চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে গণহত্যা সংঘটিত হয়, এই সংবাদ কারও অজানা নয়। তবে নানা সত্যসন্ধানী সমীক্ষায় উঠে আসছে এমন সব চাঞ্চল্যকর ও উদ্বেগজনক তথ্য যা পুলিশের চার্জশিটে মেলেনি। ১৯৮৪ সালের শিখ-নিধনযজ্ঞের পর এত বড় হত্যালীলা দিল্লিতে হয়নি। যদিও গুজরাত-ভাগলপুরের ইতিহাস এখনও মলিন নয়। গত ১৬ জুলাই দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশনের (ডিএমসি) একটি তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে দিল্লি হিংসায় পুলিশ কী ভূমিকা পালন করেছে বা স্থানীয় দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতাদের প্ররোচনা ও মদতের ফলে কীভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে চালানো হয়েছে এই মুসলিম-নিধন। এই তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট-অন-রেকর্ড এম আর শামসাদ। যুক্ত ছিলেন ডিএমসি-র চেয়ারম্যান ড. জাফরুল ইসলাম খান ও সদস্য কর্তার সিং কোচার ও আনাস্তাসিয়া গিল। এই তথ্যানুসন্ধানী দলটির সদস্যরা অকুস্থলে গিয়ে আইনি পরামর্শদাতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় দাঙ্গা-দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে, হিংসা-বিধ্বস্ত এলাকাগুলি পরিদর্শন ও তদন্ত করে প্রস্তুত করেছেন এই রিপোর্ট।
এই বছরে ২৩-২৭ ফেব্রুয়ারি উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম-বিরোধী হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র ২৩ ফেব্রুয়ারি মৌজপুরে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক ভাষণ দেওয়ার পর পরই শুরু হয় এই তাণ্ডব – রেকর্ড অনুযায়ী এই সত্য এখন ডিএমসি-এর রিপোর্টেও প্রমাণিত। জাফরাবাদে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের জোর করে হঠিয়ে দেওয়া না হলে তিনি ও তাঁর সমর্থকরা সেই দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেবেন বলে মন্তব্য করেছিলেন কপিল। তিনি যখন বলছিলেন – “তিন দিনের মধ্যে রাস্তা ফাঁকা করা না হলে আমরা পুলিশের কথা শুনব না,” তখন ঠিক তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন উত্তর-পূর্ব জেলার পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বেদপ্রকাশ সূর্য। এরপরও দিল্লি পুলিশ বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য তাঁকে ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের গ্রেফতার করা তো দূরস্থান সামান্য বাধাটুকুও দেয়নি।। ডিএমসি’র এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, “এই ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে দিল্লি পুলিশ প্রথম ও সবচেয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপটি নিতে ব্যর্থ হয়েছিল যা হিংসা শুরু হওয়া রুখতে এবং মানুষের জীবন ও সম্পত্তি বাঁচাতে অত্যন্ত জরুরি ছিল।”
তথ্যানুসন্ধানী দলের একাধিক নথির উপর ভিত্তি করে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে যেখানে হিংসায় যাঁরা বেঁচে গেছেন তাঁরা প্রত্যেকে বলেছেন যে এমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করেও পুলিশের সাড়া মেলেনি, প্রহরারত পুলিশও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি – পুলিশ সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় ছিল। এই নাগরিকেরা বলেছেন, “হস্তক্ষেপের আদেশ নেই বলে পুলিশ সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিল।” তথ্যানুসন্ধানী দলটি জানাচ্ছে – “কোনও একক ব্যক্তির নিষ্ক্রিয়তা বা বিক্ষিপ্তভাবে আইন লঙ্ঘনের ফলে হিংসা রোখা সম্ভব হয়নি, এমনটা নয়। বরং কয়েকদিন ধরে ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার ফলে এই ঘটনা ঘটেছে। দিল্লি পুলিশ আইন, ১৯৭৮ অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করার যে ক্ষমতা দিল্লি পুলিশের রয়েছে তা তারা প্রয়োগ করেনি। এই আইন অনুসারে পুলিশ কমিশনার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরনো ও ‘জনজীবনে শান্তি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয়’ বেআইনি জমায়েত বন্ধ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, অথচ তা এই পরিস্থিতিতে করা হয়নি।” এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, “নিষেধাজ্ঞা হয় জারি করা হয়নি বা কোনও রকম প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি ছাড়া শুধু নামেই ছিল। পুলিশ বেআইনি জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে বা যারা হিংসা ছড়াচ্ছিল তাদের ধরা, গ্রেফতার করা ইত্যাদিতেও নিজেদের কোনও ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি।” এই দলটি এমন তথ্য পেয়েছে যেখানে একাধিক ক্ষেত্রে হিংসার শিকার মানুষেরা এফআইআর করতে গেছেন তখন পুলিশ তা নিতে দেরি করেছে। দাঙ্গাপীড়িতরা জানিয়েছেন, “হয় এফআইআর নিতে দেরি করা হয়েছে বা নিলেও সেই মোতাবেক কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।”
“দেশে সদ্য পাশ হওয়া বৈষম্যমূলক আইনের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখানোর কারণেই একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পরিকল্পনামাফিক চালানো হয়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির এই হিংসাত্মক ঘটনা, যা ২৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী বেশ কয়েকদিন ধরে চলে,” এই রিপোর্টে এমনটাই বলা হয়েছে।
দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশন মার্চ মাসে একটি গোটা দিন হিংসা-বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে দেখেন, ৯ মার্চ গঠিত হয় তথ্যানুসন্ধানী কমিটি, কোভিড ১৯ লকডাউন মার্চের মাঝামাঝি ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও নানা পদ্ধতিতে তদন্ত চালিয়ে গেছে এই কমিটি। ৩০ জুন পর্যন্ত এই কমিটির কাজের সময়সীমা বাড়ানো হয়, ২৭ জুন কমিটি রিপোর্ট পেশ করলে কমিশন তা গ্রহণ করে। কমিটি সুপারিশ করেছে: সরকার যেন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি তৈরি করে যার নেতৃত্ব থাকবেন হাইকোর্টের একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। এই রিপোর্ট বলছে, “ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ দাঙ্গা-দুর্গতরা এমন ঘটনার কথা জানিয়েছেন, এমন উদাহরণ দিয়েছেন যাতে তাঁদের সঙ্গে যে ধর্মীয় পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয় তাই প্রতিফলিত হয়েছে, তা এমন ভাবে করা হয় যেন তাঁরা দেশের নাগরিকই নন, বরং পৃথক ও বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র ‘সম্প্রদায়’।”
চলতি বছরের জানুয়ারি ও তারপর থেকে বাড়তে থাকা রাজনৈতিক প্ররোচনা :
যাঁরা সিএএ-এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করছেন তাঁদের উল্লেখ করে বিজেপি নেতারা সাম্প্রদায়িক বিবৃতি দেয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পশুপালন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ, কারওয়াল নগরের প্রাক্তন এমএলএ ও বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সহ অনেকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুমকি ও উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশ করেন। তখন দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন।
- এই বছরের ২০ জানুয়ারি পার্লামেন্ট সদস্য ও ক্যাবিনেট মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর নির্বাচনী মঞ্চ থেকে স্লোগান দেন ‘দেশ কে গদ্দারোঁ কো/ গোলি মারো শালোঁ কো’।
- ২৭ জানুয়ারি দেশের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচনী প্রচারে এসে বলেন, ইভিএমে এমনভাবে বোতাম টিপুন যাতে শাহিনবাগের বিক্ষোভকারীরা এর ঝাপটা টের পায়। তিনি এও বলেন যে, বিজেপি প্রার্থীকে দেওয়া আপনার ভোট দিল্লি ও দেশকে নিরাপত্তা দেবে এবং শাহিনবাগের মতো ঘটনা রুখবে।
- ২৮ জানুয়ারি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বিজেপি এমপি পরবেশ বর্মা বললেন, ”মুসলিম পুরুষরা আপনাদের ঘরে ঢুকে আপনাদের মা-বোনকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলবে। এখনই সময়। পরে মোদিজি ও অমিত শাহ আপনাদের বাঁচাতে আসবেন না।”
- এই দিনই তিনি আরও ঘোষণা করেন, তাঁর ভোটকেন্দ্রে যদি বিজেপি জেতে তাহলে এই এলাকার সমস্ত মসজিদ গুঁড়িয়ে দেবেন।
- ২৯ জানুয়ারি বিজেপির জাতীয় সম্পাদক তরুণ ছুগ ট্যুইট করেন, “আমরা দিল্লিকে সিরিয়া হতে দেব না, যেখানে ওরা আইসিস মডেল চালায়, মহিলা ও শিশুদের ব্যবহার করে।”
- ২ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দিল্লির এক নির্বাচনী র্যালিতে বলেন, বুলি নয়, গুলি কাজে দেয়।
- ৫ ফেব্রুয়ারি বিজেপি এমপি তেজস্বী সূর্য সংসদে তাঁর ভাষণে শাহিনবাগের প্রতিবাদকে ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে তুলনা করেন।
- ২৩ ফেব্রুয়ারি কপিল মিশ্র উত্তর-পূর্ব দিল্লির ডিসিপি-কে পাশে নিয়ে মৌজপুরে মিছিল করেন ও ভাষণ দেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি কপিল মিশ্রের ভাষণের কয়েক ঘন্টার মধ্যে উত্তর-পূর্ব দিল্লির শিববিহার, খাজুরি খাস, চাঁদবাগ, গোকুলপুরি, মৌজপুর, কারওয়াল নগর, জাফরাবাদ, মুস্তাফাবাদ, অশোক নগর, ভাগীরথী বিহার, ভজনপুরা ও কর্দমপুরি সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভয়াবহ হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ৫৩ এবং আহত অন্তত ২৫০ জন যাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। কত জন নিঁখোজ তার কোনও হিসাব নেই। এই হিংসায় বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে যেহেতু মুসলমান মানুষদের বাড়ি, দোকানপাট নির্বিচারে লুট করা, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এভাবেই তাঁদের ব্যবসা ও অন্যান্য সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
The full report is given below:
[pdf-embedder url=”https://www.groundxero.in/wp-content/uploads/2020/07/Delhi_riots_Fact_Finding_2020_compressed.pdf” title=”_Delhi_riots_Fact_Finding_2020_compressed” width=”700″]