত জীবনের আর্থিক অনিবার্যতা, যেকোনও পরিবারের আর্থিক পরিকল্পনার আবশ্যিক উপাদান। এলআইসি-র এই অনন্যতা বোঝানোর জন্য সারণী আকারে কিছু তথ্য পরিবেশিত হল।
সারণী-১
- ভারতে জীবন বিমা পলিসির যত প্রিমিয়াম জমা হয়, তার ৭০ শতাংশ পায় এল আই সি।
- ভারতে আজ পর্যন্ত যত জীবন বিমা পলিসি হয়েছে, তার ৭৫ শতাংশ এল আই সি-র।
- এল আই সি-র সম্পদের পরিমাণ ৩১ লক্ষ কোটি এবং প্রতি বছর গড়ে ৩-৪ লক্ষ কোটি টাকা তার উদ্বৃত্ত আয়।
- এল আই সি-র হাতে ৪২ কোটি পলিসি আছে, যার মধ্যে ৩০ কোটি ব্যক্তিগত পলিসি, বাকিটা গ্রুপ ইন্সুরেন্স পলিসি।
২০১৬ সালে এলআইসি-র ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বহু তথ্য পরিবেশিত হয়েছিল, যার থেকে এই দীর্ঘ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কাজকর্ম সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
সারণী-২ (১৯৫৬-২০১৬)
- এই ৬০ বছরে প্রিমিয়াম বাবদ আয় ৮১.৭ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২ লক্ষ ৬৬ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।
- লাইফ ফান্ড ৩৭৮ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২২.১ লাখ কোটি টাকা। সম্পদের পরিমাণ ৩৪৮ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২০.৫৭ লাখ কোটি টাকা।
- কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সিকিউরিটি বন্ডগুলিতে এল আই সি-র বিনিয়োগের পরিমাণ ২২.১ লক্ষ কোটি টাকা।
- আবাসন, বিদ্যুৎ, সেচ, রাস্তা, ব্রিজ ও অন্যান্য সামাজিক পরিকাঠামোতে এল আই সি-র বিনিয়োগের পরিমাণ ২.৪ লক্ষ কোটি টাকা।
উপরোক্ত তথ্যগুলি পন্ডিত নেহেরুর সেই বক্তব্যকে সত্য বলে প্রমাণ করে যেখানে তিনি বলেছিলেন, এলআইসি শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রকেও সেবা করবে। তাই এলআইসি ভারতের বাজারে আজও বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। স্টক মার্কেটকে ধসের হাত থেকে রক্ষা করতে হোক, বা সরকারি সংস্থার পাবলিক ইস্যুকে বাঁচাতে বা সংকটপূর্ণ ভারতীয় রেলকে টাকার জোগান দিতে এলআইসি-র ডাক পড়ে সবার আগে। অর্থাৎ ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশে এলআইসি-র ভূমিকার কথা বাজার অর্থনীতির অতি বড় সমর্থকও অস্বীকার করতে পারবে না।
সারণী-৩
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এল আই সি-র অবদান
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা | বছর | বিনিয়োগ (কোটি টাকায়) |
দ্বিতীয় | ১৯৫৬-৬১ | ১৮৪ |
তৃতীয় | ১৯৬১-৬৬ | ২৮৫ |
চতুর্থ | ১৯৬৯-৭৪ | ১,৫৩০ |
পঞ্চম | ১৯৭৪-৭৯ | ২,৯৪২ |
ষষ্ঠ | ১৯৮০-৮৫ | ৭,১৪০ |
সপ্তম | ১৯৮৫-৯০ | ১,২৯৬৯ |
অষ্টম | ১৯৯২-৯৭ | ৫৬,০৯৭ |
নবম | ১৯৯৭-২০০২ | ১,৭০,৯২৯ |
দশম | ২০০২-০৭ | ৩,৯৪,৭৭৯ |
একাদশ | ২০০৭-১২ | ৭,০৪,১৫১ |
দ্বাদশ | ২০১২-১৭ | ১০,৮৬,৭২০ |
এখনও পর্যন্ত একটি বিমা সংস্থা হিসাবে এলআইসি-র সাফল্য এবং দেশ গঠনে তার ভূমিকার কথা আলোচিত হল। এবার আমরা দেখব বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার চাপে এলআইসি মুখ থুবড়ে পড়ল কি না।
সারণী-৪
বিমা ব্যবসার শতকরা ভাগ
সাল | এল আই সি | অন্যান্য সমস্ত কোম্পানি একসঙ্গে |
২০১৪-১৫ | ৭৩.০৫ | ২৬.৯৫ |
২০১৫-১৬ | ৭২.৬১ | ২৭.৩৯ |
২০১৬-১৭ | ৭১.৮১ | ২৮.১৯ |
২০১৭-১৮ | ৬৯.৩৬ | ৩০.৬৪ |
২০১৮-১৯ | ৬৬.৪৪ | ৩৩.৫৬ |
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবু তথ্যের খাতিরে এ কথা বলা চলে জীবন বিমার ক্ষেত্রে এলআইসি-র নিকটতম প্রতিযোগী এখনও পর্যন্ত এসবিআই লাইফ।
এলআইসি-র ভূমিকা আলোচনা প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় হল কর্মসংস্থান। এই সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ১০ লক্ষ এজেন্ট, যাদের পূর্ণ বা তাৎক্ষণিক জীবিকার সংস্থান হয় এই সংস্থা থেকে। প্রকৃত অর্থে এরাই সেই পদাতিক সৈন্য, যাদের পরিশ্রম ও দক্ষতা, যারা এলআইসি-র সাফল্যকে নিশ্চিত করেছে। ২০১৩ সালে ইকনমিক টাইমস্-এ একটি খবর প্রকাশিত হয়, যাতে দেখা যাচ্ছে ভরত পারেখ ও রনি জেঠানি নামে দুই এলআইসি এজেন্ট সেই আর্থিক বর্ষে যথাক্রমে ৪ ও ৩ কোটি টাকা কমিশন হিসাবে আয় করেছেন। সেই বছর এলআইসি চেয়ারম্যান ডি কে মালহোত্রার বার্ষিক আয় ছিল ৮৭ লক্ষ টাকা। এটা নেহাতই এক উদাহরণ, কিন্তু এটা সত্য যে এলআইসি-র উপর এই এজেন্টদের একটা বড় অংশের রুটি-রুজি নির্ভর করে।
শুধুমাত্র সাফল্যের গল্প দিয়েই এলআইসি-র আখ্যান শেষ হবে না, একইসঙ্গে এ কথাও বলা দরকার যে উপর্যূপরি সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণর সংস্থার বিপদও কম নেই। এই সংকটটি হল অনুৎপাদক সম্পদের বৃদ্ধি। সরকারি হুকুম মেনে এমন সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ, যেখান থেকে টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এলআইসি শুধু সরকারি ঋণপত্র বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বা ব্যাঙ্কেই লগ্নি করে না। একইসঙ্গে বেসরকারি সংস্থাতেও করে, যাদের অনেকেই ঋণ খেলাপি ও দেউলিয়া। বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সরকার কীভাবে আইডিবিআই ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে এলআইসি-কে বিনিয়োগে বাধ্য করেছিল, মিডিয়াতে সে কথা বহু আলোচিত। কিন্তু ডেকান ক্রনিক্যাল, এসার পোর্ট, গ্যামন, আইএলএফএস, ভূষণ পাওয়ার, ভিডিওকন, রিলায়েন্স ক্যাপিটালস (অনিল আম্বানি), ডিএইচএফএস প্রভৃতি দেউলিয়া কোম্পানিগুলিতে যথেচ্ছ বিনিয়োগের ফলে এলআইসি-র আর্থিক স্বাস্থ্য ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। আরেকটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হল সদ্য দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ইয়েস ব্যাঙ্ক ৮,৪১৫ কোটি টাকার AT-I বন্ডকে বাতিল (Write off) করেছে। ফলে এলআইসি আরেকটি বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে এনপিএ (অনুৎপাদক সম্পদ) ৩০,০০০ কোটি টাকা যা মোট পুঁজির ৬.১০%। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৯ (আচ্ছে দিনের প্রথম সংস্করণ) সময় পর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এলআইসি-র বিনিয়োগ ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
সারণী-৫
এলআইসি-র অনুৎপাদক সম্পদ (কোটি টাকায়)
মার্চ ২০১৫ | ১২,৩১৩ |
মার্চ ২০১৬ | ১৪,২৮৩ |
মার্চ ২০১৭ | ১৮,১৭৩ |
মার্চ ২০১৮ | ২৫,২৪১ |
মার্চ ২০১৯ | ২৪,৩৭৭ |
সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ৩০,০০০ |
এই অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা এলআইসি-র ঘাড়ে চাপার প্রধান কারণ হল নয়ের দশকের সূচনা লগ্ন থেকে সরকার যে আর্থিক পুনর্গঠনের নীতি গ্রহণ করে, তা বাস্তবত হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলির বিলগ্নিকরণ। কিন্তু এই আত্মঘাতী নীতির গুনেগার সবচেয়ে বেশি দিতে হয় এলআইসি-কে। বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংকটের কারণে দেখা যায় এই বিলগ্নিকরণের বোঝা বইতে হচ্ছে এলআইসি-কে। এক্ষেত্রে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য নেই আর এই নীতিই সংকটের কারণ।
সারণী-৬
বিলগ্নিকরণে এল আই সি-র খরচ (কোটি টাকায়)
বৎসর | সংস্থার নাম | এল আই সি-র বিনিয়োগ |
২০০৯ | ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন | ৪,২৬৩ |
২০১০ | ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন | ৬,০০০ |
২০১২ | অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশন | ১২,৭৪৯ |
২০১৩ | স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড সংস্থা | ৭১ % শেয়ার |
২০১৪ | ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড | ২,৬৮৫ |
২০১৫ | কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড | ৭,০০০ |
২০১৭ | জেনারেল ইন্সুরেন্স ও নিউ ইন্ডিয়া ইন্সুরেন্স | ১৫,০০০ |
২০১৯ | ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া | ১৩,০০০ |
(তালিকা অসম্পূর্ণ)
বিলগ্নিকরণের নামে এলআইসি-র উপর বর্তমান আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। নয়ের দশকে চালু হওয়া উদারীকরণ-বেসরকারীকরণ-ভুবনায়নের মতাদর্শের আড়ালে ভারতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সংস্কার নীতি চালু হয়, স্বাভাবিকভাবে বিমা ক্ষেত্র তার থেকে রক্ষা পায়নি। ১৯৯৩ সালে পি.ভি. নরসিমহা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা বিমা ক্ষেত্র সংস্কারের লক্ষ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গর্ভনর আর এন মালহোত্রার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। খুব দ্রুত এই কমিটি তার কাজ শেষ করে। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে কমিটি তার রিপোর্ট জমা দেয়। এই রিপোর্ট খুব পরিষ্কারভাবে বিমাক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলিকে কাজে যুক্ত করার সুপারিশ করে। বিমা ক্ষেত্রে সংগঠনগুলির তীব্র প্রতিবাদ সত্তেওনয়া উদারবাদী আগ্রাসনকে রোখা সম্ভব হয়নি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর অধীন এন ডি এ সরকার ১৯৯৯ সালে “Insurance Regulatory and Development Authority Bill” (IRDA) পাশ করে এবং ভারতে দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলিকে ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়। আইন হয় যে ভারতীয় কোম্পানিগুলি বিদেশি কোম্পানিগুলির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে ব্যবসা করতে পারলে এবং সেখানে বিদেশি ইকুইটির পরিমাণ ২৬ শতাংশের বেশি হবে না। এরপরে বিদেশি কোম্পানিগুলি ভারতে ব্যবসা করতে শুরু করে।
কিন্তু ২৬ শতাংশের অনুমতিতে গল্পটা শেষ হল না। কিছু দিনের মধ্যেই দাবি উঠতে লাগল ৪৯ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতির। পাশাপাশি কর্পোরেট লবির প্রসাদধন্য কলমচিরা দাবি তুলতে লাগলেন এলআইসি বেসরকারিকরণ করার। ২০০৮ সালে তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে পেশ করল “Insurance Laws (Amendment) Bill”। তখন এই বিলকে দেশের স্বার্থবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছিল প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। তৎকালীন সংসদীয় সিলেক্ট কমিটি দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ভারতে বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের উর্দ্ধসীমা আর বাড়াবার দরকার নেই। কিন্তু ভারতবর্ষে বেশীরভাগ সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির গিরগিটির মতো রঙ বদল কোনো নতুন ঘটনা নয়। তাই নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে সরকার এই বিলটি পাশ করাতে তৎপর হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন কংগ্রেস দল এখন বিলগ্নিকরণের প্রশ্নে কুমীরের কান্না কাঁদছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ২০১৫ সালে বিলটি পাশ হয় এবং ৪৯ শতাংশ বিনিয়োগের মাত্রা নির্ধারিত হয়।
এখন আমরা একটু দেখে নিতে চাইব যে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের মাত্রা বাড়ানোর পক্ষে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থকরা যে যুক্তিগুলি হাজির করেন, তা ভারতের বিমা শিল্পে সত্য হয়েছে কি না? যেমন প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ালে তবে আরো নতুন নতুন কোম্পানি আসবে। তাদের পুঁজির সঞ্চয় বেশি বলে তারা প্রিমিয়াম বাবদ বেশি আয় করবে এবং ভারতে বিমা পলিসির ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে। বিদেশি কোম্পানিগুলির কাছে উন্নতমানের প্রযুক্তি এবং অধিক গুণমানের পলিসি (Better Product) থাকার কারণে ক্রেতারা আরও উন্নত পরিষেবা পাবেন। এক্ষেত্রে আবার আরেকটি সারণী দেখা যেতে পারে।
সারণী-৭ (টাকার অঙ্ক কোটিতে)
কোম্পানির নাম | পুঁজি ও সিকিউরিটি | প্রিমিয়াম বাবদ আয় |
বাজাজ অ্যালায়েন্স | ৪৮৪৪ | ৬৮৯৩ |
এসবিআই লাইফ | ২৭১০ | ১০,৪৫০ |
ভারতী অ্যাক্সা | ১৯৯৯ | ৭৪৫ |
এইচডিএফসি স্ট্যান্ডার্ড | ২২০৪ | ১১,৩২৩ |
এল আই সি | ১০০ | ২,০৮,০০০ |
সারণী প্রস্তুত করার উদ্দেশ্য হল এটা দেখানো যে পুঁজির জোর থাকলেই বিমা ব্যবসায় বাজার দখল নিশ্চিত হবে, এমন কোনো ফর্মূলা নেই। এমন কি এলআইসি-র সঙ্গে বাজারে আরো দেশি বিদেশি কোম্পানিগুলি প্রতিযোগিতায় নামলেই বিমার ঘনত্ব (Insurance Penetration) বৃদ্ধি পাবে, এটাও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা মুশকিল। বরং সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে উদারীকরণের প্রথম ১৪ বছরে বিমা ঘনত্বের পরিমাণ বেড়েছে মাত্র এক শতাংশ (২.৭১ থেকে ৩.৮ শতাংশ)। ভারতে বিমা শিল্পের বাজার খুব সামান্য বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর বাজার আলাদা কিছু নয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ৩.২ শতাংশ, কানাডায় ২.৯ শতাংশ, জার্মানিতে ৩.১ শতাংশ। আমরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছি (সারণী-৪) যে এলআইসি আজও জীবনবিমা শিল্পে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সমস্ত বেসরকারি কোম্পানিগুলি যুক্তভাবেও তার ধারেপাশে নেই। ভারতে বেসরকারি কোম্পানিগুলির বিমা শিল্পে একটাই অবদান। আর তা হল ULIP product কিন্তু বাজারের ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত এই পলিসিগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা আমাদের অজানা নয়। আদতে বিমা ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি ও এলআইসি-র বিলগ্নিলকরণের গল্প একই আর্থিক নীতির সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ।
অনেকে এ কথা বলবার চেষ্টা করছেন যে, মাত্র দশ শতাংশের বিলগ্নিকরণে এত গেল গেল রব তোলার কারণ কী? এর ফলে এলআইসি-র প্রশাসন, কর্মচারীদের স্বার্থ, এজেন্টদের স্বার্থ, সর্বোপরি গ্রাহকদের স্বার্থের কোনো বদল হবে না। কিন্তু যে কথাটি তারা বলছেন না তা হল এ বছরের প্রস্তাবিত ১০ শতাংশ বিলগ্নিকরণ আরো দীর্ঘমেয়াদী গেম প্ল্যানের অংশ। আমরা যদি বিগত তিরিশ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলির পরিণতির ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাই, তাহলে দেখতে পাব যে বেশির ভাগ কোম্পানিতে ৫-১০ শতাংশ বিলগ্নিকরণ দিয়ে শুরু হয়েছিল, তারপর তা এক ধারাবাহিক রূপ পায়। হিন্দুস্তান জিঙ্ক লিমিটেড, কোল ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান কপার আদতে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আর আগামী দিনে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি যত সংকটগ্রস্ত হবে, এলআইসি-র মতো ‘দুধেল গাই’কে দোহন করার প্রবণতা ভারতীয় শাসকদের আরো বাড়বে। আমাদের চোখের সামনে বিএসএনএল, ভারতীয় রেল, ভারত পেট্রোলিয়ামের সাম্প্রতিক উদাহরণ রয়েছে, তাই এই নয়া উদারবাদী আগ্রাসন থেকে এলআইসি-কে বাঁচাতে আমাদের দ্রুত জোটবদ্ধ হতে হবে।
লেখক স্কুল শিক্ষক ও অধিকার আন্দোলনের কর্মী।
I strongly oppose privationsation of LIC and support the article written by the author in true sense . People should raise their voice in protest of change of LIC Act and issue of its share to the public. I also request all the political parties to take necessary steps to stop privationsation of LIC.