২৭ মে কিংবা ১০ জুন হল পুঁজিবাদ নামক বাঘটার বাঘজানের মানুষ-প্রকৃতি-ইতিহাসকে ছিঁড়ে ফেলার ভয়াবহ দিন। যে ঘটনার শুরু হল, সেটা আজও শেষ হয়নি। নির্বাপিত হয়নি আগুন। কবে নিববে আগুন? উত্তর নেই। কিন্তু একটা উত্তর আছে, তা হল, লাবণ্য শইকিয়া, বনলতা নেওগের মতো অসংখ্য মানুষের বুকের আগুন আর কখনো নিববে না। লিখেছেন দিগন্ত শৰ্মা।
স্বামীর মৃত্যুর পর বাঘজান গ্রামের লাবণ্য শইকিয়াকে তিনটি সন্তান ও বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব বহন করতে হয়েছিল। জীবিকার্জনের জন্য বাড়ির উঠোনে লাবণ্য খুলেছিলেন একটি ছোট পানের দোকান। দোকান চালানোর পাশাপাশি একটুকরো জমিতে চাষবাসও করতেন তিনি। সেখানে সুপুরি-পান, শাকসবজি উৎপাদনের পর বিক্রি করতেন। একটুকরো জমিতে স্বামীর বপন করা ছোট্ট চা-বাগানের চা-গাছের যত্ন নিতেন আর প্রায়ই হাত দিয়ে চা-পাতা ছিঁড়ে বিক্রি করতেন কাঁচা চা-পাতা। তাঁর শ্বশুর লম্বেশ্বের বয়স প্রায় আশি আর শাশুড়ি মিলেশ্বরীর বয়স সত্তর।
লাবণ্যর বড়মেয়ে করবীরেখা শইকিয়া দশম শ্রেণির ছাত্রী, দ্বিতীয় কন্যা বর্ণালি পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে আর ছেলে অসীম পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া। সম্প্রতি বাঘজানের তেলখাদ থেকে গ্যাস নির্গত হওয়ার পর গত ২৭ মে ঘরবাড়ি ছেড়ে এই পরিবারটি বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় স্থানীয় অস্থায়ী শিবিরে। স্বামীর অবর্তমানে ধীরে ধীরে অথচ কঠোর পরিশ্রমে লাবণ্যর লাবণ্যে বাগান, চা-গাছ, শাকসবজি, গরু-ছাগল নিয়ে পরিবার সহ ঘর হয়ে উঠেছিল লাবণ্যময়ী।
বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনার পাশাপাশি তিন সন্তানকে লালনপালন করছিলেন লাবণ্য। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একজন মহিলার ছোট্ট ব্যবসা, চাষবাস করাটাই হল নারী সবলীকরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হয়তো সেই অঞ্চলের মধ্যে মহিলা পরিচালিত একটি ‘রূপ-লাবণ্যময়’ ঘর ছিল লাবণ্য শইকিয়ার বাড়িটা। কিন্তু গত ১০ জুন বাঘজানের তেল-গ্যাস নির্গত খাদটা যখন জ্বলে উঠল আর তার পর আগুন যখন বাঘজান গ্রামের একটার পর একটা ঘর গ্রাস করতে থাকল, সেই আগুনে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল লাবণ্য শইকিয়ার বাড়িটাও। জীবনের বহু বাধা টপকে রক্ত-ঘাম-অশ্রু দিয়ে গড়া একজন মহিলার এতদিনের পরিশ্রমের ঘরটা পুঁজিপতি তেল কোম্পানির অবিবেচক কাণ্ড নিঃশেষ করে দিল।
যে বাড়িটার রূপ লাবণ্য বহন করেছিল নারী সবলীকরণের অন্যতম স্বাক্ষর, সেই বাড়িটা আর কখনো দেখা যাবে না বাঘজানে!
বাঘজানের বনলতা নেওগ নাম্নী মহিলার জন্য শুধু নিজের ঘর বা গ্রামই আপন ছিল না। তাঁর কাছে ডিব্রু-শৈখোয়ার জঙ্গল ছিল হৃদয়ের একান্ত আপন। বনলতার মতো এই অঞ্চলের অনেকের জন্যই সেই অরণ্য ছিল পরম প্রিয়। আপন ছিল অরণ্যের সন্তানরাও। কিন্তু তেল কোম্পানির পুঁজিবাদী লুণ্ঠন ও অবিজ্ঞানসুলভ কাণ্ডের জন্য বনলতারা হারাতে চলেছে একান্ত আপন অরণ্য। সেই অঞ্চলের মানুষের জন্য ডিব্রু-শৈখোয়া ছিল আবেগ ও উৎসাহের অমল উৎস।
২৭ মে কিংবা ১০ জুন হল পুঁজিবাদ নামক বাঘটার বাঘজানের মানুষ-প্রকৃতি-ইতিহাসকে ছিঁড়ে ফেলার ভয়াবহ দিন। যে ঘটনার শুরু হল, সেটা আজও শেষ হয়নি। নির্বাপিত হয়নি আগুন। কবে নিববে আগুন? উত্তর নেই। কিন্তু একটা উত্তর আছে, তা হল, লাবণ্য শইকিয়া, বনলতা নেওগের মতো অসংখ্য মানুষের বুকের আগুন আর কখনো নিববে না।
মানব চুতিয়া সেই অঞ্চলের শুধু একজন মানবতাবাদী যুবকই নন, তিনি একজন পরিবেশ কর্মীও। বন্যপ্রাণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা (WECO) নামের প্রকৃতিসেবী সংগঠনের সম্পাদক তিনি। মানব চুতিয়া, ডম্বরু চুতিয়ার মতো ব্যক্তির নেতৃত্বে মাগুরি মতাপুং বিলের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আন্দোলন ও গ্রাম্য পর্যন্টন ক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল। যেখানে নিয়োজিত হয়েছিল সেই অঞ্চলের অনেক যুবক-যুবতী। বিলটা নিয়ে এসেছিল গবেষণার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীকে। এসেছিল পর্যটক, বন্যপ্রাণ ফোটোগ্রাফার।
কিন্তু তেল কোম্পানির অবিবেচক কাণ্ড নিঃশেষ করে দিল সব। ঐতিহ্যমণ্ডিত বিলের বুকে নির্মল জলরাশি মিশে গেল তৈল পদার্থের সঙ্গে। তেলের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হল জলচর প্রাণীকুল, বিলের পাখির দল। ২০৯ রকমের বেশি প্রজাতির পাখির বিচরণস্থল, ৬টি প্রজাতির দুষ্প্রাপ্য কচ্ছপ ও অগণন জলজ উদ্ভিদ-প্রাণী থাকত এই বিলে, যার জন্য এটি ইতিমধ্যে গুরুত্বপূণ পক্ষী ক্ষেত্র বা ইম্পর্ট্যান্ট বার্ড এরিয়া বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই এই বিল বা বিল সংলগ্ন ডিব্রু-শৈখোয়া জাতীয় উদ্যানের পাশের তেলখাদ বিপদ ঘটাতে পারে বলে মানব চুতিয়ার মতো বহু প্রকৃতপ্রেমী সবাইকে সতর্ক করছিলেন।
বাঘজান থেকে বিলের মাঝে, নদীর মাঝে তেল পরিবাহী পাইপ স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। কেননা তেল পাইপ ফেটে ইতিপূর্বে (১৪.০৯.২০১৮) বিল-নদীর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু ‘অয়েল’ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনতা, পরিবেশ কর্মীর কথায় কান না দিয়ে সম্পদ লুণ্ঠন অব্যাহত রাখে। অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে সম্পদ লুণ্ঠন চালিয়ে জনসাধারণ, স্থানীয় পরিবেশ, প্রকৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাসের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার বিষয়ে সবাইকে অবজ্ঞা করল। ফলত গত ২৭ মে তেলখাদ থেকে নির্গত হল গ্যাস ও তেল। এর পর স্থানীয় জনতা বলেছিল যে তেল-গ্যাসের নির্গমন বন্ধ করো। কেননা রোদ দিলেই আগুন জ্বলে উঠবে। কিন্তু জনতার কথায় কোনো গুরুত্বই দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
অবশেষে ১০ জুন ভয়াবহ আগুন জ্বলে উঠল তেলখাদে। তার পর সেই আগুন বাঘজান গ্রামের ঘরবাড়ি, অরণ্য নিঃশেষ করে দিল। ভস্মীভূত হল লাবণ্য শইকিয়া, দীপ শইকিয়া, অমল শইকিয়া, বিকাশ শইকিয়া, লখিন মরান, সহদেব মরান, রীতু মরান, পাপুল মরান, হেমন্ত মরান প্রমুখের ঘরবাড়ি। ২৭ মে থেকে বাঘজান অঞ্চলের সবার থাকতে হল আশ্রয় শিবিরে। প্রায় দুহাজার লোককে আশ্রয় নিতে হয়েছে শিবিরে। সেখানে নেই কোনো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। অঞ্চলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর ছোট ছোট ছেলেমেয়ের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে দূরের আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেটাই কি সমাধান?
এখনও বাঘজানের আগুন জ্বলছে। অঞ্চলের জনতা ফের প্রতিবাদ করেছে প্রশাসনের কাছে। তাদের দাবি, অঞ্চলের জনগণকে সত্বর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অঞ্চলের বিল সহ প্রকৃতির সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বনলতা নেওগ বলেছেন, ‘আমরা সেই জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ছাই হতে বাধ্য হব যদি প্রশাসন উপযুক্ত পদক্ষেপ না করে।’
তাৎপর্যপূর্ণ যে সেই অঞ্চলের প্রায় দশ হাজার পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে মাগুরি-মতাপুং বিলের ওপর, স্থানীয় নদীর ওপর। ডাঙরী নদী, ডিব্রু নদী ও মাগুরি মতাপুং বিলই সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনের আয়ুরেখা স্বরূপ। সেই অরণ্য, নদী, বিলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছ সভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্য। কিন্তু আজ বাঘজানের আগুন শত শত পরিবারের উনুনের আগুন নিবিয়ে ফেলেছে। ডিব্রু-শৈখোয়া জাতীয় উদ্যানকে ধ্বংস করতে উদ্যত অয়েলের অবিবেচক কার্যকলাপ। ন্যাশনাল গ্রিন করিডোর প্রদত্ত নির্দেশিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে অয়েল, অভিযোগ এরকম।
যে বাঘজান, কলিয়াপানি গ্রামের মানুষ সম্পদ-ঐতিহ্য-প্রাকৃতিক সম্ভারে ঋদ্ধ ছিল, যে বাঘজানে এক নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার নির্দশন স্থাপন করেছিলেন, সেই বাঘজান-কলিয়াপনি গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখন দিনের পর দিন পার করছে আশ্রয় শিবিরে। এই বর্ষাকালে যাদের চাষবাসে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল, সেইসব কৃষিজীবীদের আজ ঘর থেকে দূরে আশ্রয় শিবিরে একবেলা একমুঠো খেয়ে বাঁচতে হচ্ছে। গৃহপালিত পশুপাখি হারিয়ে গেছে অনেকের। তেলের প্রকোপে জলেই যখন আগুন লেগেছে, জীবিকার সুযোগই-বা কোথায়? অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের বরাত পেয়ে তেলসম্পদ আহরণকারী গুজরাটের জন ইঞ্জিনিয়ারিং তেল কোম্পানির আগুনের চেয়েও স্থানীয় মানুষের বুকের আগুনের উত্তাপ আজ অনির্বাপিত। অঞ্চলের জনগণ এখন বন্যার সম্মুখীন। একদিকে তেল কোম্পানি থেকে বিপদ, অন্যদিকে নদীর ফুলে ওঠা জল থেকে বিপদ। তবে নদীর ফুলে ওঠা জল স্থানীয় মানুষের অতি পরিচিত। দুদিন থাকবে, তারপর চলে যাবে। রাস্তাঘাট শুকোবে। কিন্তু তেল কোম্পানি যে আগুন লাগাল সেই আগুন তেলখাদে নিবলেও অঞ্চলের জনসাধারণের বুকে জ্বলতে থাকবে চিরদিন, চিরকালের জন্য।
তেল কোম্পানির দৌরাত্ম্যে লাবণ্য শইকিয়ারা হারাল জীবনের লাবণ্য। প্রশ্ন উঠেছে – তেল কোম্পানি যে অর্থ দেবে সেই অর্থে অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতি-ঐতিহ্য-ইতিহাস-জীবিকা ফিরে পাবে তো? বছরের পর বছর একটা একটা করে জিনিস সংগ্রহ করে, একটি-দুটি করে চারা রোপণ করে, এক চাপড়া-দুচাপড়া করে মাটি এনে গড়া ঘরে এতদিন ধরে যেমনভাবে স্বপ্নের আপন ঘর হয়ে উঠেছিল – তা ফিরে আসবে কীভাবে?
২০০৫ থেকে বাঘজান-কলিয়াপানির গর্ভ থেকে বহু সম্পদ লুঠ করা হল। এখন অন্তত অঞ্চলের মানুষ-প্রকৃতি-ঐতিহ্যের বিষয়ে চিন্তা করুন, অন্যায়ের পথ ছেড়ে ন্যায় ও মানবতার দরজায় দাঁড়ান।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রত্যেক পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হওয়ার সময় বাঘজান অঞ্চলের জনসাধারণকে এই দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে বেরোতে হয়েছে রাজপথে, বলতে হচ্ছে – ‘সেই আগুনে আমরাও পুড়ে যাব’ বলে। অথচ সেই আগুন তারা জ্বালায়নি। দুর্যোগাক্রান্ত বাঘজানের জনতার মানবাধিকারকে মর্যাদা দিন, ন্যায় দিন, সুরক্ষিত হোক অঞ্চলের প্রকৃতি-পর্যটন-ঐতিহ্য। মাগুরি মতাপুং বিলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের জীবন-জীবিকা ফিরে আসুক। অধিকার দিন পক্ষীকুল, জলচর প্রাণীকে। ২০০৫ থেকে বাঘজান-কলিয়াপানির গর্ভ থেকে বহু সম্পদ লুঠ করা হল। এখন অন্তত অঞ্চলের মানুষ-প্রকৃতি-ঐতিহ্যের বিষয়ে চিন্তা করুন, অন্যায়ের পথ ছেড়ে ন্যায় ও মানবতার দরজায় দাঁড়ান।
বাঘজান অঞ্চলের খাদের তেল না হলেও চলবে পৃথিবীর চাকা।
- লেখক দিগন্ত শর্মা বর্তমানে স্বাধীন সাংবাদিক। দীর্ঘকাল তদন্তমূলক সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে আসামের জনজাতি ও সংখ্যালঘু জাতি, মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন।
- মূল অসমীয়া থেকে অনুবাদ করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক বাসব রায়।
Thanks for the nice report. The Baanglaa is nice.
A brief description, as a note if not in the original report, about the location, and the incident that led to the fire engulfing the locality will help understand the story.