কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার উদ্দাম মাত্রাহীন বেসরকারিকরণের পথ গ্রহণ করেছে। একের পর এক সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে কর্পোরেট হাঙরের গ্রাসে তুলে দিচ্ছে। রেল বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে বিজেপি সরকার। শ্রম আইন সংশোধন করে মজুরি সংকোচন, বিলগ্নিকরণ, বেপরোয়া বেসরকারিকরণ – শ্রমজীবী জনবিরোধী একের পর এক কর্মসূচির আগ্রাসী নীতি নিয়েই চলেছে মোদী সরকার। পাশাপাশি সরকার কয়লাশিল্পে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগেরও (FDI)ছাড়পত্র দিয়েছে। লিখেছেন নীলমণি ধর ।
দেশের ৫০০টি কোল ব্লক বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া, কোল ইন্ডিয়াকে সিএমপিডিআই থেকে আলাদা করা এবং কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ বিলগ্নিকরণ, কয়লাশিল্পে বাণিজ্যকরণ তৎসহ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অবিলম্বে ৪১টি কোল ব্লক নিলামের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কয়লাশিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের ধর্মঘটে যেতে বাধ্য করে। কয়লাশিল্পে এই বাণিজ্যকরণের প্রতিবাদে ইতিপূর্বে কর্মীরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন, কিন্তু সরকার ছিল অনড়।
১৮ জুন সমস্ত প্রতিবাদ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী দেশের ৪১টি কয়লা ব্লক নিলামে চড়িয়েছেন ‘দি মিনারেল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ ব্যবহার করে। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১৫ সালে কয়লাখনি বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে আইন এনেছিল ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট ২০১৫’। ১৯৭২ এবং ৭৩ সালে দুই দফায় কয়লাখনি জাতীয়করণ হয়েছিল যে আইনে, সেই আইনকেই অকেজো করে দেওয়া হল। স্মর্তব্য, তৃণমূল কংগ্রেস এই আইনের বিরোধিতা করেনি। ঐ ১৮ জুনই কয়লা শিল্পের ‘যুক্ত-মঞ্চ’ ২-৪ জুলাই ধর্মঘটের নোটিশ দেয়। এই প্রস্তাবিত ধর্মঘট সমর্থন করে প্রায় সব কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন যথা এআইটিইউসি, সিটু, আইএনটিইউসি, ইউটিইউসি, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, সেবা, এইচএমএস এমন কি আরএসএসের ট্রেড ইউনিয়ন বিএমএসও ; ব্যাতিক্রমী বিরোধিতা তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন আইএনটিটিইউসি’র।
এই ৪১ টি ব্লকের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ লক্ষ হেক্টর জমি ‘নো গো’ এরিয়ার অর্থাৎ গভীর বনাঞ্চলের অন্তর্গত।’নো গো’ এলাকা মানে সেখানে আছে সমৃদ্ধ জীব বৈচিত্র্য, গভীর বনাঞ্চল আর বিভিন্ন নদী-উপনদীদের অজস্র জলধারা। এর মধ্যে ১১ টি মধ্যপ্রদেশ, ৯ টি করে ব্লক ছত্রিশগড়, ওড়িশা আর ঝাড়খন্ডে আর ৩ টি মহারাষ্ট্রে। মোদীর সঙ্গেই ই-অকশনে শামিল ছিলেন টাটা সনস্’র চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখরণ, বেদান্ত গ্রুপের অনিল আগরওয়াল। আর খরিদ্দার হিসেবে ছুটে এসেছে টাটা, বেদান্ত, আদানি, জিন্দাল, হিন্ডালকো, জে এস ডব্লিউ থেকে বি এই পি, রিও টিন্টো, বিলিটন পিবডি’র মত বিদেশী গ্রুপ।
কয়লা ব্লকের নিলামের বিরুদ্ধে ছত্রিশগড়ের হাসদেও বনাঞ্চলের ২০ টি গ্রাম চিঠি লিখেছে মোদীকে। ছত্রিশগড় সরকারও নারাজ। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেণ মামলা দায়ের করেছেন সুপ্রিম কোর্টে অকশন বাতিলের দাবিতে। আপত্তি মহারাষ্ট্র সরকারেরও। কমার্শিয়াল মাইনিং নিয়ে আপত্তি অধিকাংশ রাজ্য সরকারেরই। শ্রমিকদের যুক্তমঞ্চ দীর্ঘদিন ধরেই কমার্শিয়াল মাইনিং-এর তীব্র বিরোধিতা করছে এবং ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রতিবাদি কর্মসূচি হয়েছে।
১ জুলাই কয়লামন্ত্রী সপার্ষদ ধর্মঘট আহ্বানকারী যুক্ত মোর্চার সঙ্গে এক ভার্চুয়াল মিটিং-এ ধর্মঘট তুলে নেওয়ার আবেদন করেন। তিনি বলেন, দেশে কয়লার চাহিদা পূরণ করার জন্য, আমদানি কম করার জন্য কমার্শিয়াল মাইনিং-এর নীতি নেওয়া হয়েছে। একযোগে শ্রমিক সংগঠনগুলি জানিয়ে দিয়েছে: “কমার্শিয়াল মাইনিং ওয়াপস লো”। তাঁদের বক্তব্য: বেসরকারি মালিকদের দিয়ে দেশের কয়লার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এটা প্রমাণিত সত্য। ২০১৫ থেকে আজ অবধি ১১২টি কোল ব্লক বেসরকারি সংস্থাকে বন্টণ করা হয়েছে। ক্যাপটিভ মাইনসের নামেই এই ব্লকগুলি দেওয়া হয়েছিল। উৎপাদিত কয়লার ২৫ শতাংশ মালিকরা বিক্রি করতে পারবে বলা হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত সবগুলি কোল ব্লকের উৎপাদন প্রায় ৩৫ মিলিয়ন টন। অন্যদিকে চলতি বছরে (২০১৯-২০) একাই সিআইএল উৎপাদন করেছে ৬০৪ মিলিয়ন টন। কয়লা উৎপাদনে প্রায় ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা সিআইএল-এর। আর এমন এমন সংস্থাই বন্ধ করে দিতে চাইছে বিজেপি সরকার।
কয়লা শ্রমিকদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে, বেসরকারি মালিকানায় কি নিদারুণ বিপদসঙ্কুল পরিবেশে তাঁদের পূর্বসূরীদের কাজ করতে হয়েছিল। মোদী সরকার ব্যাপক বেসরকারিকরণের মাধ্যমে সেই ভয়াবহ দিনগুলিই ফিরিয়ে আনতে চাইছে। কেমন ক্রীতদাসের জীবন ছিল কয়লা শ্রমিকের। ক্রীতদাসত্বের সেই অন্ধকার যুগে প্রত্যাবর্তন রুখতে ২ জুলাই থেকে তিনদিনের ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত ছিল কয়লা শ্রমিকদের। ঠিক সেই কারণেই বিজেপির গত ছ’বছরের শাসনে শ্রমিকশ্রেণির উপর নিরন্তর আঘাত নামা সত্ত্বেও যারা টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, বরং শ্রমিকদের যেকোনপ প্রতিবাদী কর্মসূচির বিরোধিতায় নেমেছে, সেই বিএমএসকেও এই ধর্মঘটে যোগ দিতে হয়েছে। শুধুমাত্র সংগঠনের মধ্যকার শ্রমিকদের প্রচণ্ড চাপ সামলাতেই ধর্মঘটে অংশ নিতে বাধ্য হয় ভারতীয় মজদুর সংঘ।
জুলাইয়ের শুরুতে তিনদিনের জন্য সারা দেশ জুড়ে কয়লা শিল্পের এই ধর্মঘট ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। পশ্চিমবঙ্গের কয়লাখনি অঞ্চলে তৃণমূল সরকার ও তার পুলিশ, মালিকপক্ষ কেন্দ্রীয় সরকার ও দালাল বাহিনী এবং তৃণমলের ইউনিয়ন আইএনটিটিইউসি ও গুন্ডাবাহিনী একযোগে ধর্মঘট ভাঙ্গার জন্য বিভিন্ন কয়লাখনিতে শ্রমিকদের উপর শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত নামিয়ে আনে। সমস্ত প্ররোচনা ও আক্রমণ প্রতিরোধ করে শ্রমিকদের ধর্মঘট সফল হয়।
সারাদেশব্যাপী সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের সার্বিক আক্রমণ এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের যেকোন আন্দোলনের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের বৈরিতা ও বিরোধিতার আবহে এই আন্দোলন ছিল শ্রমজীবী মানুষের মস্ত চ্যালেঞ্জ। তথাকথিত ‘ভার্চুয়াল আন্দোলন’ নয়, এ ছিল ‘রিয়াল আন্দোলন’। প্রথমে ১১ জুন ৪১টি কোল ব্লক নিলামের দিন স্থির করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ১০-১১ জুন বিরোধ এবং কালা দিবস পালিত হয়েছে কয়লা অঞ্চলে। দেশের কয়লা অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারের কুশপুতুল পুড়েছে। নিলামের দিন পিছোতে হয়েছিল সরকারকে। ১৮ জুন প্রধানমন্ত্রী নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ঐ দিনই কোল ইন্ডিয়ার সব সাবসিডিয়ারিতে ধর্মঘটের নোটিশ দেয়া হয়েছিল।
কয়লা অঞ্চল বলছে: “বিজেপি কর্পোরেট কা দালাল হ্যায়। বাপ-দাদা কা সম্পদ বেচকে খানেওয়ালা বিগড়া হুয়া বেটা হায় মোদী সরকার। আত্মনির্ভরতা, স্বনির্ভরতা এক জুমলা হ্যায়।”
ধর্মঘটের নোটিসের পাশাপাশি দেশের কয়লা অঞ্চল ধর্মঘট প্রচারে উত্তাল হয়ে ওঠে। ইসিএল, বিসিসিএল, সিসিএল, এনসিএল, ডাব্লুসিএল, এসইসিএল, এসসিসিএল, এমসিএল সহ সর্বত্র ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার তোলা হয়। কয়লা সমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, ছত্রিশগড়, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের ভূমি কয়লা ধর্মঘটের সমর্থনে উত্তাল হয়ে ওঠে। জোটবদ্ধ কয়লাশ্রমিক আন্দোলনের ডাকে পাঁচ লক্ষ ৩০ হাজার কয়লা শ্রমিকের ব্যাপকতম অংশ গ্রহণও ছিল এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য।
এখানে একটা বিষয় সামনে আসে। কয়লা ভারতে শক্তি উৎপাদনের একটা গরুত্বপূর্ণ উৎস, যেখান থেকে আসে মোট উৎপাদিত ৩,৭০,৩৪৮ মেগাওয়াট শক্তির প্রায় ৭২ শতাংশই। গত বছর দেশে কয়লার চাহিদা ছিল ৯৭.৬০ কোটি মেট্রিক টন, আর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কোল ইন্ডিয়া লি: উৎপাদন করেছিল ৭২.৯১ মেট্রিক টন। পরিবেশগত সাবধনতা বজায় রেখে এই উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ সরকারি উদ্যোগেই সম্ভব। যথার্থ পরিকল্পনা সহ এই উৎপাদন বৃদ্ধি কোল ইন্ডিয়ার পক্ষে করাই সহজ হবে। সরকারের ঝোঁক দেওয়া উচিত সেদিকেই।
অথচ ২-৪ জুলাই সর্বাত্মক ধর্মঘটের উপর দাঁড়িয়ে সরকারের পিছিয়ে আসার কোন লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। ১৮ অগাস্ট আবার প্রধানমন্ত্রী নিলামের আয়োজন করছেন। প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসহ যুক্তমঞ্চ আবার ১৮ আগস্ট কয়লা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, ১ অগাস্ট তারা একযোগে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নোটিশ দিয়েছে। ঐ দিনই কয়লামন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী রাঁচিতে এসেছিলেন। বৈঠকে বসার জন্য তিনি শ্রমিক সংগঠনগুলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শ্রমিকসংগঠনগুলি একযোগে বলেছে “আগে কমার্শিয়াল মাইনিং প্রত্যাহার করো, তারপরে বৈঠক।” মন্ত্রীর বৈঠক বয়কট করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। সর্বত্র খনিমুখে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে ধর্মঘটের।
পরিবেশগত বিষয়
কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য বিষয় জড়িত। সেটা হচ্ছে কয়লা উত্তোলনজনিত কারণে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্ন। কয়লা উত্তোলন, বিশেষ করে খোলামুখ খনি পরিবেশের অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। স্থানিক আবহাওয়ায় পরিবর্তন সহ বনাঞ্চল অনেক সময়েই নষ্ট হয়। উপরের আস্তরণ অপসারণ করে কয়লা উত্তোলনের ফলে কৃত্রিম খাদ ও পাহাড়প্রমাণ স্তুপ তৈরি হয়, আবহাওয়ায় ধূলিকণার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে। অনেক সময় বসতি অঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শক্তি উৎপাদনে কয়লা জ্বালাবার ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
অপর দিকে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে জল, বায়ু, সূর্যালোক, ঢেউ প্রভৃতি অচিরাচরিত সূত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ দেশের প্রয়োজনের তুলনায় এখনও ক্ষীণ। অচিরাচরিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ বৃদ্ধিতে সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক এবং দৃঢ পরিবেশ সংরক্ষণ পদ্ধতিতে প্রকৃষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া গ্রহণ এবং খননযোগ্য খনি নির্বাচনে যথার্থ পরিবেশগত নিরীক্ষা ও ব্যাপক সাবধানতার মধ্যেই পরিবেশের এই ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। ব্যবসায়িক লোভ নিবৃত্তি এবং তীব্র সদিচ্ছার দ্বারাই কেবল পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা সংহত রাখা যায়। বেসরকারিকরণের মাধ্যমে সে কাজ করা যাবে না। বরং প্রকৃষ্ট সরকারি দায়িত্বে সেই কাজ অনেকটাই সফল হওয়া সম্ভব।
সংযোজনী ১১/৮/২০২০
কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবিত ১৮ অগাস্টের কোলব্লক নিলামের তারিখ দু’মাস পিছিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষিতে কয়লা শিল্পের যুক্তমঞ্চ প্রস্তাবিত ধর্মঘট স্থগিত রেখেছে।
[রচনাটিতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে : পত্রিকা: গণশক্তি, এই সময়। ফেসবুক রচনা: যৌথ রচনা – জয়া মিত্র, অর্ক রাজপন্ডিত ও মনিদীপা ব্যানার্জি; চিত্তরঞ্জন দাশ; লেখকের দুটি লেখা এবং ইউটিইউসির অশোক ঘোষের সঙ্গে আলোচনা ।]
- নীলমণি ধর অবসরপ্রাপ্ত সরকারী বাস্তুকার।