গত দু’বছর জেলে রয়েছেন ভারভারা রাও। মহামারির শুরু হলেও তাঁকে বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হয়নি। বার্ধক্য ও অসুস্থতাজনিত নানা কারণে শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন এই প্রতিবাদী কবি। তাঁর পরিবারের তরফে বারবার তেলেঙ্গানা সরকারের কাছে এবিষয়ে আবেদন জানানো হলেও সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
গত ১১ জুলাই শনিবার যখন নিয়ম মতো পরিবারের মানুষদের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের তালোজা জেল থেকে কথা বলার সুযোগ পান জেল হেফাজতে থাকা প্রতিবাদী কবি, আন্দোলনকর্মী ৭৯ বছরের ভারভারা রাও তখন স্ত্রী ৭২ বছরের হেমলতা জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন আছো?’ উত্তরে ভারভারা বলতে শুরু করেন তাঁর পিতার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার কথা, যা আজ থেকে ৭০ বছরেরও পুরনো স্মৃতি। সেদিন তাঁর কথা ছিল সম্পূর্ণ অসংলগ্ন, পারম্পর্যহীন। তাঁর চিন্তাস্রোতের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। পরিবারের মানুষদের দূরভাষের ওপারে চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু কোনও প্রশ্ন বুঝতেই পারছিলেন না, নিজের মতো করে কিছু কথা বলে যাচ্ছিলেন, পরে চিকিৎসকেরা যাকে ‘হ্যালুসিনেশন’ বলেছেন। এর আগে জুন মাসের ২৪ তারিখ যখন তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন কিছুটা অন্যমনস্ক মনে হলেও জামিন ও অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তারপর ২ জুলাই কথা বলার সময়েই ভারভারা রাওয়ের পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারেন তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। সেদিন তিনি কথা বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছিলেন, তাঁর মতো অসাধারণ বক্তা একটি সম্পূর্ণ বাক্য বলতে পারছিলেন না, প্রতিটি শব্দ বলছিলেন কয়েক সেকেন্ড-এর বিরতিতে। একই কথা শিশুর মতো বারবার আওড়াচ্ছিলেন। আর তারপর ১১ তারিখ বোঝা যায় তাঁর অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে। যে সহবন্দী তাঁর সহায়ক হিসাবে সঙ্গে থাকেন তিনি সেদিন ফোন নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের জানান ভারভারা-র শরীর এতটাই খারাপ যে তিনি একা হাঁটতে পারেন না, শৌচালয়ে যেতে পারেন না, পরিষ্কার হতে পারেন না, দাঁত মাজতে পারেন না। একদিন হ্যালুসিনেট করে তাকে বলেছেন – তিনি জামিন পেয়ে গেছেন, বাড়ির লোকেরা জেলের দরজায় অপেক্ষা করছেন তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য।
১২ জুলাই রবিবার ভারভারা রাওয়ের পরিবারের সদস্যরা একটি অনলাইন/ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলন করে এই তথ্যগুলিই তুলে ধরলেন সাংবাদিকদের সামনে। অংশ নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী হেমলতা ও তিন কন্যা এবং ভাইপো ও সাংবাদিক বেনুগোপাল রাও। তথ্যগুলি বলার সময় বেনুগোপাল ও হেমলতা বারেবারেই কান্না চেপে ভেঙে যাওয়া কন্ঠ সামলে আলোচনায় ফিরতে বাধ্য হচ্ছিলেন। তাঁদের চাওয়া একটিই – দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সংবাদমাধ্যমে ভারভারা রাওয়ের জামিনে মুক্তি ও সঠিক চিকিৎসার দাবিতে বেশি সংখ্যক প্রতিবেদন প্রকাশিত হোক যাতে সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের উপর চাপ সৃষ্টি হয়।
ভারভারা রাও অত্যধিক অসুস্থতা নিয়ে ২৮ মে জে জে হসপিটাল-এ ভর্তি হন। ছাড়া পান ১ জুন। সে সময়ে তাঁর শরীরে পটাসিয়াম সোডিয়ামের মাত্রায় তারতম্য ছিল। এই রিপোর্ট তাঁর পরিবার সরাসরি পাননি। আদালতে পেশ হওয়ার পর আইনজীবী মারফৎ দেখেছেন। শরীর সুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও সে সময়ে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। তিনি শুধু বয়সের কারণেই শারীরিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন তা নয়, তিনি হাইপারটেনশন, পাইলস, হজমের সমস্যার মতো নানা বার্ধক্যজনিত রোগেও আক্রান্ত। তার সঙ্গে পটাসিয়াম-সোডিয়াম ভারসাম্যহীনতা তাঁকে মাত্রাতিরিক্ত অসুস্থ করে তুলেছে। তাঁর সাম্প্রতিকতম অসুস্থতার কারণও তাই বলছেন চিকিৎসকেরা।
গত দু’বছর ধরে ভারভারা রাও বন্দীদশায় রয়েছেন। তেলেঙ্গানার এই কবি ও প্রতিবাদীকে প্রথমে তাঁর বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়, তারপর তেলেঙ্গানার জেল থেকে মহারাষ্ট্রের ইয়েরওয়াড়া জেল ও তারপর তালোজা জেল-এ স্থানান্তরিত করা হয়। তালোজা জেল-এ যেখানে ২১১০ জন বন্দীর স্থান হতে পারে, সেখানে প্রায় ৩৫০০ বন্দী ছিলেন। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যেতে পারে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি, বন্দী পরিষেবার বাস্তব চিত্রটা কতটা ভয়াবহ।
এরমধ্যেই দেখা দেয় কোভিড ১৯ সংক্রমণ। মহামারির চেহারা নেয় সারা দেশ জুড়ে। তখনই অন্য অনেক কারাগারের মতোই তালোজা-তেও কর্তৃপক্ষ এমন বন্দীদের একটি তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ পায় যেখানে বয়স, কো-মর্বিডিটি, শারীরিক অবস্থার নিরিখে তাদের জামিনে মুক্তি দেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করা যেতে পারে। ইউএপি-এতে আটক হলেও বয়স, অসুস্থতা, কো-মর্বিডিটি ইত্যাদির কারণে ভারভারা রাও এই তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হতে পারতেন, কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে এই তালিকায় ভারভারা রাওয়ের নাম নেই। অবশ্য গত দু’বছরে কম করেও পাঁচ বার তাঁর জামিনের আবেদন না-মঞ্জুর হয়েছে, নানা অছিলায়, আইনের ফাঁক গলে। এবং এই বিচারাধীন থাকার সময়কালটাই যেন তাঁর জীবনে চূড়ান্ত শাস্তি হয়ে উঠেছে।
১২ জুলাইয়ের সাংবাদিক সম্মেলনে বারবারই তাঁর পরিবারের তরফে যে দাবিটি জানানো হয়, তা হল ভারভারা রাও-এর ক্রমশ অবনতি হতে থাকা শারীরিক অবস্থার কারণে তাঁকে দ্রুত কোনও উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে পারে এমন হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হোক। সেটা জেল কর্তৃপক্ষ করলে ভালো নতুবা তাঁর জামিনের আবেদন আদালতে মঞ্জুর করে পরিবারের সদস্যদের তাঁর জরুরি চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। রাষ্ট্র তাঁকে বন্দী অবস্থাতেই যেন হত্যা করতে চাইছে, যা একজন প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের ক্ষেত্রে কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। পরিবার সূত্রে আরও বলা হয় যে, গত দু’বছর ধরে তিনি যথেষ্ঠ হেনস্থা সহ্য করছেন, এবার বিনি চিকিৎসায় তাঁকে যেন জেলের ভেতরেই মেরে ফেলা না হয়, তাঁকে যেন উন্নত ও ভালো চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগটুকু দেওয়া হয়। বিচারাধীন বন্দীদেরও তো স্বাস্থ্য পরিষেবা, চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী তাঁর থেকে জীবনের অধিকার কেড়ে নিতে পারে না রাষ্ট্র।
গত দু’বছরে দফায় দফায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালদের কাছে তাঁর মুক্তির আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখেও কোনও সাড়া পাননি ভারভারা-র পরিবারের সদস্যরা। এরই মধ্যে বারেবারে সেশন কোর্টে খারিজ হয়েছে জামিনের আবেদন। মহারাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল অফ প্রিজন একবারই চিঠির উত্তরে জানিয়েছিলেন তিনি বিষয়টি দেখছেন, তবে যথারীতি কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। তেলেঙ্গানা পৃথক রাজ্য হিসাবে গড়ে ওঠার সময়ে এই প্রতিবাদী কবির ভূমিকা ভোলার নয়, অথচ তাঁর মুক্তির ব্যাপারে তেলেঙ্গানা সরকারের উদাসীন ব্যবহারে কবির পরিবার মর্মাহত। সেই ১৯৭৩ সাল থেকেই এই প্রতিবাদী, সরকারের সমালোচনাকারী, মানবাধিকারের পক্ষে নিরন্তর সওয়াল করে চলা মানুষটিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দল বারে বারেই আটক করে জেলে পুরেছে। অধিকাংশই মিথ্যা মামলায়।
তবে, এদিনের সম্মেলনে বেনুগোপাল যেমন বললেন, “আমরা এমনি এই মুহূর্তে তাঁর বন্দীদশা, মিথ্যা মামলা এই বিষয়গুলি নিয়েও কথা বলছি না। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই জানি সেই লড়াইটা কীভাবে লড়তে হয় ও সেটা চালিয়ে যাব। এখন আমরা জরুরি ভিত্তিতে শুধু তাঁর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে সরকার ও বিচারব্যবস্থাকে মানবিক হতে বলছি। একজন কবি, বুদ্ধিজীবী, সৃষ্টিশীল মানুষ জেলের ভেতরে মারা গেলে তার চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছুই হবে না আর রাষ্ট্র এর জন্য উত্তর দিতে বাধ্য থাকবে। রাষ্ট্র এখন যেটা করছে তা একজন চরম অসুস্থ মানুষকে ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা না দেওয়া, অবহেলা করা, যা অপরাধযোগ্য।’ তাছাড়া বেশ কয়েক বার ছড়িয়েছে তাঁর মৃত্যুর গুজব, ফেক নিউজ, যা পরিবারের দাবি – এক ধরনের চক্রান্ত, আতঙ্ক-বিশৃঙ্খলা তৈরি করে তাঁর সমর্থনে থাকা মানুষদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য।
ভারভারা রাওয়ের পরিবার হাই কোর্টে জরুরি ভিত্তিতে আবারও জামিনের আবেদন করতে চলেছে। দেশের বিচার ব্যবস্থা আদৌ মানবিক হয়ে ওঠে কি না তা সময় বলবে। ইতিমধ্যে সারা দেশ মুখর হয়েছে তাঁর মুক্তির দাবিতে। সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল #ReleasethePoet হ্যাশট্যাগ-এ। ভারভারা রাও-এর মুক্তির লড়াই নিঃসন্দেহে দেশের নানা প্রান্তের প্রতিবাদের স্বরকে একজোট করে তুলেছে এই মহামারি আর দূরত্ব বিধি মানার সময়ে।
Please Release The poet Vara Vara Rao from jail .