লক্ষ লক্ষ সাধারণের জীবন-রেখা সস্তা ও দ্রুতগামী পরিবহন ট্রেনও সর্বজনীনতা বর্জনের পথে। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
অবশেষে লোকাল ট্রেন চালাবার পাকা সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। রেল কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য সরকারের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ট্রেন চলবে। এর ফলে যে নিত্যযাত্রীদের সার্বিক সমস্যার সমাধান হবে না তা সহজেই অনুমেয়। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো — এই আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে অনেকেই নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেন। ক্ষুব্ধ হবেন আরও অনেকেই। যেমন রেল হকারেরা। স্টেশন চত্বর থেকে তাঁরা নির্বাসিত। ট্রেন চললেও তাঁদের ঠাঁই হবে না। অন্যদিকে, এই মহানগরে কত মানুষ নিত্য আসা-যাওয়া করেন, ট্রেনের সংখ্যা ও চলাচলে সেই হিসেব কষে ‘গ্যালোপিং’ ট্রেনের উপর ঝোঁক বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অনুমান করা যেতে পারে। যা আর এক বৈষম্য ও বঞ্চনা বোধের জন্ম দেবে। এমনটিই বলা হবে, অতিমারি-সময়ে ভীড় এড়িয়ে ‘সামাজিক দূরত্ব’ এবং স্বাস্থ্যবিধি মান্য করে চলতে গেলে দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই যুক্তিও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু, প্রায় সাত মাস যাবৎ সরকার তো এই বিধিনিষেধকেই জপের মালা করেছে, নাগরিকরা ইচ্ছে-অনিচ্ছেয়, তা মেনে চলেছে। কিন্তু, খিদে বড় বালাই, আইন-বিধি যে খাওয়া যায় না। যায় না বলেই আইন-শৃঙ্খলা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
যেমন সম্প্রতি বড় খবর হয়ে উঠেছিল হাওড়া স্টেশন। তার কিছুকাল আগে দক্ষিণ শহরতলির সোনারপুর। আইন অমান্য না করলে, শেকল ধরে টান না দিলে বহুসময় কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে না। হাওড়া স্টেশনে লাঠির বাড়ি, ঘাড় ধাক্কা খেয়ে নিত্যযাত্রীরা সরকারের ঘুম ভাঙাল বলা যায়। অতঃপর চিঠি চালাচালি, দফায় দফায় বৈঠক এবং ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত। ক’দিন লাগল এই সিদ্ধান্ত নিতে? মাত্র পাঁচ দিন। অথচ ‘স্টাফ স্পেশ্যাল’ ট্রেনে নিত্যযাত্রীদের যাতায়াত ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি, অশান্তি এড়াতে ১৩ অক্টোবর ট্রেন চালানোর ইচ্ছে জানিয়ে রেলের তরফ থেকে রাজ্য সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা যাচ্ছে অন্তত তারও আটদিন আগে ৬ অক্টোবর সংগঠিত উদ্যোগীরা খাগড়াঘাট স্টেশনে ফেস্টুন, ব্যানার-সহ লোকাল ট্রেন চালানোর দাবি জানাচ্ছেন। এর পর, মূলত মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর নেতৃত্বে অন্তত একডজন এ জাতীয় পথসভার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সরকার যদি সাধারণের কথায় কান দিত তবে আরও আগেই ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারত। মানুষ আরও আগেই আরও একটু রিলিফ পেতে পারতেন। হাওড়া-কাণ্ডের পর যে দ্রুততায় ট্রেন চলাচলে শিলমোহর পড়ল, সেখান থেকেই প্রমাণিত রেল কর্তৃপক্ষ কৌশলগত ভাবে এবং রাজ্য সরকারও মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিল। স্বাস্থ্যবিধি এবং যাত্রী নিয়ন্ত্রণে কী করতে হবে সে কৌশল বিষয়ে আগাম ভাবনা ভেবে রাখা ছিল। তা না হলে আলাপ-আলোচনা এত মসৃণ হত না।
বিগত আট মাস যাবৎ বার বার কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে রাজ্যে সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার নানা নিদর্শন দেশবাসী দেখেছেন। সারা দেশই তার কুফল ভোগ করেছে। আন্তঃরাজ্য শ্রমিক, অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক, চুক্তি শ্রমিক ও কারিগররা অবর্ণনীয় মানসিক, শারীরিক, আর্থিক দুর্দশার শিকার হয়েছেন। শুধুমাত্র সিদ্ধান্তহীনতা নয়, সরকারের দীর্ঘকালের নীতিহীনতাও এই দুর্দশার অন্যতম কারণ। এই কোভিড অতিমারির হাত থেকে রক্ষার প্রকৌশল তা প্রকট করে তুলেছে। প্রকট করেছে আরও এক চিত্র। তা হল, বঞ্চনা, বৈষম্য, অসাম্যের দ্রুত বৃদ্ধি। সামাজিক ও আর্থিক ভাবে যে জনগোষ্ঠী যত বেশি পিছিয়ে পড়া, বঞ্চনা, বৈষম্য, অসাম্য সেখানে ততটাই গাঢ়। এমনটা ছিলই, কিন্তু অতিমারি এই পিছিয়ে থাকা মানুষদের এক উল্লেখযোগ্য অংশকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে যেন একরকম বহিষ্কার করে ছেড়েছে। রেল হকার, রেল স্টেশন হকাররা এমনই এক শ্রমজীবী গোষ্ঠী। এ রাজ্যে এমনই আর এক শ্রমজীবী গোষ্ঠী লোকাল ট্রেনের উপর নির্ভরশীল গৃহশ্রমিক এবং শাক-সবজি-দুধ-ছানার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এমন আরও উদাহরণ হাজির করা যায়। রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল অর্থাৎ, পশ্চিমাঞ্চল কিংবা সুন্দরবনের দিকে মনোযোগ দিলেও এই বঞ্চনার মর্মান্তিক ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। স্রেফ ট্রেনের অভাবে এক বিশেষ জাতীয় ছাতু বা মাশরুম পৌঁছতে পারেনি রাঁচির বাজারে। মাটিতে পা থাকলে নীতিনির্ধারকরা অন্তত বিকল্প যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারতেন। এই ছাতু বিক্রির আয়ে বিশেষ বিশেষ আদিবাসী গোষ্ঠীর অন্তত ছ’মাসের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে, লকডাউন ও আমপান সুন্দরবনের অর্থনীতি বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আবার আমপান পরবর্তী কালে পাঁচ মাসে বাঘের আক্রমণে ১৮জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এক রেকর্ড। এই মৃত্যুগুলি প্রমাণ করে খাদ্যের জন্য, আয়ের জন্য মানুষ কতটা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। মৃত্যু ওত পেতে রয়েছে জেনেও মানুষ মাছ-কাঁকড়া এবং অন্যান্য বনজ দ্রব্যের জন্য বাঘের জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পিছপা হচ্ছেন না। এমন দুঃসহ পরিস্থিতিগুলিকে ইদানীং ‘নিউ নরমাল’ বলাটাই যেন আদত হয়ে উঠেছে। যেন এটাই স্বাভাবিক যে, অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী শিক্ষার স্বাভাবিক অধিকার পাবেন না। কেননা অনলাইন শিক্ষাই এখন ওই নিউ নরমাল। ধূ ধূ মেট্রোরেল ছুটবে, তারাই যাত্রী হবেন যাঁরা বিশেষ সুবিধা কিনতে পারেন। লক্ষ লক্ষ সাধারণের জীবন-রেখা সস্তা ও দ্রুতগামী পরিবহন ট্রেনও সর্বজনীনতা বর্জনের পথে।
কোভিড অতিমারি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের মুখ ঢাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, দেওয়া হয়েছে দূরত্ব বজায় আর নিজেকে সাফসুতরো রাখার সুপ্রস্তাব। সে কথা মান্য করার পথে আমরা বৃহত্তর শ্রমজীবী সমাজটাকেই দূরে ঠেলে দিয়ে ইতিমধ্যেই হাত-পা বেশ সাফসুতরো করে ফেলতে পেরেছি। লজ্জা পাইনি যে সে কথাও কারও বোঝার উপায় নেই — কেননা মুখোশ পরাটা তো বিধিবদ্ধ। কানজোড়া কিছু সমস্যা করে। দু’কান কাটা হলে আরও গটমটিয়ে হাটের মাঝে হেঁটে যাওয়া যেত। নীতিআয়োগ রয়েছে, সরকার রয়েছে নিশ্চয়ই সে যন্ত্রণারও উপশম হবে।