হিন্দুত্বের ক্রোনোলজি ও স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকার : ষষ্ঠ কিস্তি


  • July 1, 2020
  • (0 Comments)
  • 3189 Views

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব  

দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব

তৃতীয় কিস্তি : হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব 

চতুর্থ কিস্তি : হিন্দু উত্থান ও নির্বাচনী বিজয় পর্ব 

পঞ্চম কিস্তি : কংগ্রেস রাজনীতি ও সাম্প্রতিক সাভারকার পুনর্বাসন পর্ব 

 

ষষ্ঠ কিস্তি : হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বনির্মাণ পর্ব

 

বছরের পর বছর ধরে, সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন প্রসঙ্গে ‘হিন্দু’, ‘হিন্দুধর্ম’ এবং ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর অর্থ বিশুদ্ধ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শুরু করে, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার পর্যন্ত ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা করেছে। অর্ধ শতাব্দীরও আগে, প্রধান বিচারপতি পিবি গজেন্দ্রগাদকর, কেএন ওয়াঞ্চু, এম হিদায়াতুল্লাহ, ভি রামস্বামী এবং পি সত্যনারায়ণারাজু’র পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ শাস্ত্রী যজ্ঞপুরুষাদজি মামলায় {নং ১৯৬৬ এসসিআর (৩) ২৪২} হিন্দু শব্দের ঐতিহাসিক ও ব্যুৎপত্তিগত বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বেঞ্চের পক্ষে রায় লেখার সময় বিচারপতি গজেন্দ্রগাদকর বলেছিলেন, হিন্দু শব্দের ঐতিহাসিক ও ব্যুৎপত্তিগত বৌদ্ধিকতা ইন্দোলজিস্টদের মধ্যে বিবাদের জন্ম দিয়েছে; তবে সাধারণভাবে পণ্ডিতদের দ্বারা গৃহীত মতামত থেকে মনে হয় যে ‘হিন্দু’ শব্দটি সিন্ধু নদী থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা পাঞ্জাব থেকে প্রবাহিত এবং পরিচিত:

 

“আমরা যখন হিন্দু ধর্মের কথা চিন্তা করি, আমরা দেখি হিন্দু ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করা, এমনকি যথাযথভাবে বর্ণনা দেওয়া, অসম্ভব না হলেও কঠিন। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মের মতো, হিন্দু ধর্ম কোনও নবী বা প্রফেটকে উদ্গাতা হিসাবে দাবী করে না। কোনও একক দেবতার উপাসনা করে না, কোনও অন্ধবিশ্বাসে সাবস্ক্রাইব করে না, এটি কোনও একটি দার্শনিক ধারণাতে বিশ্বাস করে না, এটি কোনও একটি ধর্মীয় রীতিনীতি বা পারফরম্যান্স অনুসরণ করে না। আসলে এটি কোনও ধর্ম বা ধর্মের সংকীর্ণ ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে সন্তুষ্ট করে বলে মনে হয় না। একে বিস্তৃত অর্থে জীবনযাপনের একটি পন্থা হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে, আর কিছু নয়।”

 

‘হিন্দু’ শব্দের সংজ্ঞা নির্ধারণে ১৯৬৬ সালে সুপ্রীম কোর্ট যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তা “কমিশনার ওয়েলথ ট্যাক্স, মাদ্রাজ বনাম মরহুম আর শ্রীধরণ” {১৯৭৬ (এস.ইউ.পি) এসসিআর ৪৭৮} মামলার রায়ে প্রতিফলিত হয়। এতে বলা হয়েছে, “এটি একটি সাধারণ জ্ঞানের বিষয় যে হিন্দু ধর্ম নিজের মধ্যে এতো বিবিধ বিশ্বাস, আস্থা, অনুশীলন এবং উপাসনার বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে যে যথাযথ ভাবে ‘হিন্দু’ শব্দটি সংজ্ঞায়িত করা কঠিন।”

 

নব্বই এর দশকে সুপ্রিম কোর্টের সাতটি সিদ্ধান্তকে এখন “হিন্দুত্ব রায়” বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা আইনজীবী রাম জেঠমালানির মতে, ১৯৯৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে সাধারণভাবে, হিন্দুত্বকে জীবনযাপন পদ্ধতি বা একটি মানসিক অবস্থান হিসাবে ধরে নিতে হবে এবং ধর্মীয় হিন্দু মৌলবাদের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে হবে না। জেঠমালানির মতে, সুপ্রিম কোর্ট এই শব্দটির সত্য অর্থ যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে, হিন্দুত্ব কোনও সংগঠিত ধর্মের সাথে বৈরিতা নয় বা অন্য কোন ধর্মের ওপর তার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে না। তাঁর মতে, এটি দুর্ভাগ্যজনক যে সাম্প্রদায়িক প্রচার যন্ত্র নিরলসভাবে একটি সাম্প্রদায়িক শব্দ হিসাবে হিন্দুত্বকে প্রচার করে। এটি এমন একটি বিষয় যা রাজনীতিবিদ, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ এবং বুদ্ধিজীবী সহ ওপিনিয়ন লীডারদের মন এবং ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে”।

 

সময়ের সাথে সাথে, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে তথাকথিত তোষণের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসাবে, রাজনীতিবিদদের একটি অংশের পাল্টা রাজনৈতিক বাহিনী ‘হিন্দু ধর্ম বাঁচাও’ নির্বাচনী প্রচার চালানোর মাধ্যমে সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্রের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। একজন প্রার্থীর ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট প্রার্থনা করা গণপ্রতিনিধিত্ব আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৮৭ সালে একজন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার করার সময়, শিবসেনা প্রধান বালাসাহেব ঠাকরের ধারাবাহিক ‘হিন্দুধর্ম’ এবং ‘হিন্দুত্ববাদী’ থিমযুক্ত বক্তৃতা সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত এই প্রশ্নটির সমাধানে পাল্টা প্রশ্ন তোলে যে : নির্বাচনী প্রচারে ‘হিন্দুধর্ম’ এবং ‘হিন্দুত্ববাদ’ ব্যবহার কি আইনের চোখে অন্যায় বা অমার্জিত? বিচারপতি জেএস ভার্মার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বিচারক বেঞ্চ {১৯৯৬ এসসিসি (১) ১৩০} রমেশ যশবন্ত প্রভু মামলায় বলেছিল, ‘হিন্দু ধর্ম’ বা ‘হিন্দুত্ববাদ’ শব্দ ভারতের জনগণের সংস্কৃতি ও নৈতিকতা এবং ভারতীয় জনগণের জীবনচর্চাকে চিত্রিত করার অনুশীলনগুলির  সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কঠোর হিন্দু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে এটা আবশিক নয়।  সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের জন্য মত প্রকাশের অপব্যবহার এই পদগুলির প্রকৃত অর্থকে পরিবর্তন করতে পারে না। তার বক্তৃতায় যদি কেউ এই ধরণের শব্দের অপব্যবহার করে থাকে তবে উদ্ভূত দুষ্কর্মকেই বাধা দিতে হবে, তার অনুমোদিত ব্যবহারকে নয়।

 

হিন্দুত্ববাদ শব্দটি সাম্প্রতিক বর্তমানে আবারও তীব্র বিতর্কের মুখে পড়েছে, বিশেষত যখন প্রথমে বাজপেয়ী এবং পরে মোদী সরকার ভারতের শাসনক্ষমতা দখল করেছে। বিজেপি শুরু থেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্ববাদের আদর্শের সাথে জড়িত। শব্দগুলি বিভ্রান্তিমূলক এবংসমর্থক জনতা (পড়ুন ভোটার) হিন্দু দিয়ে শুরু হওয়া যে কোনও শব্দ সমার্থক মনে করে। এই কারণেই হিন্দু, হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুত্ববাদকে সাধারণভাবে পৃথক করা খুব জরুরি। এবং এই তিনটি পদ কীভাবে একে অপরের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পৃথক, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। যদি আমরা এই তিনটি শব্দের উৎস সনাক্ত করি তবে সাভারকার হলেন ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসের অন্যতম গভীর এবং প্রভাবশালী চিন্তাবিদ যিনি এই তিনটি শব্দের তাত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই “হিন্দুত্বের সারাংশ” তে লিখেছেন যে “হিন্দু কে” প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করাই ভুল। উপযুক্ত প্রশ্নটি হওয়া উচিত “হিন্দু কী”? তিনি লিখেছেন,“আসিন্ধুসিন্ধুপর্য‌ন্তা যস্য ভারতভূমিকা, পিতৃভূঃ পুণ্যভূশ্চৈভ স ঐ হিন্দুরিতিস্মৃতঃ”। অর্থাৎ যারা সিন্ধু নদী (উত্তর) থেকে সিন্ধু মহাসাগর (দক্ষিণ) পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিস্তীর্ণ ভূমিতে বাস করছেন এবং এই ভূখণ্ডকে তাদের পিতৃভূমি এবং পবিত্র ভূমি বিবেচনা করেন তারাই হিন্দু। সাভারকারের কাছে, হিন্দুদের এই “ইজম” কী? এটি হিন্দুদের বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং রীতি। এটি আমাদের একটি স্পষ্ট চিত্র দেয় যে হিন্দুরা কোনও নির্দিষ্ট বর্ণ, বর্ণ, ধর্ম বা শ্রেণির নয়।  বরং এই দেশকে যারাই পিতৃভূমি এবং পবিত্র ভূমি হিসাবে বিবেচনা করে, তাদের হিন্দুত্বে অন্তর্ভুক্ত করাই সাভারকারের দৃষ্টিভঙ্গী। সমাজের একটি দলিত ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের দীর্ঘকালীন অভিযোগ যে হিন্দু ধর্ম কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ্যবাদী ও মনুবাদী উচ্চবর্ণের লোকদেরই ধর্ম, বিশেষত আর্যাবর্তের (উত্তর ভারতে বসবাসকারী লোকদের) ধর্ম। সাভারকার বুঝেছিলেন অখণ্ড হিন্দুরাষ্টের স্বপ্ন তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন সম্পূর্ণ হিন্দু সমাজকে এতে সামিল করা যাবে। সাভারকার নিজেই দাবী করেন যে হিন্দু সমাজের খণ্ডন রোধ করা দরকার এবং সে জন্য সমাজ থেকে বর্ণভেদকে উৎখাত করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিজেপির উচ্চবর্ণ নেতৃত্ব, যাদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত, তারা তাদের নিজস্ব লাভের জন্য সাভারকারের হিন্দু ও হিন্দু ধর্মের আসল অর্থটি বিকৃত করে দিয়েছে বলে নিম্নবর্ণের হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত। মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণদের সংগঠন নাগপুরের আরএসএস হিন্দু ও হিন্দু ধর্মকে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দলিত-বিরোধী, সংখ্যালঘু-বিরোধী অবস্থানের পক্ষে সাভারকারকে, দয়ানন্দ স্বরস্বতীকে ব্যবহার করে থাকে মাত্র।

 

সাভারকারের সংজ্ঞায় হিন্দুত্বের তিনটি প্রয়োজনীয় বিষয় হ’ল ‘রাষ্ট্র’, ‘জাতি’ এবং ‘সংস্কৃতি’ বা সভ্যতা। সাভারকার “হিন্দু” এবং “সিন্ধু” শব্দদুটি উল্ট-পাল্টে ব্যবহার করেছেন। এই শব্দগুলি তাঁর হিন্দুত্বের ভিত্তি ছিল। ধর্ম কখনই তাঁর কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়নি। তাঁর হিন্দুত্ববাদের ব্যাখ্যায় সমস্ত ভারতীয় ধর্ম, অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম এবং শিখ ধর্ম অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাভারকার নিজেকে নাস্তিক হিসাবে ঘোষণা করে, তাঁর হিন্দুত্বের সংজ্ঞাতে ধর্মের গুরুত্বকে প্রান্তিক করে তোলে। সাভারকারের কাছে একজন হিন্দু হলেন “হিমালয় ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় যিনি বাস করেন তিনি”।”খিলাফত আন্দোলনের প্যান-ইসলামিক সংহতি”-র প্রতিক্রিয়া হিসাবে সাভারকার তাঁর তত্ব নির্মাণ করেছিলেন, যেখানে “মুসলমানরাই প্রকৃত শত্রু ছিল, ব্রিটিশ নয়”। কারণ মুসলিমদের ইসলামী আদর্শ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতিবন্ধক ছিল। তাঁর তত্বে হিন্দুত্ব একটি শব্দ নয় বরং একটি ইতিহাস।

 

স্পষ্ট বোঝা উচিত যে সাভারকারের কাছে মুসলিম এবং খ্রিস্টান হিন্দু হতে পারে না এবং তিনি এর জন্য একটি বিস্তৃত যুক্তি সরবরাহ করেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে যেহেতু মুসলিমদের পবিত্র ভূমি মক্কা এবং জেরুসালেমকে খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, ফলে তাদের এই দেশের প্রতি আনুগত্য সর্বদা সন্দেহের মধ্যে থাকবে। সাভারকার ধরেই নিয়েছিলেন যে ভারতীয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে মুসলমানরা হচ্ছে “সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতক”। তিনি সওয়াল করেছিলেন করেছিলেন যে ভারতীয় সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও জনসেবায় যেন মুসলিম সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। স্ববিরোধিতায় ভরপুর সাভারকার একদিকে চেয়েছিলেন যে হিন্দু রাষ্ট্রে সমস্ত ধর্মের সমান অধিকার থাকবে। হিন্দুস্তানে খ্রিস্টান ও মুসলমানের সঙ্গে সহাবস্থানকে কখনও সাভারকার অস্বীকার করেননি। কিন্তু অন্য দিকে তিনি মুসলমান ও খ্রিস্টানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের বেশী গুরুত্বও দিতে চান নি।

 

এখন যদি আমরা সন্ধানের সৎ চেষ্টা করি যে কেন সাভারকারের রাজনৈতিক দর্শন এমন ছিল যেখানে কেবল হিন্দুদেরই শাসনের একচেটিয়া অধিকার আছে, আমরা দেখতে পাব যে ঔপনিবেশবাদের যুগে মুসলিম এবং হিন্দু সম্প্রদায় এর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ সাভারকারের মত আত্মম্ভরী মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। মুসলিম সম্প্রদায় যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেখানে তারা একই সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিল এবং তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের সুবিধা ভোগ করছিল। কংগ্রেস মুসলিম লীগের সাথে কতিপয় সমঝোতা করেছিল এবং সাভারকার সহ হিন্দুদের মধ্যে এই সুপ্ত ভয়কে জাগিয়ে তুলেছিল যে এই জাতীয় ঘটনাবলী অব্যাহত থাকলে হিন্দুদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে না। সুতরাং হিন্দুস্তানের হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য রাজনৈতিকভাবে সাভারকার তার সম্ভাব্য প্রতিটি স্তরে তাঁর অবদানকে প্রসারিত করেছিলেন। কিন্তু সাভারকারের এই রাজনৈতিক ও সামাজিক বীক্ষা ছিলনা যাতে তিনি কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতাহীনের অবস্থানের মধ্যে তফাৎ করতে পারেন। হ্যাভস এবং হ্যাভনটসরা যে সম্প্রদায় এবং ধর্ম অনপেক্ষভাবে আলাদা এটাই তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি।

 

১৯২৫ সালেই সাভারকারের হিন্দুত্ববাদী আদর্শ নাগপুরের (মহারাষ্ট্র) কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের কানে পৌঁছায় এবং তিনি সাভারকারের হিন্দুত্বের মধ্যে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি রত্নগিরিতে গিয়ে সাভারকারের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর সাথে ‘হিন্দু জাতি’ সংগঠিত করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। সাভারকার এবং হেডগেওয়ার এর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সে বছর সেপ্টেম্বরে হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ গঠিত হয়। এই সংগঠনটি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বৃহত্তম হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়। তবে, হিন্দুত্ববাদ নয় হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণই নতুন সংস্থার আদর্শকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। হেডগেওয়ার আরএসএসকে আদর্শিকভাবে সক্রিয় কিন্তু একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। এই অরাজনৈতিকতা ছিল ক্যামোফ্লেজ মাত্র। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাইরে থাকার এই নির্মোকটি তাঁর উত্তরসূরি গোলওয়ালকারও ১৯৪০-এর দশকে ধরে রেখেছিলেন। আরএসএসের সমান্তরালভাবে, ব্রিটিশ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে সাভারকার ১৯৩৭ সালে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার যোগদান করেন এবং সভাপতিও হন। ১৯৪৪ সালে মহাসভার সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করা এবং স্বাধীনতার পরে জওহরলাল নেহেরু মন্ত্রিসভায় যোগদানকারী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন হিন্দু সনাতনবাদী রাজনীতিবিদ। তিনি হিন্দু মহাসভার সদস্যপদ সকল সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। এটি গ্রহণ না করার অজুহাতে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন এবং আরএসএসের সহযোগিতায় একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। সম্প্রদায় হিসেবে নয়,বরং হিন্দু ধর্মকে জাতীয়তাবাদী ধারণাক্রমেই গ্রহণ করেছিলেন। তাই তিনি নতুন দলটির নাম দেওয়ার জন্য “হিন্দু”-র পরিবর্তে “ভারতীয়” শব্দটি বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর দলের নাম দাঁড়ায় ভারতীয় জনসঙ্ঘ।

 

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনসংঘের সাফল্য ছিল সীমিত। জনসংঘের দুর্বল সংগঠন এবং নেতৃত্বের কারণে, হিন্দুত্ববাদী মনোভাবে অতিরিক্ত ফোকাস ভোটারদের মনে রেখাপাত করেনি, এবং প্রচারে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলির রীতিমত অভাব ছিল। নেতৃত্বের ধারণা ছিল দেশভাগের ক্ষত আর হিন্দুত্ববাদী মনোভাব দিয়েই নির্বাচনে উতরে যাওয়া যাবে। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনপর্বে ব্রিটিশ রাজের কাছে আত্মসমর্পণের ফলে, দেশবাসীর কাছে তাদের মধ্য থেকে কোনও নেতৃত্বের উত্থানও পরিলক্ষিত হয় নি। খুব ধীরে ভারতীয় জনসঙ্ঘের উত্তরসূরী ভারতীয় জনতা পার্টি উপলব্ধি করতে শুরু করে যে সুপ্রাচীন এবং ভারতীয় মাটির গভীরে শিকড় চাড়ানো কংগ্রেস দলের মোকাবিলায় দুটি উপাদান প্রয়োজনীয়। এক, একটি রেজিমেন্টেড স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, যেভাবে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি তার রেজিমেন্টেড ফোর্স তৈরী করে। বর্তমান ভারতে এ কাজে আরএসএসের চাইতে রেজিমেন্টেড আর কোন দল আছে? দুই, একটি নিটোল তত্ব যার আদর্শে প্রাণীত হয়ে সমর্থকেরা কল্পিত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, যেমন সাভারকারের হিন্দুত্ব। কংগ্রেসের এই দুটোরই অভাব। রেজিমেন্টেশন এবং তত্ত্বগত সংগ্রাম। যে সংগ্রামে কংগ্রেস পিছু হটতে বাধ্য। স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে ধুলো ঝেড়ে অতএব সাভারকারের পুনর্বাসন হলো।

 

দেশভাগ ভারতের ক্ষেত্রে একটি ট্রান্স-জেনারেশনাল ট্রমা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভারতবাসী এই ট্রমা বয়ে চলেছে। স্বাধীনতার সময় থেকে অর্ধমিথ্যা প্রচারে আজ অনেকের কাছেই এটি বদ্ধমূল ধারণা যে গান্ধী এবং নেহেরুই দেশভাগের জন্য দায়ী। পরের পর্বে আমরা এই দেশভাগ দিয়েই আলোচনা শুরু করবো।

 

সপ্তম কিস্তি : বিবেকানন্দ, হিন্দুত্ব ও দেশভাগ পর্ব 

 

গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:

  1. The Origins of Religious Violence : An Asian Perspective by Nicholas F. Gier
  2. Hindutva. Who is Hindu? by V.D. Savarkar
  3. The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard  Gordon
  4. Demons in Hindutva: Writing a Theology for Hindu Nationalism, by M. Reza Pirbhai
  5. Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
  6. Patriots and Partisans: From Nehru to Hindutva and Beyond, by Ramchandra Guha
  7. The History of Hindu India, by Satguru Bodhinatha Veylanswami
  8. Uproot Hinditva: The Fiery Voice of the Liberation Paathers, by Thirumaaialavan, translated from the Tamil by Meenakandasamy
  9. The Saffron Wave: Democracy And Hindu Nationalism In Modern India, by Thomas Blom Hansen
  10. Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
  11. The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
  12. Savarkar’s views on Hindu Nationalism, by Sauro Dasgupta
  13. Swami Vivekananda : The Friend of All, by Swami Lokeswarananda

 

লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি। মতামত লেখকের নিজস্ব।

Share this
Leave a Comment