গ্রাউন্ডজিরো রিপোর্ট
23.06.2020
সোমবার ২২ জুন উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায় ১৩টি ব্লকের প্রায় ১৫০০-২০০০ গ্রামবাসী আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ভুয়ো তালিকা তৈরি করে ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি, একশ দিনের কাজ ও তার বকেয়া মজুরি পাওয়া, জব কার্ড, রেশন কার্ড পাওয়া ইত্যাদি ন্যায্য দাবি নিয়ে বিডিও অফিস ঘেরাও করে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানালে ও সন্ধ্যায় টাকি রোড অবরোধ করলে রাতের অন্ধকারে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হামলাকারীরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের উপর আক্রমণ চালায়। পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকেরা ছিলেন নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায়। পরে পুলিশ হামলাকারীদের সঙ্গে প্রতিবাদকারী অবস্থানরত গ্রামবাসী ও গণ সংগঠনের কর্মীদের উপর নির্বিচারে লাঠি চালায় বলে সংবাদ সূত্রে জানা যায়। অবস্থানকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান ও বহু মানুষ আহত হন, কারওর কারওর চোট ছিল আশঙ্কাজনক। সেই রাতেই বেশ কয়েক জন গণ সংগঠন কর্মী ও গ্রামবাসীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সোমবার রাতেই গ্রাউন্ডজিরো এই ঘটনা রিপোর্ট করে। রইল সেই রিপোর্টের লিঙ্ক।
https://www.groundxero.in/2020/06/22/attack-on-villagers-demonstrating-for-amphan-compensation/
এরপর মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া গ্রামবাসী ও গণ সংগঠন কর্মীদের বারাসাত কোর্টে তোলা হয়। আর বর্তমানে ঠিক যেভাবে বিচারব্যবস্থা প্রশাসনের অঙ্গুলিহেলনে চলছে ঠিক সেভাবেই এক্ষেত্রেও গণ সংগঠন কর্মী ও গ্রামবাসীদের এমন কয়েকটি ধারায় আটক করা হয় (যার মধ্যে কয়েকটি জামিন অযোগ্য) যার সঙ্গে সোমবারের প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচীর কোনও যোগ নেই বলেই ধারণা। সোমবার যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁদের মধ্যে ৬ জনের পুলিশি হেফাজত আর ১০ জনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আগামী শুনানি হওয়ার কথা ২৬শে জুন। জেল হেফাজতের ১০ জনের মধ্যে ২ জন ও পুলিশ হেফাজতের ৬ জনের মধ্যে ৪ জন গণসংগঠন কর্মী ও বাকিরা গ্রামবাসী। গ্রেফতার হওয়া কারওরই এদিন জামিন মঞ্জুর হয়নি।
সংবাদ সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী সোমবার রাতে যখন প্রতিবাদকারীদের উপর বিনা প্ররোচনায় হামলা ও পুলিশি আক্রমণ চলেছে ও পরে গ্রেফতার করা হয়েছে তখন কোনও মহিলা পুলিশ ছিলেন না ও মহিলা গ্রামবাসী বা গণ সংগঠন কর্মীদের মহিলা পুলিশ ছাড়াই আটক করা হয়।
মঙ্গলবার গণ সংগঠন কর্মীরা বারেবারেই জানান যে সোমবার তাঁরা ও গ্রামবাসীরা কোনওরকম হিংসাত্মক পরিবেশ তৈরি করতে আদপেই আগ্রহী ছিলেন না ও সর্বতোভাবে তা থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিলেন। নিজেদের অধিকার ও ত্রাণ সংক্রান্ত প্রশাসনিক কাজে দিনভর ঘেরাও কর্মসূচীর পরেও যখন তাঁদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া হয় না, তখন বাধ্য হয়েই তাঁরা টাকি রোডে শান্তিপূর্ণ অবস্থান শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল পুলিশি উপস্থিতিতে বিডিও ও অন্যান্য প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায় করা ও প্রশাসনের কাজে দুর্নীতি শনাক্ত করিয়ে তা সংশোধন করানো। কিন্তু তার বদলে বিডিও এবং পঞ্চায়েত প্রধান ও অন্যান্যদের উসকানিতে, পুলিশি মদতে তাঁদের উপরেই নেমে আসে নির্মম আক্রমণ। রাতের অন্ধকারে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হামলাকারীরা ঢুকেছিল বিডিও অফিসের পেছনের গেট দিয়ে।
অথচ মঙ্গলবার আদালতে আশ্চর্যজনকভাবে এই সবই অদেখা হয়ে যায়। অপরাধীরা নয়, গ্রেফতার হয়ে ছিলেন প্রতিবাদীরা। যে বহু সংখ্যক গ্রামবাসী ও গণ সংগঠন কর্মী সোমবার আহত হন তাঁদের কোনও উল্লেখ এদিন আদালতে পেশ হওয়া সরকারি নথিতে ছিল না। উপরন্তু বলা হয় তাঁরা মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে চড়াও হন প্রশাসনের ব্যক্তিদের উপর। কিন্তু প্রশাসনের কোনও আহত ব্যক্তির রিপোর্ট তারা পেশ করতে পারেননি। এরকম আরও অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতিবেদন পেশ করা সত্ত্বেও গ্রামবাসী ও গণ সংগঠন কর্মীরাই জেল ও পুলিসি হেফাজতে যান!
যদি একবার চোখ রাখা যায় ভারতীয় দন্ডবিধির কোন কোন ধারায় আটক করা হয়েছে প্রতিবাদকারীদের তাহলেই প্রশাসনের তরফে এই গ্রেফতার যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা স্পষ্ট হয়ে যায় –
১) ধারা ১৪৭ – দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা
২) ধারা ১৪৮ – দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা, মারাত্মক অস্ত্র সঙ্গে থাকা যা দিয়ে মানুষকে আহত বা হত্যা করা যায়
৩) ধারা ১৪৯ – বেআইনিভাবে কোনও জায়গায় জমায়েত হওয়া
৪) ধারা ২৮৩ – গণ পরিবহন বা জনসাধারণের চলাচলের রাস্তায় বিপদ হিসাবে উপস্থিত থাকা বা বাধা সৃষ্টি করা
৫) ধারা ৩৩৩ – ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও সরকারি কর্মচারীকে তার সরকারি কাজ/দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া
৬) ধারা ৩৪১ – কোনও ব্যক্তিকে ভুলভাবে বাধা দেওয়া
৭) ধারা ৩৫৩ – কোনও সরকারি কর্মচারীকে লাঞ্ছনা বা তার উপর অপরাধী শক্তি প্রয়োগ করে তার দায়িত্ব পালনে ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করা
৮) ধারা ৩৫৪ – মহিলাদের সম্মানহানির উদ্দেশ্যে তাদের লাঞ্ছনা বা তাদের উপর অপরাধী শক্তি প্রয়োগ
৯) ধারা ৪২৭ – ৫০ টাকা বা তার থেকে বেশি অর্থমূল্যের ক্ষতিসাধন
১০) প্রিভেনশন অফ ড্যামেজ টু পাবলিক প্রপার্টি অ্যাক্ট-এর ৩ নং ধারা
১১) মেইনটেইনেন্স অফ পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট-এর ৯ নং ধারা
১২) হাইওয়ে অ্যাক্ট-এর ৮ নং ধারা
এরমধ্যে কয়েকটি রয়েছে জামিন-অযোগ্য ধারা এবং বেশ কয়েকটি রয়েছে যেখানে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে জামিনের আবেদন বিচার করা হয়। তবে এই ধারাগুলির অধিকাংশই যে ভিত্তিহীন ও অভিযোগকারী প্রতিবাদরত গ্রামবাসী ও গণ সংগঠন কর্মীদের থামাতেই প্রয়োগ করা হয়েছে তা স্পষ্ট। গণ সংগঠন কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা জানান, দেগঙ্গায় আহত গ্রামবাসীদের মেডিক্যাল পরীক্ষা করে পরবর্তী পর্যায়ের এফআইআর করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন তাঁরা।