১৫ অগাস্ট ভারতের স্বাধীনতা উদ্যাপনের দিন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন বিএসএনএল-এর পশ্চিমবঙ্গে ক্যালকাটা টেলিফোনস্-এর ঠিকা কর্মী চঞ্চল দাশগুপ্ত। কারণ এই মুহূর্তে আরও ৪৮০০ জন ঠিকা কর্মীর মতোই তিনিও এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না। মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরেই এই পথ তিনি বেছে নিয়েছেন বলে পরিবার ও সহকর্মীদের দাবি। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
হাতে গুনে পাঁচ দিন। ১০ অগাস্ট ভারতীয় জনতা পার্টির উত্তর কর্ণাটকের কামতা লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজয়ী সাংসদ সেখানকার এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল)-এর কর্মীদের বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহী বলে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখলেন, প্রায় হুমকির মতো করে বললেন যে কিভাবে কেন্দ্র সরকার এই সংস্থাকে সম্পূর্ণ তুলে দিয়ে, আনুমানিক ৮৮ হাজার কর্মীকে খুবই তাড়াতাড়ি চাকরিহীন করে পুরোপুরি বেসরকারিকরণ করতে চলেছে। আর ঠিক পাঁচ দিন পরে ১৫ অগাস্ট ভারতের স্বাধীনতা উদ্যাপনের দিন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন বিএসএনএল-এর পশ্চিমবঙ্গে ক্যালকাটা টেলিফোনস্-এর ঠিকা কর্মী চঞ্চল দাশগুপ্ত। কারণ এই মুহূর্তে আরও ৪৮০০ জন ঠিকা কর্মীর মতোই তিনিও এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না। মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরেই এই পথ তিনি বেছে নিয়েছেন বলে পরিবার ও সহকর্মীদের দাবি।
ঘটনার এক দিন পরে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় মানিকতলা এক্সচেঞ্চ-এ কর্মরত চঞ্চল দাশগুপ্তর পরিবারের সঙ্গে। তাঁর পরিবারে রয়েছেন বয়স্ক মা, স্ত্রী ও নবম শ্রেণীতে পাঠরতা চোদ্দ বছরের কন্যা। এই পরিবার এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে এসে দাঁড়াল। অবশ্য চঞ্চলকে নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে ক্যালকাটা টেলিফোনস্-এর প্রায় ১১ থেকে ১২ জন ঠিকা কর্মী আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। যদিও কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ উদাসীন। উচ্চপদস্থ আধিকারীকদের তরফ থেকে কোনও রকম মানবিক পদক্ষেপ এ ধরনের ঘটনাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে একবারও নিতে দেখেননি চূড়ান্ত আর্থিক অনটন ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটানো এই ঠিকা শ্রমিকেরা।
চঞ্চল দাশগুপ্তর পরিবারের তরফ থেকে জানানো হয় তারা অনুমান করতে পারেননি তিনি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাঁর অধীনে প্রায় ৪০, ৫০ জন কর্মী কাজ করতেন। নিজের পাশাপাশি তাঁদের বেতন না পাওয়া নিয়েও তিনি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। তাঁর ১৪ হাজার টাকা মাসিক বেতন গত ১৩ মাস ধরে বকেয়া ছিল। তাছাড়া অফিসেও তাঁর উচ্চ পদস্থ কেউ কেউ তাঁর উপরে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতেন বলেও পরিবার সূত্রে বলা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি একটি সুইসাইড নোট রেখে গেছেন যা আপতত পুলিসের হেফাজতে। তবে প্রাথমিক শোক কাটিয়ে উঠে তাঁর মৃত্যুর তদন্ত চালিয়ে যাবেন বলেই পরিবারের তরফ থেকে জানানো হয়।
ক্যালকাটা টেলিফোনস্-এর সাউথ ডিভিশন-এর মূল অফিস বালিগঞ্জ শাখায় কর্মরত ঠিকা কর্মী অজিত কুমার দাশ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, বললেন, “খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। পরপর এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে অথচ কেউ কর্ণপাত করছে না। বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ, সরকার কারওরই কোনও হেলদোল নেই। তারা যে আমাদের সঙ্গে কী করতে চাইছেন আমাদের আর বোধগম্য হচ্ছে না।”
তিনি কোনওরকম রাখঢাক না করেই অভিযোগ জানালেন এই সবটাই হচ্ছে ক্যালকাটা টেলিফোনস্-এর বর্তমান সিজিএম-এর অঙ্গুলিহেলনে। বিএসএনএল-এর দিল্লীর কর্পোরেট অফিস সব তথ্য পাচ্ছে কি না সে বিষয়েও তিনি সন্দেহ প্রকাশ করলেন। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন যে ২০০১-’০২ সালে বর্তমান সিজিএম যখন সাউথ ডিভিশন-এর এরিয়া ম্যানেজার হিসাবে প্রথম কাজে যোগ দেন তখনই তিনি ঠিকা কর্মীদের মজুরি ২৭০০/২৮০০ টাকা থেকে কমিয়ে ১২০০/১৩০০ টাকা করে দেন। অথচ এই ঠিকা কর্মীরা প্রথম থেকেই স্থায়ী কর্মীদের মতো তো বটেই অনেক ক্ষেত্রেই তাদের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রমও করে থাকেন। “তৃণমূল স্তরের কর্মীদের শোষন করে উনি যেন কি এক মজা পান! আসলে ওনাদের চাকরি তো সুনিশ্চিত। বিএসএনএল-এর চাকরি গেলেও অন্য যেকোনও কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি পেয়ে যাবেন। নিজের পদোন্নতি ঘটাতে চান যেকোনওভাবে। আর এদিকে আমাদের সহকর্মীরা এভাবে নিজেদের শেষ করে দিচ্ছেন। আমাদের প্রত্যেকেরই এক অবস্থা, কে কার পাশে দাঁড়াব? তবু সাংগঠনিকভাবে এরকম বিপদ ঘটলে যতটা পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো যায় আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি,” ক্ষোভ, কষ্ট মিশে যায় অজিত দাশের গলায়।
কথা হচ্ছিল ক্যালকাটা টেলিফোনস্-এর ঠিকা কর্মীদের একটি ইউনিয়নের প্রাক্তন সহ-সম্পাদক ও ঠিকা কর্মী বীরেন সমাদ্দারের সঙ্গে। প্রায় একই অভিযোগ উঠে এল তাঁর বক্তব্যেও। জানালেন কেউ ১৩ মাস, কেউ ১৬ মাস কোনও রকম বেতন পাননি ক্যালকাটা টেলিফোনস্ থেকে। শেষ বেতন পেয়েছেন ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে। তারপর থেকে টানা ডিউটি করে গেলেও কোনও ঠিকা কর্মীর বকেয়া বেতনের কোনওরকম অংশই মেটানো হয়নি। “সিজিএম শুধু পরপর নতুন নতুন নোটিস পাঠিয়ে যাচ্ছেন। কখনও ২৬ দিনের বদলে ২০ দিন, কখনও ১৩ দিন কাজ দেওয়া হবে ঠিকা কর্মীদের। কখনও পুরনো কন্ট্রাক্টরদের বসিয়ে নতুন কন্ট্রাক্টরদের নিয়ে আসা হচ্ছে। অথচ পুরনো কন্ট্রাক্টর, তাঁদের অধীন ঠিকা কর্মীদের বকেয়া পাওনা মেটানো নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। আমাদের ইএসআই পুরোপুরি বন্ধ। সিজিএম শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে আর একটাই কথা দিল্লী টাকা পাঠাচ্ছে না। আমরা কিন্তু এর সত্যি-মিথ্যে কিছুই জানতে পারছি না। ৪৮০০ জন ঠিকা কর্মীর যদি ধরে নেওয়া হয় পরিবার পিছু ন্যূনতম ৪ জন করেও সদস্য আছেন, তাহলেও দেখা যাবে যে প্রায় ২০,০০০ মানুষ এতদিন ধরে প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন,” জানালেন তিনি।
ইতিমধ্যেই ঠিকা কর্মীরা বকেয়া পাওনা আদায়ের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। তিন মাসের বকেয়া মেটানোর কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু কোর্ট থেকে জানানো হয় সব কর্মীর নামে আলাদা করে হলফনামা পেশ করতে হবে। আপাতত প্রাথমিক স্তরে ৫০০ জন কর্মীর নামে হলফনামা পেশ করা হয়েছে, আশা করা হচ্ছে আগামী কিছু দিনের মধ্যেই হাইকোর্টে রায় প্রকাশ পাবে। ইতিমধ্যে কন্ট্রাক্টররাও কোনওরকম বকেয়া টাকা না পাওয়ায় কেস করার কথা ভাবছেন। উচ্চপদস্থ সমস্ত আধিকারিক, কর্তৃপক্ষ ও সব অফিসে অভিযোগ জানিয়েও কোনও সুরাহা না হওয়ায় কর্মীরা ঘেরাও, রিলে অনশন, আন্দোলন চালিয়েছেন। কোনও ফল হয়নি। বরং প্রশাসনের সাহায্যে প্রতিবারই আধিকারিকেরা তা তুলে দিয়েছেন, নিজেরা রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। হাইকোর্ট-এ সুফল না পেলে তারা সুপ্রিম কোর্ট অবধি যেতেও রাজি।
বীরেন সমাদ্দার যেমন বলছিলেন, “এক সহকর্মী আগের দিন রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে… । পরের দিন হার্ট অ্যাটাক-এ মারা গেলেন। আমরা জানি দুশ্চিন্তা থেকেই এই মৃত্যু। এর দায় কর্তৃপক্ষ নেবে?”
গণমাধ্যমের ভূমিকাতেও এই কর্মীরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে কোনওভাবেই তাঁদের এই দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কথা আসছে না, যেটুকু খবর হচ্ছে তা কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের ভিত্তিতে একপেশে খবর।
কেন্দ্র সরকার যখন করোনা পরিস্থিতিতে কোথাও কোনও কর্মীর বেতন বাকি রাখা যাবে না বলে ঘোষনা করেছে, তখন কীভাবে তাঁদের এক বছরেরও বেশি সময়ের বেতন আটকে রাখা হচ্ছে, এই জরুরি পরিস্থিতির অর্থনৈতিক সঙ্কট অনুধাবন করেও কর্তৃপক্ষ কেন তা মেটাচ্ছে না সেই প্রশ্ন তুললেন কর্মীরা।
Also read : একটি শ্রমিক আত্মহত্যা ও দেশে চলতে থাকা লকডাউন
ei sarkar bsnl ke bhate aar hate marche !! Nirlajjya bhabe eder mantri aar mla mp ra bsnl er kormee der galagal korche !! Samabeto protibad haoa uchit er biruddhe !! Ekta fascist sarkar ke ashane bosiyeche jara vote diye…tara ki bhujte parche ??