লকডাউনের প্রাথমিক পর্বের কয়েকটা দিন ছাড়া কৃষিজাত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বাজারজাত করা, কেনাবেচার ক্ষেত্রে কোনও বাধা ছিল না। অথচ বনজাত ছাতুর আড়ত বন্ধ কেন? এতো আদিবাসীদের লাইফলাইন। আদিবাসীদের খাদ্যবস্তু বলেই কি তা গুরুত্বহীন ? অত্যাবশ্যকীয় নয়? নাকি নির্ধারকদের নীতি প্রণয়নের মানচিত্রে আদিবাসীদের অস্তিত্বই নেই! লিখছেন দেবাশিস আইচ।
জৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র। এই চারমাস জঙ্গল চষে ফেললে ন’মাসের সংস্থান হয়ে যায় প্রেমচাঁদ শবরের। এই সময়টা কুড়কুড়ি বা মার্বেল ছাতু বা মাশরুমের সময়। প্রেমচাঁদ কেন ঝাড়গ্রামের জামবনির বড়হরকি গ্রামের লোধা শবর পরিবারগুলির বড় অংশটাই বড়হরকির শাল জঙ্গল নির্ভর। ২ টাকা কিলো চাল আর জঙ্গলের সম্পদ তাঁদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। লকডাউন তাঁদের বেঁচেবর্তে থাকার মতো আয়টুকুতেও বড়সড় থাবা বসিয়েছে। যানবাহন আর লকডাউনের দোহাই পেড়ে শালের থালা অর্ধেক এমনকি তারও ঢের কমে হাতিয়ে নিয়ে গিয়েছে মহাজনরা। খড়্গপুর-রাঁচি প্যাসেঞ্জার ট্রেন বন্ধ তাই গিধনির কাঁটা বন্ধ থাকে প্রায়। কুড়কুড়ির প্রায় পুরোটাই বিক্রি হতো রাঁচির বাজারে। প্রেমচাঁদরা অসহায় দিন জপে।
দেশজোড়া লকডাউন ঘোষিত হয়েছিল ১০ চৈত্র। চৈত্র গেছে বৈশাখ গেছে। দাবদাহের মাস। হাহাকারের মাস। এই শবরপল্লির দু’চার ঘরের সামান্য জমি আছে বাকিরা ভূমিহীন। পাট্টা পেয়েছিলেন কেউ কেউ। সে জমি পাথুরে, ঝাঁটিজঙ্গলে ভরা, সেচহীন। মুরগি আছে অবশ্য প্রায় ঘরেই। কারো কারো গরু-ছাগলও রয়েছে। শবর পরিবারগুলোর এক বড় অংশ জঙ্গল থেকে আলু খুঁড়ে আনে। মুরাল ছাতু সিদ্ধ খায়। লকডাউনে বন্ধ হাট-বাজার। জ্বালানি কাঠ জোগাড় হলেও বিক্রি নেই। জৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে কুড়কুড়ির মরসুম। এই দুই মাস জঙ্গল ঢুঁড়ে এক একজন পাঁচ থেকে ছ’কেজি ছাতু সংগ্রহ করতে পারেন। পাঁচ দফার লকডাউন শেষ হয়ে ৮ জুন শুরু হয় আনলক ওয়ান। অর্থাৎ, ২৫ জৈষ্ঠ। মরসুমের প্রথম দু’মাস জৈষ্ঠ-আষাঢ় গিয়েছে এভাবেই। আনলকেও কোনও সুরাহা মেলেনি। শ্রাবণ-ভাদ্র ভরা মরসুম। এ প্রতিবেদন লিখছি ৫ শ্রাবণে। যখন সংক্রমণ যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে কন্টেনমেন্ট জোনের কড়াকড়ি। তার সঙ্গে ঘোষিত হয়েছে সপ্তাহে দু’দিন রাজ্যব্যাপী লকডাউনের নির্দেশ। অথচ, এই দুই মাস এক-একজন একবেলায় ঝোলায় ভরতে পারতেন অন্তত ২৫ কেজি ছাতু। সহজ করে বলা গেল বটে তবে এই পঁচিশ কেজি ছাতু তুলতে চড়তে হয় গড়ে আট-দশ কিলোমিটার। গাঁ-ঘেঁষা জঙ্গল থেকে ভিন জঙ্গলেও যেতে হয়। এমনটাই হিসেব প্রেমের।
২-৩ সেমি চওড়া, গোল মার্বেলের মতো দেখতে এই ছাতু কুঁড়ি অবস্থায় মাটির নীচে থাকে। পরবর্তীতে মাটির আস্তরণ সরিয়ে একাংশ বেরিয়ে আসে। কচি অবস্থায় তা তুলতে হয়। অভিজ্ঞ চোখই তা খুঁজে পায়। কখনও সামান্য জায়গায় অনেকটা মেলে আবার প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে হলে চড়ে বেড়াতে হয় হাতি আর বুনো শূকরের নাগাল এড়িয়ে। সকাল সাতটা থেকে মধ্যদুপুর পেরিয়ে কিশোর-কিশোরী, মেয়ে-পুরুষ, কোমর ভেঙে ভেঙে একটানা খুঁজে চলেন কুড়কুড়ি। সুদিনে সাইকেলে বেঁধে বস্তাভরা ছাতু নিয়ে যাওয়া গিধনির কাঁটায়। রাঁচির ট্রেন পৌঁছানোর আগেই পৌঁছতে হয়। সুদিনে ১৫০ টাকা কেজিতে ছাতু বেচে হাতে নগদ নিয়ে ফিরতেন সকলে। যাঁরা যেতে পারতেন না মহাজন বাড়ি বয়ে এসে নিয়ে যেতেন তবে তাতে কেজিতে বিশ টাকা কম মিলত। এখন তো এই জঙ্গল নির্ভর শবর অর্থনীতিটাই ভেঙে পড়েছে। খতিয়ে দেখলে হয়তো দেখা যাবে শুধু শবর কেন, জঙ্গল নির্ভর আদিবাসী অর্থনীতি আজ বিপন্ন। প্রেম হিসেব দেন এই মরসুমে পরিবারের চার সদস্য মিলে ছাতু সংগ্রহ করে বিক্রি করতে পারলে চার মাসে আয় হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। যা দিয়ে তাঁরা ন’ মাস সংসার চালিয়ে নিতে পারেন। এই সামান্য আয়টুকুও কেড়ে নিয়েছে লকডাউন। লকডাউনের প্রাথমিক পর্বের কয়েকটা দিন ছাড়া কৃষিজাত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বাজারজাত করা, কেনাবেচার ক্ষেত্রে কোনও বাধা ছিল না। অথচ বনজাত ছাতুর আড়ত বন্ধ কেন? এতো আদিবাসীদের লাইফলাইন। আদিবাসীদের খাদ্যবস্তু বলেই কি তা গুরুত্বহীন? অত্যাবশ্যকীয় নয়? নাকি নির্ধারকদের নীতি প্রণয়নের মানচিত্রে আদিবাসীদের অস্তিত্বই নেই! কেন গিধনির কাঁটা, রাঁচির বাজার চালু রাখা যাবে না? কেন প্যাসেঞ্জার ট্রেনের বদলে ব্যবহার করা যাবে না অন্য যান? এই লকডাউন পর্বে সারা দেশের জঙ্গল নির্ভর আদিবাসী অর্থনীতির দিকে তাকালে প্রায় সর্বত্র এই এক চিত্র দেখতে পাওয়া যাবে।
কী মেলে সাধারণ ভাবে এই নির্দিষ্ট জঙ্গলটি থেকে? তালিকাটি এরকম, নানা মরসুমে নানা জাতীয় ছাতু, শাল-কেঁদের পাতা, শালের ধুনা, কুরকুট বা পিঁপড়ের ডিম, কন্দ, বন কুঁদরি, ফল, জ্বালানির কাঠ, ভেষজ — যা বিক্রিও হয় আবার খাওয়াও যায়। যা সংগ্রহ করতে প্রাণপাত করতে হয়। অথচ দাম মেলে সামান্যই। মহাজনরা যা দ্বিগুণ তিনগুণ দামে বিক্রি করে থাকেন। এই ১৫০ টাকায় ছাতু রাঁচির বাজারে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া ধরা যাক শালপাতার কথা। বড়হরকির শাল জঙ্গলে এক-দেড় কিলোমিটার ঘুরে ঘুরে তোলা হলো শালপাতা। এবার এমন ছ’-সাতটি পাতা কাঠি দিয়ে বুনে তৈরি হলো শালের থালা। এটি প্রাথমিক ধাপ। এর পর সেলাই করে কানা বাঁকিয়ে তৈরি হবে পূর্ণাঙ্গ থালা। তার হিসেব থাক। এই কাঠি দিয়ে সাঁটা হাজার থালা বিক্রি করে মেলে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। যা দ্বিগুণের বেশি দামে বিক্রি হয়। অথচ লকডাউনের প্রাথমিক পর্বে পাতার সময় ৪০-৫০ টাকা ঠেকিয়েছেন মহাজনরা। পিঁপড়ের ডিম বা কুরকুটের কেজি ১৫০ টাকা। ঝাড়গ্রামের বাজারে যদি তা বিক্রি হয় ৫০০ টাকায় তবে কলকাতার হাতিবাগানের আড়তে বিক্রি হবে হাজার থেকে বারশো টাকায়। মেদিনীপুর, ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ বিভিন্ন জেলা থেকেই এখানে পিঁপড়ের ডিম আসে। ক্রেতা পেশাদার কিংবা শখের অ্যাঙলাররা। মাছ ধরার চার হিসেবে যা বিক্রি হয়। শালের ধুনা ১০০ টাকা কেজিতে কিনে চারগুণ দামে বিক্রি করে মহাজন। এমন বনজ দ্রব্য রয়েছে যার ব্যবহারিক কিংবা গুণগত মূল্য জানা নেই বর্তমান প্রজন্মের। যেমন দুধিলতা। চারফুট মাপে কেটে এই লতার হাজার খণ্ড ৮০ থেকে ১০০ টাকায় কিনে নিয়ে যান ব্যাপারীরা। পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদের ‘মেঠো বই’ বাংলার ঝোপঝাড়ে চোখ বুলিয়ে জানা গেল, এই শ্যামলতা, দুধিলতা বা ল’য়ের ব্যবহার।
“… এদের বেশি দেখা যায় লাল মাটির জায়গায়। এখন ব্যাপক ভাবে এই লতা দিয়ে ঘর সাজানোর জিনিস তৈরী হয়। লতার ছাল তুলে, সাদা কাঠ অংশটাকে নানা ভাবে পেঁচিয়ে বল, তারা মাছ, ফুল ইত্যাদি গ্রামের মহিলারা বানাচ্ছেন।… খুব শক্ত বলে পানের বরোজ তৈরী করতে কাজে লাগে। ঝুড়ি-ঝাঁকার মুখের বেড়, মাছ ধরার সরঞ্জাম এই লতা দিয়ে বানানো যায়।”
সত্যি কথা বলতে কী প্রতিটি বনজ সম্পদের ক্ষেত্রেই আদিবাসী ঠকানো ব্যবসাটি রমরমিয়ে চলে আসছে। এই গৌণ বনজ সম্পদ ভোগদখলের অধিকার, জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার আইনটি, বনবাসী অধিকার আইন, ২০০৬ এ তল্লাটে আলোচিতই হয়নি কখনও। হবেই বা কেন। দেশের বন-রাজনীতির আর্থনৈতিক দিগদর্শনটি হলো, বন থেকে যত বেশি বেশি করে পারো আদিবাসী তাড়াও আর বন বেচে দাও। যার প্রস্তুতি তুঙ্গে। খসড়া বিল তৈরি। অথচ দেশের সর্বত্র আকালের ছায়া ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। ফাও, হু, ইউনিসেফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির বার্ষিক প্রতিবেদন ‘স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট জানাচ্ছে, কোভিড-১৯ কৃষি, জোগানের শৃঙ্খল, বাজার ও মুদির দোকানের সচলতা, জীবিকা তছনছ করে দিয়েছে। খাবার বাজারে আছে কিন্তু এর পর ক্রমে খাবার কেনার মতো আর অর্থ থাকবে না মানুষের হাতে। যার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই মিলেছে এদেশে। সারা বিশ্বে শুধুমাত্র এই করোনা অতিমারির কারণে ঠিক কত দাঁড়াতে পারে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা? রিপোর্ট বলছে, ৮.৩ কোটি থেকে ১৩.২ কোটি। এর সঙ্গে রিপোর্টটি মনে করিয়ে দিয়েছে ২০১৯ সালে বিশ্বের ৬৯ কোটি মানুষ দু’বেলা পেটভরে খেতে পায়নি। ক্ষুধার্ত থেকেছে। এশিয়া মহাদেশে সেই সংখ্যাটি ৩৮.১ কোটি। মানে পরিস্থিতি ক্রমে হাতের বাইরে যাচ্ছে। ঘরের দিকে তাকালে, এ রাজ্যের আদিবাসীদের উপর এশিয়াটিক সোসাইটি ও প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এর করা সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা ‘লিভিং ওয়ার্ল্ড অফ দ্য আদিবাসিজ অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ জানাচ্ছে, সমীক্ষাকৃত আদিবাসীদের ৩১ শতাংশ বছরের কোনও কোনও সময় দু’বেলা পেট ভরে খেতে পান না। আর এই আকালে তবে কেমন আছেন সেই মানুষেরা? চোখ মেলে তাকালে হয়তো আমরা দেখতে পাব করোনা অতিমারি আদিবাসী জগতে ক্ষুধার অতিমারি হয়ে দেখা দিতে চলেছে। আমরা কি আরও এক সমীক্ষার অপেক্ষায় থাকব?
লেখক স্বাধীন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।
ছবি: প্রেমচাঁদ শবরের সৌজন্যে।
সারা দেশে আদিবাসী দের একিই অবস্থা । আদিবাসী দের রাজনৈতিক প্রতিনিধি রা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল থেকে পদ পায়, সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ভুলে যায় বিগত দিনের শোষণ অভাব অভিযোগ এর কথা। তাদের বলা হয় সরকারের প্রতিনিধি হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বলা যায়না । তাই তো ঠান্ডা ঘরে র মালিক রাত কিছুই জানতে পারে না