নজিরবিহীন রাজনৈতিক চাপান-উতোরের মধ্যে দিয়ে চলেছে শান্তিনিকেতন। আরও স্পষ্টভাবে বললে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববন্দিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ কার্যতই স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তচিন্তা, উদারবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আজ ঢেকে যাচ্ছে রাজনীতির সবুজ-গেরুয়া-লাল-নীল রঙের তরজায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ যে রাজনীতি, সমাজনীতির কথা তাঁর লেখায়, শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার ভাবনায় প্রতিফলিত করেছিলেন তা এক বৃহত্তর পরিমন্ডলে ব্যপৃত। সেখানে দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্প ঢুকে পড়া শুধু অনভিপ্রেতই নয়, ভয়ের ব্যাপার। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
দশকের পর দশক ধরে শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী যে মানবতার, সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শ তুলে ধরেছে, যার আকর্ষণে ছুটে আসেন দেশ-দেশান্তরের মানুষ, তা স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের হাতে নষ্ট হতে বসেছে। সেইজন্যই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় রবীন্দ্র আদর্শেই প্রতিরোধের জন্য ঋজু হয়ে হাত ধরছেন শান্তিনিকেতনবাসীরা।
বিশ্বভারতীর উপাচার্যের নেতৃত্বে মেলার মাঠে প্রাচীর তুলতে যাওয়া, শান্তিনিকেতনের প্রবীণ আশ্রমিক ও বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের বাধাদান ও প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়া, ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিবাদে ভূমিকা, এই পুরো ঘটনা বিজেপি ও তৃণমূলের স্বার্থ চরিতার্থের রাজনৈতিক লড়াই বলে মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে (মূলত বাংলা) প্রচার – সবটাই মোটামুটি গত ১৫ অগাস্ট থেকে এ রাজ্যের মানুষ কম-বেশি জানেন। খুব অদ্ভূতভাবে গত কয়েক দিনের এই ঘটনাপ্রবাহকে কেবলই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই বলে দেগে দেওয়ার একটা প্রয়াস চোখে পড়ছে। সেই সূত্রেই হারিয়ে যাচ্ছে শান্তিনেকতনবাসী, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রী ও রবীন্দ্র ভাবধারায় বিশ্বাসী মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ছবিটি। কেবলই তাৎক্ষণিক উত্তেজনা খুঁজতে চাওয়া হাতে-গরম সংবাদের ভিড়ে যা হওয়াটা স্বাভাবিক।
বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তিনিকেতনে গৈরিকীকরণের পালে হাওয়া লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের থেকেও গুরুত্বহীন নানা বিষয় এবং শান্তিনিকেতনের বহু বছরের পুরনো সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, প্রতিদিনের দিনযাপনের সঙ্গে যুক্ত দৈনন্দিনতাকে নষ্ট করতেই যেন তাঁর অনেক বেশি উৎসাহ। বিশেষত পড়ুয়া, অধ্যাপক, কর্মী, আশ্রমিকদের সঙ্গে কোনওরকম কথাবার্তা, আলোচনায় না যাওয়া, যে কোনও সিদ্ধান্ত নিজের মর্জি মতো নেওয়া, এমনকি বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ভেঙে সিআইএসএফ মোতায়েনের পরিকল্পনা, স্বাধীন মতপ্রকাশ বা নাগরিক অধিকারের জন্য আন্দোলনে বাধা দেওয়া, পুরনো দোকান জোর করে তুলে দেওয়া – সবকিছুতেই তাঁর গেরুয়া রাজনীতির স্পষ্ট ছাপ ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে।
কারণটি জটিল নয়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথের যে আদর্শের কথা বলে তা এক উন্মুক্ত পরিবেশে স্বাধীন চিন্তায় শিক্ষার্থী মনের বিকাশের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। সেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদির কোনও জায়গা নেই। এক বিশ্বজনীন জীবনের পাঠ পাওয়া যায় সেখানে। যা নিশ্চিতভাবেই বর্তমান কেন্দ্র সরকারের গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরিপন্থী। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে তাই কেন্দ্র সরকারের এখন উদ্দেশ্য যেনতেন প্রকারেণ রবীন্দ্রনাথের এই আদর্শ ও তা পরিস্ফূটনের কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করা। হিংসা-দ্বেষহীনতার যে পরিবেশ যেখানে গানের সুরে, কবিতার উচ্চারণে, ছবির রেখায় বা ভাস্কর্যের দৃঢ়তায় ফুটে ওঠে প্রতিরোধের স্বর তা এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ হওয়া ব্যক্তি বারেবারেই নষ্ট করে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন সাম্প্রতিক অতীতে এমন বেশ কিছু ঘটনার উদাহরণ রয়েছে।
অনেক দিনের পুঞ্জীভূত রাগের বিস্ফোরণ ঘটেছে। মেলার মাঠের প্রাচীর তাঁরা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। ফলত এবার সরাসরিই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে লড়াইটা সামনে চলে এল।
এই তালিকাতেই নতুন সংযোজন মেলার মাঠ প্রাচীর দিয়ে ঘিরতে চাওয়া, প্রবীণ শিল্পী ও আশ্রমিকদের বাড়ির সামনে বিরাট উঁচু পাঁচিল তুলতে চাওয়া (শান্তিদেব ঘোষের বাড়ির সামনে আট ফুট উঁচু পাঁচিল দেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে), পৌষমেলায় জোর করে দোকান উচ্ছেদ, পড়ুয়াদের কম খরচে খাবার ছোটখাটো দোকান তুলে দেওয়া ইত্যাদি। এবার অবশ্য শান্তিনিকেতনবাসী থেমে থাকেননি। অনেক দিনের পুঞ্জীভূত রাগের বিস্ফোরণ ঘটেছে। মেলার মাঠের প্রাচীর তাঁরা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। ফলত এবার সরাসরিই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে লড়াইটা সামনে চলে এল।
গত ১৫ অগাস্ট পাঁচিল দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন একটি ছোট মিছিল করেছিলেন স্থানীয় মানুষ ও পড়ুয়ারা। তার জবাবে দূরভাষে অধ্যাপক ও কর্মীদের জোর করে ডেকে এনে এই মহামারী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নিরাপত্তাবিধি না মেনে বিরাট মিছিল ও জমায়েত করেন উপাচার্য। সেখানেই এক প্রবীণ আশ্রমিকের হেনস্থা হওয়া ও প্রতিবাদের ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়।
মেলার মাঠ ঘিরে দেওয়ার প্রতিবাদ করায় হেনস্থার শিকার প্রবীণ আশ্রমিক। অসৌজন্যতা দেখিয়ে উপাচার্য কথা না বলে দূরে মাঠে চলে গেলেন।
Posted by আমার খবর on Saturday, 15 August 2020
এরপরেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সকলের। পরদিন ‘মেলা মাঠ বাঁচাও কমিটি’ বোলপুর, শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রচার চালায় এই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত যা সম্পূর্ণ শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বিরোধী তার বিরূদ্ধে একজোট হওয়ার জন্য। সকলের মিলিত ক্ষোভের সামনেই সেদিন ভেঙে পড়ে অর্ধনির্মিত পাঁচিল। হ্যাঁ, সেই পাঁচিল ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি শান্ত, সুসংহত ছিল না হয়তো, কিন্তু সেখানে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল।
সেদিন শান্তিনিকেতনের মানুষ প্রতিবাদে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক রঙ লাগতে দেননি। এটি কোনও দলের কুক্ষীগত বিষয় নয়। শান্তিনিকেতনের মানুষেরই ক্ষোভের প্রকাশ ছিল পাঁচিল ভেঙে দেওয়া। — ছাত্র, ফাল্গুনী পান
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্নাতকস্তরে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফাল্গুনী পান-এর সঙ্গে কথোপকথনে যেমন বারেবারেই উঠে আসছিল বিদ্যুৎ চক্রবর্তী উপাচার্য হয়ে আসার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন তথা শান্তিনিকেতন জুড়ে কীভাবে নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে উঠছে, অথচ তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কখনওই কোনও ইতিবাচক আলোচনায় আগ্রহী নন। বেতন বৃদ্ধি থেকে বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের প্রাণকেন্দ্র রতনপল্লী ঘিরে দেওয়ার মতো নানা শিক্ষার্থী-বিরোধী পদক্ষেপে তাঁর বিরূদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষ দানা বাঁধছে। ফাল্গুনী যেমন পরিষ্কার বললেন,
“বিশ্বভারতীর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কোনওভাবেই জেলখানায় পরিণত হতে দেব না আমরা। পৌষমেলায় দোকান উচ্ছেদের পরেই ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে উপাচার্যর মতবিরোধ তৈরি হয়। কিন্তু এবারে যখন পাঁচিল তোলার বিরূদ্ধে প্রতিরোধ ও ঘটনাচক্রে তা ভেঙে ফেলার ঘটনা ঘটে তখন ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও শুধু তারাই ছিলেন, এমনটা নয়। প্রচুর মানুষের জমায়েত হয় সেখানে। ব্যবসায়ী সমিতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হয়তো রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের সমর্থক। কিন্তু সেদিন শান্তিনিকেতনের মানুষ প্রতিবাদে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক রঙ লাগতে দেননি। এটি কোনও দলের কুক্ষীগত বিষয় নয়। শান্তিনিকেতনের মানুষেরই ক্ষোভের প্রকাশ ছিল পাঁচিল ভেঙে দেওয়া।”
তাঁর সঙ্গে কথা থেকেই জানা গেল প্রবীণ আশ্রমিকদের স্বাস্থ্য ভাতা ও হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা নিয়েও অনিয়ম চলছে এই উপাচার্যর আমলেই, ট্রাস্টি বোর্ড-এ তাঁদের সম্মানজনক ভূমিকা বারবারই উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিজেপি সাংসদ, অখিল ভারত বিদ্যার্থী পর্ষদের সদস্যদের বিশ্বভারতীতে নিয়ে এসে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরিতে উস্কানি দিচ্ছেন। ইডি-র এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ, আবার সিআইএসএফ আনার পরিকল্পনা চলছে কি না ভেতরে ভেতরে সবটা নিয়ে শিক্ষার্থী মহল বাস্তবিকই চিন্তিত। ফাল্গুনী জানালেন উপাচার্যের নেতৃত্বে শান্তিনেকেতন ও বিশ্বভারতীর আদর্শবিরোধী পদক্ষেপের বিরূদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলবে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ সালের প্রাক্তনী প্রিয়াঙ্কা দত্ত জানালেন বর্তমান উপাচার্যর সময় বিষয়টি লাগামছাড়া হয়ে গেলেও ২০১৩ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ছাত্র-রাজনীতি করাকালীন দেখেছেন এর আগের উপাচার্যের সময়েও পাঁচিল দিয়ে বিশ্বভারতীর সীমানা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। “তবে বর্তমানে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। গৈরিকীকরণের প্রোপাগ্যান্ডা পড়ুয়াদের উপর, বিশ্বভারতীর পলিসি তৈরির উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উপাচার্য সব কিছুকেই গ্রীণ ট্রাইব্যুনাল-এর নোটিস বলে চালাতে চাইছেন।” বক্তব্য প্রিয়াঙ্কার। বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রকল্পে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত এই প্রাক্তণী রবীন্দ্রনাথের আদর্শ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দৃশ্যতই আহত, বিশ্বভারতীতে কোনও নির্বাচিত ছাত্র সংগঠন না থাকাও যে আরও মজবুত প্রতিরোধ প্রথম থেকেই গড়ে না ওঠার একটা কারণ তেমনটাও মনে করেন তিনি। তবে তাঁর স্পষ্ট কথা –
সংবাদমাধ্যমে যেভাবে দুই রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা দখলের লড়াই হিসাবে পাঁচিল ভাঙার ঘটনাটিকে তুলে ধরা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। শান্তিনিকেতনের মানুষ সর্বদাই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করেন, এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ব্যানার, শ্লোগান নিয়ে তাঁদের প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করতে দেননি তাঁরা।
বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকে অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য জানালেন, গ্রীণ ট্রাইব্যুনাল দেখিয়ে উপাচার্য যে কাজগুলি করছেন তা অত্যন্ত অস্বচ্ছ। যা কিছু ঘটছে তার দায় উপাচার্যের উপরে বর্তায়। তিনি যখন কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা আগে থেকে স্টেকহোল্ডারদের জানানো হচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে কোনও বিপদ ঘটলে তখনই তাদের ডাকা হচ্ছে। যেমন পাঁচিল তোলার বিরূদ্ধে প্রথম জমায়েতের পর ফোন করে অধ্যাপক ও কর্মীদের ডেকে আনা হয় পাঁচিল তোলার সমর্থনে মিছিল করার জন্য। যদিও তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া সমর্থন করছেন না, কিন্তু মানুষের বহু দিনের চাপা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশকে অস্বীকারও করতে পারছেন না। অধ্যাপক ভট্টাচার্য জানালেন,
“গ্রীণ ট্রাইব্যুনাল-এ ডিমার্কশেন-এর কথা বলা হয়েছে। সেটা অস্থায়ী কোনও প্রাচীর, গাছ লাগানো যা কিছুই হতে পারত। গত দু’বছরে পঠন-পাঠন নয় যাবতীয় নন-ইস্যু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বেশি হৈ-চৈ হচ্ছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ডাকা আলোচনাতেও উপাচার্য গেলেন না, বিশ্বভারতীর কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকল না। সব পক্ষই বিষয়টির রাজনীতিকরণ ঘটাতে চাইছে, যা কাম্য নয়।”
বর্তমান উপাচার্যর অ্যাজেন্ডাই হল যেকোনওভাবে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার বিরোধীতা করা। কারণ তাঁর সবটুকুই বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের পরিপন্থী। — শিক্ষক ও সমাজকর্মী মণীষা ব্যানার্জী
শান্তিনিকতনের পরিবেশে গত কয়েক বছর ধরেই আমূল বদল আসছে। কর্পোরেটদের নজর পড়েছে এই মুক্তাঞ্চলে। কংক্রিটে মুড়ে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে বহুদিন, নির্বিচারে গাছ কাটা চলছে। খোয়াই হাটেও প্রাণের টানের থেকে বাণিজ্যিকিকরণের বাড়-বাড়ন্ত চোখে লাগে। এই পরিবর্তন এক দিনে যেমন হয়নি, তেমনি বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশ্বভারতীর উপাচার্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। শিক্ষক ও সমাজকর্মী মণীষা ব্যানার্জীর মতে নির্মাণকাজে সব উপাচার্যদেরই কম-বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। বিশ্বভারতীর জমি দখলে রাখার জন্য তাঁদের উৎসাহ বরাবরের। এই পাঁচিল তোলার বিষয়টি নিয়ে শান্তিনিকেতনবাসী ও বিশ্বভারতীর পড়ুয়ারা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। “বর্তমান উপাচার্যর অ্যাজেন্ডাই হল যেকোনওভাবে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার বিরোধীতা করা। কারণ তাঁর সবটুকুই বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের পরিপন্থী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, অথচ কোনও রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনকার উপাচার্য পড়ুয়াদের সঙ্গে আলোচনাও করেন না। ফি বাড়ানো নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই ওঁনার অথচ সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ, দোকান ভেঙে দেওয়া, মেলা বন্ধ করতে চাওয়া এইসবই ওঁনার নির্দেশে হচ্ছে। প্রবীণ আশ্রমিকেরা অনেকেই ওঁনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, ঔদ্ধত্য দেখিয়ে তিনি কোনও কথা বলেননি কখনও,” জানালেন মণীষা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন বোলপুর ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা পাঁচিল তৈরির কাজে নিযুক্ত তাদের কন্ট্রাক্টরকে মেরেছে, তার প্রতিবাদে অধ্যাপক, কর্মীদের মিছিলে অংশ নিতে আসতে হবে। মহামারী চলাকালিন সময়ে এরকম নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদৌ দিতে পারে কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কদর্য রাজনীতির খেলা শুরু হয়ে গেছে। তবে মণীষা যেমন বললেন, “বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন আর পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থেকে আলাদা। এটার সঙ্গে মানুষের স্বপ্ন, কল্পনা, আদর্শ মিশে আছে। তা ধ্বংস করতে একটা ভয়ের আবহ তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু অচলায়তন ভাঙার সময় হয়ে গেছে। মানুষের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা থামবে না।”
১৮৯৪ সালে রবীন্দ্রনাথ পৌষমেলা শুরু করেছিলেন। সে সময়ে তিনি দেখেছিলেন সেখানে হিন্দুদের দু’টি মেলা, মুসলমানদের একটি মেলা হয়। কিন্তু এই তিনটিই তো ধর্মীয় মেলা! তাই তিনি চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ মেলা শুরু করতে, যার ফলশ্রুতি শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা। অথচ এখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য এসেই পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব সেগুলির অসাম্প্রদায়িক রূপটি বদলাতে চাইলেন। এগুলিকে কেন্দ্র করে যে বিভেদ-বৈষম্যহীন সৌভ্রাতৃত্বের পরিবেশ তৈরি হয় তা বন্ধ করতে চাইলেন। তিনি যেন চাইছেন এই উৎসবগুলিতে মানুষের অংশগ্রহণ কমতে থাকুক। সেইজন্যই মেলার মাঠ স্থায়ী পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার উদ্যোগ, বিশ্ববিদ্যালয়কে জেলখানা বানিয়ে দিলে বাইরের লোক আর আসবে না। প্রবীণ গণআন্দোলনের কর্মী শৈলেন মিশ্র-র কথায় এই উপাচার্য “মানুষ বিরোধী, মানুষ পছন্দ করেন না”। এখন উপাচার্যের কর্মী-অধ্যাপক-শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী চেহারাটিও প্রকাশ হয়ে গেছে। “বিজেপির গোপন কর্মসূচী হল হিন্দু ফ্যাসিস্ত সরকার গঠন করা, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান-এর আদর্শ সমানে প্রচার করে যাওয়া। সেই লক্ষ্যে সরকারি বক্তব্য নির্লজ্জভাবে পড়ুয়াদের কাছে তুলে ধরছেন উপাচার্য। বলছেন শিক্ষামূলক আলোচনা। তাহলে তো একতরফা নয় সকলের বক্তব্য নিয়েই আলোচনা হবে। উনি কারওর কথা শুনছেন না। সম্পূর্ণ স্বৈরতন্ত্রী আচরণ। যা হয়েছে তা জনরোষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এখন একটা থমথমে আবহাওয়া। পাঁচিল তোলার কাজ যেমন বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ। পুলিস জড়িয়ে পড়েছে। ইডি এসেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীও মোতায়েন হতে পারে। আর সংবাদমাধ্যম এটাকে রাজনীতির কাদা ছোঁড়াছুড়ি বলে দেখাচ্ছে। এতজন মানুষ, শান্তিনিকেতনের মানুষ তাঁদের রাগ-দুঃখ-প্রতিবাদটা পেছনে চলে যাচ্ছে, চাপা পড়ে যাচ্ছে। আন্দোলনকারীরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আদর্শেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেন”, দৃঢ় কন্ঠে বললেন শৈলেন মিশ্র।
গত ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে উপাচার্যর নানা স্থূল মন্তব্য ও আচরণ উপস্থিত সকলকেই অত্যন্ত বিস্মিত ও বিরক্ত করেছিল। বিশ্বভারতীর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকেও ধীরে ধীরে নষ্ট করার চেষ্টা চলছে। বিষয়টি শুধু আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দু’টি রাজনৈতিক দলের আখের গোছানোর লড়াই নয়। একজন মানুষ যিনি সমাজ, জীবন, রাজনীতি, সংস্কৃতিকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন এবং একটা গোটা জীবন দিয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক বিশ্বজনীন এক শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র তৈরিতে তাকে আজ ধর্মীয় গোঁড়ামি, হিংসা, দ্বেষ, টাকার খেলা, সংকীর্ণ রাজনীতির পাঁকে টেনে নামানোর অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু শান্তিনিকেতন আসলে মানুষের, বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থীদের। যাবতীয় দলীয় রাজনীতির দড়ি টানাটানির বাইরে বেরিয়ে ঐ দীর্ঘকায় মানুষটির সময় অতিক্রম করা ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাঁরাই বলতে পারেন – “বাঁধ ভেঙে দাও….ভাঙো।”
সুন্দর প্রতিবেদন। অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।