বছর দুয়েক আগে, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমরা কড়েয়ায় তাঁর ছোট্ট কোয়ার্টারে বসে বলে এসেছিলাম, শতবর্ষের জন্মদিনটা তাঁকে নিয়েই পালন করব কিন্তু। কথা রাখতে পারলাম না। আর মাত্র ক’টা দিন — তার আগেই তিনি চলে গেলেন। – নীলাঞ্জন দত্ত ও নীলাঞ্জন মণ্ডল।
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এই বংশটি উপত্যকা ছেড়ে এসেছিল প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে। তারপর থেকে তাঁদের ঠিকানা সিমলা, দিল্লি, এবং শেষপর্যন্ত কলকাতা। এখানেই কমিউনিস্ট হয়েছেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে গেছেন, জেল খেটেছেন, বেরিয়ে এসে অবিভক্ত পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন জলিমোহন কল — ১৯৫২ থেকে ’৬২, টানা এক দশক। এই শহরেই হয়ে গেছেন এক মুখরোচক গল্পের নায়ক এবং বহু নেতার ঈর্ষার পাত্র — বয়সে দশ বছরের, পার্টিতে পদমর্যাদা এবং জনপ্রিয়তায় অনেকটা বড় মণিকুন্তলা সেনকে বিয়ে করে।
মণিকুন্তলাকে নিয়েও কম কেচ্ছা হয়নি তাঁর ড্রাইভার জলি কলকে বিয়ে করার জন্য, (মণিকুন্তলাকে ড্রাইভ করা — সেটা ছিল পার্টিরই দেওয়া দায়িত্ব)। কিন্তু দুজনের কারোরই তাতে কিছু এসে যায়নি, বরং তাঁদের কমরেড গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, এত নিবিড় জুটি ছিলেন তাঁরা, যে অনেকে বলত “জলিকুন্তল”।
এসবে পাত্তা দেওয়ার কোনও কারণও ছিল না তাঁদের। মণিকুন্তলার কাহিনী তাঁর ‘সেদিনের কথা’-র দৌলতে অনেকেই জানেন। জলি কলও অনেক লড়াইয়ের যোদ্ধা। ১৯৪৮-৫১ যখন বিনাবিচারে বন্দি ছিলেন, দমদম জেলে সশস্ত্র গোর্খাবাহিনী ডেকেও কর্তৃপক্ষ তাঁদের সেলে ঢোকাতে পারেনি, এবং প্রথম সারিতেই ছিলেন জলিমোহন। তিনি অবশ্য আমাদের বলেছেন, গোর্খারা হয়ত হিন্দিতে তাঁর বক্তৃতা শুনে একটু প্রভাবিতই হয়ে গিয়েছিল, নইলে সেদিন একটা ‘জেল ম্যাসাকার’ হয়ে যেত। গুলি চলেছিল ঠিকই, তিনজন মারাও গিয়েছিল, কিন্তু সেই গুলিগুলো নাকি দেওয়ালের দিকে ছোঁড়া হয়েছিল, সেখান থেকে ‘বাউন্স’ করে তাদের গায়ে লেগেছিল। তাঁর সহবন্দী ছিলেন চারু মজুমদার। তিনি নাকি খুব শান্তশিষ্ট ছিলেন, যদিও তাঁর ‘জলপাইগুড়ি গ্রুপ’-এর অন্যান্যরা ছিলেন দারুণ জঙ্গী। তবে পরবর্তীকালে নকশালবাড়ি পর্যায়ে চারু মজুমদারের লাইনের সঙ্গে তিনি সেই সময়কার রণদিভে লাইনের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছিলেন, তাও বলেছিলেন।
এর আগে, ১৯৪৭এর ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কলকাতা বন্দরে ৮৭ দিনের যে শ্রমিক ধর্মঘট ইতিহাস তৈরি করেছিল, তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন জলি কল। এবং সেখানেও তাঁর স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। পোর্টের ৩০,০০০ শ্রমিকের মধ্যে ৮৫ শতাংশই তখন তাঁদের লাল ঝান্ডা ইউনিয়নে, তবু বহু চেষ্টায় একেবারেই সংখ্যালঘু আইএনটিইউসি ইউনিয়নকেও স্ট্রাইকে টেনে এনেছেন, শ্রমিক ঐক্য ভাঙতে দেবেন না বলে। আবার স্ট্রাইক চলাকালীন আইএনটিইউসি নেতৃত্ব যখন বার বার পিছুটান মেরেছে “এভাবে কিছু হবে না, ওরা কিছুতেই মানবে না” বলে, তখন শ্রমিকরাই তাদের গদ্দারি করতে দেয়নি। শেষপর্যন্ত সরকার পে কমিশন বসাতে বাধ্য হয়েছে, অনেক টাকা মাইনে বেড়েছে।
আমাদের কাছে বলেছেন, “ট্রেড ইউনিয়নটাই আমার করা উচিত ছিল, পরে পার্টির জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়াটাই ভুল হয়েছে।” কেন? কারণ, “ওই দশ বছর নেতৃত্বের অংশ হিসেবে আমাকেও এমন অনেক কিছু করতে হয়েছে, যার জন্যে আমি আজও লজ্জিত।”
অনেকে লিখছেন দেখলাম, পার্টি ভাগাভাগির সময় তিনি পার্টি ছেড়েছেন। আমাদের কাছে কিন্তু বলেছেন, ১৯৬১ সালেই তিনি ভবানী সেনকে চিঠি লিখে পার্টি ছাড়তে চান, এবং তার পরের বছরেই ছেড়ে দেন। আবার মুজফফর আহমেদ সম্পর্কে সেদিনও বলেছেন, মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধা করবার মত।
পার্টি ছাড়লেন কেন? “কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা আর মার্ক্সিস্ট পার্টি নেই, একটা স্ট্যালিনিস্ট পার্টি হয়ে গেছে।” (খেয়াল রাখবেন, তিনি কিন্তু এটা অবিভক্ত সিপিআই সম্পর্কেই বলছেন।) তারপর ব্যাখ্যাও করেছেন, “দুটোর মধ্যে অনেক তফাত আছে। মার্ক্স ছিলেন একজন হিউম্যানিস্ট। আর এরা মানুষকে একটা যন্ত্র হিসেবে দেখে।”
তাহলে জীবনের শেষ পর্যায়ে কোথায় দাঁড়িয়েছিল তাঁর আদর্শ? কিসে তাঁর আস্থা? একটুও না থমকে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি এখন যা নিয়ে ভাবি — অধ্যাত্মবাদ ছাড়া — তা হল, আমাদের পৃথিবীটা কী করে বাঁচবে। ক্যাপিটালিজম তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাপিটালিজম নিজেও ধ্বংস হয়ে যাবে। জলবায়ু, পরিবেশ যেভাবে পাল্টাচ্ছে, এরপর সমুদ্র উঠে আসবে, লক্ষ লক্ষ লোক বাস্তুহারা হবে — তারা কি ছেড়ে দেবে?” কিন্তু কোন আদর্শকে নিয়ে মানুষ বাঁচবে? তাঁর স্পষ্ট উত্তর, সমাজবাদের সঙ্গে পরিবেশবাদকে যোগ করতে হবে। “ইকো-সোশ্যালিজমই ভবিষ্যৎ।”
লেখকরা, মানবাধিকার কর্মী।
excellent writing and nice analysis Nilanjan da