গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২০, বুধবার বিএসএনএল-এর প্রায় ২০০০ জন ঠিকাকর্মী কলকাতার ডালহৌসিতে ক্যালকাটা টেলিফোন ভবন অভিযান চালান। চারটি ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চের ডাকে এদিনের এই বিক্ষোভ অভিযান ঠিকা কর্মীদের ১৬ মাসের বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
বিএসএনএল ক্যালকাটা টেলিফোনস্ ইউনিয়ন এসোসিয়েশন অফ কন্ট্রাক্ট ওয়াকার্স – ঠিকাকর্মীদের চারটি ইউনিয়ন-এর যৌথ মঞ্চের আপাতত এটাই নাম। আগে গঠিত হওয়া যৌথ মঞ্চ থেকে একটি ইউনিয়ন কিছু মতভেদের কারণে বেরিয়ে যাওয়ায় এই যৌথ মঞ্চটি তৈরি হয়েছে। এতে যে চারটি ইউনিয়ন রয়েছে – সিটিটিএমইউ, বিএসএনএলসিএলইউ, সিডব্লিউইউপিবি, বিএসএনএলএনটিডব্লিউসি। এই নতুন মঞ্চের ডাকেই গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২০, বুধবার প্রায় ২০০০ জন ঠিকাকর্মী কলকাতার ডালহৌসিতে ক্যালকাটা টেলিফোন ভবন অভিযান চালান। এই অভিযান ও প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি বসে অত্যন্ত জরুরি কিছু দাবি আদায়ের জন্যই এই অভিযান করা হয়েছিল। লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার কারণে বহু কর্মী এদিন যোগ দিতে পারেননি, কিন্তু প্রায় ২০০০ জন কর্মীর উপস্থিতিতে এদিনের বিক্ষোভ অভিযান বিএসএনএল ক্যালকাটা টেলিফোন্স-এর ঠিকা কর্মীদের ১৬ মাসের বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এদিন যে দাবিগুলি নিয়ে যৌথমঞ্চের তরফ থেকে সিজিএম-এর দপ্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচী ও স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য হাজির হয়েছিলেন কর্মী ও প্রতিনিধিরা তা হল:
- ক্যালকাটা টেলিফোনস্-এর ৪৮৬২ জন ঠিকাকর্মীর ১৬ মাসের বকেয়া বেতন মেটানো
- নতুন এসএলএ প্রথা বাতিল
- দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে আসা সকল ঠিকা কর্মীদের কাজের ব্যবস্থা
আগে থেকে জানানো সত্ত্বেও এদিন ঠিকাকর্মীরা জমায়েত হলে টেলিফোন ভবনের দুটি গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাঁরা যাতে মাইক ব্যবহার করতে না পারেন তার জন্য ভবনের নীচের তলার বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এইসময়ে জমায়েত কর্মীরা ডালহৌসি চত্ত্বরে পথ অবরোধ করেন আধ ঘন্টা সময়। উপস্থিত হন পুলিস প্রশাসনের ব্যক্তিরা। কার্যত তাঁদের মধ্যস্থতাতেই এদিন ক্যালকাটা টেলিফোন্স-এর কর্তৃপক্ষ গেট খুলে যৌথ মঞ্চের প্রতিনিধিদের ভেতরে ঢুকতে দেন ও তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
এদিন উপস্থিত ঠিকাকর্মীদের সঙ্গে হাজির ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস্ অর্গানাইজেশন (আইএইচআরও)-এর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জন প্রতিনিধি, এই সংগঠন বেতন আটকে থাকা ও কাজ চলে যাওয়া ঠিকাকর্মীদের অধিকারের দাবিতে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু এদিনের আলোচনায় আইএইচআরও-এর কোনও প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকতে দেয়নি ক্যালকাটা টেলিফোন্স কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসাবে বলা হয়, যৌথ মঞ্চের দাখিল করা চিঠিতে তাঁদের উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ ছিল না। তাঁদের বলা হয় আলাদা চিঠি দিয়ে দেখা করতে।
আলোচনায় বসেন যৌথ মঞ্চের চারটি ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা, ক্যালকাটা টেলিফোন্স-এর সিজিএম বিশ্বজিৎ পাল, জিএম ফিনান্স, জিএমএইচআর, নর্থ ও সাউথ ডিভিশনের জিএম, সিজিএম-এর সেক্রেটারি, টেলিফোন ভবনের ডিজিএম। এদিনের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন হেয়ার স্ট্রিট থানার ওসি ও নর্থ ডিসি। যে নির্দিষ্ট বিষয়গুলি ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা তুলে ধরেন, সেগুলি ছিল – (১) এসএলএ বাতিল করা, (২) ঠিকাকর্মীদের ১৬ মাসের বকেয়া বেতন যে তারা মিটিয়ে দেবেন বলছেন তা অন্তত এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মিটিয়ে দেওয়া, (৩) গ্র্যাচুইটি দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ যে বলছে তা কন্ট্র্যাক্টদের দিতে হবে তা না বলে কোম্পানির তরফ থেকেই তা মিটিয়ে দেওয়া। আলোচনার পরে কর্তৃপক্ষ যথারীতি একটি দাবিও মেনে নেননি, ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন। এরপর তাঁরা কী করবেন, বিএসএনএলসিএলইউ-এর প্রতিনিধি ও যৌথ মঞ্চের সদস্য পাপ্পু চৌধুরি বললেন, “আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেখব কর্তৃপক্ষ কোনও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কি না। না হলে এবার আমাদের সামনে বাস্তবিকই ‘জঙ্গি’ আন্দোলন করা ছাড়া কোনও উপায়ই রইল না।” ইতিমধ্যেই যদিও কয়েকটি মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তাঁদের শান্তিপূর্ণ আলোচনা, প্রতিরোধ ও কর্মবিরতিকে কর্তৃপক্ষের ধারণা অনুযায়ী ‘জঙ্গি আন্দোলন’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের বকেয়া বেতন মেটানো নিয়ে এই অতিমারীর সময়েও টালাবাহানা চালিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই অতি তৎপর হয়ে পুরনো প্রথা অনুযায়ী জব কন্ট্র্যাক্ট লেবার-দের একজনের চুক্তি বাতিল করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অধীনে থাকা ঠিকাকর্মীদের কাজও আপাতত বাতিলই হয়ে যাচ্ছে। জানা গেল, পুরনো কন্ট্র্যাক্টদের কেউই নতুন এসএলএ-এর জন্য টেন্ডার তোলেননি, নতুন কন্ট্র্যাক্টর-রাই তা তুলেছেন, ফলে পুরনো কন্ট্র্যাক্টরদের অধীন কর্মীদের ভবিষ্যত স্বভাবতই অনিশ্চিত। এদিকে কর্তৃপক্ষ বলছে নতুন কন্ট্র্যাক্টরদের কর্মীদের কাজ করতে দিলে তবেই পুরনো কর্মীদের বকেয়া বেতন মেটানো হবে।
পুরনো ঠিকাকর্মীদের কর্মবিরতির কারণে বাস্তবে হয়তো কিছু কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, তবে দাবি আদায়ের জন্য এছাড়া আর কোনও পথ তাঁদের সামনে খোলা নেই। পাপ্পু চৌধুরি জানালেন সেদিনের আলোচনায় জিএম ফিনান্স বলেন, “আপনারা এরকম চালালে ডিপার্টমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে, আমাদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। কিভাবে বলতে পারলেন উনি এ কথা? গত ১৬ মাস ধরে আমাদের ৪৮৬২ জন কর্মী বেতন পাচ্ছেন না, ১১ জন কর্মী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের পাশেও মালিক পক্ষের কেউ দাঁড়াননি। এখনও আমাদের জব কন্ট্র্যাক্ট লেবার প্রথায় নিরাপত্তা রক্ষী, ইলেকট্রিশিয়ান-রা ডিউটি করছেন বিনা মাইনেতে। আর উনি নিজেদের এক, দেড় লাখ টাকা বেতনের কথা এখন এভাবে আমাদের বলতে পারছেন?”
কর্তৃপক্ষ যদিও পুরনো কন্ট্র্যাক্টরদের বিল জমা দেওয়ার কথা বলছেন বকেয়া বেতন মেটাতে, কিন্তু কর্মীদের দাবি ইএসআই ইত্যাদি কোম্পানি না মেটালে কন্ট্র্যাক্টর-রা বিল দেবেন কীভাবে! এক বিরাট অঙ্কের টাকা তাহলে তাদের নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়, যা আদৌ সম্ভব নয়। কর্মবিরতিতে থাকা কর্মীদের কোনও কোনও ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার অন্য কর্মীদের কাজ করতে দেওয়ার অনুরোধ করায় তাঁরা জানিয়েছেন দপ্তরের স্থায়ী কর্মীদের কেউ হলে কাজ করতেই পারেন, কিন্তু নতুন কন্ট্র্যাক্টরের কোনও কর্মীকে কাজ করতে দেওয়া হবে না। তবে পুরনো দক্ষ কর্মীদের তুলনায় স্থায়ী কর্মীরা অদক্ষ হওয়ায় তাঁদের পক্ষে কাজ সামলানো যে সম্ভব হচ্ছে না, তাও সত্যি।
এমতাবস্থায় বিএসএনএল ক্যালকাটা টেলিফোনস্ কর্তৃপক্ষ মানবিক হয়ে ও সুষ্ঠু পরিষেবার স্বার্থে ২০-২২ বছরের পুরনো কর্মীদের বকেয়া বেতন মিটিয়ে দেন না কি ঠিকাকর্মীদের আরও জোরদার আন্দোলনের পথে যেতে হয় তা সময়ই বলবে।
Also read :
বিএসএনএল (ক্যালকাটা টেলিফোনস্)-এর ঠিকা কর্মচারীদের দাবি আদায়ে তৈরি হল যৌথমঞ্চ
স্বাধীনতা দিবসে আত্মহত্যা বিএসএনএল-এর আরও এক ঠিকা কর্মীর