প্রশ্ন তুলতেই হয়, ভারত কি বহুজাতি-ভাষা-ধর্মের এক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ, নাকি কোভিড-১৯ কালে ভারত পরিণত হলো এক বহুজাতিক কর্পোরেশনে! যেখানে দেশের চরম সঙ্কটের দিনে আইন-আদালতকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে, সংসদকে এড়িয়ে, বিরোধী রাজনীতিকদের গৃহবন্দির সুযোগে দেশের নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো এক্সিকিউটিভদের হাতে। আর সবই অতিমারির নাম করে। সংসদে প্রশ্নোত্তর ছাঁটাইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুললেন দেবাশিস আইচ।
সংসদের দরজা খুলতে চলেছে। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে বাদল অধিবেশন। চলবে ১ অক্টোবর পর্যন্ত। গণতন্ত্রের বহু সমর্থকের কাছেই সংসদ সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্দির-সম। এই তো সেদিন, এনডিএ জোটের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদে প্রবেশের প্রাক মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদীকে দেখা গিয়েছিল, লোকসভার সোপানে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে। মোদী ভক্ত মানুষ এ-বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। রাম-সংসদ-দেশ কোনও ভক্তিই কখনও টাল খায়নি তাঁর। মোদীর আরও একটি স্থির বিশ্বাস রয়েছে, মোদীই বলি কেন, আরএসএসের দীক্ষায় সে বিশ্বাস বিজেপিরও। এবং তা হলো সংখ্যাগুরুবাদ। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কিংবা লালকৃষ্ণ আদবানীরাও এই সংখ্যাগুরুবাদেই বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু, এ-পথে যে অনমনীয়তা প্রয়োজনীয় তা তাঁদের ছিল না। হৃদয়হীন শাসককেও জনমানসে শিশুবৎসল, পশুপক্ষীপ্রেমী ভাবচ্ছবি তুলে ধরতে হয়। এ হলো জনসংযোগ। আবার স্বীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠায় গণহত্যা, নির্বিচার শিশু ও নারীহত্যা কিংবা খাণ্ডবদাহনে পিছপা হলে চলে না। সেও এক ভাবমূর্তি গঠন। শক্তিশালী নেতার ভাবমূর্তি। গুজরাত শাসনকালে মোদীজি সাফল্যের সঙ্গে একাধিক ভাবমূর্তি গঠন করেছিলেন — একদিকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’, অন্যদিকে পুঁজিপতির অভিন্ন হৃদয় বন্ধু।
এই সাফল্যের পথ ধরেই লোকসভায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। না, একক দলীয় ক্ষমতায় নয়। তবু, মোদী বিরোধী কিংবা মোদী সমর্থক কেউ ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স বা এনডিএ জোট ভুলেও উচ্চারণ করেন না। কোন কোন দল, ক’টি দল এই জোটের সঙ্গী তা হঠাৎ করে প্রশ্ন করলে অনেকেই এখন তার উত্তর দিতে পারবেন না। অতএব মোদীরাজত্ব। সময়কাল বোঝাতে মোদী ০.১ বা ০.২ বসানোই দস্তুর। মোদী ০.২ প্রধানমন্ত্রীকে অনেক বেশি নিঃশঙ্ক ও নির্ভীক করে তুলেছে। এই যে প্রশ্নোত্তরহীন সংসদ সে-কথাই প্রমাণ করে।
এর একটা ধারাবাহিকতা আছে। সে কথায় আসছি। তার আগে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিক্রিয়া দেখে নিই। আর বুঝতে চেষ্টা করি এই প্রতিক্রিয়ার মর্মবস্তুটুকু। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ ও দলীয় নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, কোভিডের অজুহাতে সরকারকে প্রশ্ন করার অধিকার হরণের এই সিদ্ধান্ত ‘গণতন্ত্রকে হত্যা করার বাহানা’। এখানে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, ডেরেক যে গণতন্ত্রের কথা, যে সংসদীয় গণতন্ত্র ‘হত্যা’র সঙ্গে তুলনা করছেন, তা কি আদৌ এই করোনা-কালে বেঁচে ছিল? এ-মুহূর্তে এই প্রশ্ন কি সমীচিন নয় যে, ২৪ মধ্যরাত থেকে জাতীয় বিপর্যয় আইন অনুসারে ‘দেশবন্দি’র সিদ্ধান্ত কি সংসদীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল? কিংবা অতিমারির অতিপ্রয়োজনীয়তায় স্রেফ এক দূরদর্শনীয় ঘোষণায় সারা দেশকে যখন কতিপয় প্রশাসনিক কর্তার হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখন দেশের ৩২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মত নেওয়া হয়েছিল কিনা? দু’টি প্রশ্নেরই উত্তর — না। তাই যদি হয়, যদি এই সিদ্ধান্ত ডেরেকের বাক্যচয়ন অনুসারে (যা এই কলমচির মনে ধরেছে) মেসার্স ‘এম/এস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তবে একথা বলতে হবে ভারতীয় গণতন্ত্রের কফিনে সেই ২৪ মার্চ ছিল আরও এক পেরেকের ঘা। এই প্রসঙ্গটি আলোচনার আগে আমরা বিরোধী নেতাদের আরও কিছু মন্তব্য এবং লোকসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বের তাৎপর্য বুঝে নেব।
কংগ্রেসের সাংসদ শশী থারুর মন্তব্য করেন, “সরকারকে প্রশ্ন করা সংসদীয় গণতন্ত্রের অক্সিজেন। এই সরকার তাদের দমণীয় সংখ্যাধিক্যের জোরে সংসদকে একটি নোটিশ বোর্ডে নামিয়ে আনতে, তাদের যা-ইচ্ছে পাস করিয়ে নিতে রাবার স্ট্যাম্প করে তুলতে চায়।” লোকসভার ডিএমকে সাংসদ কানিমোঝি বলেন, “এমনকি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সংসদে সরকারকে প্রশ্ন করার অধিকার নেই।” জাতীয় কংগ্রেস এক প্রেস বার্তায় বলেছে, প্রধানমন্ত্রী কখনও প্রশ্নের জবাব দেন না। সংসদেও প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া প্রমাণ করে বিজেপি ‘না বিশ্বাস করে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির,না সুশাসনে’। প্রতিবাদ জানিয়েছে বামদলগুলিও।
যে সময় জনস্বাস্থ্য থেকে অর্থনীতি সংক্রান্ত বহু তথ্যই অধরা এবং এখনও অচল সংসদের সুযোগ নিয়ে মন্ত্রিসভা একের পর এক সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে, তখন বিলম্বিত হলেও এই বাদল অধিবেশন অত্যন্ত জরুরি ছিল। সংসদের নিয়মিত অধিবেশনগুলিতে প্রতিদিন একঘণ্টা করে বরাদ্দ থাকে প্রশ্নোত্তর পর্ব বা কোয়েশ্চন আওয়ারের জন্য। এই সময় সাংসদরা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মন্ত্রীদের প্রশ্ন করতে পারেন। যা মন্ত্রীরা উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতিও নিয়ে থাকেন। এভাবেই এক একটি মন্ত্রকের এবং এক একজন মন্ত্রীর কাজের ধারার বিচার এবং তার জবাবদিহি করার বা কৈফিয়ত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। এই প্রশ্নোত্তর থেকেই উঠে আসে বিভিন্ন তথ্য, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও। আর্থিক অনিয়মও প্রকাশ্যে এসে পড়ে। সরকার পরিচালনার তথ্য, বিভিন্ন ডেটা এই প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকেই গণপরিসরে আসে। সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী এই গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় রীতিটি বাতিল করা হয়েছে। মৌখিক প্রশ্নোত্তরের সুযোগটি থাকবে না। দ্বিতীয়ত, জিরো আওয়ারও একঘণ্টা থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে আধ ঘণ্টায়। যে-সময় সাংসদরা দেশের বা তাঁর নির্দিষ্ট কেন্দ্রের কোনও আশু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লোকসভায় তুলে ধরতে পারতেন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি সেখানে আকর্ষিত হতো। জিরো আওয়ার রুলবুকে না-থাকলেও ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি উদ্ভাবন এবং মান্যরীতি। তাহলে কী হবে সংসদের দুই কক্ষে? রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা, প্রধানমন্ত্রীর আর একদফা ‘মন কি বাত’, আর বিভিন্ন মন্ত্রীদের ‘সাফল্য’র ঘোষণা। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই মন্ত্রিসভার সদস্যদের তাঁদের ‘ভালো কাজ’-এর তালিকা প্রস্তুত করে তৈরি থাকতে বলে দিয়েছেন। অতঃপর ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত সংসদে প্রচুর হই-হট্টগোল, প্রশ্নোত্তর পর্বের দাবি, দফায় দফায় কক্ষত্যাগ ছাড়া আর কিই-বা প্রত্যাশা করা যেতে পারে? দেশের বাকস্বাধীনতা, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা বিষয়ে এক চৎমকার ট্যুইট করেছেন লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। অনুবাদে তাঁর বক্তব্যটি এরকম:
“আদালতে প্রশ্ন করলে: ‘অবমাননা’
সংসদের বাইরে প্রশ্ন করলে: ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’
এখন সংসদের অভ্যন্তরে প্রশ্ন করাটা: ‘নিষিদ্ধ’।”
এখন প্রশ্ন হলো অন্ধকার প্রশ্নহীন রাজত্বে, এক লৌহযবনিকার আড়াল কি দেশ মেনে নেবে? এখনও পর্যন্ত তেমন ইঙ্গিত নেই। জিএসটি কাউন্সিলের সভায় অর্থমন্ত্রীর নিদান মেনে নেয়নি পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড-সহ বিরোধী রাজ্যগুলি। হকের পাওনা, ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি, সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতিনীতির প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রীরা। প্রশ্ন উঠেছে প্রশ্ন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে। কিন্তু, যখন ঢের বেশি করে প্রশ্ন ওঠার কথা জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্রমপতন নিয়ে — সেখানে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে সংসদে প্রশ্ন করা বারণ কেন? এ পরিস্থিতি একদিনে তো হয়নি। বিজেপি সমাজের সর্বস্তরেই সংখ্যাগুরু ও একদলীয় একাধিপত্য চায়। সংসদীয় গণতন্ত্রেও তা স্পষ্ট। শশী থারুর যাকে বলছেন ‘দমণীয়’ সংখ্যাধিক্যের জোর, সেই জোর তারা ইতিমধ্যেই ফলিয়েছে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে। যে প্রতিবাদ কাম্য ছিল বিরোধীদলগুলির কাছে — আজ যারা আর্থিক স্বাধীনতা থেকে বাকস্বাধীনতা হারাতে বসেছে — সেই প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি। কাশ্মীর প্রসঙ্গে একের পর এক সাংবিধানিক অধিকার বিষয়ক মামলার ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষ আদালত বার বার বিচার বিলম্বিত করে চলেছে — যা অ-বিচারের নামান্তর। সংখ্যাগুরু প্রতিক্রিয়ার ভয় সেদিন এবং আজও আধিপত্যবাদী ক্ষমতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারেনি। শীর্ষ আদালতের ‘রাম-বিশ্বাস’ রায় এবং প্রধানমন্ত্রীর রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনেও সেই বৃহত্তর নকশারই প্রতিফলন। এক্ষেত্রে বাধ সাধেনি কোভিড-১৯ অতিমারির বিধিনিষেধ। দেখতে চাইলে দেখতে পাব, এনআরসি, সিএএ, এনপিআরেও সেই একই ছক। একমাত্র শাহিনবাগ এবং শাহিনবাগের প্রেরণায় দেশজোড়া বহু শাহিনবাগের উত্থান এই মোদীশাহের দুর্দমণীয় অভিযানকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও থমকে দিয়েছিল। যা গুঁড়িয়ে দিতে একটি সংখ্যালঘু বিরোধী অভিযান শাসকের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়ে। দিল্লির সংগঠিত দাঙ্গাই তার প্রমাণ। এবং প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নামিয়ে আনা হলো প্রতিহিংসা। তাঁদের জুড়ে দেওয়া হতে লাগল দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলায়। গ্রেপ্তার করা হলো তাঁদেরই, যাঁরা এই দাঙ্গার শিকার। আড়ালে চলে গেল উস্কানিদাতা বিজেপির প্রধান প্রধান মুখগুলি। ঠিক যেভাবে ২০১৮ সালের ভীমা কোরেগাঁও এলগার পরিষদের দলিত আন্দোলনকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এখনও যে মামলায় দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিরা জেলবন্দি এবং ‘ডাইনি শিকার’ অভিযান অব্যাহত — সেই একই কৌশলে এনআরসি বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনে নামানো হলো দিল্লি পুলিশকে। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকাই আজ বিজেপিকে সংসদে নিষেধাজ্ঞা জারির সাহস জুগিয়েছে। এবং এই প্রতিটি প্রশ্নকে কাটাছেঁড়া করলে দেখতে পাব বিগত ৭০ বছরের নানা নীতিহীনতা অক্সিজেন যুগিয়ে গিয়েছে এই চরম নীতিভ্রষ্টাচারীদের।
আদ্যন্ত একটি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যাকে বাগে আনতে প্রথমেই রাজ্যগুলিকে ১২৩ বছরের পুরনো একটি ব্রিটিশ আইন এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট, ১৮৯৭ জারি করার পরামর্শ দিল কেন্দ্রীয় সরকার। এই আইনের বলে চিকিৎসক কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নন, লাঠি ঘোরানোর লাগামহীন অনুমোদন মিলল পুলিশ-প্রশাসনের। একের পর এক রাজ্য আট-দশদিনের জন্য সার্বিক লকডাউন ঘোষণা করতে শুরু করল। থালাবাটি বাজিয়ে এবার আসরে নামল কেন্দ্রীয় সরকার বা মেসার্স ‘এম/এস প্রাইভেট লিমিটেড’। মানসিক ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল অতএব মাত্র চারঘণ্টার নোটিশে স্তব্ধ হলো দেশ। এর পিছনে মূলত যে আইন ও বিধিগুলিকে কাজে লাগানো হলো সেগুলি হল:
এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট, ১৮৯৭,
ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৫
ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের (১৮৬০) ধারা ১৮৮ ও
ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের (১৯৭৩) ধারা ১৪৪।
প্রথম দু’টি নিয়ন্ত্রণমূলক, পরবর্তী দু’টি দণ্ডবিধি। দণ্ড ও ডাণ্ডায় অতিবিশ্বাসী পুলিশ-প্রশাসন যাবতীয় ক্ষমতা দেখানোর ছাড়পত্র পেয়ে গেল। অতঃপর, সারা দেশ দেখল, জীবিকাহীন, অজানা রোগে আতঙ্কগ্রস্ত মজদুররা ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে চলেছেন রাজপথ ধরে। আইন ভাঙার শাস্তি দেওয়া হয়েছে তাঁদের। রাসায়নিক ছিটিয়ে ভাইরাস মুক্ত করা হচ্ছে পরিযায়ীদের, শিশুর দুধ কিনতে বেরিয়ে পুলিশের লাঠির ঘায়ে লাশ হয়ে যাচ্ছেন বাবা। এবং পুলিশের ভূমিকায় উল্লাস আছড়ে পড়ছে টেলিভিশনের সামনে। রাজপথে পাহারা তাই বনের পথে লুকিয়ে চলতে গিয়ে দাবানলে পুড়ে মরছে তামিলনাড়ুর চার শ্রমিক। আগ্রা থেকে মধ্যপ্রদেশে হেঁটে আসার ধকল সামলাতে না-পেরে মরে গেল ৩৯ বছরের রেস্তোরাঁ কর্মী। এরই মধ্যে যেমন আমরা দেখেছি শুনেছি, ইউরোপের দেশগুলিতে ঘটতে, তেমনই দুধের গাড়ি, বন্ধ কন্টেনার, কংক্রিট মিশ্রণের ট্রাকের পেটে ঢুকে, অ্যাম্বুলেন্সে করে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে নিজেদের ‘পাচার’ করছে পরিযায়ী শ্রমিকরা। কেন না আন্তঃরাজ্য সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছে। এসবই ঘটেছে মার্চের ২৪ থেকে তিরিশের মধ্যে। নানা সমীক্ষা থেকে পরিষ্কার প্রায় এককোটি পরিযায়ী শ্রমিককে স্রেফ পথে বসিয়ে ছেড়েছে এই দণ্ডনীতি। পথে বসেছে দেশের অর্থনীতিও।
কোভিড-১৯ অতিমারির হাত থেকে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য ২৯ মার্চ গঠিত হল ১১টি ‘এমপাওয়ার্ড গ্রুপ’। সেখানে চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ভাইরোলজিস্টরা কোথায়? কোথাই-বা অর্থনীতিবিদ, তালিকায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আধিকারিক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক আধিকারিকদের ছড়াছড়ি।1 পুলিশ তো লাঠিয়াল মাত্র। এঁরাই বিগত ছ’মাস দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, এবং এখনও। প্রশ্ন তুলতেই হয় ভারত কি বহুজাতি-ভাষা-ধর্মের এক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ, নাকি কোভিড-১৯ কালে ভারত পরিণত হলো এক বহুজাতিক কর্পোরেশনে! যেখানে দেশের চরম সঙ্কটের দিনে আইন-আদালতকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে, সংসদকে এড়িয়ে, বিরোধী রাজনীতিকদের গৃহবন্দির সুযোগে দেশের নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো এক্সিকিউটিভদের হাতে। আর সবই অতিমারির নাম করে। গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক গাঁথার প্রসঙ্গ উঠেছিল। এর পরও যদি সে প্রসঙ্গ না-ওঠে তবে আর কবে উঠবে?
পুনঃ — ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধিবেশন। এই অধিবেশনে, যদিও দু’দিনের, কোনও প্রশ্নোত্তর পর্ব নেই। ডেরেক ও’ব্রায়েন ও মহুয়া মৈত্রদের কথা নিশ্চয় এখনও চোখের সামনে ভাসছে। আর নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে সেই নীতিবাক্যটি — আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখায়ো।
Note:
1. file:///C:/Users/abc/Downloads/MHA%20Order%20Dt.%2029.3.2020%20on%20%20Disaster%20Management%20Act%202005.pdf
- লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।