চোরের মায়ের বড় গলা


  • November 4, 2020
  • (0 Comments)
  • 1502 Views

কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যম, দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি সংবাদমাধ্যম — যাদের সাংবাদিকরা যখন তখন খুন হয়ে যান, গ্রেপ্তার হন — সেগুলি কি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ নয়? তাদের হাত-মুখ বেঁধে ফেলা কি ‘রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার’, ‘জরুরি অবস্থা’ কিংবা ‘ফ্যাসিজম’ নয়? ‘হ্যাশট্যাগ’ ও ‘জাস্টিস ফর …’ ধ্বনি তখনই ভাইরাল হবে যখন শুধুমাত্র তথাকথিত জাতীয় মিডিয়া স্বৈরাচারী শাসকের প্রতিহিংসাপরায়ণতার শিকার হবে? এই প্রশ্নগুলিও আজ জোরের সঙ্গে তুলতে হবে। লিখেছেন দেবাশিস আইচ

 

‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ ও ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’-র উপর ‘রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার’-এ ক্ষুব্ধ অমিত শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বোধদয়ের জন্য কি মহারাষ্ট্র সরকারের ধন্যবাদ প্রাপ্য? এর পর আমরা কি দেখতে পাব নবজাগ্রত বিবেকের তাড়নায় শাহ উত্তরপ্রদেশে বেআইনি কার্যকলাপ (নিরোধক) আইনে গ্রেপ্তার হওয়া কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের মুক্তির জন্য ট্যুইট করছেন? দেখতে পাব তিনি নিন্দা করছেন কাশ্মীর টাইমসের কার্যালয়ে তালা মেরে দেওয়ার কিংবা কাশ্মীরে ফিরিয়ে দিচ্ছেন ফোর জি ইন্টারনেট কানেকশন? কাশ্মীরে সাংবাদিকদের উপর যাবতীয় রাষ্ট্রীয় খবরদারি, লিখিত-অলিখিত নিষেধাজ্ঞা এক লহমায় তুলে নিচ্ছেন এক ট্যুইটে? তবে অবশ্যই বোঝা যেত এ দেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রয়েছে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগ সৎ। কিন্তু সে হবার নয়। কথায় আছে না, চোরের মায়ের বড় গলা।

 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ট্যুইট থেকে যদি ‘রিপাবলিক টিভি’ ও ‘অর্ণব গোস্বামী’ শব্দদুটির বদলে দেওয়া যায় তবে তা এভাবে পড়া যেতে পারে। এবং সত্য একই থাকে। যদি অবস্থানটি বদলে ফেলা যায়।

 

“ব্ল্যাটান্ট মিসইউজ অফ স্টেট পাওয়ার এগেইনস্ট ‘কাশ্মীর টাইমস’ অ্যান্ড ‘অনুরাধা ভাসিন’ ইজ অ্যান অ্যাটাক অন ইনডিভিজুয়াল ফ্রিডম অ্যান্ড দ্য ফোর্থ পিলার অফ স্টেট।” কিংবা ‘ব্ল্যাটান্ট মিসইউজ…আঝিমুখম.কম অ্যান্ড সিদ্দিক কাপ্পান…’ অথবা ‘দ্য ওয়ার হিন্দি অ্যান্ড প্রশান্ত কানোজিয়া’… অথবা… তালিকা দীর্ঘ না করেও প্রশ্ন তোলা যায়, এমনটা কেন সত্যি হয় না? এই সময় কেন স্তম্ভ, স্বাধীনতা, রাষ্ট্রশক্তি, জরুরি অবস্থা, ফ্যাসিবাদ… ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দগুলি মনে করতে পারেন না অমিত শাহ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার তাবড় সদস্যরা? পারেন না, কেননা তাঁদের আর্থ-রাজনৈতিক বিশ্বাস ও অবস্থান সর্বত্র শুধুমাত্র তাঁবেদার খুঁজে বেড়ায়। রিপাবলিক টিভি ও অর্ণব গোস্বামী (এবং অবশ্যই কর্পোরেট মিডিয়ার এক বড় অংশ। তাদের মধ্যে বর্তমান দ্বন্দ্ব আদৌ সাংবাদিকতার ভালো-মন্দ নিয়ে নয়, দ্বন্দ্ব ব্যবসায়িক, দ্বন্দ্ব ভুয়ো টিআরপির।) এই ‘ক্রোনি জার্নালিজম’-এর প্রতিভূ।

 

সাংবাদিকতার স্বাধীনতা যে মোদী-শাহ রাজত্বে তলানিতে ঠেকেছে সে বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এই সেদিন ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টস প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিল, “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ-সহ সব অভিযোগ তুলে নিতে রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হোক।” অনুরোধ করেছে নির্ভয়ে কোনও হেনস্থা ছাড়াই কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করুক সরকার। এই আবেদন ছিল মূলত কোভিড অতিমারি পরিস্থিতিতে। সরকারের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা তুলে ধরার জন্য ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে-র মধ্যে ৫৫জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বিভিন্ন রাজ্য সরকার। এই গ্রেপ্তার, দেশদ্রোহিতার মামলার নিন্দা করে তারা বলেছে, “করোনা অতিমারির পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ব্যাপকহারে বেড়েছে। যারা কোভিড নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছেন অতিমারির যুক্তিতে তাঁদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। … স্বাধীন ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিকদের হেনস্থার জন্য দেশদ্রোহ আইনের ব্যবহার শুধু সরকারের নীতিভঙ্গ নয়, তা যে কোনও ভাবেই সমালোচনার কণ্ঠরোধের চেষ্টা। সাংবাদিকদের কাজ  কোনও ভাবেই দেশদ্রোহিতার সামিল হতে পারে না।”

 

না, কোনও অমিত শাহ, কোনও প্রকাশ জাভরেকর, কোনও স্মৃতি ইরানিকে এই গ্রেপ্তার ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগের বিরুদ্ধে ট্যুইট করতে দেখা যায়নি। কোনও কর্পোরেট মিডিয়া সান্ধ্যকালীন ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এ (যার সঙ্গে হিন্দিবলয়ের খাপ পঞ্চায়েতই একমাত্র তুলনীয়।) পেড়ে ফেলেনি প্রতিপক্ষ সরকারকে। আজ যাঁদের গেল গেল রব চাঁদ ছুতে চাইছে তাঁদের নীরবতা ছিল পাতালচুম্বী। ২ নভেম্বর, সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে ইউনেস্কো সাংবাদিক হত্যার নিরিখে ভারতকে ষষ্ঠ অতি বিপজ্জনক দেশ বলে চিহ্নিত করেছে। ২০০৬ থেকে ২০১৯ এদেশে ৩৯ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ থেকে ২০১৯ অর্থাৎ মোদী-শাহের রাজত্বে খুন হয়েছেন ২২জন। ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ডগুলির একটি মামলারও নিরসন হয়নি। ২০১৬-র দু’টি মামলা এখনও চলছে বাকিগুলোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও তথ্য ইউনেস্কোকে দেয়নি।

 

যে মামলাটি নিয়ে এত শোরগোল তা ২০১৮ সালের। মহারাষ্ট্রে তখন বিজেপি-শিবসেনা সরকার। এক ইনটিরিয়র ডিজাইনার এবং তাঁর মা আত্মহত্যা করেন। অভিযোগ অর্ণব গোস্বামী এবং আরও দুটি সংস্থা প্রায় পাঁচ কোটি প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না। ফলত, ধার না মেটাতে না পারার জন্য তাঁরা আত্মহত্যা করছেন। অর্ণবের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়। অভিযোগ, মামলার কোনও তদন্ত বা অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ না করেই আদালতকে পুলিশ জানায় অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই। আদালত মামলাটি ‘ক্লোজ’ করে দেয়। আজ মৃতের মেয়ে ও স্ত্রী জানাচ্ছেন, অর্ণব গোস্বামী গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁরা খুশি। এও জানিয়েছেন, অর্ণব প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান। কোন ক্ষমতা বা প্রভাবের জেরে অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার মতো অভিযোগের, যা একরকম মৃত্যুকালীন জবানবন্দি, তার তদন্ত হয় না? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাঁদে পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বান্দ্রায় পরিযায়ী বিক্ষোভ, আদিবাসী হত্যাকাণ্ড, সুশান্ত সিং রাজপুত ইত্যাদি কাণ্ডে মহারাষ্ট্র সরকারকে বার বার জড়িয়ে দেওয়া, মুখ্যমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করার খেসারত দিতে হচ্ছে অর্ণব গোস্বামীকে। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিক টিভি শুধু নানা অভিযোগ তুলে থেমে থাকেনি কিংবা মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেনি, রিয়া চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার করার ‘নির্দেশ’ জারি করেছে। অর্ণবরা শিবসেনাকে জেএনইউর ছাত্র কিংবা শাহিনবাগের শান্তিপ্রিয় মায়েদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলেন বোধহয়। শত মিথ্যা, শত চক্রান্ত করেও পার পেয়ে গিয়েছেন অর্ণবরা। কোনও আদালত ছাত্র কিংবা মায়েদের রক্ষা করতে আসেনি। এলগার পরিষদ মামলায় এই মহারাষ্ট্র পুলিশ (পরবর্তীতে বিজেপি সরকারের পতন হলে এনআইএ) অমিত শাহ, রিপাবলিক, জি, টাইমস নাওয়ের ভূমিকাও ভুলে যাওয়ার নয়। আজ বম্বে হাইকোর্টে এই মিডিয়া ট্রায়াল বিচারাধীন। বিচারপতিরা একের পর এক নিদর্শন হাজির করে অর্ণব-ব্রান্ডের সাংবাদিকতাকেই প্রশ্ন করে চলেছেন। তার কোনও সদুত্তর রিপাবলিক বা প্রায় একই দোষে দোষী অন্যান্য কর্পোরেট মিডিয়া দিতে পারেনি। একই প্রশ্ন উঠেছে শীর্ষ আদালতে। দিল্লি হাইকোর্ট সুনন্দা পুস্কর মামলায় অর্ণবকে সতর্ক করার আগে মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে। টিআরপি জালিয়াতি মামলায় অর্ণব রেহাই পায়নি সুপ্রিম কোর্টে। মুম্বাই পুলিশ সংক্রান্ত আর এক মামলায় শুধু অর্ণব নয়, রিপাবলিকের এডিটোরিয়াল এবং আউটপুট ডেস্ককে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছে মুম্বাই পুলিশ। এছাড়াও রয়েছে আদিবাসী হত্যাকাণ্ড ও বান্দ্রা-কাণ্ড নিয়ে মানহানি এবং জাতি ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে একাধিক মামলা। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট কিংবা শীর্ষ আদালতের নির্দেশে অর্ণব গোস্বামীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। রেহাই মিলেছে। আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার মামলাটি যে কবর থেকে খুঁড়ে বার করে রাতারাতি তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে — তা বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। যে ছাড়পত্র আদালতের কাছে রিপাবলিক ও অর্ণব পেয়েছেন, সেই রেহাই মেলেনি টিআরপি মামলায় অভিযুক্ত অন্যান্য মিডিয়ার কর্ণধারদের। কেন? এখানেই প্রভাব কিংবা ক্ষমতার তত্ত্ব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আদালতের ভূমিকা নিয়ে কেউ যদি সন্দেহ প্রকাশ করে বসে তা হলে বোধহয় অন্যায় হওয়ার কথা নয়। কেন শীর্ষ আদালত কাশ্মীরে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা সংক্রান্ত অনুরাধা ভাসিনের মামলায় ওই কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের সাংবাদিকদের কোনও নিরাপত্তা দিতে পারে না? কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যম, দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি সংবাদমাধ্যম — যাদের সাংবাদিকরা যখন তখন খুন হয়ে যান, গ্রেপ্তার হন — সেগুলি কি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ নয়? তাদের হাত-মুখ বেঁধে ফেলা কি ‘রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার’, ‘জরুরি অবস্থা’ কিংবা ‘ফ্যাসিজম’ নয়? ‘হ্যাশট্যাগ’ ও ‘জাস্টিস ফর…’ ধ্বনি তখনই ভাইরাল হবে যখন শুধুমাত্র তথাকথিত জাতীয় মিডিয়া স্বৈরাচারী শাসকের প্রতিহিংসাপরায়ণতার শিকার হবে?

 

এই প্রশ্নগুলিও আজ জোরের সঙ্গে তুলতে হবে। অর্ণব-ব্র‍্যান্ড, কর্পোরেট মিডিয়ার একশ্রেণির অ্যাঙ্কারদের আচরণ, ভাবভঙ্গি — এলাকা দখলে মরিয়া সমাজবিরোধীদের আচরণের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। অর্ণব বনাম শিবসেনার লড়াইও সেই রাজনৈতিক এলাকা দখলেরই লড়াই। শেষ বিচারে যা — শাহ, সেনা কিংবা ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ জাতীয় নয় — প্রকৃত ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রকেই ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করে তুলেছে। এবং নিঃসন্দেহে এই অত্যন্ত ভীতিকর পরিবেশের জন্য নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজের অপার নীরবতাও দায়ী। নীরবতা অন্যায় এক সহায়ক শক্তি। অপরাধীর সাকরেদ।

 

 

  • Feature Image : Anvay Naik’s family address reporters in Mumbai on Wednesday (Express photo)

 

Share this
Leave a Comment