প্রয়াত হলেন ‘আধুনিক রবিনহুড’ অ্যানার্কিস্ট লুসিয়ো উর্তুবিয়া


  • July 19, 2020
  • (0 Comments)
  • 1434 Views

গত ১৮ জুন বিদায় নিলেন সুবিখ্যাত স্পেনীয় অ্যানার্কিস্ট লুসিয়ো উর্তুবিয়া। ‘আধুনিক রবিনহুড’ বা  ‘আধুনিক দোন কিহোতে ’ লুসিয়োর জীবন ছিল প্রায় সিনেমার মতো। সে জীবনকে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দর্পণও বলা যেতে পারে। নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামু ও সুররিয়ালিজম তত্ত্বের জনক আন্দ্রে বের্টনের ব্যক্তিগত বন্ধু লুসিয়োর মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। লিখেছেন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

 

 

উত্তর স্পেনের এক অতি দরিদ্র পরিবারে ১৯৩১ সালে লুসিয়োর জন্ম। বাবা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে যান এবং সেখানে পাঠ নেন কমিউনিজমের। সেই সময় স্পেনে ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, শৈশবের দারিদ্র্যের মধ্যেই তাঁর অ্যানার্কিস্ট মতাদর্শের শিকড় নিহিত। যাই হোক, বড় হয়ে তাঁকে মিলিটারিতে যোগ দিতে হয়, কিন্তু ১৯৫৪ সালে পালিয়ে চলে যান প্যারিসে। সেখানে গিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন, যে পেশায় তিনি আজীবন যুক্ত ছিলেন। সেখানেই পরিচিত হন স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে নির্বাসিত কিংবদন্তী বিপ্লবী সাবাতে ইয়োপার্টের সঙ্গে এবং তাঁর কাছে অ্যানার্কিজমের পাঠ নেন। নির্বাসনে থেকেই সাবাতে ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদ গড়ে তোলেন এবং সাহায্য করতেন অন্য নির্বাসিত বন্ধু ও তাদের পরিবারকে। কিন্তু তিনি ধরা পড়ায় থমকে যায় এই কাজ। তখন লুসিয়ো সেই অসমাপ্ত কাজ হাতে তুলে নেন। এর কিছুদিন পর থেকে তাঁর জীবনে শুরু হয় এক্সপ্রোপ্রিয়েটিভ অ্যানার্কিজমের অধ্যায় অর্থাৎ বিপ্লবের স্বার্থে চুরি, ডাকাতি, ষড়যন্ত্র এবং নোট জাল করার কাজ। যে কোনও জিনিস নকল করার কাজে তিনি ছিলেন এক নিপুণ শিল্পী। সেই সময়ে প্রচুর জাল পাসপোর্ট তৈরি করেন যাতে গেরিলা যোদ্ধারা নিরাপদে দেশের বাইরে বেরোতে পারেন। তারপর ষাটের দশকে শুরু করেন নোট জাল করার কাজ, উদ্দেশ্য পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দেওয়া। বিপ্লবের কাজে অর্থ সংগ্রহের জন্য অনেক ডাকাতিতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি চে গেভারাকে প্রস্তাব দেন নকল ডলার বাজারে এনে আমেরিকার আর্থিক ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার। কিন্তু চে রাজি হননি, লুসিয়ো বাস্তবিক হতাশ হন।

 

কিন্তু সেই ভাবনাকে নিজের মধ্যে জিইয়ে রাখেন। অনেক পরে, ১৯৭৭ সালে, সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক আমেরিকার সিটি ব্যাঙ্কের ট্রাভেলার্স চেক নকল করেন তিনি। এই চেক পৌঁছে যায় ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন গেরিলা সংগঠনের কাছে। তার ফলে সিটি ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এক সময় ব্যাঙ্ক ট্রাভেলার্স চেকের লেনদেন পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়, যার ফলে হাজার হাজার ট্যুরিস্ট সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালে তিনি গ্রেফতার হন। সিটি ব্যাঙ্কের আমেরিকার কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছিল ভয় দেখালে আর অত্যাচার করলেই লুসিয়ো হার মানবেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে ‘এ বড় কঠিন ঠাঁই’। অন্যদিকে তিনি গ্রেফতার হওয়ার পরেও নকল চেক ব্যাঙ্কে জমা পড়তে থাকে। ফলত সিটি ব্যাঙ্ক কোর্টের বাইরে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। নকল চেক ছাপার প্লেটের বিনিময়ে মাত্র ছ’মাস জেলে থাকার পর নিঃশর্ত মুক্তি পান তিনি এবং এক কিংবদন্তী চরিত্রে পরিণত হন।

 

পঞ্চাশ বছর বয়সের পর ডাকাতি বা নকল করার কাজ থেকে অব্যাহতি নেন, কিন্তু আমৃত্যু তিনি ছিলেন একজন আদর্শ অ্যানার্কিস্ট, কখনও নিজের মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সারা জীবন রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন এবং অতি সাধারণ সেই জীবনে ছিল প্রকৃত বিপ্লবীর যাপন। ৭৬ বছর বয়সে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “People like Loise Michel, Sabate, Durruti, all the expropriators taught me how to expropriate, but not for personal gain, but how to use those riches for change.” আজীবন তিনি বিভিন্ন ধরনের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। স্পেনের কাতালান উগ্র বাম সংগঠন ‘মোভিমিয়েন্তো ইবেরিকো দে লিবেরাসিয়োন’ বা ফ্রান্সের মার্ক্সবাদী ‘রিভোলিউশনারি ইন্টারন্যাশনালিস্ট অ্যাকশন গ্রুপস’ থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার সোশালিস্ট ‘ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি’-র সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়, “লুসিয়ো আধুনিক যুগের সেই দোন কিহোতে যিনি হাওয়া কলের দৈত্য নয়, সত্যিকারের দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন।”

 

অবিশ্বাস্য বৈচিত্রে ভরা তাঁর এই জীবন নিয়ে বার্নার্ড থমাস ফরাসি ভাষায় লিখেছেন একটি বই “লুসিয়ো উর্তুবিয়া: এক অদম্য অ্যানার্কিস্ট”, ২০০০ সালে প্রকাশিত। ২০০৯ সালে তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন পরিচালক হোসে মারিয়া গোয়েনাগা ও আইতোর আররেগি, নাম “লুসিয়ো”।

 

লেখক স্পেনীয় ভাষার প্রাক্তন অধ্যাপক ও অনুবাদক।

 

 

Share this
Leave a Comment