ইআইএ খসড়া ২০২০: একটি রাজনৈতিক মূল্যায়ন


  • July 31, 2020
  • (0 Comments)
  • 2611 Views

দীর্ঘদিনের জনস্বার্থবাহী আইন ইত্যাদিকে কর্পোরেট স্বার্থে খোলাখুলি বদলে দেওয়া, আমূল পালটে দেওয়ার মত কাজ করার রাজনৈতিক সামর্থ্য কংগ্রেসিদের বা জোট সঙ্গী বামেদের, সমাজবাদীদের নেই। পুঁজির পক্ষে একটা ছোট সংস্কার করতেও এরা দীর্ঘদিন লাগিয়ে দেয়। এখানেই মোদি-শাহ’এর ফ্যাসিস্ট রাজের সুবিধা। এক ধাক্কায় যা যা করার সব করে দিচ্ছে। গোটা খেলাটাই বদলে যাচ্ছে। নিয়ম বদলে দিচ্ছে, সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছে, মানে বদলে দিচ্ছে। আলাদা করে দেখলে সত্যিই ইআইএ প্রক্রিয়ার কোনো গুরুত্ব নেই। এটা চিরকালই রাষ্ট্রের বানানো একটি প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্র চিরকাল নিজের মতো একে যেমনতেমন করেছে। আমরা ইআইএ খসড়ার বিরোধিতা করবো কিন্তু কখনোই এই বিশ্বাস থেকে করব না যে ইআইএ করে পরিবেশ বাঁচানো যায়। ইআইএ এমন একটি জটিল প্রক্রিয়া যে তা দেশের অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। ইআইএ বুঝতে গেলে তাই দরকার পড়ে শহুরে বাবুদের, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের, প্রশিক্ষিত এনজিওদের। এদেশে পরিবেশ-প্রকৃতি বিষয়ক যে সব আইন সরাসরি আমজনগণ, গোষ্ঠীবাসীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে তা অরণ্যের অধিকার আইন ২০০৬ আর পেসা ১৯৯৬। এই দুই আইনে অরণ্য এলাকায় যে কোনও প্রকল্প নিয়ে ওই এলাকার গ্রামবাসী মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আছে। মোদি-শাহ সরকারের অরণ্য আইনের নতুন বিধিতে তাই সরাসরি এই আইনকে খারিজ করে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। ইআইএ-এর ক্ষেত্রেও দেখা যাবে তাই জন-অংশগ্রহণকে কমানোর চেষ্টা। আমাদের এই সামগ্রিক অবস্থাটার ওপর দাঁড়িয়ে ইআইএ খসড়ার বিরোধিতা করতে হবে। বুঝতে হবে, এটা একটা অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির, সে রাজনীতির সঙ্গে নিওলিবারেল অর্থনীতির নির্লজ্জ সমঝোতার অংশ। গোটা ভারতববর্ষে কর্পোরেটদের/পুঁজির অবাধ প্রবেশের জন্য সব কিছু বদলে ফেলা হচ্ছে। ইআইএ-র ওপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র, স্বশাসন, পরিবেশ ও প্রাণব্যবস্থার ওপর সার্বিক আক্রমণের বড় ছবিকে বুঝে নিতে হবে।লিখছেন নন্দন মিত্র। 

 

 

 শুরুর কথা

 

ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় একটা খুব নির্দিষ্ট চরিত্রায়ন আছে। অনেকে নির্ধারকভাবে সেই চরিত্র দিয়ে ফ্যাসিবাদকে বুঝতে চান না, তার অন্য নানাবিধ কারণ আছে। তবে সেই চরিত্রায়নটি হল, ফ্যাসিবাদ আসলে পুঁজিবাদেরই আরেকটা রূপ। পুঁজিবাদের একটা শর্টটার্ম কোর্স। অনেকটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মতো। এমনিতে ভদ্দরলোক টেস্ট ক্রিকেট জমানা, মানে যাকে প্রগতিশীল পুঁজিবাদ বলা হত, ওয়ান-ডে জমানা মানে এই ধরুন বিংশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ ছেড়ে, বহুদিনই টি-টোয়েন্টি তে ঢুকে পড়েছে। তবে বিগত তিরিশ বছরে পুঁজিবাদের মূল চরিত্র টি-টোয়েন্টিই। (তার ফলে এখনো পুঁজিবাদের প্রগতিশীল ভদ্দরলোক যাঁরা এ খেলায় খেলোয়াড়ি স্পিরিট খুঁজে পান, তাঁরা নিশ্চয়ই নমস্য।  অথবা এসব বলে ফাটকা টি-টোয়েন্টিতে রাজনৈতিক কারেন্সি কামানোর ধান্দা আছে)। যত কম সময়ে মুনাফা যতগুণ বাড়িয়ে নেওয়া যায়, তাতেই মঙ্গল। প্রথম থেকে শেষ ওভার অবধি ব্যাট চালাতে হবে। এখন এখানেই আসল খেলা। ব্যাট চালাব বললেই তো আর চালানো যায় না। বল সহজেই ব্যাটের গোড়াতেই আসবে এর কি গ্যারান্টি আছে! অতএব, পিচটাকে যথোপযোগী পাটা উইকেট ক’রে নিতে হবে, যাতে বেশি স্পিন, স্যুইং, স্লোয়ার, দুসরা এসব এসে বিভ্রান্ত না-করতে পারে। বিগত বিশ বছরে দেশে-দেশে ‘গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত’ সরকারগুলির ভূমিকাই হল কর্পোরেট-পুঁজিবাদের জন্য পাটা পিচ তৈরি করা। তাতে কাজ না-হলে আম্পায়ার ম্যানেজ করা (মানে হলো প্রয়োজনীয় ম্যানিপুলেশন)। আর তাতেও যদি কাজ না-হয়, তবে গোটা খেলার নিয়মটাকেই এমনভাবে বদলে ফেলা যাতে কিছুতেই যেন উইকেট না পড়ে। এই কাজগুলো করতে হলে সেকারণেই এমন একটা পুঁজিবান্ধব সরকার দরকার যেটা অত্যন্ত দ্রুত যাবতীয় বুলডোজার চালিয়ে পিচ থেকে নিয়মকানুন টি-টোয়েন্টি-ফ্রেন্ডলি করে দিতে পারে। অথচ, এর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও বাজারে উঠবে না। মানে কোনো অস্বস্তিই হবে না। দিব্যি ফেয়ার গেম হিসেবে গোটাটা বলবৎ থাকবে। এ সময়েই আসলে ওই শর্ট টার্ম অপশনটা সবথেকে বেশি কাজে আসে। মানে ফ্যাসিস্ট সরকার। উগ্র দক্ষিণপন্থী সরকার। দেশে দেশে ট্রাম্প-বলসোনারো-মোদী’রা এই কাজটা অত্যন্ত সহজে করতে পারে যা করতে বাদ বাকি নরম-দক্ষিণ, কম্যুনিস্ট-নামধারী-সরকারি বাম, সমাজবাদী বা সমাজ-গণতন্ত্রীদের বিবিধ মিলিজুলি জোটের অনেক সময় লেগে যায়। বিশ্ব অর্থনীতি এমন হাঁড়ির হালে এসে ঠেকেছে যে এই ফাটকা খেলা, চটজলদি টি-টোয়েন্টি ছাড়া পুঁজিবাদের সামনে কোনো অন্য রাস্তা নেই। ভারতের মতো দেশ যার শ্রমের বাজার থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ তথা জোগানের বাজারের সঙ্গে সঙ্গে পণ্য-বাজারও বিপুল আয়তনের সেখানে মোদী-শাহ সরকার ছাড়া এত ভাল টেকসই পন্থা আর কি হবে?

 

ইউপিএর দু’টো মেয়াদে যথেচ্ছ সময়-পুঁজি-গ্রিনহান্ট বিনিয়োগ করেও যা করা যায়নি, মোদি-শাহ’র সোয়া-এক টার্মে তার চেয়ে অনেক বেশি করে নেওয়া গেছে। মোদ্দায় ভারতীয় গণতন্ত্র, তার সংবিধান, তার এত বছরের তথাকথিত জনহিতকর নীতিমালা যে এত কম সময়ে জনগণের নাকের ডগা দিয়ে এভাবে ওলটপালট করে দেওয়া যায়, ইতিহাসেও এমন খুব একটা দেখতে পাওয়া যাবেনা। পরের কথা পরে। পুঁজিবাদ আসলে বেঁচে আছে এই মুহূর্তের মুনাফার সর্বোৎকৃষ্ট আহরণে। এই মুহূর্তের খেলার পিচ পাটা করাতেও তার চলছে না, আম্পায়ার ম্যানেজ করার মতো সময়ও সে দিতে রাজি নয়। এবার গোটা খেলার নিয়ম নীতিটাই বদলে ফেলা চাই। মোদি-শাহ’র ‘ফ্যাসিস্ট এন্টারপ্রাইজ’ ফার্স্ট টার্মের অসমাপ্ত কাজ এবার প্রবল গতিতে শেষ করতে নেমেছে। কোভিড অতিমারির প্রকৃত আতঙ্ক, তার মোকাবিলায় সরকারি প্রহসন আর বিবিধ মিথ্যাচারের আড়ালে এবারের নিশানা পরিবেশ সংক্রান্ত বিধি-ব্যবস্থা। এই জট ছাড়িয়ে ফেললেই ভারতের বিপুল অরণ্য, উপকূল, নদী, পাহাড় এক্কেবারে আইনি ভাবে কর্পোরেট মুক্তাঞ্চলে পরিণত করা যাবে। অতএব, সরকার এবার একটি খসড়া এনেছে। ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ বা ‘পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন’ সংক্রান্ত পুরোনো নীতিমালা একধাক্কায় ছেঁটে ফেলার জন্য। এই যাবতীয় ভূমিকা আসলে এ-প্রসঙ্গে পৌঁছনোর জন্যেই। প্রথমে এই ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ বা ‘পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন’ (যাকে আমরা এরপর থেকে ইআইএ বলেই অভিহিত করব) বিষয়টি একটু জানা বোঝার দরকার।

 

ইআইএ ইতিবৃত্তান্ত

 

ইআইএ ধারণাটির জন্ম ছ’য়ের দশকে, মূলত পশ্চিমবিশ্বের পরিবেশবাদী আন্দোলনগুলির হাত ধরে। এমনিতে তার আগে অবধি পরিবেশ-প্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে গণ-পরিসরে ভাবনার খুব জায়গাও ছিল না। দু’টো বিশ্বযুদ্ধ আর তার খেসারত দিতে দিতেই অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বজুড়েই একটা বড় মাত্রায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল পরিবেশ প্রশ্নে। প্রথম থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ভয়াবহতায় ব্যাপক পরিবর্তন হয় এবং মারণাস্ত্রের এমনই বিবর্তন হয় যা কিনা গোটা বিশ্বটাকেই মুহূর্তকালের মধ্যে ধুলো করে দিতে পারে। হিরোসিমা-নাগাসাকির হাতে গরম অভিজ্ঞতা সহ পূর্ব আর পশ্চিম রণাঙ্গণের বিখ্যাত যুদ্ধক্ষেত্রগুলিতে যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল, তা মানুষের এতাবৎকালীন অভিজ্ঞতায় একটা বড় মাপের ফাঁক তৈরির পক্ষে যথেষ্ট ছিল। বস্তুত আশির দশক থেকে যখন পরিবেশবাদ বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ইতিহাস-ভূগোল থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের গবেষণাতেও জায়গা করে নিচ্ছে, তখনো দেখব ১৯৪৫-৫০কে প্রকৃতি-পরিবেশ প্রশ্নে একটা ছেদবিন্দু হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। স্বভাবতই এর সাথে মিশেছিল ঠান্ডা যুদ্ধে পরমাণু শক্তিধর দুই রাষ্ট্রের রেষারেষি। পশ্চিম বিশ্বে তখন পুঁজিবাদের অক্ষ পাকাপাকিভাবে আমেরিকায় থিতু হয়েছে। তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ সোভিয়েত রাশিয়ার ‘সমাজতান্ত্রিক’ অর্থনীতি। ফলত একদিকে একচেটিয়াকরণ আর অর্থপুঁজির বাড়বাড়ন্ত হলেও অন্য দিকে আবার অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রনীতিতে সেই পুরোনো ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর বুলি ফিরে এসেছে। ষাটের দশকে একদিকে পরিবেশবাদী আন্দোলনের সক্রিয়তা অন্যদিকে বিশ্বশান্তি’র পক্ষে। এই দুই’ই মিলে আগ্রাসী রাষ্ট্রনীতির পক্ষে সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়াবে, এ নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের সংশয় ছিল না। একভাবে রাষ্ট্রের ‘গণতান্ত্রিক’ কাঠামোর মধ্যে সময়ের দাবি হয়ে উঠে আসা পরিবেশবাদকে জায়গা করে দেবার প্রয়োজন ছিল। ১৯৬৯’এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেপা বা ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট পলিসি অ্যাক্ট গঠনের মধ্যে দিয়ে ইআইএ সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় মান্যতা পেল। ১৯৭০-এর পয়লা জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যে কোনো প্রকল্পে নেপা মোতাবেক ইআইএ ছাড়পত্র আবশ্যিক ছিল।

 

১৯৭২-এ স্টকহোম ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পরিবেশনীতি গ্রহণ শুরু হয়, যার মধ্যে দিয়ে একভাবে ইআইএ প্রক্রিয়াও শুরু হয়, বলা চলে। যেমন ভারতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭২, জল আইন ১৯৭৪, বায়ু আইন ১৯৮১, পরিবেশ (সংরক্ষণ) আইন ১৯৮৬-র মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের তরফে পরিবেশনীতি লাগু হয়। এরপর ১৯৮৪-র ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পর এই প্রকল্পগুলোর ওপর সরকারি নজরদারি বাড়ানোর দাবিতে ভারতের গণসমাজেও একধরণের নড়াচড়া হয়। ভূপাল বিপর্যয় ঘিরে গণ-আন্দোলনও বিকশিত হয়। এর কিছু আগে বনরক্ষার দাবিতে চিপকো আন্দোলন, কর্নাটকের আপ্পিকো। ১৯৮৫ থেকে বড় বাঁধের ধ্বংসাত্মক প্রভাবের বিরুদ্ধে নর্মদা বাঁচাও আর ঝাড়খণ্ডে কোয়েল কারো আন্দোলন হয়। এ সবের  ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪-থেকে ইআইএ প্রক্রিয়ার নির্দিষ্টকরণ সম্পূর্ণ হয়। ২০০৬ সালে তাতে নতুন ক’রে সংযুক্তি/সংস্কার হয়েছিল। মোদী-শাহ সরকার ২০০৬ সংশোধনীর ওপরেই তাদের খসড়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

 

এবার আসা যাক ইআইএ প্রক্রিয়াটার ব্যাখ্যায়। ইআইএ-এর সংজ্ঞায় বলা হয়, যে যে উন্নয়নমূলক প্রকল্প পরিবেশে  অনাকাঙ্খিত প্রভাব ফেলতে পারে, সুসংবদ্ধ পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে ইআইএ সেই সম্ভাব্য প্রভাবগুলোই নির্ধারণ করে যাতে প্রকল্পজাত নেতিবাচক প্রভাবকে কমিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। যদি কোথাও এমন হয় যে কোনোভাবেই নেতিবাচক প্রভাবকে কমানো সম্ভব হচ্ছে না অথবা যতটুকু হচ্ছে সেটা যথেষ্ট নয়, সেক্ষেত্রে ইআইএ-র ওপর দাঁড়িয়ে প্রকল্প বাতিলও করা যেতে পারে। কিন্তু সে তো পরের কথা। ইআইএ’এর কাজ হল প্রকল্পটি কী ধরণের প্রভাব ফেলছে তা বিশদভাবে খতিয়ে দেখা। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ইআইএ’কে “the process of identifying, predicting, evaluating and mitigating the biophysical, social, and other relevant effects of development proposals prior to major decisions being taken and commitments made” বলে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে প্রথমত আছে খুঁজে দেখা, অর্থাৎ কী কী প্রভাব হতে পারে তা নির্ধারণ। দ্বিতীয় ধাপে প্রেডিক্টিং অর্থাৎ সেগুলির সম্ভাব্যতা বিচার, কী হতে পারে তা নির্ধারণ। পরবর্তী ধাপে, ইভালুয়েটিং। মানে প্রকল্পটি যে যে বাস্তব শর্তের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তার নিরিখে সম্ভাব্যতাকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পরিমাণগত বিচারে মূল্যায়ন করা। পরবর্তী বিষয় মিটিগেশন, অর্থাৎ কীভাবে এই প্রভাব কমানো যেতে পারে তা নির্ধারণ। এখন এই যে বিচার, তা কী কী বিষয়কে কেন্দ্র করে করা হবে? আন্তর্জাতিক সঙ্ঘের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, প্রথমটা বায়োফিজিকাল। অর্থাৎ প্রকল্পটি ভূ-প্রকৃতি এবং জৈব-প্রকৃতির মূল-গঠন, ভারসাম্য এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়ামকের ওপর কী ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে—তা খতিয়ে বিচার। এই অংশটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সে কথা সহজেই বোধগম্য হয়। পরবর্তী প্রভাবের জায়গা হিসেবে ধরা হয়েছে সোশ্যাল বা সামাজিক প্রভাব। অর্থাৎ, কোনো একটি প্রকল্প যখন কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গড়ে তোলা হবে তখন তার এক ধরণের প্রভাব পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা এবং  সংস্কৃতির ওপর পড়তে বাধ্য, আবার সামগ্রিকভাবে সমাজের ওপরও পড়তেও বাধ্য। এখানে ইআইএ’তে সামাজিক প্রভাবকেও অগ্রাহ্য করা যাবে না নিয়ম-মোতাবেক। খেয়াল করুন, নিয়মগিরি আন্দোলনের সময় ডোংরিয়া কোন্ধ জনগোষ্ঠীর আপত্তির একটা বড় জায়গা ছিল পাহাড়টি তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত। অতএব, তাদের সামাজিক অস্তিত্বও তাদের মতে নিয়মগিরি পাহাড় ছাড়া সঙ্কটে। সামাজিক প্রভাব বিচারের সময় ইআইএতে এগুলিকেও বিচার করতে হবে। এর বাইরেও স্থানভেদে নানারকম প্রভাব থাকতে পারে যাকে সামাজিক বা ভূ/জৈব প্রাকৃতিক প্রভাব এ দু’টো খোপের কোনোটার মধ্যেই ধরে ফেলা যাচ্ছেনা, ইআইএ-র বিচারে সে ধরণের প্রভাবকেও ধারণ করতে হবে। এই প্রভাব নির্ণয় করতে সরকার নির্ধারিত গবেষণা সংস্থা থাকবে। এবং আন্তর্জাতিক গাইডলাইন এবং আইন মোতাবেকই ইআইএ প্রসেস চালাতে হবে।

 

ইআইএ প্রক্রিয়ায় দুটি ধাপে জনগণের অংশগ্রহণ আবশ্যিক। প্রথম হচ্ছে যখন সামাজিক প্রভাব নির্ণয় করা হবে, দ্বিতীয় যখন ইআই-এ-র রিপোর্ট বেরোবে তখন তা জনশুনানির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে এবং প্রকৃতিগত ও সামাজিক ও বিবিধ যা যা সম্ভাব্য প্রভাব নির্ণয় করা গেছে তার সমস্ত তথ্য পাবলিক ডোমেনে অর্থাৎ জনগণের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। সে বিষয়ে তাদের ওয়াকিবহাল করতে হবে। নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য ‘মিটিগেশন’ প্রক্রিয়া  জানাতে হবে। সে বিষয়ে জনগণের মতামত, অন্যান্য বিশেষজ্ঞ যাঁরা মতামত দিতে চান, সব একত্র করে পুনর্বিচার করতে বসতে হবে। ইআইএ প্রক্রিয়ার মধ্যে জনসমাজ বা কম্যুনিটির অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়ার পিছনে পরিবেশ আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রের দিক থেকে এই অংশগ্রহণের আইনি অস্তিত্ব অনেকটা সেফটি-ভাল্ভের মত। প্রকল্পের যাবতীয় দায়ভারে জনগণকে জড়িয়ে নেওয়া গেলে, প্রকল্প-সম্পর্কিত সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিপর্যয় থেকে রাষ্ট্র মুক্ত হয়ে গেল, খানিকটা এমন ভাব যেন বা।

 

যদি ইআইএ-এর গোটা প্রক্রিয়া এবং তার এযাবৎ কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায়, দেখা যাবে যে রাষ্ট্রশক্তিরা, বিশেষত ভারতবর্ষ বা বাংলাদেশের মত তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে, ইআইএ’কে একটি মূর্ত প্রহসনে পরিণত করেছে। একটু সাহস করে এ-কথাও বলা যায় যে, কোনো প্রকৃতি-ধ্বংসকারী প্রকল্প শুধুমাত্র ইআইএ’র জন্য বাতিল হয়নি। ইআইএ হয়েছে ইআইএ-র মতো, রিপোর্ট বেরিয়েছে, সম্ভাব্য ক্ষতির খতিয়ানও বেরিয়েছে, প্রয়োজনীয় অদলবদল হয়েছে, তারপর বহাল তবিয়তে প্রকল্প জারি থেকেছে। এর উদাহরণ ভূরি ভূরি। বস্তুত যাঁরা বলছেন যে ইআইএ খসড়া ২০২০ ব্যাপক পরিবেশ ধ্বংসের রাস্তা খুলে দিল, তাঁদের কথাটা ঠিক হলেও, সেই কথার পিছনে একটা কথা বা ধারণা প্রচারিত হয়ে যাচ্ছে যে পুরোনো ইআইএ নোটিফিকেশন ২০০৬ দিয়ে যেন বা প্রকৃতি বাঁচানো যেত! এই ধারণাটা আদ্যোপান্ত ভুল। কখনো যেত না এবং কোনোদিনই যায়নি। একটা প্রকল্প নিয়ে আপত্তি উঠেছে, আদালতে মামলা হয়েছে, অন্যদিকে বারংবার রিপোর্ট বদল করা হয়েছে। পরিবেশগত প্রভাব লঘু করে দেখানো হয়েছে আকছার, প্রকল্প ছাড় পাবার জন্য। থুথুকোডির স্টারলাইট কারখানার ইআইএ রিপোর্টকে ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইন্সটিটিউট (নিরি) প্রহসনে পরিণত করেছিল। স্থানীয়দের বারংবার আপত্তি সত্ত্বেও নিরি নিজের বানানো রিপোর্টকে ভুল বলে পরে জল মেশানো রিপোর্ট বানিয়েছে। আরো ভালো উদাহরণ হলো দিল্লির কমনওয়েলথ ভিলেজ। তৈরির আগেই বিশেষজ্ঞরা বলেছিল যে জায়গাটি যমুনা নদীতটের অংশ। নিরি সে কথা খারিজ করে দিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিল যে সেটা মোটেও নদীতটের অংশ নয়। নির্মাণের পর প্রথম যে বর্ষা আসে তাতেই জলমগ্ন কমনওয়েলথ ভিলেজ গোটা ইআইএ প্রক্রিয়ার প্রহসনটি প্রমাণ করে দিয়েছিল। খেয়াল করুন সাম্প্রতিক সময়ে অযোধ্যা পাহাড়ে প্রস্তাবিত পাম্প স্টোরেজ বিদ্যুৎ প্রকল্প বা সেবক-রংপো রেলরুট প্রকল্পের কথা। ব্যপক পরিমাণ অরণ্য ধ্বংস, বণ্যপ্রাণকে সঙ্কটে ফেলা এই প্রকল্পগুলোর ইআইএ-এর রিপোর্ট দিয়ে এগুলোকে আটকানো গেছে? রেলপ্রকল্প এবং রাস্তাপ্রকল্প ইত্যাদিকে এমনিতেই তো ইআইএ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে বহুকাল। ক্ষতিকর প্রকল্প যেখানে যতটুকু যা আটকানো গেছে তা সম্পূর্ণ অন্যভাবে। পরে সে কথায় আসা যাবে। এই কদিন আগেই হওয়া ভাইজাগে এলজির পলিমার কারখানার গ্যাস লিক, অসমের তিনসুকিয়ার বাঘজানে তেলের কুয়োতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার কথা ভাবুন। দু’ক্ষেত্রেই পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে কোনো সমস্যাই হয়নি। বিশেষ করে বাঘজানের মতো বাস্তুতান্ত্রিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ, বণ্যপ্রাণের বসতি এলাকাতেও। তবে কিসের আইন? কিসের ইআইএ?

 

ইআইএ খসড়া বিজ্ঞপ্তি ২০২০: মোদি-শাহ এবং কর্পোরেট প্রচার

 

এবার দেখে নিই মোদী-শাহ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক ইআইএতে নতুন কী সংযোজন করল। এমনিতে মোদী সরকারের প্রথম দফার পরিবেশ নীতি ছিল যাবতীয় প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত বাধা-বিপত্তি উধাও করে দেওয়া। সরকারের পরিবেশ মন্ত্রককে বারবার ‘সিঙ্গল উইন্ডো ক্লিয়ারেন্স’ ইত্যাদি কথা বলতে শোনা গেছে। যার অর্থ, অত-ঘাট-ঘুরে ছাড়পত্র জোগাড়ের ঝক্কি কর্পোরেট মহাপ্রভুদের ঘাড়ে না-দিয়ে সরকার নিজের দায়িত্বে ছাড়পত্র জোগাড় করে দেবে। অনলাইন সিঙ্গল উইন্ডো, অর্থাৎ নির্দিষ্ট পোর্টালে ছাড়পত্র চাইতে হবে। বাকিটা সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব। পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত যাঁরা রাষ্ট্রীয় ধারার বাইরে চিন্তা করেন, তাঁরা দীর্ঘকাল ধরেই এটা বলে আসছিলেন যে সরকারি পরিবেশ দপ্তর বা বনদপ্তর আসলে হল পরিবেশ বা বন ধ্বংসের বহুজাতিক পরিকল্পনায় সরকারের এজেন্সি। মোদী-শাহ সরকার সেটা খোলামেলা করে দেখিয়েছে। অত রাখঢাক রাখেনি। নতুন খসড়ায় পরিবর্তনগুলো দেখে নিই একবার।

 

১। এই যে বছর বছর আন্তর্জাতিক সব পরিবেশ ও জলবায়ু-সম্মেলন হয়, সেখানে কথায় কথায় জনগণের অংশগ্রহণ, কম্যুনিটি ইনভলভমেন্ট ইত্যাদি নিয়ে দিস্তা দিস্তা পাতা খরচ হয়। মোদ্দায় এখন আন্তর্জাতিকভাবে ইআইএ গোছের প্রক্রিয়া থেকে পরিবেশ রক্ষায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, এসবকেই অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। যুক্তি, যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনজাত অবস্থার জন্য জনগণই সব থেকে বড় ‘স্টেক-হোল্ডার’, তাই তাদের অংশগ্রহণ যে কোনও উন্নয়নমূলক কাজকে পরিবেশ-প্রকৃতি সংবেদী হতে বাধ্য করবে। সেভাবে দেখলে, গোটা ইআইএ প্রক্রিয়ায় এক এই জনগণের অংশগ্রহণটুকু ছাড়া বাকি প্রত্যেকটা অংশকেই ডাইলিউট মানে লঘু করে নেওয়া যেতে পারে। ওই জায়গাটাই সরকারের কাছে, কোম্পানিদের কাছে অস্বস্তিকর। অতএব, ২০০৬ খসড়া অনুযায়ী যেখানে সাধারণ মানুষের ইআইএ শুনানিতে জবাব দেবার সময় ছিল ৩০ দিন, বর্তমান খসড়ায় তা কমিয়ে করা হয়েছে ২০ দিন। অথচ এখানে বহুদিনের দাবি ছিল দিনসংখ্যা বৃদ্ধি। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময়ে এই শুনানির খবর প্রকল্প-প্রভাবিত মানুষের কাছে পৌঁছয়না। রিপোর্টে লেখা তথ্য এবং মূল্যায়নের বিচার করার মত শিক্ষা বা যোগ্যতা গোষ্ঠীর মানুষদের বহুক্ষেত্রেই থাকে না। তাদেরকে ওই রিপোর্টের খুঁটিনাটি বোঝানোর মতো কোনো প্রক্রিয়াও সরকার নেয় না। যদিও নিয়ম মোতাবেক তাদের সেটা কর্তব্য। হালের খসড়ায় জন-অংশগ্রহণের যাবতীয় সুযোগকে প্রথমেই যথাসম্ভব ছেঁটে ফেলা হয়েছে।

এমনকি, বিবিধ অস্বচ্ছতার মধ্যে দিয়ে এই খসড়া পেশ করা হল। লকডাউন আর অতিমারি নিয়ে ব্যস্ততা/আতঙ্ক এসবের আড়ালে অত্যন্ত কম সময়ে (৬০ দিন) ধার্য করা হয়েছিল সাধারণ মানুষের মতামত দেবার জন্য। অথচ জন শুনানির যথেষ্ট সুযোগ ছাড়া ইআইএ প্রক্রিয়ার কোনো অর্থই নেই। আদলতে তা নিয়ে মামলা গড়ালে ১১ অগষ্ট অবদি সকল নাগরিকের মতামত দেবার সময়সীমা বর্ধিত হয়েছে।

 

২। পোস্ট-ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভালের নামে নতুন খসড়ায় পরিবেশ ধ্বংস করার এবং আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাবার আইনি ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমান খসড়া নিজেই ভারতের আইনি ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করার দারুণ উদাহরণ। এই পোস্ট-ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল মতে, কোথাও ছাড়পত্রবিহীন ভাবে কারখানা চললে বা কনস্ট্রাকশন শুরু হয়ে গেলে সেই প্রজেক্টকে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হবে। পরিবেশগত ক্ষতি কী হয়েছে তা মাপজোখ করে প্রয়োজনে একটু বকেঝকে জরিমানা উসুল করে নিলেই চলবে। অর্থাৎ কিনা যেভাবে পাড়ায় পাড়ায় প্রোমোটারি চলে ঠিক একই কায়দায় এবার থেকে ভারতবর্ষের অরণ্য-জল ধ্বংস করে ‘উন্নয়ন’ চলবে। লক্ষণীয় ২০১৭-র মার্চে মোদি-শাহ সরকার একটি নোটিফিকেশন জারি করেছিল ইআইএ লঙ্ঘনকারী প্রকল্পদের পোস্ট-ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভালের জন্য। নতুন খসড়ায় সেটা পাকাপাকি করা হয়েছে।

 

৩। ছাড়পত্র পাওয়া প্রকল্পকে আগে প্রতি ছ-মাসে রিপোর্ট দিতে হতো পরিবেশগত নিয়মবিধি মানা এবং দূষণ ইত্যাদির মাত্রা জানিয়ে। মোদ্দায়, পরিবেশগত প্রভাবের রিপোর্ট প্রতি ছ-মাসে দাখিল করতে হতো যা নতুন খসড়ায় এক বছর করে দেওয়া হল। কয়লা বিদ্যুৎ, পরমাণু বিদ্যুৎ, রাসায়নিক তৈরির মতো শিল্পের ক্ষেত্রে এক বছর যদি কোনো তদারকি বা খোঁজ না থাকে তবে একটা অঞ্চলের সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এধরণের ক্ষতিকর শিল্পের প্রভাবে।

 

৪। এর মধ্যে নতুন খসড়ায় কিছু প্রকল্পকে ‘স্ট্রাটেজিক’ ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। অর্থাৎ এদের ক্ষেত্রে কোনো তথ্য পাব্লিক ডোমেনে প্রকাশ করা হবে না। নতুন ড্রাফটে কয়লা উত্তোলন, নির্মাণ শিল্প, শক্তি-উৎপাদন শিল্পগুলির ক্ষেত্রে সরকার নিজের হাতে অসীম ক্ষমতা রেখেছে। ‘জাতীয় গুরুত্ব’ আখ্যা দিয়ে ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে। এর সাথেই যুক্ত হচ্ছে, নতুন নির্মাণ শিল্প, যা ১,৫০,০০০ স্কোয়্যার মিটারের মধ্যে, তার এক্সপার্ট কমিটির ‘ডিটেল স্ক্রুটিনি’ করার দরকার পড়বে না, দরকার হবে না ইআইএ নিরীক্ষার বা জনশুনানির। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ-ধরণের প্রজেক্ট ২০,০০০ স্কোয়্যার মিটারের মধ্যে থাকলে আগে এই ছাড় পেত যা নতুন খসড়ায় এক লপ্তে বাড়িয়ে দেওয়া হলো।

 

৫। বছরে যেখানে আগে ২.৫ লাখ টন কয়লাচুল্লির ছাড়পত্র দেওয়া হতো কোনো প্রকল্পে, তা নতুন খসড়ায় বাড়ানো হয়েছে ৮ লাখ টন অবধি। এবং এ ধরণের প্রকল্প এখন বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলের ৫ কিমির মধ্যেই করা যেতে পারে। ৫ হেক্টরের কম জমিতে চলা খনি শিল্পকে বর্তমান পরিবেশগত ছাড়পত্র জনিত প্রক্রিয়া থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২৫ মেগাওয়াটের কম ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইআইএ প্রক্রিয়ার বাইরে। ফলাফল এখনই বলে দেওয়া যায়। গোটা হিমালয় জুড়ে অসংখ্য জলবিদুৎ প্রকল্পকে খাতায়-কলমে ২৫ মেগাওয়াটের কম দেখিয়ে দেওয়া হবে। ঢালাও ক্লিয়ারেন্স। তারপর একটা ২০১৩-র উত্তরাখণ্ডের মতো বন্যা লাগবে গোটা অঞ্চলটা ধূলিসাৎ হতে।

 

সীমান্ত এলাকায়, লাইন অফ কন্ট্রোল ইত্যাদির কাছে ১০০ কিমি দৈর্ঘ্যের পাইপলাইন প্রকল্প বা হাইওয়ে প্রকল্পে কোনো জনশুনানির প্রয়োজন হবে না। গোটা উত্তরপূর্ব ভারতটাই, অতএব, ছাড়ের আওতায় চলে এলো।

 

৬। খনিশিল্পে পরিবেশগত ছাড়পত্র এখন থেকে ৩০ বছর থেকে বেড়ে ৫০ বছর অবধি বৈধ থাকবে। নদী পারের প্রকল্পের ক্ষেত্রে ১০ বছর থেকে বেড়ে ১৫ বছর।

 

এই কয়েকটিই যথেষ্ট গোটা বিজ্ঞপ্তির উদ্দেশ্য-বিধেয় বুঝে নেবার জন্যে। কিন্তু প্রথম থেকেই যে কথাটা বলার চেষ্টা করছিলাম, শুধু এই ইআইএ বিজ্ঞপ্তির দিকে তাকালে গোটা ছবিটা পরিষ্কার হবে না। বিষয়টাকে রাজনৈতিকভাবে আরো গভীরে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

 

ইআইএ এবং সামগ্রিক রাজনীতি, প্রকৃতি-পরিবেশনীতি

 

ইআইএ-র গোটা বিষয়টা বেশ চুপিচুপিই হচ্ছিল। প্রতিবাদ ইত্যাদিও সচেতন কিছু অংশ, পরিবেশবাদী এনজিওদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হঠাৎই গত কয়েকদিনে পরিবেশ মন্ত্রক, মন্ত্রী এবং দিল্লি পুলিশের কল্যাণে ইআইএ খবরে চলে এসেছে। কারণ কী! না, কয়েকটি পরিবেশবাদী ওয়েবসাইট, যারা ইআইএ খসড়ার বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহ করছিল, মন্ত্রকে চিঠি দিয়ে আপত্তি জানানোর জন্য জনগণকে উৎসাহিত করছিল, প্রতিবাদপত্রের সাধারণ একটা প্রতিলিপি বিলি করছিল, তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ খড়্গহস্ত হয়ে উঠল মাননীয় পরিবেশ মন্ত্রী এবং তার মন্ত্রক। তারা নাকি এত চিঠির উপর্যুপরি চাপে বিরক্ত। হঠাৎ http://letindiabreathe.in/, http://fridaysforfuture.in/, http://thereisnoearthb.in/ এই ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। দিল্লি পুলিশ প্রথমে ইউএপিএ (আনল’ফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট)-এর আওতায় ওয়েবসাইট বন্ধের নোটিশ পাঠায়। তারপর শোরগোল শুরু হলে বলে ভুল হয়েছে, বলে পুরোনো নোটিস বাতিল করে আইটি আইনে নোটিস পাঠায়। কিন্তু, ঠিক কোন কারণে এখনো অবধি ওয়েবসাইটগুলো সরকার বন্ধ করে রেখেছিল তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ তারা বে-আইনি কিছু করছিল বলে জানা যায়নি। খসড়া বিজ্ঞপ্তি নিয়ে মতামত দেবার সময় ১১ অগষ্ট ২০২০ অবধি আছে। লোকে দিতেই পারে। সরকার একবার বলছে বে-আইনি অভিসন্ধির কারণে বন্ধ করছে, আইটি অ্যাক্টে বন্ধ করে বলছে ধর্মীয় হিংসায় প্ররোচনামূলক বিষয়বস্তু ছিল, মন্ত্রী জাভরেকরের ইমেল স্প্যামে বা ভুয়ো মেলে ভরে যাবার দায় চাপাচ্ছে, মানে গোটাটাই গণতন্ত্র নিয়ে প্রহসন আর ক্ষমতার যাচ্ছেতাই অপব্যবহার। কিন্তু এই ঘটনা দিয়েও আসল গল্পটা বোঝা যাবে না। মূল গল্পটা লুকিয়ে আছে ওই টি-টোয়েন্টি খেলায়। আসলে কর্পোরেটের অতি-অতি মুনাফার জন্য সব খুলে দিতে হবে। মেক ( সুপার প্রফিট) ইন ইন্ডিয়া। পিচ যেমন পাটা করে দিতে হবে তেমনি আম্পায়ার ম্যানেজ করতে হবে তেমনই খেলার নিয়ম-নীতিটাও বদলে দিতে হবে। সহজ কথা হল প্রথম কাজটা অন্যান্য মিলিজুলি কংগ্রেস, সমাজবাদী, বাম ইত্যাদিরা করতে পারলেও, তৃতীয় কাজটা এরা করতে পারে না সহজে। তার কারণ এদের একটা দীর্ঘদিনের পলিটিকাল লিগ্যাসি বা রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের গল্প, যেটা ভাঙিয়েই এরা খায়। ফলত, চাইলেও কংগ্রেসের পক্ষে সংবিধানের মূলগত ভিত্তিতে হাত দেওয়া সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিনের জনস্বার্থবাহী আইন ইত্যাদিকে কর্পোরেট স্বার্থে খোলাখুলি বদলে দেওয়া, আমূল পালটে দেওয়ার মত কাজ করার রাজনৈতিক সামর্থ্য কংগ্রেসিদের বা জোট সঙ্গী বামেদের, সমাজবাদীদের নেই। পুঁজির পক্ষে একটা ছোট সংস্কার করতেও এরা দীর্ঘদিন লাগিয়ে দেয়। এখানেই মোদি-শাহ’এর ফ্যাসিস্ট রাজের সুবিধা। এক ধাক্কায় যা যা করার সব করে দিচ্ছে। গোটা খেলাটাই বদলে যাচ্ছে। নিয়ম বদলে দিচ্ছে, সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছে, মানে বদলে দিচ্ছে। কে কী বলবে! মজা হল সংসদীয় বড় খেলোয়াড় বিরোধীরা হয় বিশেষ কিছু বলবে না, নয় বললেও সে বলা গ্রাহ্য হবে না। এরপর  কর্পোরেট মিডিয়ার বড় অংশ, তাদেরও কোনও দায় নেই। তারা মূলত রাষ্ট্র ও কর্পোরেটদের পক্ষে। রইল বাকি জনতা। তাকে তো রামমন্দির থেকে এনআরসি, লিঞ্চিং, ওয়েবসাইট ব্লক, করোনা, হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটিতে ব্যস্ত রাখাই আছে। এখানে আলাদা করে দেখলে সত্যিই ইআইএ প্রক্রিয়ার কোনো গুরুত্ব নেই। কারো কাছেই নেই। এটা চিরকালই রাষ্ট্রের বানানো একটি প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্র চিরকাল নিজের মতো একে যেমনতেমন করেছে। সে কারণেই রাষ্ট্রক্ষমতার দাবিদার খেলোয়াড়েরা কেউ এর পেছনে থাকা পুঁজিপন্থী মুনাফাপন্থী পরিবেশবিরোধী নিওলিবারেল নীতি নিয়ে কোনও কথা বলছে না। এই লকডাউন-কোভিড ১৯ এর মধ্যেও কেরালার বাম সরকার প্রকৃতি-নিধনকারী প্রকল্পকে ছাড় দিয়েছে। একটা দু’টো নয়, চার-চারটে প্রকল্প। সবরীমালার কাছাকাছি অঞ্চলে পশ্চিমঘাট পাহাড়ের পাদদেশে অরণ্য ধ্বংস করে বিমান বন্দর, থিরুবনন্তপুরম আর কাসারগোরের মধ্যে সেমি-হাইস্পিড রেল প্রকল্প যেটিও বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সংবেদী এলাকার মধ্যে দিয়ে যাবে। বাস্তুতান্ত্রিকভাবে খুবই সংবেদশীল থোটাপ্পালির মোহনায় নদীচরের বালি উত্তোলন, যা কিনা কচ্ছপদের ডিম পাড়ার জায়গা থেকে শুরু করে প্রচুর সরীসৃপ এবং পরিযায়ী পাখির স্বাভাবিক বাসস্থান। সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৩০ জুন অবধি গত ৪০ দিনে ৪৪,২০০ টন কালোবালি তোলাও হয়ে গেছে। এর সাথেই যুক্ত হয়েছে আথিরাপল্লি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে সবুজ সংকেত দেওয়া। ভোট বড় বালাই যে। ২০২১-এ ভোট আসছে। জনগণ কে যেমন উন্নয়নের খুড়োর কল দেখিয়ে নাচাতে হবে তেমনই কর্পোরেট অনুগ্রহও তো জরুরিঝ । কে না জানে, শেষেরটা না-থাকলে, এদেশে ক্ষমতায় অন্তত টিকে থাকা যায় না।

 

অতএব, এ একথা বুঝে নেওয়া জরুরি, এক, ইআইএ-র ঝামেলা চুকলে তা সব কটি সংসদীয় দলের পক্ষেই মঙ্গল। বাকিদের ক্ষমতা নেই, মোদি-শাহ’র আছে। দুই, ইআইএ থাকলেও তা দিয়ে কিছুই আসে যায় না, এবং ডান, বাম, রাম কেউই তাকে কোনোকালে পাত্তা দেয়নি।

 

আমরা কীভাবে দেখব?

 

কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হলো আমরা কীভাবে দেখব? আমরা কি ইআইএ খসড়ার বিরোধিতা করবো না?

 

উত্তর হলো, অবশ্যই করব, হাজারবার করব। বড় গ্রিন পরিবেশবাদী এনজিওদের থেকে লক্ষ গুণ সুর চড়িয়ে করব। কিন্তু কখনোই এই বিশ্বাস থেকে করব না যে ইআইএ করে পরিবেশ বাঁচানো যায়। ইআইএ এমন একটি জটিল প্রক্রিয়া যে তা দেশের অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। ইআইএ বুঝতে গেলে তাই দরকার পড়ে শহুরে বাবুদের, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের, প্রশিক্ষিত এনজিওদের। মুশকিল হল এদেশের প্রকৃতি-ধ্বংসকারী ঘটনাগুলো এমনই দূর ও তথাকথিত পিছিয়ে থাকা এলাকায় হয়, যদি সেখানকার মানুষ এই প্রক্রিয়াকে ঠিকভাবে বুঝে উঠতে না-পারেন তবে ইআইএ তাদের শক্তি দেবে না। বরং শক্তিহীন করবে, পরনির্ভরশীল করে রাখবে। যা অবধারিতভাবে তাদেরই ঠকানোয়, ভুল বোঝানোয় কাজে আসবে। এদেশে পরিবেশ-প্রকৃতি বিষয়ক যে সব আইন সরাসরি আমজনগণ, গোষ্ঠীবাসীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে তা অরণ্যের অধিকার আইন ২০০৬ আর পেসা ১৯৯৬, যা শুধুমাত্র সংবিধানের পঞ্চম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত মধ্য-দক্ষিণ ভারতের আদিবাসী এলাকায় জারি। এই দুই আইনে অরণ্য এলাকায় যে কোনও প্রকল্প নিয়ে ওই এলাকার গ্রামবাসী মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আছে। তারা পরনির্ভরশীল নন। মোদি-শাহ সরকারের অরণ্য আইনের নতুন বিধিতে তাই সরাসরি এই আইনকে খারিজ করে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। ইআইএ-এর ক্ষেত্রেও দেখা যাবে তাই জন-অংশগ্রহণকে কমানোর চেষ্টা। আমাদের এই সামগ্রিক অবস্থাটার ওপর দাঁড়িয়ে ইআইএ খসড়ার বিরোধিতা করতে হবে। বুঝতে হবে, এটা একটা অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির, সে রাজনীতির সঙ্গে নিওলিবারেল অর্থনীতির নির্লজ্জ সমঝোতার অংশ। গোটা ভারতববর্ষে কর্পোরেটদের/ পুঁজির অবাধ প্রবেশের জন্য সব কিছু বদলে ফেলা হচ্ছে। অযথা ইআইএ-এর মতো একটা মেকি সুরক্ষাই বা থাকে কেন? ইআইএ-র ওপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র, স্বশাসন ও পরিবেশ ও প্রাণব্যবস্থার ওপর সার্বিক আক্রমণের বড় ছবিকে বুঝে নিতে হবে। এই রাজনীতিটাকে সজোরে আক্রমণ করা দরকার। ইআইএ খসড়া থেকে যত না পরিবেশ-প্রকৃতির সংকট বোধগম্য হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি বোধগম্য হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর কেন্দ্রীভূত, রাষ্ট্রীক ব্যবস্থা এবং পুঁজির অতিবৃদ্ধির ছক।

 

আরো গভীরে গিয়ে এই সময়টার কথা ভেবে দেখতে হবে। এতদিন ধরে পরিবেশবাদী গোষ্ঠীরা, পরিবেশকর্মী, নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ, ছাত্রছাত্রীরা যে উষ্ণায়ণ, প্রকৃতি-সঙ্কট এবং সমগ্র প্রাণবিশ্বে তার আশু প্রভাবগুলো নিয়ে হাল্লা করছিল, সেটা কেউই খুব পাত্তা দেয়নি। রাষ্ট্র দিতে চায় না, তা পরিষ্কার। দেশ তথা এ-বিশ্বের গণ-সমাজও সেভাবে এটাকে খুব কাছের সঙ্কট বলে দেখতে পাচ্ছিল না। আর রাজনৈতিক নেতা বা দলের কথা তো ছেড়েই দিন। কোভিড-১৯ অতিমারি চোখে আঙুল দিয়ে গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে এই কথাগুলো নেহাত ‘শখের বিপ্লবী’ মার্কা কথাবার্তা নয়। প্রাণ-প্রকৃতি সঙ্কট কোনো আঞ্চলিক বিষয়ও নয়, সাধারণ বা ছোটখাটো বিষয়ও নয়। তার প্রভাব আবিশ্ব, সেটা করোনা সংক্রমণ হাতেগরম প্রমাণ করেছে এবং করে চলেছে। আজ এ-কথা সামনে চলে এসেছে যে বিপুল পরিমাণ অরণ্য ধ্বংসের কারণেই সার্স-করোনাভাইরাস-২’এর মতো ‘জুনোটিক প্যাথোজেন’ (অর্থাৎ যে সমস্ত রোগসৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরজীবী ইত্যাদি না-মানুষী জীব থেকে মানুষের দেহে রোগের সংক্রমণ ঘটায়) তার নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে ঢুকে পড়ছে মানুষের বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে, খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে। এবং, এই বিশ্ব-জোড়া খাদ্য-পণ্য ব্যবসা, বহুজাতিক মাংস-ব্যবসার হাত ধরে, তা এক-মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশের বাজারে অচিরেই পৌঁছে যাচ্ছে। গবেষকরা দেখাচ্ছেন যে ভাইরাসের সংক্রমণের রাস্তা আসলে বিশ্বায়িত পণ্য-পরিবহনের রুট ধরেই হচ্ছে। বলা যেতে পারে পুঁজির সঞ্চলনের সার্কিট বা বর্তনী ধরেই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রত্যক্ষ করছি আমরা। আগামীদিনে আরো হাজার হাজার না-জানা প্যাথোজেনের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আর অমূলক থাকছে না। অথচ এই বিশ্বের রাষ্ট্রবাদী রাজনীতিকদের দেখে সে-কথা বোঝার উপায় নেই। বিশেষ করে উগ্র-দক্ষিণপন্থী ট্রাম্প-বলসোনারো বা হিন্দু-ফ্যাসিস্ট মোদী-শাহ’দের আচরণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। ইআইএ খসড়া ২০২০ প্রমাণ করছে যে এরা প্রকৃতি-সংকটকে স্রেফ পাত্তা দিচ্ছে না। অন্য দশটা পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি এক নয় মোটেই। আজকের পরিস্থিতিতেও প্রকৃতির সঙ্কটকে উড়িয়ে দিয়ে এই গা-জোয়ারি, অতি-রাষ্ট্রিক আচরণ প্রমাণ করে আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজি কী পরিমাণ সংকটে এবং তারা কী পরিমাণ মরিয়া ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদকে বাজারজাত করতে। রাজনৈতিকভাবে এই ধ্বংসাত্মক বেপরোয়া এবং হিংস্র ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকেও মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ জানানোটা প্রকৃতি-সঙ্কটের মতোই জরুরি হয়ে পড়ছে। প্রথমটা না-করলে দ্বিতীয় কাজটা হওয়াই সম্ভব নয়।

 

ফলত ইআইএ প্রক্রিয়াকে আমজনগণের বোধগম্য করার দাবি অবশ্যই তুলতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ এবং নীতিনির্ধারণের জন্য সওয়াল করতে হবে যাতে ইআইএ প্রক্রিয়া লঘু করার কৌশলগুলি বন্ধ করা যায়। সমস্ত তথ্য জনপরিসরে বা পাবলিক ডোমেনে আনার দাবি জানাতে হবে। স্ট্রাটেজিক বলে কোনো তথ্য লুকিয়ে রাখা যাবে না। একটা বিষয় পরিষ্কার, পুরোনো ইআইএ প্রক্রিয়ার জন্য লড়াই করার কোনো মানে নেই, ওটা এমনিতেও ছিল না। যদি লড়াই করতেই হবে তবে একটি প্রকৃত, স্বচ্ছ এবং সহজে বোধগম্য, জনগণের নীতি-নির্ধারণ ক্ষমতাযুক্ত ইআইএ প্রক্রিয়া ও নীতিমালার জন্য লড়াই করা উচিত। অর্থাৎ, লড়তে হবে একটি নতুন পরিবেশ আইনের জন্য, যা অরণ্যের অধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। আর এ-কথা বুঝে নেওয়া উচিত, যে সংসদীয় বিরোধীদের সেরকম কোনও সাহায্য এ প্রশ্নে আমরা পাব না। এমনকি আজ যেসব আন্তর্জাতিক এনজিওরা লড়ছে, তারাও হয়তো কেউই থাকবে না। ভারতবর্ষের আমজনতা, প্রকৃতি-নির্ভর মানুষগুলো ছাড়া, বাস্তবত এ লড়াইয়ে পাশে কেউই থাকবে না।

 

শেষ কথা

 

ভারতবর্ষের মতো দেশে রাজনীতিতে এখনো পরিবেশ-সঙ্কটের কোনো জায়গা নেই। সংসদীয় দলেরা সচেতনভাবেই এই জায়গা দিতেও চায় না। কারণটা পরিষ্কার। আজকের কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের মূল জায়গাটা যেমন সস্তা শ্রম তেমনই সস্তা প্রকৃতি। ফলত এই ইআইএর মতো প্রক্রিয়া দিয়ে ভারতবর্ষে কোনোকালেই খুব কিছু সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। যতটুকু যা হয়েছে তা ওই পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থা, গ্রুপ, এনজিওদের চাপে। ২০০৯-এ প্রকাশিত এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিভিউ নামক আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রে ভারতের পরমাণু প্রকল্পগুলির ইআইএ সংক্রান্ত একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সাল থেকে প্রতিটা প্রকল্পের জনশুনানিগুলিতে প্রচুর স্থানীয় মানুষ অংশ নিয়েছেন, অনেক কথা উঠে এসেছে, অনেক লিখিত মতামত জমা পড়েছে। অথচ তার কোনোটারই ছাপ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পড়েনি। জনশুনানিগুলোতে ব্যাপক পুলিশি বন্দোবস্ত করে একটা ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করা, যাঁরা বলতে পারেন, বিরোধিতা জানাতে পারেন তাদের বেছে বেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সভায় ঢুকতে না-দেওয়া, ইআইএ-এর কপি গ্রামবাসীদের হাতে না-পৌঁছনো, মিটিংয়ের সারাৎসার বা মিনিটসে কী লেখা হল তা গ্রামবাসীদের না-জানানো, এগুলোই ওই জনশুনানিগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

 

অতএব পাঠক, মোদ্দা কথাটা মোদ্দায় বুঝে নিন। প্রথমত ইআইএ খসড়ার বিরোধিতা করতে হবে এবং শেষতও বিরোধিতা করতে হবে। ফ্যাসিস্ট কায়দার রাজনৈতিক দাদাগিরির বিরোধিতা করতে হবে। প্রকৃতির ওপর পুঁজির দখলদারী রোখার দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত বিরোধিতাকে একজোট করতে হবে। এবং সর্বোপরি, দেশের প্রকৃতি বাঁচানোর মূল শক্তি যে সাধারণ জনগণ, তাদের হাতে নীতি নির্ধারণের ক্ষমতার স্বার্থে লড়াই করতে হবে। এ দেশের প্রাণ-প্রকৃতি এদেশের প্রত্যেক মানুষের, প্রত্যেক মনুষ্যেতর প্রাণের, তথা বিশ্বপ্রাণের অংশ। এটা কর্পোরেট মহাপ্রভুদের জায়গির নয়, আর মোদি-শাহ বা ফ্যাসিস্টদের শর্ট টার্ম ধ্বংসলীলার পর যারা গণতন্ত্রের ধ্বজা ধরে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছে সেই কংগ্রেস-বাম-সমাজবাদীরাও তার জায়গিরদার নয়।

 

সূত্র:

১।  https://www.thehindu.com/sci-tech/energy-and-environment/what-is-eia-and-why-is-indias-new-eia-draft-problematic/article32110013.ece

২। https://ipdonline.net/2020/07/17/indias-new-environment-impact-assessment-eia-draft-2020-a-critical-assessment/?fbclid=IwAR0N9ge1QhLIz4udsgjO_yUY5e1RCKrlKNacGjSt-OnRnZBq9RlPHteKwrQ
৩। https://scroll.in/latest/967589/centre-run-agency-blocks-website-of-environmental-collective-after-it-criticises-draft-law?fbclid=IwAR1Fj0tTVDlvO-dapcbVjIZKWdLXurtXHc6ihvjI0xvmo_WBDkQn7c4GhhY
৪। https://scroll.in/article/967671/in-kerala-development-projects-cleared-amid-lockdown-threaten-the-states-ecological-balance?fbclid=IwAR01sMBtISgHzZsqYhGr9S5pTn0BA7inL8g3vKYtHH3mG-AZZ0ERPu1vjJo
৫। The environmental impact assessment process for nuclear facilities: An examination of the Indian experience; Environmental Impact Assessment Review; M.V. Ramana, Divya Badami Rao
৬। https://inotherwords.in/2020/07/04/response-indian-government-eia-draft-2020/

 

  • লেখক সামাজিক কর্মী ও স্কুল শিক্ষক।

 

Share this
Leave a Comment