মোদীবাবুর অপরিকল্পিত লকডাউন-এর প্রথম সপ্তাহ পেরনোর আগেই থেকেই সোনাগাছির বেশিরভাগ মেয়েরই অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল। এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের প্রায় ৬ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে আটকে পড়ে যেমন চরম দুর্দশায় পড়েছেন, কলকাতার যৌনপল্লীগুলির প্রায় ১০ হাজার মেয়ের অবস্থা তার থেকে কিছু কম ভয়াবহ নয়। লকডাউনের দিন দশেকের মধ্যেই কোনোরকমে চালডাল ফোটানোর মতো অবস্থাও ওদের থাকত না যদি না বাইরে থেকে ত্রাণ পৌঁছত। লিখেছেন তরুণ বসু। তৃতীয় কিস্তি।
প্রথম কিস্তি – এই লিঙ্কে।
দ্বিতীয় কিস্তি – এই লিঙ্কে ।
All history must be studied afresh, the conditions of existence of the different formation of society must be examined individually before the attempt is made to deduce from the political civil-law, aesthetic, philosophic, religious, etc., views correspondingly to them. – Frederic Engels to Conrad Schmidt, 1898 [১]
করোনা মহামারীর কবলে পড়ে সোনাগাছির মেয়েরা কেমন আছে – জানার জন্যে ঢুকে পড়েছিলাম ওদের অন্দরে। দ্বিতীয় পর্ব লেখার পর দেখলাম, বাকি থেকে গেছে অনেক কথা। এই পর্বে ওদের পেশা, পুরাণ-ইতিহাসে ওদের অবস্থানের খোঁজ। বর্তমান সময়কে কেন্দ্র করে, ফলাফল ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই-ই হোক, চর্চাটি চলবে এই পেশায় আসা বা থাকা মেয়েদের কথাগুলো একটু স্পষ্টভাবে বুঝতে, ওদের-ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটু পরিষ্কারভাবে জানতে।
১
মার্ক্সীয় ব্যাখ্যায় সমাজের মূল চালিকা শক্তি হলো অর্থনীতি। আর তার সঙ্গে থাকতে পারে আইন-ধর্ম-দর্শন ইত্যাদি। যেমন, এঙ্গেলস জোসেফ ব্লককে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন: We make our history ourselves, but, first of all, under very definite assumptions and conditions. Among these the economic ones are ultimately decisive. But the political ones, etc., and indeed even the traditions which haunt human minds also play a part, although not the decisive one. [২] অর্থাৎ আশপাশ যাই-ই থাক না কেন, শেষপর্যন্ত অর্থনীতিই ভিত এবং নিয়ামকও বটে। সোনাগাছির অন্দর হাতড়ে দেখা গেল প্রধানত আর্থিক অসঙ্গতির কারণেই মেয়েরা এই পেশায় আসে। [৩] তা সে স্বেচ্ছায় হোক বা অন্য কোনোভাবে। তবে কারণটা প্রবল দারিদ্র্য হলেও মনে রাখতে হবে – এই সমাজ ব্যবস্থায় একজন শ্রমজীবী মানুষ নামে ‘স্বাধীন’ হলেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার তাগিদেই প্রতিযোগিতাময় বাজারে সে যখন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পরাধীনতার শেকলে তখ তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কোনো ভূমিকার প্রসঙ্গ অবান্তর। তত্ত্বগতভাবে এই ধারণার সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই যেমন ঠিক, তেমনই ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের গোলোকধাঁধায় ফেলে ঐ বিষয়টিকে সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। তাছাড়া এ-দেশের সমাজ একজন প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ন্যূনতম চাহিদা-জোগানের বাইরেও কিছু দায় ঘাড়ে চেপে বসে। ফলে তাকে খুঁজে নিতে হয় এমন এক আপাত সহজ রাস্তা যাতে এই ঋণ শোধ করার ক্ষমতা তার হয়। বলা বাহুল্য, এইরকম পরিস্থিতিতে তথাকথিত সামজিক নৈতিকতা হালে পানি পায় না। যদিও তথাকথিত ভারতীয় সমাজে একজন নারীর পক্ষে এই কাজটি যথেষ্ট দুরূহও বটে। এ-সম্পর্কে ঐ সোনাগাছি থেকে পাওয়া একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
২০০৯-১০ সালে সোনাগাছি-রামবাগান-শেঠবাগান অঞ্চলের বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম ওদের সম্পর্কে আরও কিছু জানতে। [৪] একদিন অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট-এর একজন যৌনকর্মীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় আরও একটি মেয়ের দেখা পাই। সে ছিল চলমান যৌনকর্মী মানে ‘ফ্লাইং সেক্স ওয়ার্কার’। এর কিছুদিন আগে গত দশকের পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম আর্থিক কেলেঙ্কারি সারদা ঘটে গেছে। মেয়েটি জানিয়েছিল, এক সময়ে সে ছিল সারদার এজেন্ট। সারদা কোম্পানি লাটে ওঠার পর সে যাদের আমানত করিয়েছিল তারা তাদের গচ্ছিত টাকা ফেরত চায়। তারা সারদা জানে না, এজেন্টের কথায় বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছিল। সুতরাং তাকেই ফেরত দিতে হবে। আর টাকা ফেরত পেতে তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যে মেয়েটির নিজেরই টেঁকা দায় হয়ে উঠেছিল। একসময় এমনকি রাস্তাঘাটে বেরনোই তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় বার করতে না-পেরে সে যৌনকর্মের পথ বেছে নেয়, আমানতকারীদের টাকা শোধ করতে, মানে, [সারদা-র] জোচ্চুরির দায় মেটাতে। অবশ্য এমন আখ্যান আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। এ-দেশের শতকরা ৯০ জন নিরীহ সাধারণ মানুষ নিজেরা অনাহারে, অশিক্ষায়, অচিকিৎসায় থেকে দায় মেটায় এই সময়ের ধান্ধাবাজ-রাজনীতিবিদ, অসৎ-শিল্পপতি বা দুর্নীতিবাজ-বানিয়ার জোচ্চুরির। সে যাই হোক, সেদিন ঐ মেয়েটি কাতর হয়ে বলেছিল, “আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আমি যতটা লেখাপড়া জানি তাতে এমন কোনো কাজ আমি পেতাম না যা করে আমি এই টাকা শোধ করতে পারি।” যদিও এটা মানতে অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই যে, যে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রান্তে এই মানুষদের বাস সেখানে এর থেকে ভালো কিছু ঘটানোর অন্য কোনো রাস্তা বোধহয় তাদের জন্যে খোলা থাকে না। তারপরও ধরে নেওয়া যায়, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যদিও অন্যের, মূলত পরিবারের পুরুষের যেমন বাবা, স্বামী বা সন্তানের আর্থিক ঋণ শোধের দায়ে একটি মেয়ের এই পেশায় আসার ঘটনাও অবশ্য নেহাৎ কম নয়। বলা বাহুল্য, এও সেই চরম আর্থিক-সামাজিক দুর্দশা থেকে মুক্তির উপায়। আরও দু-একটা এমন উদাহরণ দেওয়াই যায়। যেমন দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম, সে এই পেশায় এসেছিল কারণ, স্বামী জুয়া খেলেছিল ঘরবাড়ি বন্ধক রেখে। এ-ছাড়াও, এমনকি আরও যে নগদ টাকা ধার করেছিল, সন্তানপালন ছাড়াও, সেই ঋণ শোধের দায়ও বর্তেছিল ঐ মেয়েটির কাঁধে। বাবা-স্বামী-সন্তানের দায় বহন কি তার ব্যক্তিগত নৈতিকতা নাকি সামাজিক চাপে বাধ্য হওয়া! একুশ শতকের নারীবাদের হাজারো তথ্য-তত্ত্বের আঁচে গরম হওয়া অতি সামান্য অংশের ওপরতলার নারীদের চকমিলান্তি ‘ডেটা’র হিসেবের খোপে আঁটবে না ‘বাধ্য-হয়ে স্বামী-সন্তানের দায়’ বহনকারী এই প্রান্তজীবী নারীর শ্রমের হিসেব।
এই প্রতিবেদনের পর্ব ২ শেষ করেছিলাম এই বলে যে: পেশাটা দু-হাজার বছর ধরে টিঁকে আছে, এও এক আয়রনি! সুতরাং এই পর্যন্ত পৌঁছে আমরা জানতে চাইতে পারি: দু-হাজার বছর আগে এই পেশায় আসার কারণ কী ছিল? প্রাচীন সংস্কৃত বা পালি (বৌদ্ধ) সাহিত্য থেকে বহু ‘গণিকা’-র নাম আমরা জেনেছি, যেমন, আম্রপালী, শামা, বাসবদত্তা, কিংবা কামমঞ্জরী বা বসন্তসেনা ইত্যাদি। আম্রপালী বা অম্বপালীর কাহিনি (৮.১.১) গৌতম বুদ্ধের এবং রাজা বিম্বিসারের সূত্রেই বেশি পরিচিত। এটি পাওয়া যায় বৌদ্ধসাহিত্যর মহাবগগ-য় যেটি একটু বড় আকারে বিনয়বস্তুতেও পাওয়া যায়। দুটি পুঁথিতেই মূল বিষয়বস্তু একই, কীভাবে একজন নারীকে গণিকা করে তোলা হলো। কাহিনিটি এরকম : বৈশালী নগরীর এক আম্রবৃক্ষের তলায় একটি অতীব সুন্দরী কন্যা কুড়িয়ে পায় ঐ বাগানের এক মালী। আমগাছের তলায় পাওয়া গিয়েছিল বলে তার নাম রাখা হয়েছিল আম্রপালী (পালিতে অম্বপালী)। মালী তাকে লালনপালন করে এবং বড় হলে নগরে নিয়ে যায়। আম্রপালীর রূপলাবণ্য ও নৃত্যগীতে পারদর্শিতা দেখে বৈশালীর বহু যুবক তাকে বিয়ে করার জন্যে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় নগরের পরিচালকরা ঠিক করে যে, কোনো যুবকই এককভাবে তাকে লাভ করতে পারবে না। তাকে গণভোগ্যা হয়ে থাকতে হবে। প্রতি রাত্রে একেক জনের মনোরঞ্জন করত আম্রপালী এবং তার জন্যে সে ৫০ কার্ষাপণ মজুরি পেত। তার আয় থেকে রাজাকে কর দিতে হতো। [৫] অর্থাৎ নৃত্য-গীত পটীয়সী সুন্দরী আম্রপালী কোনো একক পুরুষের ‘সম্পত্তি’ হবে না বলে তাকে গণিকা হতে হলো। কিন্তু সব গণিকাকেই তো এমনভাবে সৃষ্টি করা হতো না। তাহলে আর কী কী কারণে সমাজে গণিকার সৃষ্টি হতো? সে কি যৌন-পেশা একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃত ছিল তাই, যেমন ‘কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র’-য় পাওয়া যায়, [৬] নাকি দারিদ্র্যের কারণে? তাহলে কি পাচার হয়ে আসত নাকি কিনে আনা হতো? বাল্য-বৈধব্যর কারণেও কি গণিকার জন্ম হতো? নাকি যুদ্ধ-বন্দি করে আনা মেয়েদের এই পেশায় নিয়ে এসে ফেলা হতো? অথবা গুপ্তচর বৃত্তির বা অন্য কোনো রাজকীয় কারণে? তুলনায় নবীন আমলের একটি তথ্য পাচ্ছি সতেরো শতকের ফরাসি পর্যটক জ্যঁ-বাপতিস্ত তাভারনিয়ে (১৬০৫-১৬৮৯)-এর লেখায়। তাঁর যাত্রাপথের বিবরণের এক জায়গায় তিনি বলছেন: After Cambay you next reach a village which is only three coss distant, where there is a pagoda to which the majority of the courtesans of India come to make their offerings. This pagoda contains many nude figures, and among others a large figure like an Apollo, which has the private parts all uncovered. When the old courtesans have amassed a sum of money in their youth, they buy young female slaves, to whom they teach dances and lascivious songs, and all the tricks of their infamous trade. When these young girls have reached the age of eleven or twelve years their mistresses take them to this pagoda, as they believed that it will be good fortune to them to be offered and abandoned to this idol.[৭] অর্থাৎ বয়স্ক গণিকারা অল্প বয়সী মেয়ে-দাস কিনে নিয়ে তাদের গণিকাবৃত্তিতে দক্ষ করে এই মন্দিরে রেখে যেত ভবিষ্যতের ভালোর আশায়। এখানে আরও লক্ষণীয় যে, তিনি একে বলছেন ‘infamous trade’। আমাদের জানা জরুরি, কীভাবে এই পেশায় আসত গণিকারা, কারণ সে যুগের নারীর অবস্থান এবং এই পেশা – দুটি বিপরীতমুখী দিক।
২
মহাভারতের উদযোগপর্বে একটি শ্লোক আছে। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রর দূত হয়ে যুধিষ্ঠির-এর কাছে গেছেন “যাহাতে যুদ্ধানল প্রজ্জ্বলিত না হয় এবং ভারতগণের হিত লাভ হইতে পারে, তুমি উপযুক্ত অবসর বিবেচনা করিয়া রাজগণের [পাণ্ডবদের] মধ্যে সেইরূপ বাক্য প্রয়োগ করিবে।” – অর্থাৎ সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে। সঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর যুধিষ্ঠির একে একে সবাইয়ের কুশল জানতে চাইছেন। তার মধ্যে এক জায়গায় বলছেন : অলংকৃতা বস্ত্রবত্যাঃ সুগন্ধা অবীভৎসাঃ সুখিতা ভোগবত্যাঃ। লঘু যাসাং দর্শনাং বাক চ লঘ্বী বেশস্ত্রিয়ঃ কুশলং তাত। পৃচ্ছেঃ।। [৮]
অর্থ্যাৎ, ‘যাহাদের দর্শন ও বাক্য মনোহর এবং যাহারা অলংকৃতা, সুবসনা, সুসৌরভা, সদ্ব্যবহারা, সুখশালিনী ও ভোগপরায়ণা সেই সকল বেশ্যাদের নিকটেও মঙ্গল জিজ্ঞাসা করিও।’ আমি হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ সংস্করণ থেকে এই উদ্ধৃতি দিলাম। কথাগুলি আরও অনেকেই উল্লেখ করেছেন। যেমননৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর ‘কৃষ্ণা কুন্তী ও কৌন্তেয়’ গ্রন্থে বেশ গদগদ হয়ে যুধিষ্ঠির-এর মহানুভবতা [৯] বোঝাবার জন্যে এই শ্লোকটির উল্লেখ করেছেন, ‘যাদের দেখতে ভাল লাগে, যাদের কথা শুনতে ভাল লাগে, খুব গয়না পরে, খুব সাজে, সেই সুখশালিনী সেই বেশ্যাদের কাছে গিয়েও আমার হয়ে কুশল জিজ্ঞাসা কোরো – বেশস্ত্রিয়ঃ কুশলং তাত পৃচ্ছেঃ।’ [১০] রাজশেখর বসুও তাঁর ‘কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত’ সারানুবাদে এই অংশটি রেখেছেন, ‘বেশ্যা দাসদাসী খঞ্জ ও কুব্জদের, এবং অন্ধ ও বধির শিল্পীদের অনাময় জিজ্ঞাসা ক’রো।’ [১১] কালীপ্রসন্ন সিংহ-র অনুবাদে আছ “যে সকল বনিতা, দৃষ্টিপথে আগমন বা সমক্ষে কথোপকথন করেন না, তাঁহাদিগকেও কুশল জিজ্ঞাসা করিবে।” [১২] উল্লেখ্য যে, বাঙালির সবচেয়ে পরিচিত কথকীয় ঢঙে সুর-করে-পড়া কাশীরাম দাসের মহাভারতে এর কোনো উল্লেখ নেই। আর উপরে বলা অনুবাদের একটিতে পাই “যাহারা অলংকৃতা, সুবসনা, সুসৌরভা, সদ্ব্যবহারা, সুখশালিনী ও ভোগপরায়ণা” এবং আর-একটি অনুবাদে পাই “যে সকল বনিতা, দৃষ্টিপথে আগমন বা সমক্ষে কথোপকথন করেন না” – এর একটি বাখ্যা হতে পারে এই যে, ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদক ভিন্ন ভিন্ন পাঠ ব্যবহার করেছেন কারণ যেসব পুঁথি পাওয়া গেছে তাতে পাঠের ভিন্নতা আছে। মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় শতক। এরপর আরও কয়েক শতক ধরে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। ফলে মহাভারতের বিচারমূলক সংস্করণ (ক্রিটিকাল এডিশন-এর অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকৃত শব্দার্থ)-এও কিছু কিছু প্রক্ষিপ্ত অংশ পাওয়া যাবে। সুতরাং কোন্ কাহিনি কবেকার তার স্পষ্ট সময় জানা সম্ভব নয়। [১৩] যদিও তথাকথিত হিন্দুর কাছে মহাভারত এক ঐশ্বরিক এবং নমস্য গ্রন্থ যাতে মানবজীবনের তিনটি চরম লক্ষ্য হিসেবে ধর্ম, অর্থ ও কাম-কে স্বীকার করা হয়েছে। হিরণ্যকেশীর গৃহ্যসূত্র-য়ও ঐ একই ধারণা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, এই বছর কয়েক আগে মহাভারতের অন্তর্গত গীতাকে যা প্রধানত সাধারণ মানুষকে তাঁবে রাখার এক হাতিয়ার, তাকে জাতীয়-গ্রন্থ করার জন্য হিন্দুত্ববাদীরা আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো মহাভারত (এবং রামায়ণে) নারীর কোনো মর্যাদা নেই, এবং প্রায় গরু-ঘোড়ার মতই একই পর্যায়ের, সম্পদমাত্র। এই দুই মহাকাব্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে পুরুষতান্ত্রিকতা, নারীর প্রতি অবমাননা, বর্তমান যুগের নারীবাদীদের তা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা করা উচিত যাতে অন্তত পরম্পরাগতভাবে নারীদের রুদ্ধ করে রাখার জন্যে নির্মিত ‘মিথ’গুলি ভাঙতে পারা যায়।
ত থ্য সূ ত্র
১. Karl Marx, Frederic Engels, Selected Letters, Foreign Language Press, Peking [Beijing]: 1977, p.73. এইলেখায়অনূদিত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি ইংরেজিতেই রাখা হলো, কারণ অনুবাদের অনুবাদ ব্যবহার করার চাইতে ইংরেজি ব্যবহার করাই যুক্তিসঙ্গত।
২. Karl Marx, Frederic Engels, Selected Letters, Foreign Language Press, Peking [Beijing]: 1977, p.76.
৩. দ্র. পর্ব ১: Groundxero, http://www.groundxero.in/2020/06/07/pandemic.
৪. ওদের জীবনের সেই কথাগুলি লিখেছিলাম ‘দুর্বার ভাবনা’-য়, যেটি পরে বই হয়ে বেরোয় ২০১১-য়, ‘ভিন্ন নারী অন্য স্বর’ নামে, দুর্বার প্রকাশনী (কলকাতা) থেকে।
৫. ড. প্রার্থনা মুখোপাধ্যায়-এর বই ‘গণিকা পুরাণ’ (মৌসুমী, কলকাতা: ২০০১)-এ বিদেশি সাহিত্যে এবং ভারতীয় সাহিত্যে (প্রায় সেই ঋকবেদ, বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে বাংলা সাহিত্যের ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত) গণিকাদের অবস্থান সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। তবে তিনি মধ্যযুগ অর্থাৎ মোগল আমল সম্পর্কে একেবারেই নীরব।
৬. দ্রষ্টব্য – ‘কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র’ ২।২৭।১৫ (গণিকাধ্যক্ষ অধ্যায়)।
৭. Jean-Baptiste Tavernier, Travels in India, trans. V.Ball, Second edition, ed. William Crooke, Munshiram Manoharlal, New Delhi : 2001, p.58.
৮. মহাভারত ৫। ৩০। ৪০।
৯. ‘ভাবতে পারেন, যে যুধিষ্ঠিরকে আমরা ব্রাহ্মণ্য, জ্ঞানচর্চা আর সত্যের মহিমায় ভাস্বর দেখেছি তাঁর কাছে অন্ধ, বধির, বেশ্যাদের দুঃখও কিছু কম ছিল না।‘ -এর থেকে মনে হয় সে যুগে অন্ধ, বধির, বেশ্যারা নাগরিকের পর্যায়ে পড়ত না। যুধিষ্ঠির মহানুভব তাই তাদের কথা জিজ্ঞাসা করছেন।নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, ‘কৃষ্ণা কুন্তী ও কৌন্তেয়’, আনন্দ, কলকাতা: ১৯৯৮, পৃ.১৬২।
১০. ঐ, পৃ.১৬২। অবশ্য তাত-র পরে ‘।’ টি তিনি বাদ দিয়েছেন।
১১. রাজশেখর বসু, ‘কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত সারানুবাদ’, এম.সি. সরকার, কলকাতা, ১৪২২ ব. (২০১৫), পৃ.৩১৭।
১২. মহাভারত, অনু. কালীপ্রসন্ন সিংহ, উদযোগ পর্ব, অক্ষয় লাইব্রেরি,কলকাতা:২০০৯, পৃ.৮৩০।
১৩. সুকুমার সেন, ‘ভারতকথার গ্রন্থিমোচন’, আনন্দ, কলকাতা : ১৯৮২ পৃ.২, ১২।
১৩. গৌরীনাথ শাস্ত্রী, ‘সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস’, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা:১৯৯৮, পৃ.৪৬।
চতুর্থ কিস্তি – এই লিঙ্কে ।
কৃ ত জ্ঞ তা স্বী কা র
রণিতা ভড়, বিপ্লব মুখার্জি।
লেখক সামাজিক কর্মী ও প্রাবন্ধিক।
আন্তরিক সাধুবাদ। লেখকের ইমেইল দিলে উপকৃত হব।