সংবিধান বাতিল হয়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারও নয়। সাংবাদিকদের ধারাবাহিক ভাবে গলা টিপে ধরার প্রয়াস — হুমকি, গ্রেপ্তার এমনকি খুন — জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। যেন অঘোষিত এক জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে দেশ। এমন দমবন্ধ পরিবেশের বিস্তৃত ছবি তুলে ধরলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
দ্বিতীয় পর্ব
সংবাদ মাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন ১৯৭৫ সালে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নির্দয়ভাবে কেড়ে নিয়েছিল, আটক করে জেলে পোরা হয়েছিল প্রায় ৭০০০ সাংবাদিককে যাতে দেশে চলতে থাকা স্বৈরাচার, বেআইনি ধরপাকড়ের খবর কোনওভাবেই সামনে না আসে, যেভাবে রাতারাতি ‘প্রেস অ্যাডভাইসার’-এর পদ তৈরি করে সংবাদপত্রে কী খবর ছাপা হবে ও হবে না তা সেন্সর করা হয়েছিল টানা ২১ মাস ধরে, তার সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির আনুপূর্বিক মিল রয়েছে। এখন নিশ্চিতভাবেই সংবাদ প্রকাশের মাধ্যম অনেক বেশি হয়ে গেছে – বিশেষত স্মার্টফোন আর অনলাইন সংবাদ প্রকাশের সুযোগ ঘটে যাওয়ায় সত্য লুকিয়ে রাখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না আর। আর সেই কারণেই তীব্র হচ্ছে রাষ্ট্রের নজরদারি এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা সরকারের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করছে পুলিশ প্রশাসন ও দেশের বিচারব্যবস্থার লজ্জাজনক অবস্থান নাগরিকদের ক্রমেই আশাহীন করে তুলছে। হয়তো এখন প্রকাশ্যে কিংবা কোনও ঘোষিত ‘প্রেস অ্যাডভাইসার’ নেই, কিন্তু রয়েছে শাসকদলের হিতাহিতজ্ঞানশূন্য সমর্থকেরা। যারা সাংবাদিকের ক্যামেরা থেকে কলম, সম্মান থেকে প্রাণ – কোনওটাই কেড়ে নিতেই এক মুহূর্ত দ্বিধা করে না। সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বিপ্রতীপে তারা দাঁড় করাতে চায় ‘ফেক নিউজ’-এর কারবারকে।
এই বছরের শুরু থেকে রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের মাঝে দেশের বর্তমান বিজেপি শাসিত সরকারের দাঁত-নখ আরওই বেরিয়ে পড়েছে। প্রথমে সিএএ-এনআরসি বিরোধী দেশব্যাপী যে আন্দোলন তাকে কোনওভাবেই সামলাতে না পারা এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সে সংবাদের উপস্থাপনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ায় তারা তাদের দ্বারা সম্পূর্ণ প্রভাবিত জাতীয় সংবাদমাধ্যমে এর বিপরীত উপস্থাপনা শুরু করে। এই সময়ে ‘রিপাবলিক টিভি’, ‘টাইমস্ নাও’, ‘আজ তক’-এর মতো টেলিভিশন সংবাদ চ্যানেল-এর কথা বলা যেতে পারে, যারা সংবাদের নামে সরাসরিই কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু বিরোধী হিন্দুত্ববাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘অ্যাজেন্ডা’ ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে চলেছে। যদিও অনেক সংবাদপত্রের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেকটাই সদর্থক ছিল। ‘এনডিটিভি’, ‘ইন্ডিয়া টুডে’-এর মতো টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল নাগরিক সমাজ, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে যতই নিরপেক্ষভাবে সামনে নিয়ে এসেছে ততই ‘গোদী মিডিয়া’ তাদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে দেগে দিয়েছে। দেশের শাসনব্যবস্থার শীর্ষ নেতারা বিরোধী মতপ্রকাশকারী নাগরিকদের ‘দেশদ্রোহী’ বলছে ও এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম তাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে, এমনটা দুর্ভাগ্যজনক।
তবে আশার কথা দেশের নাগরিকেরা এখন এই নিরপেক্ষ ও মেরুকরণ ঘটে যাওয়া সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে তফাৎটা করতে পারছেন সহজেই। ফেক নিউজ কীভাবে দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে হিংসা ছড়াতে পারে সে বিষয়েও সম্যক ধারণা তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই শাহিনবাগের মতো আন্দোলন মঞ্চে রিপাবলিক টিভি-র অর্ণব গোস্বামী বা জি নিউজ-এর সুধীর চৌধুরীরা সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের সামনেই আটকে পড়েন, ঢুকতে পারেন না। নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী সাংবাদিকতা এখন এতটাই বিরল ও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে যে একমাত্র রভিশ কুমার, যিনি আসলেই সাংবাদিক হিসাবে নিজের পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিচ্ছেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে, একমাত্র তাঁকেই এসময়ের ‘আইকন’ ধরে নিতে হচ্ছে, অন্য কাউকে তেমন চোখেই পড়ছে না। এই যে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ এবং কতিপয় সাংবাদিকের, সংবাদমাধ্যমের পেশাদারীভাবে সাংবাদিকতার প্রচেষ্টা তাই সম্ভবত ভয় পাইয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রকে। সেইজন্যই যেকোনওরকম সুযোগ পেলেই এই সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের উপরে আইন ব্যবহার করে রাষ্ট্র যেন প্রতিশোধ নেওয়ার খেলায় মেতেছে।
১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার সময়ে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবাদপত্রের ছাপাখানাতেও তল্লাশি চালিয়েছেন, চেয়েছেন প্রতিটি সংবাদমাধ্যম সরকারের মুখপত্র হয়ে উঠুক, একটিও সরকারবিরোধী সংবাদ যেন প্রকাশিত না হয়, সরকারের অঙ্গুলিহেলনে চলুক সাংবাদিকতা। তিনি বহুলাংশেই সফল হয়েছিলেন সেই চেষ্টায়। হাতে গোনা কিছু সংবাদমাধ্যম ছাড়া আর কেউই এই স্বৈরাচারিতার বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি। কারণ সকলেই স্রেফ টিকে যেতে চেয়েছিলেন। যাঁরা সেটা চাননি তাঁরাই জেলে আটক হয়েছেন, তাঁদের সংবাদমাধ্যমকে সরকারের লাল চোখ দেখতে হয়েছে। টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, স্টেটসম্যান, হিম্মত-এর মতো সংবাদপত্র বুক ঠুকে জরুরি অবস্থা ও সংবাদপত্রের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের বিরোধিতা করে গিয়েছিল তার আঁচও পোহাতে হয়েছিল তাঁদের। অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে সেসময়ে প্রধানমন্ত্রী ও সরকার সংবাদমাধ্যমগুলিকে জানিয়েছিলেন যে, চিন্তার কিছুই নেই, সব ঠিক আছে, শুধু স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহ ও তা প্রকাশ করা যাবে না। কারণ তাতে দেশের সার্বভৌমত্ব-শান্তি-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী আচরণ, দমন-পীড়ন আড়াল করতে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের এই কৌশল শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দেয় বই-কি। তবে এর সামনে মাথা উঁচু করে রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর নামই তো সাংবাদিকতা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, স্টেটসম্যান সেই সময়ে এই জরুরি অবস্থার বিরূদ্ধে সাদা সম্পাদকীয় পাতা ছেপেছিল। আর এখন যখন কাশ্মীরের সাংবাদিক ও সম্পাদক সুজাত বুখারিকে হত্যা করা হল তখন সেখানেও সংবাদপত্রগুলিতে সাদা সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা চোখে পড়ল হত্যার চরমতম প্রতিবাদ হিসাবে। কাশ্মীরে বর্তমানে সাংবাদিকতার বিষয়ে আসলে আলাদাভাবেই প্রতিবেদন লেখা প্রয়োজন। কাশ্মীরে ৩৭০ রদ করাকে কেন্দ্র করে সেখানে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ জারি হওয়া ও বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমগুলিকে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে দেওয়ার যে নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা এখনও পর্যন্ত ঘটে চলেছে তা স্বাধীন ভারতের অন্যতম লজ্জাজনক ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা শুধু সাধারণ মানুষকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখাই নয়, সংবাদ সংগ্রহ ও সংবাদ প্রকাশ বন্ধের কফিনে শেষ পেরেক। খবর সংগ্রহ করার উপর যেমন চরম নজরদারি চলেছে তেমনি ডিস্ট্রিবিউশন ও বিপণনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। মিডিয়া ফেসিলিটেশন কেন্দ্র থেকে কোন্ সাংবাদিক খবর পাঠাতে পারবেন আর কে পারবেন না তা পুরোটাই নির্ভর করেছে প্রশাসনের বিচারের উপরে। বহু সংবাদপত্র বিনা সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছে। কেউ কেউ নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে লেখা ছাপতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমকে একপ্রকার ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিছু কিছু ডিজিটাল মাধ্যম বা অনলাইন নিউজ পোর্টাল চেষ্টা করেছে, যেহেতু অনলাইনে এখনও পর্যন্ত কোনওরকম ‘সেন্সরশিপ’ করা সম্ভব নয়, তবু সেক্ষেত্রেও সাংবাদিকেরা নির্দিষ্ট সময়ের পর কাজে বাধা পাওয়া, আতঙ্কিত হয়ে কাজ না করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে গেছেন। এই যে সংবাদমাধ্যমের মধ্যে ভয় বা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা তাতে সফল হয়েছে বর্তমান সরকার। তবু তারই মাঝে গওহর গিলানি, মাসরাত জাহারা, পিরজাদা আশিক, অনুরাধা ভাসিন-এর মতো লেখক ও সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক, সম্পাদকেরা রয়ে যাবেন। যারা সমস্ত বাধা ও রাষ্ট্রের চোখ রাঙানির বিরূদ্ধে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় শোষন, কেন্দ্রের হঠকারী ও অমানবিক সিদ্ধান্তের কারণে নাগরিকদের উপরে তার প্রভাব নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাবেন। গওহর, মাসরাত ও পিরজাদা-কে গত এপ্রিল মাসে ইউএপিএ আইনে অভিযোগ আনা হয়। মাসরাত ও পিরজাদাকে বার বার থানায় জেরা করে পুলিশ। আইনবিরোধী কাজ অর্থাৎ নিজেদের লেখা, ছবি, রিপোর্টে আসল কাশ্মীরের নির্ভীক উপস্থাপনা করেছেন তাঁরা – যেখানে স্পষ্ট রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক নির্মম শাসন ও অত্যাচার। ৩৭০-উত্তর কাশ্মীর বা তারও আগের রাষ্ট্রীয় শোষণের যে সত্যি রাষ্ট্র গোপন করে রাখতে চায় তারই নগ্ন রূপ দেখিয়েছিলেন তাঁরা। চাটুকারিতায় ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠা দালাল মিডিয়ার ব্যবসা বা কেরিয়ার বাঁচানো সাংবাদিকতা নয় ‘ওল্ড স্কুল’ সাংবাদিকতার প্রকৃত উদাহরণ তো এঁরাই। তাই এঁদের জন্য বড্ড জরুরি হয়ে ওঠে ইউএপিএ প্রয়োগ। তাতে অবশ্য সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায় চিন্তা আর আদর্শের স্বাধীনতায় বেড়ি পরানো যায় না। আর তাই মাসরাত জাহারার ছবি জিতে নেয় সাহসী সাংবাদিকতার জন্য আর্ন্তজাতিক পুরস্কার। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে উত্তাল হয় সারা দেশ। মাসরাতের মতো সাংবাদিকদের হয়তো রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে যেতে হয় কিন্তু তার জন্য তাঁদের তোলা ছবি, তাঁদের লেখা প্রতিবেদন মিথ্যে হয়ে যায় না, হারিয়ে যায় না। বরং তাই হয়ে ওঠে সময়ের দলিল, প্রতিরোধের হাতিয়ার।
লেখক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক।
প্রথম পর্ব : আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র, অঘোষিত জরুরি অবস্থা এবং ভারতে সাংবাদিকতার স্বরূপ