২০০১ সনের পার্লামেন্ট হানার ঘটনায় বন্দী হয়েছিলেন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস. এ. আর. গিলানি। দীর্ঘদিন আটক ও নির্যাতিত হওয়ার পর তিনি আদালত থেকে বেকসুর খালাস হয়েছিলেন। ২৫ অক্টোবর ২০১৯-এ গিলানি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। গিলানির দেওয়া শেষ এই সাক্ষাৎকারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে এসেছে কাশ্মীরে কয়েক যুগ ধরে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে, তার কথা। ভারতের গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, এসব সম্পর্কে তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন গিলানি এই সাক্ষাৎকারে। গিলানির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা সাক্ষাৎকারটির একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করলাম। ৫ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে মৃদুলা ভবানী কীবোর্ড জার্নালের জন্য এস.আর. গিলানির এই সাক্ষাৎকারটি নেন এবং এটি ২৫ অক্টোবর মুদ্রিত হয়।
- ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ ধারা বাতিল হওয়ার সময় থেকে দু’মাসেরওবেশি সময় অতিক্রান্ত, এখনও কাশ্মীরের জনজীবন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরের ছাত্ররাও এখন কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয় এর বিরুদ্ধে ভারতে কোনো প্রতিবাদ গড়ে উঠবে?
কাশ্মীরে ইতিপূর্বে এইরকম পরিস্থিতি আর ঘটেনি। সংবিধানের ৩৭০ ধারাই ভারত আর কাশ্মীরের একমাত্র যোগসূত্র। সরকারই তার ছেদ ঘটাল। তবে অনেক বছর ধরেই সংবিধানের ৩৭০ ধারা ফোঁপরা হয়ে গিয়েছিল, হয়ে উঠেছিল এক প্রতারণার নামান্তর মাত্র। সরকার ইচ্ছে করে এই বিশেষ সময়টিকে বেছে নিয়েছে, কারণ সরকার জানে, আপেল তোলার সময় এগিয়ে আসছে, শতকরা ৭০ ভাগ লোক এর উপর নির্ভরশীল। তাঁদের রুজি-রোজগার আপেলের উপর নির্ভরশীল। তাঁদেরকে কাজ করতে বাইরে বেরোতে হবে, বাড়ির বাইরে পা রাখতে হবে, কিন্তু এসব সত্ত্বেও মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কাশ্মীরের মানুষ সরকারের সাথে অসহযোগ করেছেন। আসলে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ, যাঁদের ভিতর থেকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠে এসেছে, তাঁদের কিন্তু ৩৭০ ধারায় কোনোদিনই কিছু যায়-আসেনি। যাঁরা ভারতপন্থী, সংবিধানের ৩৭০ ধারা ছিল তাঁদের আকৃষ্ট করার চাতুরি। কিন্তু যে পদ্ধতিতে এই ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটানো হল, তার মধ্য দিয়ে এই ভারতপন্থীদের দলগুলিরও বিলোপ ঘটানো হল। এই পদ্ধতি কাশ্মীরের মানুষের কাছে অপমানজনক। এবং এই ঘটনা থেকে এই বার্তাই যায় যে, ভবিষ্যতে ভারত রাষ্ট্র আর কাশ্মীরিদের কাছে নিরাপদ রইল না।
কাশ্মীরের মানুষ সঠিক ভাবেই তাদের প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্ত করছে। রাষ্ট্র তার সব ক্ষমতা দিয়েও থামিয়ে দিতে পারছে না মানুষের প্রতিরোধকে। ১০ লক্ষ মিলিটারি কাশ্মীরে রয়েছে। তারা মানুষের প্রতিবাদী স্বরকে স্তব্ধ করতে অক্ষম। বিজেপি নানা মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা প্রচার করছে যে, ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর কাশ্মীরের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে।যদি উন্নতির সূচককে মাপকাঠি ধরা যায়, কাশ্মীর গুজরাটের থেকে এমনিতেই এগিয়ে; গুজরাট, যা কিনা অমিত শাহ আর মোদীর রাজ্য। ওরা মানুষকে নানান মিথ্যা কথা বোঝাচ্ছে। কাশ্মীর চিরকালই এই মিথ্যাচারের শিকার হয়েছে। এবং ভারত সরকার আজও সেই মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরের জনসাধারণের যে অংশ আত্মনিয়্ন্ত্রনের অধিকারকে বেছে নিয়েছে, তাদের পক্ষে অবশ্য বিষয়টি সহজ হয়ে গেল। ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরে ভারতপন্থীরা নিশ্চিহ্ন হবে। কিন্তু, যে পদ্ধতিতে সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি বাতিল করা হল, তা সংবিধানের পরিপন্থী, তা ভারতীয় সংবিধানকেই বিপর্যস্ত করেছে। ভারতীয় বিচারবিভাগের মতামতকে উপেক্ষা করে এই ধারা বাতিল করা হয়েছে। সর্বোপরি, এই ধারাটি বাতিলের ক্ষেত্রে সরকার মানুষের মতামত গ্রহণ করারও প্রয়োজন বোধ করেনি। সমস্ত রকমের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই এটি পরিপন্থী।
কাশ্মীরিরা জানে ভারতের গণতন্ত্র আসলে একটি প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না। এবার ভারতের জনগোষ্ঠীকেও ভাবতে হবে, ভবিষ্যতে তাঁরা কি ভারতকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখবেন? যদি দেখেন, তবে তাঁরা প্রতিবাদ করুন। বিশ্বের কাছে জানান, যে পদ্ধতিতে এই ধারা বাতিল হল তা অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের স্বেচ্ছাচারী শাসন হতে পারে না। হিটলার জার্মান পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু শেষ বিচারে তিনি একজন ফ্যাসিস্ট শাসক। ভারতের শাসকদল মানবাধিকারকে পদদলিত করছে, ঘৃণার-রাজনীতি প্রচার করে চলেছে; এদের সাথে ফ্যাসিস্ট হিটলারের পার্থক্য কোথায়? ভারতীয় জনগণের আজ বোঝার সময় এসেছে যে আরএসএস, বিজেপি, যারা আজ ক্ষমতায় এসেছে, তাদের রাজনীতি আসলে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি। ভারতবর্ষের ক্ষমতা আজ ফ্যাসিস্টদের হাতে। জনগণের উচিত, সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতির প্রতিবাদ করা। কাশ্মীরিরা জানে, তাদের দেশ আজ বিদেশীদের দখলে। তারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করবেই এবং শেষপর্যন্ত এই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিও পাবে।
ভারতীয়দের ভাববার সময় এসেছে, তাঁরা এই ফ্যাসিবাদী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দান্রাবেন নাকি ভারতবর্ষ সম্পূর্ণভাবে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বিগত ৫-৬ বছরে অসংখ্য গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। কখনও গোমাতা রক্ষার নামে, কখনও বা গোরুর মাংস খাবার অপরাধে মুসলমান এবং দলিতরা আক্রান্ত হয়েছেন। এবং এই গণপিটুনি সামাজিক স্বীকৃতিও পাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে মানুষ সরব হচ্ছে না। ভারতীয়রা গর্ব করেন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই ভারত। এই গণতান্ত্রিক দেশেই বর্বরের মত মানুষকে রাস্তায় হত্যা করা হচ্ছে। এবং সমাজ তা মেনে নিচ্ছে। অন্যদিকে, প্রফেসর সাইবাবার মত বহু নিরপরাধ ব্যক্তি আজ কারারুদ্ধ। ভীমা-কোরেগাঁও, এলগার পরিষদের নাম করে কত নিরপরাধ মানুষকে জেলে পোরা হল। অন্যদিকে, ভিডিও ফুটেজ ইত্যাদি যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যারা গণহত্যার মত অপরাধ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
একদিকে নিরপরাধ মানুষ জেলে বন্দী হয়ে থাকছে, জামিন পাচ্ছে না, বিচারও শুরু হচ্ছে না, অন্যদিকে সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং-এর মত অপরাধীকে মালা পরিয়ে পার্লামেন্টে সীট দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় জনগণকে বুঝতে হবে তাঁরা কোনদিকে যাচ্ছেন, দেশ কোনদিকে যাচ্ছে। তাঁদের চিন্তিত হওয়া উচিত। উচিত এদের বিরুদ্ধে সঠিক ভূমিকা নেওয়া। আমরা কাশ্মীরিরা লড়ব। আমরা জানি, আমাদের ঘর দখলীকৃত। একদিন না একদিন আমরা মুক্ত হবই। কিন্তু ভারতের মানুষের চিন্তিত হওয়া উচিত। শুধু কথা বলে গেলেই হবে না, তাঁদের কিছু করেও দেখাতে হবে।
সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতির এই ফ্যাসিস্ট রূপের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হচ্ছে, তা অনেকাংশেই প্রতীকি, এবং প্রতিবাদী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে, ফলে তা যথেষ্ট নয়। প্রতিরোধ বা রেজিস্টেন্স একে এখনো বলা যায় না। এটা হল এক ধরনের ঘোষণা, “আমি এই সিদ্ধান্তের অংশীদার নই।” এইটুকু দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায় না।
বিজেপির রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তবু একের পর এক বিল যে ভাবে পাশ হচ্ছে, তাতে বিরোধীদের ভূমিকা বোঝাই যায়। শুধু আইনসভা থকে বেরিয়ে গিয়ে তারা বিলটি পাশ করতে একপ্রকার সাহায্য করছে এবং কোনো বিরোধিতা ছাড়াই বিল পাশ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রতীকী বিরোধিতা একপ্রকার দ্বিচারিতা মাত্র। অনেকটা যেমন ভারত সরকারের প্যালেস্টাইন সংক্রান্ত অবস্থান। একদিকে তাঁরা বলেন, ইস্রায়েল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও জবরদখলকারী। প্যালেস্টাইনের জমির ওপর সর্বাগ্রে অধিকার প্যালেস্টাইনের মানুষের। কিন্তু একই সাথে তাঁরা আবার ইস্রায়েলেরও রাজনৈতিক বন্ধু, ইস্রায়েলের অস্ত্র কেনার অন্যতম বৃহত্তম খরিদ্দার। এই দ্বিচারিতার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণধোলাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এখানে-ওখানে প্রতিবাদ হয়েছে বড়জোর, কিন্তু তাকে আন্দোলন বলা যায় না।
কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্যে দিয়ে ভারত চাইছে কাশ্মীরের জনবিন্যাসকে পাল্টে দিতে। কাশ্মীরে এখন পাকিস্তান থেকে আসা রিফিউজিরাও বাস করেন। এতদিন কাশ্মীরের বিধানসভায় তাঁদের ভোটাধিকার ছিল না। কিন্তু ভারতীয় পার্লামেন্টে তাঁদের ভোটাধিকার আছে। এরপর তাদেরকেও কাশ্মীরের নাগরিক বলে মানা হবে। ১৯৯০-এ কাশ্মীরের পণ্ডিতদের উপত্যকা থকে বিতাড়ন নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু কেউ বলে না যে, ১৯৪৭ সনের আগে জম্মু একটি মুসলিম-প্রধান নগর ছিল। ১৯৪৭-র দাঙ্গায় বহু মুসলিম নিহত হন এবং এইভাবেই সেখানকার জনবিন্যাস পাল্টেছে। যেমন ধরুন, আমার সাথে একবার জম্মুর এক বৃদ্ধের কথা হয়েছিল। তিনি বলেন যে, তাঁর গোটা পরিবারের প্রায় ২০০ জন মানুষ এই দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। এই নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। এবারে এরা কাশ্মীরের জনবিন্যাসকে পাল্টে ফেলতে চাইছে।
- নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি ঠিক কতটা পরিমাণে ৩৭০-এর বিলোপকে সহজতর করে তুলেছে বলে আপনার মনে হয়?
…মানে, নির্বাচনী রাজনীতিটাই আসলে সব নষ্টের গোড়া। শুধু কাশ্মীরেই নয়, সর্বতোভাবেই দেখুন। গণধোলাই, গভীর ঘৃণার রাজনীতি – এসবের উপরেই বিজেপির রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে। মানে, বিজেপির রাজনীতি হল উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। আর জাতীয়তাবাদ বহুলাংশেই দাঁড়িয়ে থাকে ঘৃণার উপরে। ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে এই উগ্র জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করেই। হিটলারও এর অন্যথা কিছু করেনি। আজকের আরএসএস-বিজেপিও কিন্তু তাই করছে। এবং, নির্বাচনী রাজনীতির বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে না কংগ্রেস না বামদলগুলো পারছে বিজেপির সাথে সম্মুখসমরে নামতে। কারণ, তাদেরও এই জাতীয়তাবাদের খেলাই খেলতে হবে। না হলে ভোটে জেতা যাবে না। কারণ তা নয়তো মানুষ ভাবতে পারে যে, এই পার্টিগুলোও আদতে “অ্যান্টি-ন্যাশানাল!” দেখুন, ২০১৬ সালে যখন জেএনইউ-এর ঘটনাটি ঘটল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তৈরি হল “ফ্রীডম স্কোয়ার”, প্রশাসনিক ভবনের লাগোয়া। রোজ মিটিং হতো, পরিচালনায় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সংগঠন। বড়ো বড়ো পণ্ডিতরা সেখানে বক্তব্য রাখতে আসতেন। গোটা বিতর্কটাই শুরু হয়েছিল বাক-স্বাধীনতা ও অভিব্যক্তির স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু, গোটা লেকচার সিরিজটাই হয়ে দাঁড়াল জাতীয়তাবাদ ও তার বিরোধিতা বিষয়ে। মূল বাক-স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে প্রায় কেউ কোনো কথাই বললেন না। মানে, গোটা আন্দোলনটাই পড়ে গেল বিজেপির ফাঁদে। গত দশ-পনেরো বছর ধরে আরএসএসের যে নাগপুরের মূল অফিস, সেখানে তেরঙ্গা উত্তোলিত হয়নি। সেই আরএসএস-এর হাতে এখন ইয়া বড়ো জাতীয় পতাকা আর বাকিরা সবাই তালে তাল মেলাচ্ছে। ওই একই ফাঁদে পড়ে গেছে। কারণ? ওই ভোটবাক্স। সবকটা লেকচার একসাথে করে যে বের করা হল, তার নামও সেই জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবাদ বিরোধিতা। গোটা মাস জুড়ে বোধহয় মাত্র দু’জন কি তিনজন বক্তা বাক-স্বাধীনতা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এবং, তাঁরা শেষ করা মাত্রই উদ্যোক্তারা ঘোষণা করলেন যে, তাঁদের বক্তব্যের সাথে উদ্যোক্তারা একমত নন। কাজেই, বোঝা খুব কঠিন নয় যে এগুলোই নির্বাচনী রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। নির্বাচনী রাজনীতিই এখানে মূল অপরাধী।
কংগ্রেসও নরম হিন্দুত্বের খেলাই খেলছে। তা আপনি যদি হিন্দুত্বের রাজনীতি মেনেই নেন, তাহলে আর নরম হিন্দুত্বই বা কেন? আসল জিনিসটাই বা নয় কেন? বাম দলগুলির ভেতরেও ঘটে গেছে গভীর অবক্ষয়। তারা এই ঘৃণা-পরিবৃত জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে না। কারণ, তাদের মনেও রয়েছে ভোট হারানোর ভয়। এটাই হল মূলগত সমস্যা। যদি মানসিক গঠনই মানুষের বদলানো না যায়, তাহলে বিপ্লবের কথা বলে কী লাভ? ভারতবর্ষের বাম দলগুলি খালি মানুষের কাছে ভোট চায়, তাদের মানসিক গঠন পরিবর্তনের দায় তারা নেয় না। তো, ঐসব বিপ্লবের কথা বাত কি বাত। ফাঁকা বুলি।
ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো অর্থ নেই এখানে। মুসলিমরা এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তারা কী ভয়ঙ্কর ভীতসন্ত্রস্ত এক জীবনযাপন করে! একটি গণতন্ত্রের মূল পরীক্ষা হল, সংখ্যালঘুরা নিজেদের ঠিক কতটা নিরাপদ বলে মনে করেন। তো এই ব্যবস্থায় কোনও সংখ্যালঘু এখানে এক মিনিটের জন্যেও নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করবে না।
- ভোটাধিকারের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভাগ্যনির্ধারণের দাবিতে এক দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছে, আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। আপনি কি মনে করেন তা একদিন বাস্তবায়িত হবে?
১৯৪৭ সনের অক্টোবর মাসে ভারতীয় সৈন্যরা কাশ্মীরে প্রবেশ করে। ভারত সরকার আর মহারাজার মধ্যে একটা চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে কেবল প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ এবং বৈদেশিক দফতর, এই তিনটি ভারতের উপর বর্তায়। প্রথমদিকে আমাদেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভিসা ছাড়া ভারত থেকে কাশ্মীরে প্রবেশ করা যেত না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় চেষ্টা করেন, এবং জেলে বন্দী হন, সেখানে তার মৃত্যুও হয়। ১৯৫০ অবধি এই ব্যবস্থা ছিল।
১৯৫৩ সালে শেখ আব্দুল্লাহ যখন গ্রেফতার হন, তিনি কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী। গোটা বিষয়টি ঘটে ৩৭০ আভ্যন্তরীণ আইনাবলীর সাহায্যে। ১৯৪৮ সনে ভারত কাশ্মীরের বিষয়টি ইউএন-এ নিয়ে যায়। ইউএন-এর সিকিউরিটি কাউন্সিল কাশ্মীরের মানুষের ভোটের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের সপক্ষে মত দেন। সেখানে বলা হয়, কাশ্মীরের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা স্বাধীন হতে চান কিনা, তাঁরা পাকিস্তানের সাথে যেতে চান নাকি ভারতবর্ষের সাথে থাকতে চান। প্রচুর, প্রচুর প্রস্তাবনা আনা হয়েছিল। ইউএন-এর তত্ত্বাবধানে একটি কাউন্সিল গঠিত হয়। দিল্লীতে আজও তাদের অফিস আছে। শ্রীনগর ও বারমুলাতেও তাদের অফিস আছে।
সেসময়ে ভারত এই ব্যবস্থায় রাজি হয়েছিল। তারাই বিষয়টিকে রাষ্ট্রপূঞ্জের কাছে নিয়ে যায়। কাশ্মীরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ কোনো দাবি নয়, এটি একটি অধিকার। ভিত্তিগত অধিকার। সেই অধিকারকে সুনিশ্চিত করার জন্য কাশ্মীরিরা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।
- কাশ্মীরের বর্তমান যে আগ্রাসন, তার বিরুদ্ধে যখন একটি মামলা দায়ের হয়, তখন চীফ জাস্টিস বলেন, কোর্টের এখন এই মামলাটির শুনানির সময় নেই। পরিবর্তে, কোর্ট সিদ্ধান্ত নেয় বাবরি মসজিদ মামলাটির শুনানির। অর্থাৎ, কি দাঁড়াল? কাশ্মীর সমস্যাটির এদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে প্রায় কোনো অগ্রাধিকারই নেই। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
অনুরাধা ভাসিনের দায়ের করা মামলাটির বিষয় যখন উঠে আসে, কেন্দ্র দ্বারা কাশ্মীরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার বিষয়টির উপর ভিত্তি করে, তখন এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে সুপ্রিম কোর্ট, যার দায়িত্ব নাকি জনগণের অধিকার সুরক্ষিত করার, সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করার জন্য সরকারকে আরো বেশি বেশি করে সময় দিয়েছে। তাঁরা কিন্তু জানেন কাশ্মীরে কি ঘটছে, আট লক্ষাধিক মানুষের জীবনে কীরকম বিপর্যয় নেমে এসেছে। মানুষের কোনো মৌলিক অধিকার নেই। স্কুল-কলেজ বন্ধ। প্রচুর জীবনহানি ঘটেছে। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট অনড়। প্রথম শুনানিতে বলা হয়, ওঁদের কিছু সময় দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেখতে হবে এবার এখানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী।
সুপ্রিম কোর্টের কাছে মানুষ যায় কোনো উপায়ন্তর না দেখে। আইনব্যবস্থাও যখন নিপীড়কের অস্ত্র হয়ে ওঠে, আমাদের বুঝতে হবে অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। সাম্প্রতিক সময়ে, যখন একটি পাঁচ সদস্যযুক্ত বেঞ্চ গঠিত হয়, সেই বেঞ্চ ভারত সরকারকে এক মাস সময় দেয় সমস্ত শুনানি সংগঠিত করার। পরের শুনানির দিন ধার্য হয়েছে ১৪ নভেম্বর। এবং ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি ঘটে ৩১ অক্টোবর। আশা করা হয়েছিল যে, সুপ্রিম কোর্ট সরকারি আদেশনামার বিরুদ্ধে স্টে অর্ডার আনবে। স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে বলবে। কিন্তু, বাস্তবে তেমন কিছু ঘটল না। কাজেই, বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, ভারতবর্ষের সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটছে। আদালত, যা কিনা সংবিধানের অভিভাবক, সে-ই এই সাংবিধানিক লঙ্ঘনের পথ পরিষ্কার করে দিচ্ছে। কাজেই, মানুষের কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে সামনে আসা উচিত। এদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে এখন? ঠিক যেভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিল, সেই একই ভাবে আজ এখানকার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মিডিয়া বলে এখন আর কিছু বাকি নেই। মূলস্রোতের মিডিয়া আসলে বিজেপিরই মুখপত্র। প্রায় বিজেপির মিডিয়া সেল বললেই চলে। যে দেশে একজন মূলস্রোতের সাংবাদিকও এই কণ্ঠস্বর ওঠাননি, যে আট লক্ষাধিক মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট চেষ্টা করছে সরকারের অসাংবিধানিক পদক্ষেপকে বৈধতা দিতে; বলছে, আমাদের জাতীয় সুরক্ষা আর মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। এই দেশটিকে কী বলা যায়? কীসের জাতীয় সুরক্ষা? ভারতবর্ষের মানুষের খুবই চিন্তিত হয়ে পড়া প্রয়োজন, তাঁদের ভাবতে হবে যে তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন।
- আফজাল গুরুর ক্ষেত্রেও তো প্রায় একই জিনিস ঘটেছে?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আফজলের ক্ষেত্রে, আমি এটা আগেই বলেছি, বিচারের নামে প্রহসন ঘটেছে। বারবারই ঘটে। দুর্ভাগ্যবশত, কাশ্মীরের প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের সমস্ত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি একমত। এক্ষেত্রে তারা সবাই একই ভাষায় কথা বলে। তারা জানে কাশ্মীরে মানুষের কাছ থেকে অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাসত্ত্বেও বলবে, “ঠিক আছে।” ভারতবর্ষের জাতীয় সুরক্ষার নামে তারা যাকে ইচ্ছে বলি দিতে পারে। আমার মনে আছে, আমি যখন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, থাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে, চারিদিকে অন্যান্য ছাত্ররা, বন্ধুরা। আমি তাদের কাশ্মীরে মিলিটারি উপস্থিতি ও প্রাত্যহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলেছি। তারা হয় বিশ্বাস করেনি, অথবা বুঝতে পারেনি। টি এন শেষণ তখন চীফ ইলেক্শন কমিশনার, মিলিটারির উপস্থিতিতে বিহারে নির্বাচন হল। আমার মনে আছে, আমার বিহারের বন্ধুরা ফিরে এসে বলেছিল, “গিলানি, তোমার কাশ্মীরের গল্প আমরা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু সামরিক বাহিনীকে নির্বাচন পরিচালনা করতে দেখে আমরা বুঝলাম, সামরিক নৃশংসতা কাকে বলে।”
আজকে ওদের শিকার কাশ্মীরিরা, কাল অন্য কেউ হবে। কাজেই, গোটা বিষয়টি নিয়ে, ভারতবর্ষের মানুষকে নতুন করে ভাবতে হবে। এই মানসিকতার শিকার শুধু কাশ্মীরীরাই হবেন, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যেমন ধরুন, শীঘ্রই এনআরসি আসছে। আজ যাদের হাতে সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ, যেমন ধরুন অমিত শাহ – একটা সময় ছিল যখন সুপ্রিম কোর্টের আদেশে তার গুজরাটে প্রবেশ নিষেধ ছিল। নরেন্দ্র মোদীর নাম ছিল, গুজরাটের কসাই। কিন্তু, আমরা এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থিত, যেখানে একবার নির্বাচন জেতা মানে সমস্ত পাপস্খলন, অনেকটা গঙ্গাস্নানের মতন। মানে, গুজরাট গণহত্যার জন্য মোদীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়া হয়নি। কাজেই, দেখতে পাচ্ছেন, ঠিক কী হচ্ছে এখানে? পুরো ব্যবস্থাটার অবনতি ঘটছে। আজকের ভারতবর্ষে এটাই স্বাভাবিক। এবং, এই যদি হয় গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের চেহারা, তাহলে আজ ভারতীয়দের ভাবতে হবে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ছিল হিটলারের জার্মানিতে। আজকে তোমরা ডিটেনশন ক্যাম্প বানাচ্ছ, এই তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের জন্য। এই ক্যাম্পগুলো আর নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মধ্যে তফাৎ কোথায়? কিন্তু, এর বিরুদ্ধে রাগ কোথায়? রাগ ফেটে না বেরোলে, এ কীসের গণতন্ত্র? আর কী বাকি রইল তাহলে? কোন মানবাধিকারের কথা বলা হচ্ছে তবে? শুধু কথায় এখন আর কিচ্ছু হবে না। এটা বিদ্রোহের সময়।
আমাকে এই সেদিন এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন, “অনেক ভারতীয়ই তো এই অবস্থাটাকে উদযাপন করছে।” আমি বললাম, “দেখুন, কাশ্মীরিরা ভয়ঙ্কর কষ্ট পাচ্ছে, আর যারা অন্য মানুষের কষ্ট বিষয়টাকে উদযাপন করে, তাদের আর যাই হোক, সভ্য বলা যায় না। তারা বর্বর।” মানুষ হলে কেউ অন্যের কষ্ট উদযাপন করতে পারে না। ভারতবর্ষ নিজেকে যদি সভ্য বলে অভিহিত করে, তাহলে আমাকে বলতেই হবে, বর্বরতাকে আর যাই হোক, সভ্যতা বলা যায় না।
- ২৬ সেপ্টেম্বর শিখ ও তামিলদের যৌথ উদ্যোগে কাশ্মীরের সমর্থনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। আপনার কি মনে হয় এইধরনের কর্মসূচি অন্যান্য রাজ্যেও নেওয়া যেতে পারে?
আমরা সেদিন সবাই মিলে গিয়েছিলাম জাতিরাষ্ট্রের অফিসে মেমোরেন্ডাম জমা দিতে। সেটা ছিল ২৬/২৭ তারিখ। মোদী ও ইমরান খান দুজনেরই বক্তব্য রাখার কথা জাতিরাষ্ট্রের সামনে। তো, আমরা চেয়েছিলাম তার আগেই মেমোরেন্ডাম জমা দিতে, যাতে জাতিরাষ্ট্রের সেক্রেটারির কাছে সেটা পৌঁছতে পারে। আমি আমার পাঞ্জাবি বন্ধুদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। শুধু শিখরাই নন, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সবাই ছিলেন সেখানে। ছিলেন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ এসেছিলেন তামিলনাড়ু থেকে। ছিলেন বহু শিখ গণ-আন্দোলনের কর্মীরাও। যেমন দল খালসার সেক্রেটারি কমলপাল সিং, ওনাদের সভাপতি হরপাল সং সীমা। পাঞ্জাব থেকে পাঁচ-ছ’শ মানুষ এসেছিলেন। যেহেতু তাঁরা নিজেরা কষ্ট পেয়েছেন, তাঁরা বোঝেন কাশ্মীরে কী ঘটে চলেছে। পাঞ্জাবে তাই ক্রমাগত প্রতিবাদ হয়ে চলেছে। আমরা চেয়েছিলাম, যন্তর মন্তরে একটা সভা করতে। জাতিরাষ্ট্রের অফিসে আমাদের দেখা করার কথা ছিল সাড়ে তিনটেয় – তার আগে। অনুমতি আগেই নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মধ্যরাত্রে ওরা সেই অনুমতি বাতিল করল। সকালে আমরা সে খবর জানতে পারলাম। আমরা অবশ্য করলাম প্রতিবাদ সভা। কিন্তু যন্তর মন্তর আমাদের যেতে দেওয়া হল না। গুরুদ্বারা থেকে শুরু করলাম, কয়েক কিলোমিটার হেঁটে, রাস্তায় বসে পড়লাম।
একদিকে তুমি গণতন্ত্রের কথা বলছ, একটা বিশেষ জায়গাকে চিহ্নিত করে দিয়েছ প্রতিবাদস্থল হিসেবে, এবং সেখানেও প্রতিবাদ হতে দিচ্ছ না। কারণ, মানুষের কণ্ঠস্বর তুমি শুনতে চাও না। যাই হোক, যখন জাতিরাষ্ট্রের অফিসে যাব বলে ঠিক করলাম, তখন তামিল ও শিখ মিলে আমরা ছ’জন। পৌঁছে দেখি, বিশালসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তারা আমাদের অফিসেও যেতে দিচ্ছে না। অবশেষে কয়েকজন ভারতীয় এসে আমাদের জিজ্ঞাসা করল, যে কী হয়েছে। আমরা বললাম। তাঁরা বললেন, ভেতরে গিয়ে মেমোরেন্ডাম দেওয়ার অনুমতি নাকি দেওয়া যাবে না। একজন বললেন, “আমি এসেছি এখানে আপনাদের মেমোরেন্ডাম জমা নিতে।” আমি বললাম, “না, আমি ভেতরে গিয়ে জমা দেব।” তিনি যখন বললেন, “আমাকে পাঠানো হয়েছে নেওয়ার জন্য,” আমি বললাম, “বেশ তো, আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তাঁকে বলুন গিয়ে আমাদের ছ’জনের ভিতরে আসার অনুমতি আছে।” এই হল গিয়ে নিরপেক্ষ স্থানের নমুনা। শেষপর্যন্ত, আমরা পাঁচজন ভিতরে গেলাম; তখন ওঁরা আমাদের জানালেন, দুর্ভাগ্যবশত এই গোটা ব্যাপারটাই দিল্লী পুলিশের করা।
পাঞ্জাবের লোকেরা কাশ্মীরিদের প্রতি সহমর্মী, তারা আমাদের সমস্যা বুঝতে পারে। তাই অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সেখানে প্রতিবাদ হয়েছে। বহু বছর ধরে আমরা একত্রে প্রতিবাদ করছি। ২০১০-এও আমরা একসাথে বিক্ষোভ করেছিলাম। স্বর্ণমন্দিরের আক্রমনের ২৫ বৎসর পূর্তিতেও আমরা একসাথে ছিলাম। সৈয়েদ আলি শাহ গিলানিও এতে অংশ নিয়েছিলেন। এই সমন্বয় আজও অটুট আছে।
নিপীড়ক এক এবং অভিন্ন। ভারতের এই শাসনব্যবস্থার শিকার দলিত, মুসলিম। এই ব্যবস্থার কারণেই কাশ্মীর আজ অধিকৃত, পাঞ্জাবের লোকেরা এর দ্বারা অত্যাচারিত, উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষও নির্যাতিত হচ্ছে। সমস্ত রাজ্যের অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক হওয়া উচিত। তাহলেই নিপীড়িতরা বল পাবেন এবং সক্ষম হবেন এই ব্যবস্থাকে রুখে দিতে। শুধু ভারতীয় মুসলিমদের দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। কারণ তাঁরা দরিদ্র, সন্ত্রস্ত, অথিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের কোনো প্রতিবাদী স্বর নেই। ভারতের নানা জনগোষ্ঠীর নিপীড়িতদের উচিত তাই ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচারণ করা।
২০১৯ সালের জুলাই মাসেও বহু মানুষকে আটক করা হয়েছিল পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট-এ। এখনও অবধি হাজার হাজার মানুষ কারারুদ্ধ। এখানে মানুষ বলে, চার-পাঁচ হাজার; আসলে সংখ্যাটা আরও আরও বেশি। দশ থেকে পনেরো হাজার, তার কম নয়। কাশ্মীরের জেলগুলি প্রায় ভর্তি। শতাধিক মানুষকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে আগ্রা, এলাহাবাদ, বেরেলির মত উত্তর প্রদেশ আর হরিয়ানার জেলে। অনেকগুলো হোটেলকে পরিবর্তিত করা হয়েছে জেলে। যেমন ধরুন, সেন্টুর হোটেলের মতো পাঁচতারা হোটেলকে পরিণত করা হয়েছে জেলখানায় আর সেখানে খ্যাতনামা রাজনীতিবিদদের আটক করা হয়েছে। অন্যান্য হোটেল এবং পুলিশ স্টেশনেও বহু মানুষকে বন্দী করা হয়েছে। এদের মধ্যে আছে নাবালকরাও। নয় বছরের শিশুও বাদ যায়নি। এদের কারোরই বিচার হয়নি। কাশ্মীরে কাঠ-চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এই পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট(পিএসএ)-এর প্রণয়ন করেছিলেন শেখ আবদুল্লা। কিন্তু কাঠ-চোরাচালানকারীদের বদলে তা প্রয়োগ হয় রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে। শেখ আবদুল্লা থেকেকে ফারুক আবদুল্লা, রাজ্যপাল সকলেই এই আইনকে ব্যবহার করেছেন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে সরব হওয়া মানুষের বিরুদ্ধে।
এই ভয়াবহ আইনের বলে বিনা বিচারে দু’বছর অবধি যেকোনো মানুষকে আটক করে রাখা যায়। কাশ্মীরের আদালতে এখনও প্রায় তিনশ কেস পড়ে আছে যারা, এই অ্যাক্টের অধীনে আটক। কমপক্ষে ছ”মাস সময় লাগে একটি কেস খারিজ হতে। অনেক ক্ষেত্রে একবার জেল থেকে ছাড়া পাবার পর আবার তাকে আটক করা হয়েছে। আবার তাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে পিএসএ-চার্জ দেওয়া হয়েছে। মাসরত আলমের কেসটি এভাবে তিরিশ বার খরিজ হয়েছিল। এখন নতুন বলতে এই যে, ফারুক আবদুল্লার মতো কাউকে পিএসএ ধারায় আটক করা হয়েছে। ভারতের মানুষ এই কালা আইনটি সম্পর্কে জানত। কিন্তু প্রতিবাদ করেনি। হুরিয়তের সদস্যদের বিরুদ্ধে ফারুক আবদুল্লা নিজেই এই আইন ব্যবহার করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে হেবিয়াস করপাস ধারায় আবেদন হয়েছে আটক ব্যক্তির খবর নেবার জন্য। তারিগামির ক্ষেত্রে ইয়েচুরি হেবিয়াস করপাস ধারায় আবেদন করেন। আদালত তাতে রায় দেয় যে, ইয়েচুরি শুধু দেখা করতে পারবেম, কোনোপ্রকার রাজনৈতিক আন্দোলনে তারিগামিকে জড়ানো যাবে না। এই হচ্ছে ভারতের গণতন্ত্র।
সুপ্রিম কোর্ট, যা কিনা আপনাদের সংবিধানের অভিভাবক, তা আজ কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করাতেই ব্যস্ত। আজ সুপ্রিম কোর্টই ব্যক্তি-বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে মানা করছে, যারা মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। কী করে আশা করা যায় যে, তারা কাশ্মীরের মানুষের খর্ব হওয়া অধিকারকে ফিরিয়ে দেবে? ভারতের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন ঘটেছে, যা খুবই চিন্তার বিষয়। কাশ্মীরের মানুষ গত সত্তর বছর ধরে লড়াই করছেন। তাঁরা লড়াই জারি রাখবেন। চিন্তাভাবনা করতে শুরু করতে হবে ভারতীয়দের।
আমার মনে হয়, আবার আজ নতুন করে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করার সময় এসেছে। ভারতীয়রা স্বাধীন নয়। ভারতবর্ষ আর গণতান্ত্রিক সমাজ নয়। সেখানে এখন ফ্যাসিস্ট রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ভারতবর্ষের মানুষ যত তাড়াতাড়ি এই বিষয়টি অনুধাবন করবেন, ততই তাঁদের মঙ্গল।
ফীচার ছবি – ইকোনমিক টাইমস
Extremely genuine