যে মেয়েরা বাঁচতে চেয়েছিল …


  • September 30, 2020
  • (0 Comments)
  • 1413 Views

বাঁচতে চেয়েছিল। তুমুলভাবে শুধু বাঁচতে চেয়েছিল। নিজের জীবনটুকু নিজের মতো করে ওঁরা বাঁচতে চায় প্রত্যেক বার। যখন জানে যে মরে যাবে, মরেই যাবে তখনও শুধু বাঁচতেই চেয়েছিল ওরা – ওরা সবাই। শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলার আগে পর্যন্ত তাই একটুও হেরে যায়নি ওঁরা। ওঁরা কেউ। প্রতিদিনের রুটিটুকু জোগাড়ের লড়াই থেকে পরিবারে একটু স্বচ্ছলতা আনা পর্যন্ত, নিজেদের শিক্ষা আর জীবিকার জায়গাটা মজবুত করা থেকে নিজেদের মতো আরও অনেকের পায়ের তলার মাটিটুকু শক্ত করা পর্যন্ত যে লড়াই — তা ওঁরা সবাই নিজেদের শর্তে লড়েছে, লড়েছে নিজেদের জাতের সম্মানটুকু বাঁচাতে। বাঁচতে চেয়েছে মেয়ে হয়ে, মানুষ হয়ে। আর তাই মরে গেছে, মারা যাচ্ছে ,মেরে ফেলা হচ্ছে ওঁদের এ দেশে –আমার আপনার গর্বের আত্মনির্ভর ভারতে। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

Hathras Dalit woman’s dead body forcibly burnt by UP police. Family members and media not allowed.

 

উত্তরপ্রদেশের উনিশ বছরের যে দলিত মেয়েটি ধর্ষিত হলো এবং মারা গেল, সেই মেয়েটির জাত-পরিচয় তার বীভৎস ধর্ষণ আর মৃত্যুর অন্যতম কারণ। লজ্জাজনক শব্দটিও যথেষ্ঠ নয় তাঁর সঙ্গে ঘটা পরবর্তী ঘটনাগুলি বোঝাতে। মধ্যরাতে চুপিসাড়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের যাবতীয় প্রশ্ন নস্যাৎ করে দিয়ে পুলিশ-প্রশাসন মেয়েটির মৃতদেহ সামান্যতম সম্মান না দেখিয়ে দাহ করে দেয়, তাঁর পরিবারের কাওকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয়নি, বরং পরিবার ও প্রতিবেশীদের পুলিশ জোর করে ঘরবন্দী করে রাখে, শেষবারের মতো তাঁর মা-বাবাকে সেই ক্ষত-বিক্ষত শরীরটি দেখতেও দেয়নি রাজ্য প্রশাসনের পোষা পুলিশ। এক্ষেত্রে পরিচিতির রাজনীতি বাদ দিয়ে এই ঘটনার বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। আবার শুধু এটুকুতে আটকে রাখলেও এই ঘটনার সবটুকু বোঝা যায় না। শুধু একটা কথা ভাবলে একটু আশ্চর্য হতে হয় – সমাজের এক শ্রেণির নির্বাচিত নৈঃশব্দ। দলিত মানুষদের পরিচিতির লড়াইতে শামিল হওয়ার জন্য  নিজেদের সামাজিক অবস্থানের সুবিধা সর্বস্তরে পেতে অভ্যস্ত কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষ যেভাবে সোচ্চার হন, ফাঁপা উন্নতির মোড়কে ঢাকা ভারত আর তার প্রতিভূরা এই অপর ভারতের দলিত মানুষদের রোজকার বেঁচে থাকা আর এভাবেই মরে যাওয়া নিয়ে যে আদৌ ততটা ভাবিত নন তা সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয় পোস্ট থেকেই বোঝা যায়। আবার বোঝা যায় না আমাদের এ রাজ্যে প্রতিবন্ধী আদিবাসী কোনও মেয়ে নির্যাতিত হলে তার প্রতিবাদে কেন সরব হয় না এই একই নাগরিক সমাজ।

 

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিজেপি শাসিত যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ মহিলাদের প্রতি হিংসায় এই মুহূর্তে রয়েছে প্রথম স্থানে। ২০১৯ থেকে চলতি বছরের এখনও পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যায়, মহিলাদের প্রতি মোট হিংসার ঘটনা সেখানে ৫৫.৪ শতাংশ। শুধুমাত্র ২০১৯ সালে সেখানে মহিলাদের প্রতি হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা ৫৯৮৫৩ (২০১৭তে ছিল ৫৬০১১, ২০১৮তে ৫৯৪৪৫)। মহিলাদের প্রতি হিংসাত্মক ঘটনায় সারা ভারতের নিরিখে শুধু উত্তরপ্রদেশেই সর্বোচ্চ ১৪.৭% ঘটনা ঘটে। কিন্তু তাতেই বা কি যায় আসে? যেখানে ঘটনাটি হটেছে সেই হাথরস-এর পুলিশ আধিকারিক বলে দিয়েছেন ঐ দলিত মেয়েটির শরীরে ধর্ষণ বা তার জিভ কেটে নেওয়ার কোনও প্রমাণ মৃত্যুর পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে চিকিৎসকরা উল্লেখ করেননি। হ্যাঁ, মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দি অনুযায়ী অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তাঁর পরিবার ন্যায়ের দাবিতে ধরনায় বসেছেন। দলিত অধিকার আন্দোলনের পরিচিত রাজনৈতিক দলও অকুস্থলে পৌঁছে গেছে। তবু এ সবই যে আজকের ভারতে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে খুব বেশি আইনি সহায়তা পেতে সাহায্য করবে তা নয়। তাঁর মৃতদেহ বে-আইনিভাবে সৎকার করে ফেলাই এর স্পষ্ট প্রমাণ। তবু ঐ মেয়েটির মরণপণ লড়াই মনে রেখেই এই প্রতিরোধটুকু শেষ পর্যন্ত রাখতে হবে, হবেই।

 

এই ঘটনাটাই আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শহুরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আলোচনা-ঘরে বা সামাজিক মাধ্যমের বক্তব্যের মধ্যে দলিত পরিচিতির লড়াইটা আদপেই বোঝা যায় না। উত্তরপ্রদেশের এই ১৯ বছরের মেয়েটিকে যারা ধর্ষণ করে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে দেয়, তারা ঐ এলাকার উচ্চবর্ণের মানুষ এবং সেখানকার দলিত বাসিন্দাদের প্রতি তাদের ঘৃণা, বৈষম্যমূলক আচরণ, তীব্র রাগ আর হিংস্র আচরণ সম্পর্কে এলাকার সকলেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের মতো জাতপাতদীর্ণ রাজ্যে যা নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা এবং বর্তমানে সেখানকার রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা যাকে আরও জোরদার করেছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য বলছে ২০১৯-এ দেশের মধ্যে তপশীলি জাতির মানুষদের প্রতি সংঘটিত নৃশংসতায় উত্তরপ্রদেশ রয়েছে শীর্ষে, সেখানে ১১৮২৯টি ঘটনা ঘটেছে (২০১৭ ও ২০১৮তে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১১৪৪৪ ও ১১৯২৪)। সারা দেশের নিরিখে যা ২৫.৮%।  সে রাজ্যে তপশীলি জাতির মানুষদের প্রতি হওয়া নৃশংস অপরাধের মোট হিসাব ২৮.৬%। ফলে দরিদ্র দলিত পরিবারগুলিকে প্রতিনিয়তই অপমান, ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে দিন গুজরান করতে হয়। কেউ তা নিয়তি বলে মেনে নেন, কেউ ভারতবর্ষের সংবিধান যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের কথা বলে, সব নাগরিকের সমান মৌলিক অধিকারের কথা বলে সেই সংবিধানকে অস্ত্র করেই রুখে দাঁড়ান অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইতে (ভুললে চলবে না এ দেশে তপশিলি জাতি ও আদিবাসীদের বিরূদ্ধে সংঘটিত হওয়া নৃশংসতা, নির্মমতা রোধে আইনও রয়েছে। যদিও তার উপযুক্ত ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়)। ফলে উচ্চবর্ণের রাগ সীমা ছাড়ায়। তারা সুযোগ খোঁজে ‘শাস্তি’ দেওয়ার। এমন ‘শাস্তি’ যাতে আর কেউ ‘সমান’ হওয়ার সাহস না দেখায়। আর ‘শাস্তি’ দেওয়ার জন্য নারী শরীরের থেকে বড় কিই-বা হতে পারে!

 

দলিত পরিবারের মেয়েদের যেভাবে ইচ্ছে ভোগ করতে পারে উচ্চবর্ণের পুরুষ, যে পরিচয় বা যে শরীরগুলোর প্রতি তাদের এত ঘৃণা তা কোনও নারীর হলে তাকে ধর্ষণ করতে দ্বিধা নেই এই পুরুষদের, কারণ এ তো ‘শাস্তি’– দলিত হওয়ার, মেয়ে হওয়ার, দরিদ্র হওয়ার, হয়তো বা সাহসী হওয়ারও। ঐ মেয়েটির মতো। না, মেয়েটির বিষয়ে এখনও এমন কিছুই জানা যায়নি, যাতে তাকে অসাধারণ মনে হতে পারে। নেহাতই মায়ের সঙ্গে বজরা খেতে কাজ করছিল। মা ছিলেন একটু দূরে। হঠাৎই এই পুরুষদের আক্রমণ, বাকিটা সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সকলেরই জানা। উত্তরপ্রদেশের এই দলিত মেয়েটির চিকিৎসা নিয়ে টালবাহানাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ কোথায় তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি থেকে পরিবারের হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়া নিয়ে জলঘোলাতে যে ধিক্কারজনক রাজনীতি রয়েছে তা দেখে কেবল বিবমিষাই জাগে। আর তারপর তাঁর মৃত দেহটির এই আইনবিরূদ্ধ, বর্বর, অমানবিক, অসম্মানের ছাই হয়ে যাওয়াটুকু সমস্ত শব্দ যেন ছিনিয়ে নেয়। শুধু ঐ ১৯ বছরের কলিজায় যে বেঁচে থাকার মরিয়া জেদ ছিল আর যারা তাঁকে বাঁচতে দিল না, তাদের ‘শাস্তি’ যে সে চায় সেটুকু বুঝিয়ে দিল মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে। এই মেয়েকে সাহসী না-বলে উপায় কী!

 

এই বীভৎসতার স্মৃতি উসকে দিচ্ছে দিল্লির ঘটনার। সেই মেয়েও ঠিক এভাবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিল যেভাবেই হোক। তাঁর ক্ষেত্রেও শুধু ধর্ষণ নয়, তাঁর শরীরের উপর অকথ্য অত্যাচারে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকেই অকেজো করে দেওয়া হয়েছিল, এক অকল্পনীয় ঘৃণা আর রাগে। মনে ভিড় করে আসে নার্স অরুণা শানবাগের কথা। ধর্ষণের সময় তাঁর উপর ঘটা শারীরিক নির্মমতায় ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি নিছক জড়পদার্থের মতো বেঁচে ছিলেন। ভুলতে পারি না তেলেঙ্গানার সেই মেডিক্যাল ছাত্রীর কথা যাঁকে রাতের অন্ধকারে ধর্ষণ করে স্রেফ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাই মনের জোর যতই বেশি হোক, শারীরিকভাবে বারবার লড়াইতে হেরে গেছে এই মেয়েরা। এই রাগ বহু কিছুর দিকে আঙুল তোলে। আর বার বার একই কথা উচ্চারণ করতে করতে কণ্ঠ বা লেখনী ক্লান্ত হলেও তা চালিয়ে যেতেই হবে লাগাতার, কারণ না-হলে স্রেফ মোমবাতি মিছিলে ন্যায়, সাম্য, সুরক্ষা কিছুই আদায় হবে না। যে মেয়েরা নিজের শর্তে, নিজের পছন্দে বাঁচতে চাওয়ার চেষ্টা করছে বারবার তাঁদের উপরেই নেমে আসছে সবচেয়ে বর্বর আক্রমণ। শরীরের পরিচিতির মধ্যেই আটকে রাখার চেষ্টা তাঁদেরঅস্তিত্ব, জীবন আর মৃত্যু। যদি মেয়ে হওয়ার জন্য বশ্যতা মেনে নিত, যদি আকুতি জানাত, যদি স্বীকার করত ভুল হয়েছে, যদি মেনে নিত জোর, যদি দলিত হওয়ার জন্য মাথা নিচু করত, তাহলে হয়তো বেঁচে যেত। কিন্তু ওঁরা যে নিজেদের অজান্তেই শুধু নিজেদের নয়, ওঁদের মতোই খুব সাধারণ শুধু স্বনির্ভর, স্বাধীন মেয়েদের মুখ হয়ে উঠেছে। তাই এভাবেই ওঁরা চলে যায় আর আমরা স্তব্ধ হয়ে দেখি।

 

এ দেশে ধর্ষণের ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তি ও অভিযুক্ত/রা দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি প্রদানের জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠিত হয়েছে। ২০১৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে তৈরি হয় নির্ভয়া ফান্ড, যা মহিলাদের নিরাপত্তা খাতে খরচ হওয়ার কথা। কেন্দ্র এই অর্থ বরাদ্দ করে এবং রাজ্যগুলি তা মহিলা সুরক্ষার নানা খাতে ব্যয় করবে এমনটাই নিয়ম। ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী এই তহবিলের মাত্র ২০% বিভিন্ন রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তার প্রকল্পে খরচ হয়েছে। ভারতবর্ষে প্রতি মিনিটে ১৫ জন মেয়ে (সমস্ত বয়সের) ধর্ষিত হন – এই তথ্য মাথায় রাখলে অস্বস্তি হয়, এই আর কি…। তবে হিসেব রেখেই বা কী হবে? নিছক পরিসংখ্যান ছাড়া তো কিছুই নয়।

 

এখনও যদি আমার দেশের বিচারব্যবস্থা সক্রিয় না-হয়, এখনও যদি পুরুষদের নারী সুরক্ষা বা সামগ্রিকভাবে নারীর প্রতি বৈষম্যহীন হওয়ার জন্য কীভাবে সচেতন ও শিক্ষিত করা যায় সে বিষয়ে ইতিবাচক আধুনিক পদ্ধতি নেওয়া না-হয়, এখনও যদি ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে সবাই কথা না-বলি, এখনও যদি এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরূদ্ধে একজোটে রুখে না-দাঁড়ায়, এখনও যদি নারীবাদী আন্দোলনে আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সর্বস্তরের সব নারীকে শামিল করতে না-পারা যায়– তাহলে এরকম প্রতিটি মৃত্যুর পর নিষ্ফল ক্রোধের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করা হবে না।

 

এই লেখা লিখতে গিয়ে গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে ওঠে। মনে হয়, আমার জীবনের অনেক পাওয়া-না-পাওয়ার মাঝে এই সমস্ত মেয়েদের মরে যাওয়াগুলো রয়ে যাচ্ছে। আর সেইজন্যই এই মেয়েদের না-বাঁচা জীবনগুলোর দিকে তাকিয়েই হাতের কলম বা কি-বোর্ডে আঙুলগুলো সচল রয়ে যায় আমার, আমাদের – ওঁদের অসমাপ্ত লড়াইগুলো লড়ার জন্য।

 

  • লেখক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক
Share this
Leave a Comment