সরকারের ব্যর্থতা থেকে চোখ ফেরাতে একটি মৃত্যুর এমন নির্লজ্জ ব্যবহার আর তার কেন্দ্রে একটি নারী চরিত্রকে রেখে ঘটনাপ্রবাহকে আরও উত্তেজক করে তোলার এক বিবমিষা উদ্রেককারী কার্যক্রম যা সারা দেশ আর তার নাগরিকদের একটা বড় অংশকে ‘নেশাগ্রস্ত’ করে রেখেছে – তা দেশব্যাপী এক মহামারীকালীন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কেমন ‘সাররিয়াল’ মনে হতে থাকে। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
শুরুতেই একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলে দেওয়া দরকার রিয়া চক্রবর্তী দাবার বোড়ে ছাড়া কিছুই নন। এমনকি তার বিপরীতে দাঁড়ানো কঙ্গনা রাণাওয়াত-ও তাই। সবটাই হয়তো বুঝতেও পারছেন অনেকেই। তবু এই মুহূর্তে স্বীকার করা যাবে না। কারণ তা হলে এই যে দীর্ঘ কয়েক মাসের টানটান উত্তেজনা তা নিমেষে শেষ হয়ে যাবে আর তারপরে কয়েকটি জরুরি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে। যা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বর্তমান ছবির দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে। গত মাস সাতেক ধরে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার নিরন্তর ব্যর্থতা থেকে চোখ ফেরাতে একটি মৃত্যুর এমন নির্লজ্জ ব্যবহার আর তার কেন্দ্রে একটি নারী চরিত্রকে রেখে ঘটনাপ্রবাহকে আরও উত্তেজক করে তোলার এক বিবমিষা উদ্রেককারী কার্যক্রম যা সারা দেশ আর তার নাগরিকদের একটা বড় অংশকে ‘নেশাগ্রস্ত’ করে রেখেছে – তা দেশব্যাপী এক মহামারিকালীন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কেমন ‘সাররিয়াল’ মনে হতে থাকে। আশ্চর্য পরিকল্পনায় একটা গোটা দেশকে যেন পি সি সরকার-এর তাজমহল ভ্যানিশ করে দেওয়া জাদুর মতো, এই বিপদকালীন পরিস্থিতিতে সব ভুলিয়ে, হত্যারহস্যের রোমহর্ষক গল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এসব করার জন্য যদি একজন মহিলাকে পাওয়া যায়, মানে যাকে ব্যবহার করা যায়, যার চরিত্র, সামাজিক জীবন, কেরিয়ার, ব্যক্তিগত সম্পর্ক – সব, সবকিছুকে প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টা ধরে লোকচক্ষুর সামনে সুরতহাল করা যায় – তাহলেই কেল্লা ফতে! রিয়া চক্রবর্তী এই সমীকরণে পুরোপুরি মিলে গেছেন, তাই তাঁর নিস্তার নেই।
হিন্দি সিনেমার এই প্রজন্মের তরুণ অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের অকালমৃত্যু বর্তমান সরকারের ও তার বিরোধী পক্ষদের হাতে একেবারে মেঘ না-চাইতেই জল হয়ে দেখা দিল। আর গল্পটিকে দর্শকদের কাছে আরও বেশি আকর্ষক করে তোলার মতো উপাদানের অভাবও প্রথম থেকেই ছিল না। হত্যা না আত্মহত্যা, মাদক, টাকা তছরূপ, জীবনে একাধিক নারী, প্রেম বনাম যৌনতা, পরিবারের সঙ্গে প্রেমিকার বিবাদ, বন্ধুদের ভূমিকা – সব মিলিয়ে সংবাদমাধ্যমে দিনের পর দিন শিরোনাম তৈরি করা, সাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা ধরে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চালিয়ে যাওয়া কোনও সমস্যাই নয়। কোভিড সামলাতে ব্যর্থতা, পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু, কৃষকের আত্মহত্যা, দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া এবং সমস্ত রাষ্ট্রবিরোধী স্বরকে কারাবন্দি করা, দিল্লি হিংসার মতো বীভৎসতায় জড়িত আসল দোষীদের আড়াল করে আন্দোলনকারী, সমাজকর্মীদের আটক করার মতো সমস্ত ঘটনা চাপা পড়ে যায়। থুড়ি, ভুল বললাম, দারুণ পরিকল্পনায় মগজধোলাই করে এই সবকিছুকে চাপা দিয়ে দেয় রাষ্ট্র ও মিডিয়ার জমজমাট যুগলবন্দী। রিয়া-রা শুধু ব্যবহার হয়ে যেতে থাকেন।
সুশান্ত সিং-এর মৃত্যুতে তাঁর তথাকথিত প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তী কোনওভাবে জড়িত কি না তা দেখা বিচারব্যবস্থার কাজ। যদি কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে তাহলে তার তদন্ত হবে, দোষী শাস্তি পাবে। প্রশ্ন একটাই – মৃত্যুটি যতই দুঃখদায়ক হোক না কেন, তার কারণ সত্যিই কি ‘নেশন ওয়ান্টস টু নো?’, বা ‘জাতি জানতে চায়? ‘না, খুবই স্পষ্ট ও দৃঢ় উত্তর হল ‘না’। কারণ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্রের কাছে কৈফিয়ৎ চাওয়ার রয়েছে। জানতে চাওয়ার আছে রোহিত ভেমুলার সুইসাইড নোট পাওয়ার পরেও দোষীদের শাস্তি হয় না কেন? জানতে চাওয়ার আছে নাজিব কোথায়? ২০১৭ সালে রোহিত ভেমুলা মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে নিয়ে দলিত ছাত্রদের আত্মহত্যার সংখ্যা ২৩ ছুঁয়েছিল এবং এগুলি সব ঘটেছে এআইআইএমস, আইআইটি, এনআইআই সহ দেশের বিভিন্ন প্রথম সারির উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। রোহিতের আত্মহত্যার পরে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ, ধিক্কার, সরকারের কাছে জবাবদিহি চাওয়া সবই আরও দানা বাঁধলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। লাগাতার উচ্চবর্ণের সহপাঠী, কখনও অধ্যাপক, কোথাও সহকর্মীদের হাতে হেনস্থা, কর্তৃপক্ষের দ্বিচারিতা ও সরকারের উদাসীনতায় দলিত ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার ঘটনা এখনও ঘটেই চলেছে। গত বছর এমবিবিএস-এর চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী পায়েল তাদভি-র মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনাও স্মৃতিতে রয়েছে আমাদের। তাছাড়া এই সরকারের কাছে তো আবার হয় তথ্য থাকে না বা তা হারিয়ে যায়। যেমন দেশজুড়ে চরম আর্থিক ক্ষতির মধ্যে থাকা কৃষকদের অসংখ্য আত্মহত্যার ঘটনা। অথচ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সাম্প্রতিক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে দেশের মোট আত্মহত্যার সংখ্যার মধ্যে ৭.৪% কৃষিক্ষেত্রের ঘটনা। গত ২০১৯ পর্যন্ত মোট ৫৯৫৭ জন কৃষক ও ৪৩২৪ জন কৃষিমজুরের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এদেশে। এই আত্মহত্যার কারণ কী, কৃষিক্ষেত্র ঠিক কতটা বেহাল হলে অসহায় কৃষকদের এভাবে আত্মহত্যা করতে হয় তার জবাব চেয়েও পাওয়া যায় না সেই সরকারের কাছে, যার অর্থমন্ত্রী দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়াকে ‘ঈশ্বরের কাজ’ বলে চালিয়ে দিতে পারেন। এইসব উত্তর দিতে অপারগ হওয়ার কারণেই এমন গা ছমছমে মৃত্যরহস্য সংবাদমাধ্যমে পরিবেশন করিয়ে রাতের ঘুম উড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। রিয়া চক্রবর্তী এই খেলায় খুব সহজে পেয়ে যাওয়া এমন তাস যাকে দেশবাসীর সামনে আনা মাত্রই যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয় থেকে চোখ ঘুরিয়ে দেওয়া গেছে।
রিয়া চক্রবর্তীর এই মৃত্যুর সঙ্গে নাম জুড়ে যাওয়া ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ একেবারেই একমুখী নয়। এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে অজস্র পরত। রাজনৈতিক, সামাজিক সবকিছু মিলিয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনার একটা ভালো পরীক্ষা হয়ে গেল এই সুযোগে। এই ঘটনাটি যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনার ক্রমহ্রাসমান অবস্থাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আর সেইসঙ্গে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল একজন নারীর অবস্থানটা এই সমাজে ঠিক কী। স্বাধীন নারীর সংজ্ঞা তৈরি করতে যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দশকের পর দশক পেরিয়ে যায়, সেখানে স্বাধীনতা পেতে গেলেও অনেক কিছুই ছেড়ে দিতে হয়, নিজের সত্তার সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়। আর তা যদি হয় একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের ভেতরে তাহলে ‘স্বাধীন নারী’ নেহাত একটা ইমেজ হয়ে রয়ে যায় এবং তা বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঘুরেফিরে সেই পিতৃতন্ত্রের হাতই শক্ত করতে হয়। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে এই খেলার শরিক হয়ে যান। যাঁরা নিজেদের বিচারবুদ্ধি বজায় রেখে মানুষ হিসাবে স্বাধীন সত্তা, নারী হিসাবে আত্মসম্মান বজায় রেখে কাজ করতে চান – তাঁদের সারা ‘শরীর’ জুড়ে নানা তকমা দিয়ে দিতে সময় লাগে না।
হিন্দি সিনেমার জগত যা বলিউড নামে পরিচিত তা শুরু থেকেই অন্যান্য সব কাজের জগতের মতোই সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক। অতীতে তাও কয়েকজন বিশিষ্ট অভিনেত্রী এরই মাঝে নিজেদের অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সময় যত গেছে ‘বলিউড’ তত বেশি করে ‘ম্যাচো’ পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। আর সেখানে মহিলাদের অবস্থান হয়ে গেছে স্টিরিওটাইপড, ছকে বাঁধা গ্ল্যামার গার্ল ছাড়া যেখানে তাঁদের আর কোনও অস্তিত্ব নেই এবং সেইসঙ্গে শুধুই যৌনতার প্রতিমূর্তি তাঁরা, শিক্ষা-বুদ্ধি এসব তাঁদের জন্য নয়। যত বেশি পেশিশক্তির প্রদর্শন বেড়েছে বলিউডের সিনেমায়, তত বেশি করে নায়িকাদের সঠিক ভারতীয় নারীর প্রতীক করে তোলা হয়েছে। প্রেমিক-অন্ত প্রাণ, যৌনতায় দক্ষ অথচ লজ্জাশীলা, গ্ল্যামার-পুত্তলি এবং অবশ্যই অবলা, যাঁর নিজের কোনও মত বা স্বর থাকা একেবারেই চলবে না। তবে সময় তো বদলাচ্ছে। তাই সময়ের সঙ্গে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এমন মহিলারাও এই জগতে কাজে আসছেন যাঁরা নাম-যশ-গ্ল্যামারের পাশাপাশি অভিনয়কে একটা পেশা হিসাবেই দেখছেন এবং নিজেদের বোধবুদ্ধি গচ্ছিত রেখে আসছেন না, যাদের স্পষ্ট রাজনৈতিক মত রয়েছে এবং যারা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার বিরূদ্ধেও সোচ্চার। যেমন – স্বরা ভাস্কর, তাপসী পান্নু, কল্কি কেঁকলা প্রমুখ। রিয়া চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে এঁদের সঙ্গেই পাশে দাঁড়িয়েছেন সোনম কাপুর, করিণা কাপুর, দিয়া মির্জা, রবীনা ট্যান্ডনের মতো গ্ল্যামারাস নায়িকারাও। যা একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট করছে যে পুরুষতন্ত্রের দাপাদাপি আর চুপ করে সহ্য করতে রাজি নয় মায়ানগরীর নায়িকারাও। নিজেদের লড়াইটা তাঁরা নিজেরাই লড়বেন।
বাস্তবটা হল কেন্দ্রের বর্তমান সরকার, মহারাষ্ট্রের সরকার সবাই মিলে ভারি মজার একটি খেলা খেলতে শুরু করেছেন আর সেইসঙ্গে পেয়ে গেছেন মেরুদণ্ডহীন ভারতীয় মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমকে, যারা তাদের এই খেলায় সেনাপতির ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে। এই মৃত্যুটা এমন সময়ে ঘটল, যখন শাসক ও বিরোধী দু’পক্ষই বিষয়টিকে ব্যবহার করতে পারছে আসন্ন নির্বাচন, নিজেদের সমর্থক আর ভক্তকুল। আর প্রতিটি চাল দেখলেই বোঝা যায় যে পরস্পরের মধ্যে তাদের কী চমৎকার যোগসাজশ। সেখানে কী সুন্দরভাবে রিয়া চক্রবর্তী নামে এক উঠতি নায়িকা মানিয়ে যায় খলনায়িকার চরিত্রে। তিনি হিন্দি সিনেমার জগতে বহিরাগত, তিনি নিজের শর্তে বাঁচতে চেয়েছেন, তিনি বয়সে বড় পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে সেই ছবি প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন না, তিনি প্রেমিকের মৃত্যুতে ভেঙে পড়ার সময়টুকুও পান না। কারণ তাঁকে গণমাধ্যমের খাপ পঞ্চায়েতের অশ্লীল কার্যক্রমের শিকার হয়ে যেতে হয়। হ্যাঁ ‘ভিক্টিম’, ‘সারভাইভার’ নন। শুধু রাজনৈতিক সুবিধা চরিতার্থ করতে এই একজন মেয়েকে রাজনৈতিক দল থেকে, উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সমর্থকেরা — গণমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যম, হ্যাশটাগের সরগরম বাজারে যথেচ্ছ আঁচড়ে-কামড়ে এক ধরনের ধর্ষকাম মানসিকতা টানা মিটিয়ে চলে। কোনওরকম যুক্তি-বুদ্ধি নয়, স্রেফ ‘ডাইনি শিকার’-এর নৃশংস আনন্দে মাতিয়ে দেওয়া গেছে জনগনের একটা বড় অংশকে। কিছুটা আবেগ আর তার সঙ্গে ভারতীয় নীতি-নৈতিকতা, ভারতীয় নারীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতির মিশেলে রিয়া চক্রবর্তীকে খলনায়িকা বানিয়ে তাঁর কড়া শাস্তি থেকে মৃত্যুদণ্ডের দাবি – সবেতেই জুটিয়ে দেওয়া গেছে এদের। দেশ এখন করোনা ও যাবতীয় সমস্যামুক্ত! তাই না? অন্তত সংবাদমাধ্যম দেখলে তাই মনে হবে।
তাঁর বিপরীতে অন্য আরেক দাবার বোড়ে কঙ্গনা রাণাওয়াত। তিনিও বলিউডে বহিরাগত। তিনি এতদিন পর্যন্ত সেখানে স্বাধীন, সাহসী, নারীবাদী কণ্ঠস্বর হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখতে পেরেছিলেন। বলিউডের ন্যক্কারজনক পিতৃতন্ত্রকে হেলায় উপেক্ষা করে অন্তত এমন একটি ইমেজ তৈরি করে রাখতে পেরেছিলেন, যেখানে বারেবারেই দেখানো গেছিল একজন একা নারী বহু বাধা পেরিয়ে কোনও পুরুষশাসিত ক্যাম্প-এ নাম না-লিখিয়েও দিব্যি সফল নায়িকা হয়ে উঠতে পারেন। পারেন নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করে নিতে। এরকম একটা মুখের সঙ্গে কি চমৎকারভাবে জুড়ে দেওয়া গেছে জাতীয়তাবাদী, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অ্যাজেন্ডাকে। তিনি এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সত্যবাদিতা, আদর্শ তদন্তের মুখ, যিনি চেষ্টা করছেন বলিউডের মুখোশ খুলে দিতে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এই প্রতিবাদে রাজনীতির কূট গন্ধ লেগে আছে। আগের কঙ্গনা আর এখনকার কঙ্গনায় তফাত এখানেই স্পষ্ট যে –আগে হলে তিনি হয়তো রিয়া চক্রবর্তীর এই সংবাদমাধ্যম ও গণমাধ্যমের খাপ পঞ্চায়েতের নির্মম অপমানের প্রতিবাদ করতেন, এখন তিনি তা সারা দেশ জুড়ে যাতে আরও উসকে দেওয়া যায় সেই চেষ্টা করছেন।
রিয়া চক্রবর্তীকে টার্গেট বানিয়ে নেওয়া সহজ, কারণ তাঁর গডফাদার আছে না-নেই সে প্রশ্ন ব্যতিরেকেও বলা যায় যে রিয়ার সে অর্থে বলিউডে কোনও ‘বিগ শট’-এর সঙ্গে ওঠা-বসা নেই। হয়তো সময়-সুযোগ পেলে তিনি সে চেষ্টা করতেন, কিন্তু সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। হ্যাঁ, তাঁর নানা কথাবার্তা ও আচরণে অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে, কিন্তু তা তাঁকে কোনওভাবেই সরাসরি খুনি বলে দেগে দেয় না। পুরো বিষয়টিই পুলিশি তদন্ত, আইনি জেরা, বিচারব্যবস্থার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। আর কে-না-জানে যে, আজকের ভারতে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ইত্যাদির তৈরি করে দেওয়া জনমত এইসব কিছুকে প্রভাবিত করতে কতটা কার্যকরী হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আদালতের বেশ কিছু রায়ই তার প্রমাণ।
এর সঙ্গে জুড়ে নেওয়া যেতে পারে সিনেমা জগত বিশেষত হিন্দি সিনেমার জগত নিয়ে আপামর ভারতবাসীর, বিশেষত হিন্দিভাষী বলয়ের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল, উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা। কোনও কারণ ছাড়াই তা তাদের জীবনের, সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর গত কয়েক বছর ধরে সুচতুরভাবে কেন্দ্রের শাসক দলের কৌশলে তার সঙ্গে একটু একটু করে মিশিয়ে মূলস্রোতের হিন্দি সিনেমাপ্রেমী ভারতবাসীকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় নারীর নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের আফিম। ফলে চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালনের সঙ্গে মিশে এখন রিয়া চক্রবর্তীর উপর নেমে আসছে মূলত গো-বলয়ের উগ্র দক্ষিণপন্থী হিন্দিভাষী আক্রমণ। যা এক বিরাট সংখ্যক জনমানসে প্রভাব ফেলছে। কেউ সুশান্তর প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে, কেউ বা অত্যন্ত চতুরভাবে ভোটের রাজনীতি করার লক্ষ্যে রিয়াকে শিকার করতে নেমে পড়েছেন।
এই প্রেক্ষিতে সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি ভুলে গেছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে তার কর্তব্য। এদেশে বিক্রি হয়ে গেছে তার যাবতীয় আদর্শ। ফলে সরকারের ব্যর্থতাকে প্রশ্ন করা নয়, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার কারণ জানতে চেয়ে কৈফিয়ত চাওয়া নয়, মানবাধিকারবিরোধী নানা কাজের কট্টর সমালোচনা নয়, তাদের শিরোনাম ও প্রাইম টাইম দখল করে নেয় রিয়া চক্রবর্তী নামের এক নারী। নারী বলেই আক্ষরিক অর্থেই যে কি না ধরাছোঁয়ার মধ্যে। ক্যামেরা, বুম, শরীর সবকিছু দিয়ে তাঁকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া যায়। একজন ব্যক্তিমানুষ, একজন নারী – যাঁর অপরাধ তখনও প্রমাণিতই নয় – তাঁর সম্মানকে এভাবেই ঠুনকো প্রমাণ করে দেওয়া যায়। তাঁর শরীরী ‘প্রিভেসি’-র সীমারেখা যখন-তখন পেরিয়ে যাওয়া যায়। তাঁর গোপন ও ব্যক্তিগত বার্তালাপ মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষের চোখের সামনে কার্যত ফাঁস করে দেওয়া যায়। কারণ তিনি নারী এবং তিনি এখনও যে কোনও কারণেই হোক মাথা নোওয়াতে রাজি নন। এরকম নারীদের বলিউডের অচেনা বৃত্ত থেকে আমার-আপনার চেনা সমাজ প্রত্যেকেই কোনও ভাবে নুইয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলে পরিবার, সমাজ কেউই ছাড়ে না। রেখা থেকে রিয়া – যাত্রাপথটা একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এরকম মেয়েদের আক্ষরিক অর্থেই ‘ডাইনি’, ‘জাদুবিদ্যা জানা’, ‘পুরুষদের বশ করে রাখা’ এইসব বলে কত সহজে দেগে দেওয়া যায়। আর এই কাজটা সংবাদমাধ্যম নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাচ্ছে। এর পক্ষে যুক্তি, বক্তব্য খুঁজে বের করে আনাও সহজ। আর এই লাগাতার খবর পরিবেশনের ফলে হোয়াটস্অ্যাপ, সামাজিক মাধ্যমে রিয়ার বিরূদ্ধ দল তৈরি করে ফেলা ও দিনরাত শুধু এই আলোচনাতেই জনসমাজের ভাবনা-চিন্তাকে আটকে রাখা সহজতর হয়ে যাচ্ছে। এইসব গ্রুপগুলিতে যে ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে এই মহিলার বিরূদ্ধে তা পড়লে রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি উদ্রেক তো হয়ই, সেইসঙ্গে একটা ভয়ও অসাড় করে দেয় – কোনও মেয়েই এই সমাজে নিরাপদ নয়, তার সামাজিক অবস্থান, বয়স ইত্যাদি যাই হোক না কেন – যদি না সে পুরুষতন্ত্রের চেনা ছকে আটকে থাকতে রাজি হয়।
এই বলিউড, এই সমাজই কত সহজে নায়কদের একাধিক সম্পর্ককে পুরুষোচিত বলে গর্ব করে, পুরুষ ও নারীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলে তাকে পৌরুষের শ্লাঘার বিষয় বলতে পারে, সাক্ষ্য-প্রমাণসহ নাশকতা, মাদকচক্র, বণ্যপ্রাণী থেকে নেশার ঘোরে মানুষ মারার মতো ঘটনাতেও কত সহজে ছাড় পেয়ে যায় পুরুষ তারকারা। সেখানে সংবাদমাধ্যম থেকে, সহকর্মী, রাজনৈতিক দল সকলের আচার-ব্যবহারটাই তাঁদের প্রতি হয় অনুগত স্তাবকদের মতো। যে ধরনের সম্মান, স্তাবকতা, সহমর্মিতা এই অপরাধীরা পেয়েই চলেছেন দশকের পর দশক পেরিয়ে তার পাশে রিয়া চক্রবর্তীর ঘটনাটিকে এবং সংবাদমাধ্যম যেভাবে তাঁকে নিয়ে একনাগাড়ে কাঁটাছেঁড়া করে চলেছে সেই পুরো প্রক্রিয়াটিকে রাখলে বৈষম্যের ছবিটি স্পষ্ট হয়ে যায়। এই পুরুষ অপরাধীদের নিয়ে টানা ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর প্রশ্নই নেই। এক-আধবার ‘খবর’ হয়েই তাদের পরবর্তী রিলিজ, হিট-ফ্লপ, একশ কোটির ব্যবসা, দেশাত্মবোধক মন্তব্য ইত্যাদি জরুরি হয়ে ওঠে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, হয় তাদের বিরূদ্ধে কেস তামাদি হয়ে যায় বা নামমাত্র শাস্তি ভোগ করতে হয় বা বেকসুর খালাস। ফলাফল যাই হোক-না-কেন সমর্থক, ভক্ত, চাটুকারদের সংবর্ধনায় ভাসতে ভাসতে তারা আবার নিজেদের পেশায় ফিরে আসে, ব্যক্তিগত জীবনও যেমন ছিল তেমনি স্থিতিশীল হয়ে যায়, নতুন বিতর্ক তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত তারা নিশ্চিন্ত। এবং পুরুষ হওয়ার সুবাদে বিতর্ক যাই হোক না-কেন তার আঁচটুকু শেষ পর্যন্ত তাদের গায়ে লাগে না। তাদের নারীবিদ্বেষী চিত্রনাট্যে অভিনয়, ‘সেক্সিস্ট জোকস্’ চলতেই থাকে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে অসম্ভব এক পুরুষালি ভাবমূর্তি বা ইমেজ তাদের শুধু সিনেমাতেই নয় বাস্তব জীবনেও তৈরি করে রাখতে দেখা যায়। এই নায়কেরা সিনেমাতে যেনতেন প্রকারেণ নায়িকাকে নিজেদের প্রেমে সাড়া দিতে বাধ্য করে, আদপে যেটাকে প্রেম বলে দেখানো হয় তা অনেক সময়েই পুরুষের জোর খাটানো, অনেক ক্ষেত্রেই নায়িকা নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে সেই ভালবাসার সম্পর্কে নায়কের বাহুলগ্না হয়েই খুশি, নায়কের যাবতীয় পুরুষালি কাজকর্মের (দেশ বাঁচানো, উগ্রপন্থী পেটানো, জীবনে নাম করা ইত্যাদি ইত্যাদি) নিশ্চুপ সঙ্গী। নারীকেন্দ্রীক যে সিনেমাগুলি তৈরি হচ্ছে সেখানেও সবক্ষেত্রে এই ধাঁচা পুরোপুরি ভাঙা এখনও সম্ভব হয়নি। ঠিক একইভাবে এই নায়কেরা বাস্তব জীবনটাও সাজানোর চেষ্টা করেন। একটা সামাজিক বিয়ে বা প্রেমের সম্পর্ক, অসংখ্য নারীসঙ্গ (যেখানে ভালবাসা ও যৌনতার আধুনিক সংজ্ঞা নয় মহিলাদের পণ্য হিসাবে দেখার মানসিকতাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্পষ্ট) যা তাদের পুরুষ হিসাবে সাফল্যের স্মারক। ব্যক্তিজীবনেও তারাই সব কিছু ঠিক করেন, সেখানে স্ত্রী বা প্রেমিকার মতামত গুরুত্ব পায় না, তিনি অভিনেত্রী হলে সংসার সামলাতে বা বংশের ঐতিহ্য মেনে পেশা ছাড়তে হয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে পিতৃতান্ত্রিকতা তারা গোপনে এই ছবিটা দেখেই খুশি হয়। সুশান্ত-এর আত্মহত্যায় মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা চমকে উঠেছিলেন কারণ অনেকটা চেনাজানা প্রতিবেশ থেকে উঠে আসা কিছুটা অন্যরকম এক নায়ক বলিউডে সফলতা ছুঁয়ে কেনই বা আত্মহত্যা করবেন তা তাদের ভাবিয়েছিল। সেই আবেগের কাছে সুশান্তের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও যে পরস্পরবিরোধী তথ্যগুলি তদন্তে উঠে আসছে তা গুরুত্ব পাচ্ছে না। একজন ত্রিশোর্দ্ধ সাবলম্বী, বুদ্ধিমান মানুষকেও সেখানে এক ‘ষড়যন্ত্রকারী’ মহিলা ও তার সঙ্গীদের হাতের পুতুল হিসাবে দেখতেই চাইছেন তারা। রিয়া আসলে বলিউডের চেনা বাক্সে মিলে যাচ্ছেন না। তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন না, সোচ্চার নারীবাদী হিসাবেও কখনও উঠে আসেননি, আবার তিনি বলিউডি পুরুষতন্ত্রের চেনা গোষ্ঠীর সদস্য-নায়িকাও নন, তিনি শুধুই নিজের মতো করে নিজের প্রতিটি সিদ্বান্তকে এখন হাজার চাপের মুখেও ন্যায্য বোঝাতে চাইছেন, এক ও একমাত্র পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই একজন নারীর জীবন-জীবিকার ন্যায়-অন্যায় ঠিক করার বিরূদ্ধে হয়তো নিজের অজান্তেই রুখে দাঁড়াচ্ছেন। শুধু এইজন্যই হয়তো দেখা যাবে রিয়ার মতো মহিলাদের কেরিয়ার থেকে ব্যক্তি জীবন এক নিমেষে শেষ হয়ে যেতে পারে। কারণ মহিলা হওয়ায় তাঁর তো চরিত্রের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতেই পারে না।
রিয়া চক্রবর্তীর চরিত্রহানি শুধু নয়, তিনি কেন বেশি বয়সের পুরুষের প্রতি অনুরক্ত, কেন প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গেছেন যাবতীয় ব্যক্তিগত বিষয়কে টেনে আনা হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের গোপনীয়তার তোয়াক্কা না-করে। এবং তুলনা করা হচ্ছে সুশান্তের সেই প্রেমিকা/দের সঙ্গে যাদের ইমেজ তুলনায় শান্ত, ঘরোয়া না-হলেও পারিবারিক। রিয়ার নাম এমন কোনও কাজে জড়ায়নি যা বলিউডে নতুন, রিয়া কতটা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী কোনও পুরুষের সঙ্গী হিসাবে – প্রতি মুহূর্তে তা তুলে ধরা হচ্ছে। তাঁর মতো একই জীবনযাপন হয়তো বলিউডের প্রথম সারির নায়িকাদেরও, কিন্তু নিছক বলিউডি পুরুষতন্ত্রের তাঁবেদার হওয়ায় তারা ছাড় পেয়ে যান। রিয়ারা খেলাটা বোঝার আগেই বোড়ে বনে যান। স্বরা, তাপসীর মতো কিছু স্বর তবু জেগে থাকে, যাঁরা নায়িকা হয়ে, পেশাদার অভিনেত্রী হয়েও নিজের সত্তা বিকিয়ে দেন না।
সামনে বিহার, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন, রয়েছে লোকসভা নির্বাচনের হাতছানি। সব পক্ষকেই ঘর গোছাতে হয়। জাতিসত্তা নিয়ে আবেগ তৈরি করা ভোট টানার অন্যতম সহজ ও পুরনো পন্থা। সুশান্ত সিং ‘রাজপুত’-এর মৃত্যু ও তাতে রিয়া ‘চক্রবর্তী’-র জড়িয়ে যাওয়া রাজনীতির সেই ব্যবসায়ীদের কাজটা আরও সহজ করে দেয়। সেখানে যদি আবার দু’জন নারীকেই পরস্পরের বিরূদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় তাহলে গল্পটা আরও জমাটি হয়ে যায়। আপাতত জিডিপি-র পতন, পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে সরকারের কাছে কোনও নথি না-থাকা, একের-পর-এক মানবাধিকারকর্মীকে ভুয়ো অভিযোগে গ্রেফতার সব ভুলিয়ে দিতে রামের বদলে এখন রিয়া। আর আমরা যদি এখনও শুধুই দর্শক হয়ে থাকি, নীতি-নৈতিকতা-আবেগ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের আজব মিশ্রণ পান করতে থাকি, তাহলে এরপরের শিকার হওয়ার জন্যও যেন তৈরি থাকি।
লেখক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক।
[…] Sudarshana Chakraborty-Best Web (Bengali) Feature, Eastern region Riya Amader Bhenge Jawoa Ayenar Mukh (The saga of Rhea Chakraborty) […]