এটাই নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী, অমিত শাহদের গুজরাত মডেল। এখনও যদি আমরা চুপ থাকি। এখনও যদি হাতে হাত না-রাখি, ঐক্যবদ্ধ না-হই। পথে না-নামি। বলতে না-পারি, আর এক পাও এগোতে দেব না। ছিনিয়ে নিতে না-পারি আমাদের ভারতকে — তবে আরও এক হলোকাস্ট, আরও নাজি নিধনযজ্ঞের জন্য প্রস্তুত হোন। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
নিয়েমোলারের কথা মনে পড়ছে। মার্টিন নিয়েমোলার, সেই লুথেরান জার্মান যাজকের কথা। নাজি জমানার শেষ সাতবছর যাঁর কেটেছিল হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। মনে পড়ছে তাঁর বহু উচ্চারিত উক্তির কথা,
“ওরা প্রথমে সোশ্যালিস্টদের জন্য এসেছিল আর আমি সোচ্চার হইনি — কারণ আমি সোশ্যালিস্ট ছিলাম না।
এর পর ওরা ট্রেডইউনিয়নিস্টদের জন্য এসেছিল আর আমি সোচ্চার হইনি — কেননা আমি ট্রেডইউনিয়নিস্ট ছিলাম না।
এর পর ওরা এল ইহুদিদের জন্য, আমি সোচ্চার হইনি — কেননা আমি ইহুদি নই।
এবার ওরা আমার জন্য এল — আমার হয়ে কথা বলার জন্য আর কেউ বাকি ছিল না।”
মনে পড়ছে এই কারণেই যে, মুসলমান, দলিত, আদিবাসী, মাওবাদী, এলগার পরিষদ, শাহিনবাগের পর ওরা এবার সংসদীয় বামেদের দরজায়ও কড়া নেড়েছে। এমনটা না-হওয়ার কারণ ছিল না। নিয়েমোলার মনে করতেন, হিটলারের জমানায় বন্দিত্ব, নিগ্রহ, লক্ষ লক্ষ হত্যাকাণ্ডে জার্মানদের নীরবতা এই অপরাধগুলিতে অংশগ্রহণের নামান্তর। প্রোটেস্টান্ট চার্চের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এ-কথা বিশেষভাবে সত্য।
আমরাও প্রকৃত অর্থে একতাবদ্ধ হয়ে ধারাবাহিক ভাবে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারিনি। তেমন করে, শাসকের কানে জল ঢোকানোর মতো করে প্রতিবাদে সামিল হয়ে উঠতে পারিনি। আর তাই, আদবাণীর রথযাত্রার অন্যতম সারথি, গুজরাতে দলিত, মুসলমান, চাষি কিংবা শ্রমিক নিগ্রহ ও হত্যাকাণ্ডের প্রধান পুরোহিত যে সমগ্র দেশটাকেই ফ্যাসিস্ত কারাগারে পরিণত করবে — এ-কথা বুঝতে আমরা বড্ড দেরি করে ফেলেছি। দিল্লির সংগঠিত, আরএসএস-বিজেপি-পুলিশের মদতপুষ্ট গণহত্যা, সংখ্যালঘু মহল্লাকে নির্বিচারে ধ্বংসের ঘটনাটি এবং উল্টে সেই দাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে ছাত্র-শিক্ষক-মানবাধিকা কর্মীদের জড়িয়ে দেওয়াটি কি জার্মানির সংসদ ভবন রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগার ঘটনাটিকেই মনে পড়িয়ে দেয় না? অয়াডলফ হিটলার তখন ক্ষমতায়। রাইখস্ট্যাগে অধীন। থার্ড রাইখের ফুয়েরার অ্যাডলফ হিটলার।
সেই নাজিবৃত্ত ভারতকে ঘিরে ফেলেছে। এক এক করে দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অকেজো করে দিয়েছে মোদী-শাহের নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। নির্বাচন কমিশন থেকে অশোক লাভাসাকে সরিয়ে দেওয়া কিংবা মোদী ঘনিষ্ঠ গুজরাত ক্যাডারের আইএএস জিসি মুর্মুকে কন্ট্রোলার অয়ান্ড অডিটর জেনারেল পদে বসানো — এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারের আজ্ঞাবহ করে তোলার প্রথম পদক্ষেপ বলেই মনে করা হচ্ছে। এবার সংসদের আসন্ন বাদল অধিবেশনে বিরোধীদের প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবি করেছে সরকার। তাদের প্রশ্ন তোলা বারণ।
দেবাঙ্গনা ও নাতাশা পুলিশের বয়ানে সই করতে অস্বীকার করেছে। বয়ানের স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা স্পষ্ট লিখেছেন, “আই রিফিউজ টু সাইন।” অথচ, তার ভিত্তিতেই অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দিল দিল্লি পুলিশ।
দিল্লির হিংসাকে হাতিয়ার করে অতিমারির লৌহযবনিকার আড়ালে ঘুঁটি সাজানো চলছিলই। পেটোয়া নাগরিক সংগঠন দিয়ে তথাকথিত তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করা থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গুলফিশা ফতিমাদের দিল্লির জাফরাবাদে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা — এক স্বৈরাচারী চক্রান্তের অঙ্গ। এখন বলা হচ্ছে, দেবাঙ্গনা কলিতা ও নাতাশা নারওয়ালের ‘ডিজক্লোজার স্টেটমেন্ট’ বা পুলিশের কাছে ‘স্বীকারোক্তি’-র ভিত্তিতে সীতারাম ইয়েচুরি, জয়তী ঘোষ, যোগেন্দ্র যাদব, অপূর্বানন্দ, রাহুল রায়ের নামে এফআইআরের অতিরিক্ত চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অথচ দেবাঙ্গনা ও নাতাশা পুলিশের বয়ানে সই করতে অস্বীকার করেছে। বয়ানের স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা স্পষ্ট লিখেছেন, “আই রিফিউজ টু সাইন।” অথচ, তার ভিত্তিতেই অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দিল দিল্লি পুলিশ। এই তিন ছাত্রী এখনও ইউএপিএ-র বিভিন্ন ধারায় জেল হেফাজতে। তিনজনই সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের মুখ। দেবাঙ্গনা ও নাতাশা ছাত্রী স্বাধীনতাকামী ‘পিঁজরা তোড়’ আন্দোলনের নেত্রীও বটে। এবং প্রকৃতপক্ষে এই প্রথম শাহিনবাগের মায়েদের, ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃত্বে সারা দেশেই অজস্র শাহিনবাগ জ্বলে উঠেছিল। এই শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ, মুসলমান সম্প্রদায়ের মহিলাদের নিজের হক বুঝে নিতে পথে নেমে আসা আসলে স্বদেশকে সংখ্যাগুরুবাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার এক মরিয়া আন্দোলন। হিন্দুত্ববাদীরা তা ভালো চোখে নেয়নি। অতঃপর দিল্লিতে হিংসার জাল বোনা, তা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে প্রতিহিংসা নয় — হিংসা থাকলে তো প্রতিহিংসা হবে — ফ্যাসিস্ত সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রতিস্পর্ধাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান।
এটাই নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী, অমিত শাহদের গুজরাত মডেল। এখনও যদি আমরা চুপ থাকি। এখনও যদি হাতে হাত না-রাখি, ঐক্যবদ্ধ না-হই। পথে না-নামি। বলতে না-পারি, আর এক পাও এগোতে দেব না। ছিনিয়ে নিতে না-পারি আমাদের ভারতকে — তবে আরও এক হলোকাস্ট, আরও নাজি নিধনযজ্ঞের জন্য প্রস্তুত হোন।
Get united. Demand immediate unconditional release release of all political prisoners.