কয়লা সম্পদকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য, ৪১টি কোল ব্লককে নিলাম ডেকে কর্পোরেটগুলির হাতে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৮ জুন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই ৪১টি কয়লা ব্লক জঙ্গল প্রধান আদিবাসী এলাকায় অবস্থিত। এর ফলে সবার প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এইসব এলাকার লক্ষ লক্ষ আদিবাসী মানুষ, পশুপাখি এবং ধ্বংস হবে হাজার হাজার হেক্টর সবুজ অরণ্য। ব্যক্তি মালিকরা আমাদের দেশের শিল্পায়নের নামে পরিবেশ ও শ্রমিকদের কোনও অধিকারেরই তোয়াক্কা না করে কয়লা তুলে আনলে উচ্ছেদ হবেন ৪১টি কয়লা ব্লকের কয়েক হাজার আদিবাসী ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ। পাশাপাশি সরকারি কোম্পানি কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডকে বাঁচিয়ে রাখার আর কোনও দরকার পড়বে না এবং কোল ইন্ডিয়া বন্ধ হলে কাজ হারাবেন প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমিক। লিখেছেন সুদীপ্তা পাল ।
কয়লার বাণিজ্যিক ব্যবহারের উত্তোলন ছাড়পত্র ২০১৫ সালেই দেওয়া হয়। কয়লা শিল্পের বাণিজ্যিকিকরণ ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, আগামী ২-৪ জুলাইয়ের কয়লা শিল্পে ধর্মঘটে সামিল হচ্ছে সবকটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সিটু, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, বিএমএস ও ইউটিইউসি ছাড়াও রানিগঞ্জ কয়লাখনিতে ইসিএল ঠিকা শ্রমিক অধিকার ইউনিয়ন, গোদাবরী খনিতে এআইএফটিইউ-সহ সিঙ্গারেনি ট্রেড ইউনিয়ন, জয়েন্ট ফোরাম এই ধর্মঘট সফল করার ডাক দিয়েছে।
রেল-সহ অন্য প্রত্যেকটি শিল্পের মতোই ১৯৯১-এর নয়া শিল্পনীতি অনুসারে ভারত সরকার যখন ধাপে ধাপে কয়লা শিল্পকেও বেসরকারি হাতে তুলে দিচ্ছে তখন কোনও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন জোরদার প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। মুখে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার নামে কার্যত প্রত্যেকটি বেসরকারিকরণের ধাপকে মেনে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার বেসরকারি বেঙ্গল এমটা কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কোলিয়ারি চালু করে পথ দেখায়। এমনকি ২০০২ সালে বামফ্রন্টের আমলেই ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ বেসরকারি কয়লা খনি গোয়েঙ্কাদের মালিকানায় চালু হয়েছে রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে। ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু হলো কয়লাশিল্পকে ব্যক্তিমালিকের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া। ২০১৫ সালে কোল মাইন্স স্পেশাল প্রভিশান অ্যাক্ট রাজ্য সভায় পাস করতে সাহায্য করে তৃণমূল কংগ্রেস। কংগ্রেসের আনা এই বিলের পক্ষে ভোট দিয়ে। এই আইনেই ব্যক্তি মালিককে বাজারে কয়লা বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচদিনের ডাকা ধর্মঘটে স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সামিল হয়েছিল। প্রথম দু’দিন সফল ধর্মঘটের পর যখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে কয়লার জোগানে টান পড়ে, শুধুমাত্র কমিটি গঠনের আশ্বাসে পাঁচটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সিআইটিইউ ছাড়া চারটি ইউনিয়ন ধর্মঘট তুলে নেয়। এই ধর্মঘটের সরাসরি বিরোধিতা করেছিল তৃণমূল আশ্রিত ইউনিয়ন। মার্চে কোল মাইন্স (স্পেশাল প্রভিশান) অ্যাক্ট, ২০১৫ তৈরি করতে আর কোনও বাধা থাকে না।
২০১৫-এর আইনের পথ ধরে করোনাভাইরাস অতিমারির লকডাউনের মধ্যে কয়লার বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ব্যক্তি মালিকের হাতে ৪১টি কয়লা ব্লকের তালিকা অনুমোদন করা হলো। সরকারি কয়লা সংস্থা কোল ইন্ডিয়ার সব সাবসিডিয়ারি বন্ধ করার পথে কার্যত হাঁটতে শুরু করল ভারত সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা শিল্পের এই মরণকালেও লোক দেখানো ধর্মঘটে জাতীয় কংগ্রেসের শ্রমিক ইউনিয়ন আইএনটিইউসির যেমন ধর্মঘটের সমর্থনে জোরদার প্রচার বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না, তেমনই তৃণমূল কংগ্রেস শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকারকে স্বীকারই করছে না এবং এই ধর্মঘটকে সমর্থনও করছে না। সিটু, এআইটিইউসির মতো বামপন্থী কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন নিজেদের নীতিহীনতার কারণে বার বার ডানপন্থী ইউনিয়নের সঙ্গে যৌথতার নামে কোল ইন্ডিয়ার সব শ্রমিক বিরোধী চুক্তিতে সই করেছে। শেষ ওয়েজ বোর্ডে মাটির তলার খনি বন্ধ হওয়া মেনে নিয়েছে। আজ শুধু কিছু প্রচার চালিয়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভকে সামাল দিতে চাইলেও শ্রমিকরা সংসদীয় পথের বামপন্থী ইউনিয়নগুলোর উপরও ভরসা রাখতে পারছে না। সিটু ইউনিয়নের সাধারণ শ্রমিক সদস্যরা বলছেন, ‘নেতারা ধর্মঘট তুলে নিলেও আমরা ধর্মঘট সফল করব।’ শ্রমিকরাই আজ বাধ্য করছে বিএমএসকে ধর্মঘটে সামিল হতে। এই প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়নগুলো কেউ দাবি করেনি কোল মাইন্স (স্পেশাল প্রভিশান) অ্যাক্ট, ২০১৫ বাতিল করতে। ২০১৮ সালেই ১২টি কয়লা ব্লককে চিহ্নিত করা হয় ব্যবসায়িক কারণে ব্যবহারের জন্য। এখানে উল্লেখ করা দরকার ঝাড়খণ্ডের বিস্থাপন বিরোধী যৌথ মঞ্চ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন গণসংগঠন আদিবাসী এলাকায় অবস্থিত কোল ব্লক বণ্টন বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হবে আদিবাসী মানুষ ও পরিবেশ
নিলাম করার জন্য বাছাই করা ৪১টি ব্লকের ২০টি ঝাড়খণ্ডে, বাকিগুলো ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র ও ওড়িশার গভীর জঙ্গল এলাকায় অবস্থিত। প্রত্যেকটি জঙ্গল এলাকা অসংখ্য নদী নালা, বন্যপ্রাণী ও জ়ৈববৈচিত্রে ভরপুর। ছত্তিশগড়ের হসদেব অরণ্যের মধ্যে ৪টি কয়লা ব্লক ৮৭ শতাংশ জঙ্গল এলাকা ধ্বংস করবে। মহারাষ্ট্রের বন্দের ও মধ্যপ্রদেশের গিটিটোরিয়া (পূর্ব) কয়লাখনি এলাকার ৮০ শতাংশ ও ঝড়খণ্ডের কোলব্লক এলাকার মধ্যে ৫৫ শতাংশই ঘন জঙ্গল। পরিবেশ কর্মী ও বনবাসীদের আন্দোলনের চাপে ইউপিএ সরকারের আমলে পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ এই সব ঘন জঙ্গল এলাকাকে কয়লা খনির জন্য ‘গো জোন’ ও ‘নো গো জোন’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। এবং ‘নো গো জোন’ এলাকায় কয়লা খনন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ইউপিএ সরকারের আমল থেকেই এই গো ও নো গো জোনের নীতি দুর্বল হতে থাকে এবং ২০১২ সালে প্রথম বণ্টন হওয়া ২০৪টি কয়লা ব্লকের ১০০টির বেশি ব্লকের অবস্থান ছিল ‘নো গো জোন’ এলাকার মধ্যে।
পাহাড় জঙ্গল এলাকার আদিবাসী মানুষ সরকারি, বেসরকারি খনন কাজ, রাস্তা, বাঁধ ও অন্যান্য পরিকাঠামোর জন্য বার বার উচ্ছেদ হতে থাকায় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তৈরি হয় আদিবাসী এলাকার (শিডিউল এলাকা) গ্রাম সভাকে স্বশাসনের অধিকার দেবার জন্য পেসা আইন বা পঞ্চায়েত (এক্সটেনশান টু শিডিউল্ড এরিয়াস) অ্যাক্ট, ১৯৯৬। এই আইনে গ্রাম সভাকে দেওয়া স্বশাসনের অধিকার অনুসারে — আদিবাসীদের বসবাস ও চাষের জমি ছাড়াও আদিবাসীরা যে জঙ্গল বা নদী, ঝরনার জল ব্যবহার করে সেই এলাকা শিডিউল এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং এই এলাকার মধ্যে বাইরের মানুষ বা সংস্থা জমি নিলে বা কোনও প্রকল্প তৈরি করতে চাইলে গ্রামসভার অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। ২০১২ সালে ২০৪টি কোল ব্লক নিলামের সময় যেমন পেসা ভঙ্গ করা হয় তেমনই এই ৪১টি ব্লক নিলাম করার সিদ্ধান্তও রাষ্ট্র গ্রাম সভার অনুমতি না নিয়েই একতরফা ভাবে গ্রহণ করেছে। কারণ আদিবাসীরা স্বাভাবিক ভাবেই, যে পাহাড়, বন, নদী তাদের জীবন-জীবিকার উৎস তাকে ধ্বংস হতে দেবে না। ছত্তিশগড় বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা বলেছেন, কয়লা খননের ফলে শুধু জঙ্গল ধ্বংস হবে না পুরো এলাকার জলের উৎস ধ্বংস হয়ে জলের তীব্র অভাব দেখা দেবে। ছত্তিশগড়ের হসদেব নদীতে বাঁধ দিয়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা, হাতির করিডোর ও প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা গোন্ড আদিবাসীদের বাসস্থান, জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি ধ্বংস হওয়া রুখতে ২০০৯ সালে এই অঞ্চল ‘নো গো জোন’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি দস্তাবেজেই বলা আছে এই এলাকা থেকে কয়লা না তুললে কয়লা উৎপাদনে কোনও প্রভাব পড়বে না।
‘নো গো জোন’-এ কয়লা খনি করার আদৌ দরকার কিনা?
২০১৯-২০ সালে ভারতের কয়লা উৎপাদনের পরিমাণ ৭২.১ কোটি টন ও আমদানি হয়েছে ২৪.২৯ কোটি টন। ভারত সরকারে নিজের রিপোর্টে দেখিয়েছে ২০৩০ পর্যন্ত যে ১৫০ কোটি টন কয়লার প্রয়োজন আছে সেই চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন কোনও কোল ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করার প্রয়োজন নেই। কোল ইন্ডিয়া থেকেই প্রয়োজনীয় কয়লা পাওয়া যাবে। তার মানে নতুন করে জঙ্গল ধ্বংস করে কয়লা খনি করার প্রয়োজন নেই। এবার প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে ১০ বছর পরে কী হবে? সারা পৃথিবী কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করে না এমন পরিষ্কার শক্তি উৎসের (ক্লিন এনার্জি) দিকে ঝুঁকছে। ভারতে বর্তমানে ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ তৈরি হয় কয়লা থেকে। ২৩ শতাংশ বিদ্যুৎ তৈরি হয় সূর্যের আলো, বাতাস, বায়োমাস ও ছোট জল বিদ্যুতের মতো নবীকরণ যোগ্য শক্তির উৎস থেকে। ২০২২-এর মধ্যেই নবীকরণ যোগ্য শক্তির উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩৩ শতাংশ করার যোজনা বানিয়েছে ভারত সরকার। সরকারের দেওয়া হিসাবে ভারতে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সম্ভাবনা আছে তাতে ভবিষ্যতে পুরো দেশের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা সম্ভব। তা স্বত্ত্বেও আদিবাসীদের হাজার হাজার বছরের বাসস্থান উজাড় করে, পরিবেশের তোয়াক্কা না করে ৪১টি কোল ব্লক ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হল কেন?
এই কেনর উত্তর পাওয়ার জন্য বেসরকারিকরণের ইতিহাস একটু দেখা দরকার।
ভারতবর্ষের শিল্পের উন্নতির প্রয়োজনে ১৯৭২-৭৩ সালে কয়লা শিল্প জাতীয়করণ হয়। ভারতের সকল মানুষের অধিকার তৈরি হয় কয়লা সম্পদের উপর। কয়লার সঙ্গে সঙ্গে কোল কোম্পানিগুলোও সরকার অধিগ্রহণ করে। কয়লা ব্যবহারকারী শিল্পপতিদের চাপে সরকার কয়লার দাম নিজে নির্ধারণ করত। ফলে কয়লা শিল্প জাতীয়করণের পর উৎপাদন খরচের থেকে কম দামে কয়লার যোগান পেয়েছে বেসরকারি শিল্পপতিরা। ১৯৯১ সালে নয়া শিল্পনীতির বা নয়া উদারনীতির হাত ধরে কয়লার দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হল। রাষ্ট্রায়ত্ত কোল কোম্পানিকে বাধ্য করা হল বাজারে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে টিকে থাকতে। নয়ের দশকের মাঝামাঝি কয়লার আমদানি শুল্ক ৮৫% থেকে কমে ৩৫% হল। তার ফলে আমদানিকৃত কয়লার দাম কোল ইন্ডিয়ার কয়লার দামের থেকে কমে গেল। সরকারি ও বেসরকারি উভয় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের উৎপাদিত কয়লার সাথে বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লা ব্যবহার করতে শুরু করল।
কয়েক বছরের মধ্যে কোল ইন্ডিয়ার বিভিন্ন সাবসিডিয়ারিতে নতুন মাটির তলার খনির বদলে ঠিকা সংস্থাকে দিয়ে (যার পোশাকি নাম আউটসোর্সিং) খোলামুখ খনি থেকে কম ব্যয়ে কয়লা উত্তোলন শুরু করলো। খনি এলাকার মানুষের উচ্ছেদ, ধ্বংসপ্রাপ্ত জীবিকা ও পরিবেশকে ক্ষতি হিসাবে না ধরার ফলে খোলামুখ খনি থেকে উৎপাদিত কয়লার উৎপাদন খরচ কম রাখতে পারল। ধীরে ধীরে লোকসানে চলা মাটির তলার খনি বন্ধ হয়ে গেল। কোল ইন্ডিয়া খোলামুখ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের উপর জোর দিল। কোল ইন্ডিয়ার লাভের অঙ্ক যখন সবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে সেই সময় কয়লা শিল্পের ময়দানে এল বেসরকারি পুঁজি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সাল থেকে ভারতে ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণ শুরু হয়েছে। ১৯৯৩ ও ২০০০ সালে পরপর সংশোধনী এনে বেসরকারি বিদুৎ কোম্পানি, সিমেন্ট ও অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানি এবং ২০০৭ সালে বেসরকারি কোল গ্যাসিফিকেশন ও লিকিউডিফিকেশন সংস্থাকে ক্যাপটিভ কয়লাখনি করার অনুমতি দেওয়া হল। তারপর ২০০৬ সালে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজি ক্যাপটিভ মাইনে আসার ছাড়পত্র পেয়ে গেল। মাইনস অ্যান্ড মিনারেল (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশান) অ্যাক্ট-এ ২০১০ সালে সংশোধনী এনে অন্যান্য খনিজ দ্রব্যের সাথে কয়লাকেও নিলামে চড়ানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ২০১২ সালে ২০৪টি কয়লা ব্লক বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও বেসরকারি কোম্পানিকে দেবার জন্য নিলাম ডেকে বরাদ্দ করা হয়।
বেসকারিকরণের পথে শেষ ধাপ
ব্যক্তি মালিকদের সামনে কয়লাখনি থেকে লাভের অঙ্ক বাড়ানোর পথে একটি বাধা রয়ে গেল। কয়লা ব্লক ব্যক্তি মালিকরা পাবেন ক্যাপটিভ কয়লাখনি হিসাবে মানে খনির কয়লা বেসরকারি মালিকের নিজের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিমেন্ট বা অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করতে হবে, বাজারে কয়লা বিক্রি করতে পারবেন না। মাত্র ২৭ শতাংশ কয়লা ব্যক্তি মালিকরা উৎপাদন করায় কোল ইন্ডিয়ার একচেটিয়া বাজার তখনও রয়ে গেল। ২০১২ সালে বণ্টন করা ২০৪টি কয়লার ব্লক যা বেসরকারি বিদ্যুৎ সংস্থা পেয়েছে তারা জমি অধিগ্রহণের সমস্যা, ‘নো গো জোন’-এর নীতি সহ কিছু পরিবেশ আইনের বাধানিষেধের জন্য কয়লার খনি প্রকল্পগুলো থেকে যথেষ্ট লাভের টাকা পাবে না বলে খনি চালু করল না। কমদামে কয়লা আমদানি করতে লাগল।
২০০৯-১০ নাগাদ পরিবেশ আন্দোলনের চাপে কয়লার উৎপাদন কমে গিয়ে আমদানিকৃত কয়লার দাম বাড়ল। তার সাথে যুক্ত হলো কোলগেট কেলেঙ্কারি। ভারত সরকারের থেকে কয়লা ব্লক পাওয়ার জন্য নিলামে অংশ নেওয়া সংস্থাগুলোর মালিকরা ভুয়ো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দেখিয়ে নিলামে অংশ নিয়েছে, যা ২০১৪ সালে কোল গেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত। ২০১৪-এর ২৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বণ্টন হওয়া ২০৪টি কয়লা ব্লক ভারত সরকার ফিরিয়ে নেয়। তখন ব্যক্তি মালিক ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা সরকারের উপর চাপ তৈরি করতে থাকল তাদের বাজারে কয়লা বিক্রির নিয়ন্ত্রণ দিয়ে কয়লা ক্ষেত্রকে পুরোপুরি বেসরকারিকরণের জন্য। এবং কোল ইন্ডিয়ার একচেটিয়া বাজার ভেঙে দেবার জন্য।
ফিরিয়ে নেওয়া এই কোল ব্লক আবার বণ্টন করার জন্য ২০১৪ সালের অক্টোবরে কোল মাইন্স (স্পেশাল প্রভিশান) অর্ডিনান্স, ২০১৪ আনা হয়। পরে ১২ ডিসেম্বর কোল মাইন্স (স্পেশাল প্রভিশান) বিল, ২০১৪, স্ট্যান্ডিং কমিটিকে এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে লোকসভায় শুধুমাত্র ধ্বনি ভোটে অনুমোদন পেয়ে রাজ্যসভায় যায়। এই বিলে বেসরকারি উদ্যোগকে কয়লার ব্যবসায়িক ব্যাবহারের অনুমতি দেওয়া হল। ২০১৫-এর মার্চে রাজ্যসভার অনুমোদনে কোল মাইন্স (স্পেশাল প্রভিশান) অ্যাক্ট, ২০১৫, তৈরি হয়। ২০১৯ সালে কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজি নিয়োগের ছাড়পত্র পেয়ে গেল। আজ এই সুত্রেই বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেবার জন্য ৪১টি কয়লা ব্লককে নিলাম করা হবে। স্বাভাবিক ভাবেই এই অকশান প্রক্রিয়াতে ভারতের টাটা, বিড়লা, আদানিরা এবং রিও টিন্টো, বিএইচপির মতো বিদেশি কোম্পানি অংশ নেবে।
প্রয়োজন থাকবে না রাষ্ট্রায়াত্ত কোল কোম্পানি বা কোল ইন্ডিয়ার।
বেসরকারি মালিকরা কোনও শ্রম আইন, পরিবেশ আইন না মানায় কোল ইন্ডিয়ার উৎপাদিত কয়লার উৎপাদন খরচ বেসরকারি খনির তুলনায় বেশি। এরপর ধীরে ধীরে কোল ইন্ডিয়ার কয়লার চাহিদা কমতে থাকবে। ধীরে ধীরে কোল ইন্ডিয়া বন্ধ হবার দিকে এগিয়ে যাবে বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সব মাটির তলার খনি বন্ধ করে দিতে হবে, স্থায়ী শ্রমিকদের স্বেচ্ছা অবসর নিতে বাধ্য করবে। মাটির তলার খনি বন্ধ করার অনুমতি ইতিমধ্যে দশম বেতন চুক্তিতে পাঁচটি ট্রেড ইউনিয়নের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে এবং নানা কৌশলে শ্রমিকদের স্বেচ্ছা অবসর নেবার হুমকি দিচ্ছে। বেসরকারি খনির মালিকরা যেহেতু কয়লা বাজারে বিক্রি করার ছাড়পত্র পেয়ে গেল তাই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বণ্টন হওয়া কয়লা ব্লক থেকে উৎপাদন শুরু হলে ভবিষ্যতে কোল ইন্ডিয়ার দামি কয়লার বাজার থাকবে না। বাজারের প্রতিযোগিতার নিয়মে কোল ইন্ডিয়া বন্ধ হবে বা বেসরকারি মালিকানায় চলে যাবে। দেশি ও বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে দেশের কয়লা সম্পদ।
কয়লা সম্পদের উপর ও বাজারে দামের উপর সরকারের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এখনও আমাদের দেশের মূল শক্তির উৎস হল কয়লা। কয়লার মতো খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানিগুলির হাতে চলে গেলে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও নির্ভরশীলতা তৈরি হবে। দেশি-বিদেশি ব্যক্তি মালিকের স্বার্থে জমি আইন, পরিবেশ আইন সবই বদলে দিতে চাইছে আজকের বিজেপি সরকার। মালিকশ্রেণির দ্বারা পরিচালিত ভারত রাষ্ট্র আদিবাসীদের জমি রক্ষার পেসা আইন বা শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য শ্রম আইন কোনও কিছুই ব্যক্তি মালিককে মানতে বাধ্য করবে না।
এই পরিস্থতিতে আমাদের দেশের কয়লা সম্পদের লুট আটকাতে, শ্রমিকদের ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে, লক্ষ লক্ষ আদিবাসী মানুষের উচ্ছেদ প্রতিরোধ করতে, জল-জঙ্গল রক্ষা করতে আগামী ২-৪ জুলাইয়ের ধর্মঘট সফল করার দায় শ্রমিকশ্রেণি সহ সমাজের সমস্ত মানুষের। সরকারের শ্রমিক বিরোধী ও জনবিরোধী চক্রান্তকে পরাস্ত করার জন্য নির্দিষ্ট দাবিকে সামনে রেখে ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিচ্ছে রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের শ্রমিকরা।
১) কোল মাইন্স অর্ডিনান্স অ্যাক্ট, ২০১৫ বাতিল করতে হবে।
২) সব ধরনের বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া বাতিল করে পুরো কয়লা শিল্পকে পুনরায় রাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে।
৩) ৪১টি কোল ব্লক-সহ সমস্ত কোল ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে।
৪) কয়লাখনিতে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে।
৫) ঠিকা প্রথা রদ করতে হবে।
৬) ১০ বছরের মধ্যে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে এনে তার বদলে নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস থেকে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে হবে।
৭) পরিবেশ ধ্বংস করবে এবং মানুষ ও পশুপাখি উচ্ছেদ করবে এমন সমস্ত কয়লাখনি প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
লেখক ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্টিভিষ্ট, ইসিএল ঠিকা শ্রমিক অধিকার ইউনিয়নের সাথে যুক্ত।
Also read: কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ: কফিনে শেষ পেরেক
খুব ভালো লেখা। কয়লা সম্পদ বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ধাপে ধাপে যে আইনগুলোর উল্লেখ এই লেখায় পেলাম, সেগুলির আরো বিস্তৃত আলোচনা দরকার।