ইয়েস ব্যাংক – দেউলিয়া অর্থনীতির ধারাবিবরণী


  • July 5, 2020
  • (0 Comments)
  • 2405 Views

শুধুমাত্র পাইকারি হারে ঋণ বিলি ও অত্যুৎপাদক সম্পদের বৃদ্ধিই নয়, ইয়েস ব্যাঙ্কের আখ্যানের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে দুর্নীতির কাহিনী। এখনও পর্যন্ত যা প্রকাশিত হয়েছে তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা রানা কাপুর ও বিভিন্ন অসাধু কোম্পানিগুলির যোগসাধনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। লিখেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

 

ইয়েস ইয়েস নো নো

 

আয়তনের দিক থেকে পঞ্চম এবং ঋণদানের ক্ষেত্রে চতুর্থ বেসরকারি ব্যাংক ইয়েস ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, রিজার্ভ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ এবং বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এর পরিবর্তন, নতুন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার নিয়োগ এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে জনগণের টাকায় পুনরুজ্জীবন প্রকল্প ও একদা ভারতীয় ব্যাংক জগতের পোস্টার বয় রানা কাপুরের গ্রেপ্তারি — এই অলীক কুনাট্য রঙ্গ আরেকবার ভারতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান ভঙ্গুরতা কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ইয়েস ব্যাংকের পতন ভারতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলির ক্ষেত্রে এমন প্রশ্ন ও ভাবনাকে সামনে এনেছে যেগুলির মুখোমুখি আজ আমাদেরকে হতেই হবে।

 

প্রথমত ব্যাংকের গ্রাহকদের মাসে ৫ হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না, এই নির্দেশটি বর্তমানে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি ইয়েস ব্যাংক সংকটের আদৌ সমাধান হয়েছে? ব্যাংকের গ্রাহকরা যেভাবে তাদের টাকা আতঙ্কিত হয়ে সরিয়ে রাখছেন তার ফলে নগদ এর যোগান বিশেষভাবে কমে গেছে। এছাড়া বর্তমান সময়ে ব্যাঙ্কগুলি আয় এর অন্যতম উৎস হল ডেবিট কার্ড ক্রেডিট কার্ড এর ব্যবসা। যেগুলি দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার ফলে ব্যাংকের অপূরণীয় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পলিসির প্রিমিয়াম ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ইয়েস ব্যাংকের মাধ্যমে জমা হতো, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতীয় জীবন বীমা নিগম। এরা তাদের ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছে। ওয়ালমার্টের মালিকানাধীন phone pay ভারতের অন্যতম বৃহৎ পেমেন্ট ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যারা ইয়েস ব্যাংকের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করত, সেই ব্যবসাতেও তালা পড়ে গেছে। ইয়েস ব্যাংকের বর্তমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে তারা AT-1 বন্ড (যার আর্থিক মূল্য ৮,৪১৫ কোটি টাকা) বাতিল করেছে। এর ফলে বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড, লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও পেনশন ফান্ড –যারা এই বন্ডে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন যার প্রভাবে ইতিমধ্যেই গভীর সংকটে থাকা ভারতীয় অর্থনীতির জন্য সংকটের বার্তা বয়ে আনবে। আবার এ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না যে যারা প্রচুর পরিমাণে সংস্থার বন্ড কিনেছিলেন তাদের অনেকেই আইন-আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।

 

দ্বিতীয়তঃ ব্যাংকিং ও নন ব্যাংকিং সংস্থাগুলির আর্থিক লেনদেনের প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল গ্রাহকদের বিশ্বাস। গ্রাহকরা যাতে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা নিরাপদে আছে এই ভাবনা তে আস্থা রাখতে পারেন সেইটা নিশ্চিত করাই ব্যাংকিং’ কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। ষাটের দশকে যখন ব্যাংক জাতীয়করণ করা হয় তখন গ্রাহকদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আশ্বাস। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে আর্থিক সংস্কার নীতি চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে আমজনতার মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, আইসিআইসিআই ব্যাংকের সর্বোচ্চ ডিরেক্টরের কার্যকলাপ, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রের কো-অপারেটিভ ব্যাংকের আর্থিক অনিয়ম ও গ্রাহকদের দুর্দশা, নন-ব্যাংকিং সংস্থা DHFL ও ILFS এর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং শেষমেষ ইয়েস ব্যাংক এর পরিণতি এক ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতার দৃষ্টিকে সামনে তুলে এনেছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক ডেভিড এনরিস ‘Dark Towers’ নামক একটি বই লেখেন যার মূল উপজীব্য ছিল যে আর্থিক দুনিয়া এক ভয়ঙ্কর জায়গা, সেখানে ব্যাংকে যেকোনো সময় লাল বাতি জ্বলতে পারে, বাজারকে অসৎ উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, মুহুর্তের মধ্যে বিনিয়োগ করা কোটি কোটি টাকা খোলামকুচিতে রূপান্তরিত হতে পারে, হিসাব নিরীক্ষকরা সব জেনেও বিপদের ঘণ্টা বাজাতে ভুলে যেতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ডেভিডের বইটির উৎস ছিল জার্মানির ডয়েস ব্যাংক এর সীমাহীন দুর্নীতি ও রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে অশুভ যুগলবন্দী (কেন্দ্রীয় চরিত্রে বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রপতি ধনকুবের ট্রাম্প)। আজ ইয়েস ব্যাংকের ক্রমাগত প্রকাশিত বিভিন্ন ঘটনায় সেই দিকটি ফুটে উঠছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় বাজেটে ব্যাংকে লালবাতি জ্বললে গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আগে কোনদিন এই নিয়ে আলোচনার দরকার ছিল না, আজ তা এক বাস্তবতার রূপে হাজির। বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ ব্যাংক ও আর্থিক নিয়ামক সংস্থাগুলির নীরবতা ইয়েস ব্যাংক এর প্রেক্ষাপটে বহু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

 

তৃতীয়তঃ নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্ন থেকে বাজার অর্থনীতির মুক্তকচ্ছ সর্মথকরা আমাদের অর্থনীতির যে পাঠ দিতে শুরু করেন তার মূল কথা ছিল যা কিছুই ব্যক্তিগত তাই পবিত্র। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা (তা শিল্পই হোক বা ব্যাংক) মানেই তা অদক্ষ, লাল ফিতের বাঁধনে জড়িয়ে থাকা জনগণের টাকায় চলা সাদা হাতি যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বেঁধে আছে। আর বেসরকারি সংস্থা মানেই দক্ষতা, স্বচ্ছতা কে সাথে নিয়ে এক স্বপ্নের উড়ান যেখানে যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি। আর এই অর্থনীতির পাঠ কে আমাদের গেলানোর জন্য আমলা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্পোরেট জগতের কেষ্ট-বিষ্টুরা গড়ে তুলেছিল সহমতের রাজনীতির এক অসাধু আখ্যান (reform or perish)। সেই সহমতের রাজনীতির ও অর্থনীতির উপর আমআদমি বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যাতে ভরসা রাখতে পারে তার জন্য বশম্বদ মিডিয়া দায়িত্ব নেয় মিথ নির্মাণের, তৈরি করে সাফল্যের পোস্টার বয়। অসামরিক বিমান পরিবহন ব্যবসার ক্ষেত্রে বিজয় মাল্য, টেলিকম শিল্পে অনিল আম্বানি, আর ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ছন্দা কোচার বা রানা কাপুর সেই তালিকারই কয়েকটি নাম। কিন্তু আজ যখন তারা খলনায়ক এ রূপান্তরিত তখন মূল ব্যাবস্থা যে ঠিক তা বোঝানোর জন্য সক্রিয় বাজার অর্থনীতির দালালেরা। ইয়েস ব্যাংক এর ঘটনা যখন সামনে এল তখন পৃথিবীর বৃহত্তম বিমা সংস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের বিলগ্নীকরণ এর নীল নকশা তৈরি করে ফেলেছে মোদি সরকার। তাই ইয়েস ব্যাংক এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও আর্থিক অপরাধের যে কাহিনী সামনে আসছে তাকে আমাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। যেমন করতে হবে স্টেট ব্যাংকের টাকায় ইয়েস ব্যাংকের কালি ধোয়ার (পুনরুজ্জীবন প্রকল্প) কার্যকারিতা নিয়ে। আর বাজার অর্থনীতির ঘোষিত এজেন্ডাগুলোও যে আদতে মুক্ত অর্থনীতির শ্লোগানগুলিকে অস্বীকার করে এক বিকৃত পুঁজিবাদের জন্ম দেয় (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) তার স্বীকৃতি ইয়েস ব্যাংকের অভিজ্ঞতায় মেলে। ইয়েস ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক দিকটি দেখলে সেই সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকে না বললেই চলে।

 

চতুর্থত, ইয়েস ব্যাংক এর পতন, অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ, ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক দুর্নীতির রোমহর্ষক আখ্যান, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে রানা কাপুরের যোগাযোগ মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সৌজন্যে ইতমধ্যেই বহু আলোচিত।  কিন্তু এই তথ্যগুলি উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনাকে এবং অন্যান্য আর্থিক দুর্নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলির দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উদাহরণগুলি সাধারণভাবে ব্যতিক্রমী হিসেবে চিহ্নিত করার এক মরিয়া চেষ্টা দৃশ্যমান। ফলত এই দেউলিয়া হয়ে যাওয়া অর্থনীতি কি নব্য উদার অর্থনীতির অনিবার্য পরিনাম, সে সম্পর্কিত আলোচনা বিরল। ইয়েস ব্যাংকের ঘটনায় সেই প্রশ্নের উত্তরও আমাদের খুঁজতে হবে।

 

গল্পটা যেখানে শুরু

 

ইয়েস ব্যাংকের পতনের কারণ উপলব্ধি করার জন্য যদিও অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব জানার দরকার হয় না, কিন্তু আলোচনার সুবিধার্থে ব্যাংকের ইতিহাস টা খুব সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যেতে পারে। ব্যাংকের মূল স্থপতি রানা কাপুর শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ শুরু করেন প্রথমে সিটি ব্যাংকে এবং পরে ব্যাংক অফ আমেরিকায়। কিছুদিনের মধ্যে রানা ব্যাংকের ভারতীয় অপারেশনের প্রধান হন। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ডাচ রোবো ব্যাংকের সঙ্গে মিলে একটি নন ব্যাংকিং সংস্থা গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে রানা কাপুর, এবিএন আমরোর ভারতীয় অপারেশনের প্রধান অশোক কাপুর এবং ডয়েস ব্যাংকের হারকিট সিং এর সঙ্গে মিলে ২০০৩ – ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়েস ব্যাংক।

 

একথা অনস্বীকার্য যে ভারতের ব্যাংকিং জগতে এই ইয়েস ব্যাংকের উত্থান উল্কাসদৃশ। কর্পোরেট মহলে একথা সর্বত্র প্রচারিত ছিল যে অন্য কোন ব্যাংক থেকে প্রত্যাখ্যাত হলেও ইয়েস ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যাবেই। এই অনুশীলন একদিকে যেমন রানা কাপুরের উত্থানের কারণ, ঠিক তেমনই নিশ্চিত পতনের। আর্থিকভাবে সংকটগ্রস্ত বিভিন্ন কোম্পানি তখন হাজার হাজার কোটি টাকা ইয়েস ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে শুরু করে যার বেশিটাই আর কখনো ব্যাংকে ফেরত আসেনি।

 

২০০৪ সালে ব্যাঙ্ক চালু হওয়ার কিছু দিন পরেই হারকিত সিং নিজেকে সরিয়ে নেন। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলায় (২৬/১১) আরেক প্রতিষ্ঠাতা অশোক কাপুর মারা যান। অশোকের স্ত্রী তাদের তিন মেয়ের মধ্যে একজনকে ব্যাঙ্কের বোর্ড অব ডিরেক্টরসে মনোনয়নের জন্য আবেদন করলে রানা কাপুর তা মানেননি। ফলে অশোকের স্ত্রী মধু কাপুরের সাথে রানা কাপুরের দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হয়। সেই লড়াইতে শেষপর্যন্ত মধু কাপুর জয়লাভ করেন। শুরুর সময় থেকেই একের পর এক ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের কারণে ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য দুর্বল হতে শুরু করে কিন্তু কর্পোরেট মিডিয়া সব জেনেও রানা কাপুরের এই অনুশীলনকে দু হাত তুলে কুর্নিশ জানাতে থাকে। একটা সময় ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লক্ষ কোটি টাকা। আমরা আগেই সেই মিথ নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছি। এর কারণ মিডিয়া, নিতি প্রণেতাদের হাতের মুঠোয় রাখতে রানা কাপুর ও তার ব্যাঙ্ক লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। বিভিন্ন মিডিয়া ও  থিংক ট্যাঙ্কের অনুষ্ঠানের প্রধান স্পনসর থাকে ইয়েস ব্যাঙ্ক। সাধারণ বুদ্ধি বলে যে কোন কর্পোরেট কোম্পানি চালানোর সেরা উপায় যৌথ নেতৃত্ব, বোর্ড অব ডিরেক্টরস যার প্রতিনিধি। কিন্তু প্রথম দিন থেকে ইয়েস ব্যাঙ্ক ছিল রানা কাপুরের খাস তালুক, যেখানে তার কথাই আইন। এই স্বেচ্ছাচারী, অনিয়ন্ত্রিত আচরণকে কর্পোরেট মিডিয়া চিহ্নিত করে দূরদর্শী নেতৃত্ব হিসাবে। সেসময় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রানা কাপুরকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়ার ধুম পড়ে যায়।

 

এর ফলে যা হওয়ার ঠিক তাই হলো। কাফে কফি ডে, সি জি পাওয়ার, ভোডাফোন, জেট এয়ারওয়েজ, ডিএইচএফএল, আইএলএফএস, অনিল আম্বানি, মিডিয়া ব্যারন সুভাষ চন্দ্রের জি গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা ইয়েস ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিলেন। খাতায় কলমে একটা সময়ে ব্যাঙ্কের সম্পত্তির পরিমাণ হয়ে দাঁড়ায় ২৫,০০০ কোটি টাকা। যদিও জেপি মরগ্যান ও ক্যাপিটালের সাম্প্রতিক মূল্যায়নে এর পুরোটাই খতম ও মোট মূল্য এক টাকার বেশি হবে না। যদিও জন্মের কয়েক বছর পর থেকেই ইয়েস ব্যাঙ্কের অনিয়মের খবর ইতিউতি বাইরে আসছিল। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগ ও কর্পোরেট মিডিয়ার মদতকে কাজে লাগিয়ে ইয়েস ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তথ্যের কারচুপি ঘটিয়ে বিষয়গুলি ধামাচাপা দিতে সমর্থ হয়। একজন ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন, কীভাবে রানা কাপুর ‘রিলেশনশিপ ম্যানেজার’, ‘প্রজেক্ট ম্যানেজার’, ‘রিস্ক ম্যানেজার’ নামে বিভিন্ন পদ তৈরি করেন যাদের কাজ ছিল তথ্যের কারচুপি ঘটানো। বিমুদ্রাকরণ ও জিএসটি’র জোড়া অভিঘাতে যখন বাকি ব্যাঙ্করা ঋণ দিতে ভরসা পাচ্ছে না, ভারতের রুগ্ন আর্থিক কোম্পানিগুলিতে তখন ইয়েস ব্যাঙ্কের ঋণের খাতা রকেটের গতিতে বাড়ছে।

 

২০১৬ সালের মার্চ মাসে ইয়েস ব্যাঙ্ক জানায় যে তাদের নন-পারফর্মিং অ্যাসেট (NPA)-এর পরিমাণ মাত্র ৮৩৬ কোটি টাকা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া তদন্তের হুমকি দিলে তিন মাসের মধ্যে সংশোধিত হিসেব করে রানা কাপুর জানান NPA-এর পরিমাণ ৪,৬৬২ কোটি টাকা (৫ গুণ বৃদ্ধি)। ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয় ৭,৫৬২ কোটি টাকা। এই হিসাবটাকে শতকরা হিসেবে দেখে নেওয়া যেতে পারে। ২০১৮ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর: ২.১০%, জানুয়ারি-মার্চ (২০১৯): ৩.২২%, এপ্রিল-জুন (২০১৯): ৫.০১%, জুলাই-সেপ্টেম্বর (২০১৯): ৭.৩৯%। ধারের খাতাটাও কম চমকপ্রদ নয়। যখন অর্থনীতি ধুঁকছে, তখন ডুবন্ত কোম্পানিগুলিকে আরও বেশি বেশি করে ঋণ দিচ্ছে ইয়েস ব্যাঙ্ক। ২০১৪ সালে যেখানে ঋণের পরিমাণ ৫৫,০০০ কোটি টাকা, তা ২০১৭ সালে বেড়ে হলো ১,৩২,০০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ২,৪১,০০০ কোটি টাকা। এর পরেও কি কোন ব্যাঙ্ক না ডুবে থাকতে পারে?

 

এই হযবরল অবস্থা ব্যাঙ্কের প্রশাসনেও ছিল। ২০১৮ সালে ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান অলোক চাওলা সিবিআই চার্জশিটে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একের পর এক নির্দেশনামায় বাধ্য হয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে রানা কাপুর পদত্যাগ করেন এবং অজয় কুমার অন্তর্বর্তী CEO (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার) নিযুক্ত হন। পরে ওই পদে আসেন রণজিত গিল, ২০১৯ সালে ব্যাঙ্ক পরিচালনায় বিভিন্ন অনিয়মের কারণে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইয়েস ব্যাঙ্ককে বড়ো অঙ্কের টাকা জরিমানা করে। এপ্রিল (২০১৯) মাসে বোর্ড মিটিংয়ে নগদ টাকা জোগানের জন্য বাজার থেকে ১ বিলিয়ন টাকা তোলার সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রানা কাপুর তার সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে  ব্যাঙ্কের কাজকর্ম থেকে হাত ধুয়ে ফেলেন। এর পরের গল্পটা আমাদের সবার জানা। শুধু এটুকু উল্লেখ থাক যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাঙ্কের নতুন মূল্যাঙ্কণ হয়, ৫০০০ কোটি টাকা।

 

দুর্নীতির জলছবি:

 

শুধুমাত্র পাইকারি হারে ঋণ বিলি ও অত্যুৎপাদক সম্পদের বৃদ্ধিই নয়, ইয়েস ব্যাঙ্কের আখ্যানের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে দুর্নীতির কাহিনী। এখনও পর্যন্ত যা প্রকাশিত হয়েছে তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা রানা কাপুর ও বিভিন্ন অসাধু কোম্পানিগুলির যোগসাধনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। যেমন ডিএইচএফএল (দেওয়ান গ্রুপ পরিচালিত)-এই নন-ব্যাঙ্কিং সংস্থাটি আবাসন ক্ষেত্রে টাকা লগ্নি করতো। ভারতে আবাসন শিল্পের সংকটের সঙ্গে এই কোম্পানির দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ডিএইচএফএল ৩৭০০ কোটি টাকা ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিল। এরাই আবার রানা কাপুরের এক কন্যার পরিচালিত সংস্থাকে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়, কাপুর কন্যা মাত্র ৪০ কোটি টাকার একটি জমি জামানত রেখে এই টাকা পায়। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের বক্তব্য অনুযায়ী জামানত রাখা ওই সম্পত্তিটার মধ্যেও জালিয়াতি আছে। কারণ সেখানে কাগজের হেরফের করে কৃষিজমিকে রেসিডেন্সিয়াল প্লট হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার এই ডিএইচএফএল ও ইয়েস ব্যাঙ্কের যৌথ দায়িত্বে ছিল উত্তরপ্রদেশ পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেডের কর্মীদের এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড। সেখানে ২২৬৭ কোটি টাকার গরমিল ধরা পড়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ব্যাঙ্ক লাটে ওঠার কিছুদিন আগে রানা কাপুরের স্ত্রী বিন্দু কাপুর (ব্লিস অ্যাবোড প্রাইভেট লিমিটেড) ৩৭৮ কোটি টাকা দিয়ে গৌতম থাপারের (অজন্তা রিয়েলিটি লিমিটেড) এর কাছ থেকে একটি বাড়ি কেনেন। এই বাড়িটি আবার ইয়েস ব্যাঙ্কের কাছে মর্টগেজ রাখা ছিল। থাপারের কাছ থেকে ৩৭৪ কোটি টাকা পাওয়ার পরে ইয়েস ব্যাঙ্ক সম্পত্তিটিকে মুক্ত করে। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করেছে এই সম্পত্তি দেখিয়ে থাপার গ্রুপ দু’দফায় ইয়েস ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ১২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে রানা কাপুর ৭৮টি শেল কোম্পানির মালিক এবং রানা কাপুরের তিন কন্যা ৪২টি কোম্পানির ডিরেক্টর যার অনেকগুলিই কোম্পানি আইনে রেজিস্ট্রিকৃত নয়। তার ৪২,০০০ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণের মধ্যে ২০,০০০ কোটি টাকা স্বয়ং রানা কাপুর নিজের সিদ্ধান্তে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছিলেন। আমরা যদি ইয়েস ব্যাঙ্কের প্রধান ঋণগ্রহীতাদের তালিকার দিকে নজর রাখি তাহলে সেই নামগুলিই দেখতে পাবো যারা এর আগে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে শোধ করেনি। এই তালিকার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এরা সবাই কেন্দ্রের শাসকদলের ঘনিষ্ঠ। এর মধ্যে রয়েছে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গ্রুপ। আন্তর্জাতিক আদালতে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা এই শিল্পপতি দেশকে রক্ষা করার জন্য রাফাল বিমান তৈরির বরাত পেয়েছেন। আরও আছে সুভাষচন্দ্রের জি গ্রুপ যারা ঘোষিতভাবে মোদি সরকারের নির্লজ্জ সমর্থক। ডিএইচএফএল, আইএলএফএস ইতিমধ্যে দেউলিয়া, জেট এয়ারওয়েজ উঠে গেছে। ভোডাফোন প্রায় দেউলিয়া হওয়ার মুখে। বলার কথা হলো রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে বাজার অর্থনীতির সাধারণ নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই শিল্পপতিরা কোটি কোটি টাকা লুট করেছে। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম।

 

ভগবান নিদ্রা গেছেন:

 

ইয়েস ব্যাঙ্কের সংকটের সময় সবথেকে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো যে সবাই জানতো সংকট আসছে, আর যখন ঘটনাটি সত্যি সত্যি ঘটলো তখন সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তথা মেনস্ট্রিম মিডিয়া অবাক হওয়ার ভান করছে। ভারতে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে অনাদায়ী ঋণের সমস্যা যে সুনামির আকার ধারণ করছে সে সম্বন্ধে আমাদের প্রথম সতর্ক করেন আশীষ গুপ্ত (ক্রেডিট সুইস এজি)। তাঁর ‘House of Debts’ (২০১২) তে বলা হয় যে, প্রকৃত অর্থে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির NPA (নন পারফর্মিং অ্যাসেট) এর পরিমাণ ৩% থেকে ৯.৩%। এতে আরও বলা হয় ১৫ শতাংশ কোম্পানির গ্রাহকদের আমানতের বার্ষিক সুদ দেবার পর নগদ অর্থের যোগান নেই। কিন্তু সেদিন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সে কথা কানে নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। এরপরে ২০১৪ সালে বিশাল গোয়েল ও ইশাঙ্ক কুমার নামে দুই তরুণ বিশেষজ্ঞ সুইস ইনভেস্টমেন্টে ব্যাঙ্ক ইউবিএস-এর তরফে ভারতে অনাদায়ী ঋণের সমস্যা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। এদের রিপোর্টে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা হয় ইয়েস ব্যাঙ্ক এমন ১০০টি কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে যাদের আর্থিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে তারা ঋণ ফেরত দেবার মতো অবস্থায় নেই। তারা হিসেব কষে দেখান যে ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ এর মধ্যে এই ধরণের ঋণের পরিমাণ ৩০৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রিপোর্টে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়- “Yes Bank had the highest share of term loans backed by unlisted shares and current movable assets.” প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়- “If the India’s investment slowdown continues, Yes Bank would be in deep trouble.” ২০১৭ সালের মে মাসে হিমেন্দ্র হাজারিও তার অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে ইয়েস ব্যাঙ্ক সম্পর্কে একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ ইতিউতি বলার চেষ্টা করছেন যে ব্যাঙ্কিং বোর্ডে দক্ষ প্রশাসক না থাকার কারণে এতো অনিয়ম হয়েছে। সেটাও সত্যি নয়। বিগত দশ বছরে প্রাক্তন আমলা, আইএএস অফিসার, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন উচ্চপদস্থ আধিকারিক (এস এল কাপুর, রাধা সিং, অশোক চাওলা, দত্ত প্রমুখ) ইয়েস ব্যাঙ্কের বোর্ডে ছিলেন কিন্তু তাতে ইয়েস ব্যাঙ্কের অসাধু ব্যাঙ্কিং অনুশীলন বিন্দুমাত্র কমেনি।

 

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে সমস্ত খবর প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কী করছিল? ২০১৭ সালের ৩১শে মার্চ ইয়েস ব্যাঙ্কের Annual Financial Inspection হয়। সেখানে অনেক জটিলতার আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন নির্ভরযোগ্য সংস্থা দিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ফরেন্সিক অডিটের নির্দেশ দিতে পারতো, তা হয়নি। আমাদের বাক্যবাগীশ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ গত একবছরে ইয়েস ব্যাঙ্ক সম্পর্কে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেননি। সেবি ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটও দীর্ঘ সময় ধরে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সত্তর ও আশির দশকের বলিউডি সিনেমায় যেমন সমস্ত ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শেষ দৃশ্যে পুলিশের আগমন ঘটতো, ইয়েস ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে সাধারণ গ্রাহকদের টাকা লুট হয়ে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নড়েচড়ে বসেছে। আর এই নীরবতা কাকতালীয় নয় কারণ আমাদের সবার স্মরণে আছে বিমুদ্রাকরণের নির্বোধ ঘোষণার পর সারা দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে তখন একমাত্র ইয়েস ব্যাঙ্কের রানা কাপুর এই সিদ্ধান্তকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে অভিনন্দিত করেছিলেন। আর আজ তথ্যপ্রমাণ থেকে এটা পরিষ্কার যে বিমুদ্রাকরণের পর ইয়েস ব্যাঙ্কের ঋণ ও অগ্রিম দানের পরিমাণ একশো শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। শুধু তথ্যের খাতিরে একথা বলা প্রয়োজন যে ভারতে কোন কোন সংস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত ও প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলি থেকে ব্যাপক অঙ্কের ঋণ নিয়ে শোধ দিচ্ছে না তাদের তালিকা তৈরি, ঋণদানের আচরণবিধি, নন ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য অনুসন্ধানের জন্য কার্যকরী আইন তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। কিন্তু তার পরিণতি কী হয়েছিল তা আমাদের সবার জানা।

 

প্রসঙ্গ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া

 

প্রতিটা কর্পোরেট লুণ্ঠনের যা পরিণতি হয়, ইয়েস ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও আলাদা কিছু ঘটলো না। ‘লাভের বেসরকারীকরণ ও ক্ষতির সরকারীকরণ’- এই ফর্মূলা মেনে করদাতাদের টাকায় পুনরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে আসরে ঝাঁপিয়ে পড়লো স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। অনেকের মনে থাকতে পারে ২০০৪ সালে  এইরকম আরেকটি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক (গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক) কে সরকারি নির্দেশে অধিগ্রহণ করে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অব কমার্স। এই কিছুদিন আগে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে এক জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়েছে ৫টি অধীনস্থ ব্যাঙ্ক। অত্যুৎপাদক সম্পদ ও অনাদায়ী ঋণের কারণে এমনিতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির স্বাস্থ্য খারাপ। অবস্থা সামাল দিতে সরকার ইতিমধ্যে ৭০,০০০ কোটি টাকা ব্যাঙ্কগুলিকে দিয়েছে। এই অবস্থায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ইয়েস ব্যাঙ্কের দায়দায়িত্ব কেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক নেবে, তার উত্তর দেওয়ার কোন দায় আজ বাজার অর্থনীতির মুক্ত কচ্ছ সমর্থক তথা দালালদের নেই। এই ধরণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তগুলি যে আগামী দিনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির জন্য আরও অনিশ্চয়তা নিয়ে আসছে তা নিশ্চিত।

 

নয়া উদারবাদের অনিবার্য সংকট

 

ইয়েস ব্যাঙ্কের ঘটনা ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান সংকট ও ভঙ্গুরতার আদর্শ প্রতিফলন। এই অর্থনৈতিক দুর্নীতি, লুটেরা অর্থনীতির জন্য আমরা যদি শুধুমাত্র রানা কাপুরকে দায়ী করি তাহলে আমরা সংকটের মাত্রাটা উপলব্ধি করতে পারবো না। অপদার্থ পরিচালন ব্যবস্থা, সর্বোচ্চ ব্যাঙ্কের নজরদারি অভাব, ব্যাঙ্কার, কর্পোরেট সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগসাধনে গড়ে ওঠা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম আসলে ফল, মূল কারণটা লুকিয়ে আছে নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে। আসলে এই অর্থনীতিতে ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানগুলি যে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের পন্থা নেয় তা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও ভঙ্গুর করে তোলে। যেকোনো মূল্যে তা যতই অসাধু ও অনৈতিক হোক না কেন বৃদ্ধির গতিকে উর্দ্ধমুখী রাখতে যে চেষ্টা তাকে শীর্ষ ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই অর্থনীতিতে বিশ্বজুড়ে চলমান ফিনান্স পুঁজির চাপে ফিসকাল ঘাটতি জিডিপি’র এক নির্দিষ্ট শতাংশে বেঁধে রাখতে চায়, ভারতের ক্ষেত্রে যেমন তাদের লক্ষ্য গড়পড়তা জিডিপি’র তিন শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে ঋণের চাহিদা কমে। যদি জনগণের স্বার্থে অর্থনীতিকে ভাবা যায় তাহলে চাহিদা বৃদ্ধি করতে হয় সাধারণ মানুষের, সরকারি ব্যয় বাড়াতে হয়। সর্বোপরি পুঁজিপতিদের উপর কর বৃদ্ধি করতে হয় কারণ এরা একটা বড়ো অংশের আয়কে কুক্ষিগত করে রাখে। কিন্তু বাজার অর্থনীতির কাছে এই ভাবনা পরিত্যাজ্য। ফলে একদিকে যেমন সুদের হার কমে অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি এমন সংস্থাগুলিকে ঋণ দিতে বাধ্য হয় যাদের শোধ দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে (ব্যাঙ্কের ভাষায় বলা হয় Lower quality loan investing risk)। এর আদর্শ উদাহরণ ২০০৮ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Housing Bubble’। আমেরিকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি আবাসন শিল্পের গতিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে ঢালাও ঋণ দিয়েছে যা আর ব্যাঙ্কে ফেরত আসেনি। এ ঘটনা থেকেই ২০০৮ সালের বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা শুরু হয়। ভারতের ক্ষেত্রে ওই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। পরিকাঠামো, আবাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে বিপুল ঋণ দিয়েছে ইয়েস ব্যাঙ্কসহ বিভিন্ন ব্যাঙ্ক তা আইএলএফএস, ডিএইচএফএল, অনিল আম্বানির রিলায়েন্স, ভোডাফোন শোধ দিতে পারছে না। তাই ইয়েস ব্যাঙ্ক আসলে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির দেউলিয়াপনার একটি উদাহরণ মাত্র, একমাত্র নয়। যতদিন এই অর্থনীতি থাকবে, ততদিন এরকম ঘটনা নিয়ম করে ঘটতেই থাকবে।

 

লেখক স্কুলশিক্ষক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী। 

 

Share this
Leave a Comment