গ্রাউন্ডজিরো রিপোর্ট, ১০.০৬.২০২০
কোভিড ১৯ সংক্রমণের কারণে দেশজোড়া লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই অন্যান্য সব কিছুর মতোই তার আঁচ এসে পড়ে এ দেশের বিচারব্যবস্থার গায়েও। দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতোই এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট, তার সার্কিট বেঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ জুডিশিয়াল আকাডেমি ও সাব-অর্ডিনেট কোর্টগুলি ২৫ মার্চ ২০২০ থেকে বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে সাম্প্রতিক ৮ জুন ২০২০ পর্যন্ত কোরোনা-র জেরে লকডাউন-এর কারণে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও নিয়মিতভাবে বিভিন্ন তারিখে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে জামিনের মামলা সহ নানা জরুরি মামলারই শুনানি চলেছে ‘ভার্চু্য়াল’ ভাবে।
৮ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন শিথিল হওয়ার পর এক অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এ রাজ্যের বিচারব্যবস্থার প্রেক্ষিতে। কলকাতা হাইকোর্ট থেকে ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ শুরুর জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলা হয় গত ১জুন কলকাতা হাইকোর্ট-এর রেজিস্ট্রার জেনারেল-এর অফিস থেকে এক নোটিসের মাধ্যমে। এও বলা ছিল সেই নোটিসে যে যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে যাতে যাতায়াতের সমস্যায় না পড়েন কর্মীরা তাই বিভিন্ন রুট নির্ধারণ করে তার কোনও নির্দিষ্ট স্থান থেকে একেকটি অঞ্চলের কর্মীদের নিয়ে আসার জন্য কলকাতা হাইকোর্ট কর্তৃপক্ষ পরিবহনের ব্যবস্থা করবেন। সেই নোটিসে কলকাতা হাইকোর্ট-এর অফিসার সদস্য ও কর্মীদের উপস্থিতি যে নির্ধারিত দিন থেকে বাধ্যতামূলক তা স্পষ্ট করে বলা হয়। সমস্ত অফিসার ও কর্মীদের তাঁদের নির্দিষ্ট দপ্তরের প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, মাননীয় হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত যেকোনও দায়িত্ব পালন ও প্রয়োজনে নিজের পোস্টিং-এর বাইরে অন্যত্র দায়িত্ব সামলাতে প্রস্তুত থাকা – এমন নানা বক্তব্য উল্লেখিত ছিল।
ঐ একই তারিখে একটি চিঠি যায় রেজিস্ট্রার জেনারেল, কলকাতা হাইকোর্ট-এর তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিচারবিভাগীয় দফতরের সচিবের কাছে যাতে অনুরোধ করা হয় – লকডাউন (আনলক ১) পর্যায়ে ৮ জুন-এর পরবর্তী সময় থেকে ১৫টি বিশেষ বাস যেন কলকাতা হাইকোর্ট-এর জন্য ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয় যাতে সহকারী রেজিস্ট্রারেরা (কোর্ট), সহকারী কোর্ট অফিসারেরা, মাননীয় বিচারপতিদের ব্যক্তিগত সহকারীরা, বেঞ্চ স্টাফেরা, কোর্ট পিওনেরা এবং আরও অন্যান্য দপ্তরের অফিসার ও কর্মীরা যাতায়াত করতে পারেন। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদীয়া, বর্ধমান ইত্যদি পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে কর্মীদের আনার জন্যই এই ব্যবস্থা, যেহেতু এখন লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিবহন ও রেল চলাচল স্বাভাবিক নয়। বিচারব্যবস্থাকে সচল রাখতে ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’-এর সঙ্গে ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ চালু হওয়া দ্রুত জরুরি বলেই এই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন এমনটাও বলা হয়। খুবই আশ্চর্যজনকভাবে এই নোটিস ও চিঠি দু’টির কোনওটিতেই আলাদা করে আইনজীবীদের কোনও উল্লেখ ছিল না। অথচ বহু আইনজীবীই এই জেলাগুলি থেকে নিয়মিত কোর্ট-এ আসেন। তাঁদের যাতায়াতের কি ব্যবস্থা হবে সে বিষয়েও কোনও স্পষ্ট বক্তব্য ছিল না।
এরপর ৫ জুন রেজিস্ট্রার জেনারেল, কলকাতা হাইকোর্ট-এর নির্দেশ প্রাপ্ত একটি নোটিস জারি করে কলকাতা হাইকোর্ট সূত্রে জানানো হয় লকডাউন (আনলক ১) পর্যায়ে আগামী ১১জুন থেকে কলকাতা হাইকোর্ট-এর মূল ভবনে মাননীয় বিচারপতিদের উপস্থিতিতে কয়েক’টি নির্দিষ্ট দিনে যাবতীয় কোভিড ১৯ প্রতিরোধের সরকারী নিয়মাবলী মেনে কিছু বেঞ্চ-এ বিচারবিভাগীয় কাজ শুরু হবে। এতে কোর্টে আইনজীবী ও কর্মী উভয়েরই অনেক কম সংখ্যায় উপস্থিতি প্রয়োজন হবে। ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’-এর সঙ্গেই চলবে এই ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ যাতে অত্যন্ত জরুরি মামলা ও জামিনের শুনানির কাজ আটকে না থাকে। তবে মাননীয় মুখ্য বিচারপতি যদি কোনওভাবে বুঝতে পারেন যে কোরোনা প্রতিরোধের সরকারি নিয়ম ও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না তবে পূর্বঘোষিত কোনও নোটিস ছাড়াই তিনি কোর্টের কাজ বন্ধ করতে পারেন ও কোর্ট চত্ত্বর ফাঁকা করার নির্দেশ দিতে পারেন। উল্লেখ করা হয় ৮ জুনের সপ্তাহে ১১ জুন এবং ১৫ জুনের সপ্তাহে ১৫, ১৭ ও ১৯ জুন ফিজিক্যাল কোর্ট বসবে।
কীভাবে আদালতের নিয়ম মেনে ন্যূনতম সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে আদালতের কাজ চালানো যেতে পারে সে বিষয়ে বিশদে এই নোটিসে উল্লেখ ছিল। বলা ছিল কাজ চলাকালীন যেকোনও সময়ে নির্দিষ্ট কোর্ট রুমে মাননীয় বিচারপতি ছাড়া তিন জন আদালত কর্মী, আট জন আইনজীবী ও লিটিগ্যান্ট উপস্থিত থাকতে পারবেন। কোনও মামলায় এর বেশি আইনজীবী প্রয়োজন হলে তা মুলতুবী থাকবে এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বলা হয় আইনজীবীদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে বার রুমগুলিতেও। যাতে দিনের যেকোনও সময় বসার ব্যবস্থার মধ্যে ২৫%-এর বেশি ভর্তি না হয় কোনও লাইব্রেরি রুম-এ তা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় লাইব্রেরিগুলি ও বার-এর সদস্যদের। এমন আশাও প্রকাশ করা হয় যে নিয়ন্ত্রিত কাজকর্মের জন্য আদালত চত্ত্বরে আইনজীবী, কর্মী ও মামলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উপস্থিতিও হবে ন্যূনতম।
এর পরেই আইনজীবীদের মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং তাঁরা নিজেদের তরফ থেকে কিছু ‘সাজেশনস্’/মন্তব্য সম্বলিত একটি চিঠি তৈরি করেন লকডাউন-পরবর্তী আদালতের কার্যাবলী পরিচালনার ‘রেকমেন্ডশন’-এর প্রেক্ষিতে। ‘রেকমেন্ডেশন’-এর সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহমত পোষন করেই তাঁরা তাঁদের নিজস্ব বক্তব্যগুলি পেশ করেন যা বিচারকার্য সচল রেখেই আইনজীবী ও আদালত কর্মীদের কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও ফলপ্রসূ হতে পারে, যেহেতু তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থেকে আদালতের কাজকর্মে অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এই চিঠিটি তৈরি হয় বার-এর তিনটি শাখা – বার লাইব্রেরি ক্লাব, বার অ্যাসোসিয়েশন ও ইনকরপোরেটেড ল’ সোসাইটি-র তরফ থেকে। অন্যান্য মন্তব্যগুলির মধ্যে বিচারকার্য ও করোনা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত মন্তব্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – হাইকোর্ট-এ জরুরি চিকিৎসার জন্য যে অ্যাম্বুলেন্স থাকে সেটিকে কোভিড ১৯ মোকাবিলার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও উপযুক্ত চিকিৎসা কর্মী দিয়ে প্রস্তুত করা ও তা সম্ভব না হলে নতুন অ্যাম্বুলেন্স-এর ব্যবস্থা করে হাইকোর্ট চত্ত্বরে উপস্থিত রাখা। তাছাড়া হাইকোর্ট-এর যে মেডিক্যাল ইউনিট সেখানে কোভিড ১৯-এর বিষয়ে পারদর্শী একজন চিকিৎসক যাতে থাকেন তেমন পরামর্শও দেওয়া হয়। বলা হয় একটি পরিচিত হাসপাতালে অন্তত ৫টি শয্যা হাইকোর্ট-এর সেই আইনজীবী ও কর্মীদের জন্য যেন রাখা হয়, যাঁদের করোনা-র উপসর্গ দেখা দেবে। একটি কমিটি তৈরি করা হোক যেখানে একজন বিচারপতি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের একজন আধিকারিক থাকবেন যাঁদের তত্ত্বাবধানে কোনও আইনজীবী বা আদালত কর্মীর যদি কোভিড ১৯ উপসর্গ দেখা দেয় বা করোনা ধরা পড়ে তবে তাঁদের চিকিৎসা, হাসপাতালে ভর্তি ইত্যাদি হবে – এমন অনুরোধও করা হয়।
কিন্তু এই পরামর্শ/মন্তব্যের অধিকাংশই খারিজ হয়ে যায় বা কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় ৯ জুন থেকে আধিকারিক ও আদালত কর্মী ও ১১ জুন থেকে আইনজীবীদের নিয়ে ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ চালু হওয়ার নোটিস আসায় আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। গত ৮ জুন বার অ্যাসোসিয়েশন-এর তরফ থেকে আবারও একটি চিঠি পাঠানো হয় মাননীয় মুখ্য বিচারপতি এবং মাননীয় জাজে’স কমিটির উদ্দেশে। সেখানে স্পষ্টতই যে বিষয়গুলি জানানো হয়–মাননীয় জাজে’স কমিটির নির্দেশিকা ছিল যে লকডাউন পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট-এর স্বাভাবিক কার্যাবলী তখনই শুরু করা যাবে যখন গণ পরিবহন বিশেষত ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে। কারণ বহু আইনজীবী বিভিন্ন জেলা থেকে আসেন এবং পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হলে ও লকডাউন উঠে যাওয়া নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশ না পেলে নিয়ন্ত্রিত ভাবেও আদালতের কাজ শুরু করা সমস্যাজনক। তাছাড়া লকডাউন উঠলে অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগবে আদালত চত্ত্বর ও প্রয়োজনীয় বিচারকক্ষগুলি স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবানুমুক্ত করার জন্য। গত ৫ই জুনের নোটিসে এই সব নিয়ে কোনও বক্তব্যই ছিল না। বার-এর তিনটি শাখার যে যুগ্ম পরামর্শ/মন্তব্য এর আগে ৩১শে মে পাঠানো হয়েছিল তার কোনও উত্তর মাননীয় হাইকোর্ট-এর তরফ থেকে না আসায় আইনজীবীরা অনুমান করছিলেন যে তা হয়তো মাননীয় জাজে’স কমিটির বিবেচনাধীন রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ শীঘ্রই খোলা হবে এমন আলোচনা শুরু হয়। তা জানার পর রেজিস্ট্রার জেনারেল-এর কাছে ২রা জুন পুনরায় আবেদন করা হয় আইনজীবীদের তরফ থেকে যাতে এই পরামর্শ/মন্তব্যগুলির প্রেক্ষিতে মাননীয় বিচারপতিরা আইনজীবীদের সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল মিটিং-এর মাধ্যমে আলোচনা করেন ও তাঁদের মতামত জানেন। কিন্তু এই আবেদনের কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। ৫ই জুন আসে ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ খোলার নির্দেশ।
এই অবস্থায় গত ৭ জুন এক ম্যারাথন ভার্চুয়াল মিটিং-এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৫০০ জন আইনজীবী অংশগ্রহণ করে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে জানান যে এমতাবস্থায় ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ চালু হওয়া মানে শুধু কোভিড ১৯ সংক্রমণকালে তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া নয়, প্রায় ৮০% আইনজীবী যাঁরা হাইকোর্ট-এর সঙ্গে যুক্ত তাঁদের কেরিয়ারেও নেতীবাচক প্রভাব পড়া। যেসব আইনজীবী দূরের জেলা থেকে মামলা লড়ার জন্য আসেন স্বাভাবিক পরিবহনের অভাবে কোর্টে উপস্থিত না হতে পারার কারণে মামলা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে যখন করোনা সংক্রমণের হার দ্রুত গতিতে বাড়ছে তখনই ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েও দ্বিধা তৈরি হয়। মাননীয় জাজে’স কমিটির নির্দেশিকা বা বার-এর তিনটি শাখার যুগ্ম পরামর্শ/মন্তব্য মোতাবেক প্রায় কোনও সিদ্ধান্তই এই ঘোষণায় ছিল না। তাছাড়া কোরোনা সংক্রমণের শিকার হলে আইনজীবীদের জন্য যে চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরির আবেদন করা হয়েছিল সে বিষয়েও কোনও সদর্থক উত্তর পাওয়া যায়নি। বহু আইনজীবীর পক্ষেই করোনা আক্রান্ত হলে বহুমূল্য বেসরকারি পরিষেবা গ্রহণ সম্ভব নয়, অনেকের উপরেই থাকে পরিবার চালনার দায়িত্ব।
অনুরোধ করা হয় ৫ জুনের নোটিসটি প্রত্যাহার করতে এবং বার অ্যাসোসিয়েশন-এর বক্তব্য আরও একবার বিবেচনা করতে, তার আগে যেন মাননীয় মুখ্য বিচারপতি এই নোটিসটি কার্যকর করার নির্দেশ না দেন।
যেহেতু আইনজীবীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকার প্রশ্ন জড়িত এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাই মাননীয় হাই কোর্ট সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে বার অ্যাসোসিয়েশন-এর তরফ থেকে বিনীতভাবে জানানো হয় যে আইনজীবীরা এখনও পর্যন্ত স্থির হওয়া ফিজিক্যাল কোর্ট-এর তারিখগুলিতে বা আরও কোনও তারিখ স্থির হলে তাতে উপস্থিত থাকবেন না। তাঁদের তরফ থেকে এও বলা হয় যে কোনওভাবেই তাঁরা মাননীয় হাইকোর্ট-এর বিচারকার্য বয়কট করছেন না বা তাঁর কার্যপ্রণালী থেকে সরে যাচ্ছেন না, শুধু তাঁদের সদস্যরা ‘ফিজিক্যাল কোর্ট’-এ অংশগ্রহণ করবেন না। বার অ্যাসোসিয়েশন-এর সদস্যদের যদিও ভার্চুয়াল শুনানীতে অংশগ্রহনে কোনও বাধা নেই।
এই প্রসঙ্গে বার অ্যাসোসিয়েশন-এর সাম্মানিক সচিব অ্যাডভোকেট ধীরাজ কুমার ত্রিবেদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “আমাদের সদস্য আইনজীবীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং করে আমরা বুঝতে পারি যে তাঁদের মধ্যে ৯০%ই ফিজিক্যাল কোর্ট-এ যোগদানে নিরাপদ বোধ করছেন না। এখনও গণ পরিবহন স্বাভাবিক নয়, রেল পরিষেবা চালু হয়নি। ট্রেন-এর উপর এক বড় সংখ্যক আইনজীবী নির্ভর করেন। ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি ভাড়া করে কোর্টে আসার আর্থিক সামর্থ্য অধিকাংশ আইনজীবীরই নেই, বিশেষত জুনিয়র অ্যাডভোকেটদের। ভার্চুয়ালি তো আমাদের মামলা, শুনানী সবই গত তিন মাস ধরে লকডাউন-এর মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছেই। ফিজিক্যাল কোর্ট চালু হলে সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েই যায়। আমরা যে চিকিৎসাব্যবস্থার আবেদন করেছিলাম তাও গ্রাহ্য হয়নি। আমরা কোনওভাবেই মাননীয় হাইকোর্ট-এর কার্যপদ্ধতিতে বাধা সৃষ্টি করতে চাই না। কিন্তু ফিজিক্যাল কোর্ট-এ অংশগ্রহণ আমাদের আইনজীবীদের পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব নয়। ভার্চুয়ালি আমরা যাবতীয় কাজ যেমন করছিলাম তেমনই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।”
এক অংশের আইনজীবীরা মনে করছেন যে আইনজীবীদের কাজের ক্ষেত্রে যেহেতু কোনও সরকারী স্বাস্থ্যবিমা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সুবিধা নেই এবং তাদের কাজে যেহেতু দূরত্ব বজায় রাখা বা কম সংখ্যক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক সেহেতু এভাবে আচমকা ফিজিক্যাল কোর্ট চালু করার সিদ্ধান্ত তাঁদের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে। আবার যাবতীয় ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেও তাঁরা নিজেদের পেশার প্রতি দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারছেন না। বিশেষত লকডাউনকালীন সময়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা তাঁদের আরও সতর্ক করে তুলেছে। ধীরে ধীরে লকডাউন যখন উঠে যাচ্ছে তখন আইন-আদালত কতদিন বন্ধ রাখা সম্ভব তা নিয়েও তাঁরা সন্দিহান, কারণ তাতে এক শ্রেণীর মানুষের আইনি সহায়তা বঞ্চিত থাকার প্রশ্ন বড় হয়ে উঠবে। এই মুহূর্তে মহামারি থেকে সুরক্ষা ও পেশার প্রতি দায়িত্বের মাঝে আইনজীবীদের যেন শাঁখের করাতের দশা।
এরমধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে কারণ আলিপুর আদালতের দু’জন সিভিল জাজ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আইনজীবীরা ভার্চুয়ালি কাজ করলেও বিচারপতিদের অনেক সময়েই আদালতে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। তাছাড়া আইন অনুযায়ী ২৪ ঘন্টার মধ্যে আসামীকে আদালতে উপস্থিত করার যে প্রক্রিয়া সেটুকু আদালতে লকডাউনকালীন সময়েও চলেছে। এই দু’জন মাননীয় বিচারপতি কীভাবে সংক্রামিত হয়েছেন তা জানা না গেলেও বিষয়টি আইনজীবী মহলে নিশ্চিত আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি করেছে।
গত ৯ জুন আদালত কর্মীরা নির্দেশ মতো হাইকোর্ট-এর ঠিক করে দেওয়া বাসে আদালতে উপস্থিত হন। কিন্তু তাঁরা রেজিস্ট্রার জেনারেল-এর সামনে বিক্ষোভ দেখাতে বাধ্য হন। সাতটি ইউনিয়নের যুগ্ম মঞ্চ হাইকোর্ট কর্মচারী ফেডারেশন-এর সচিব সুপ্রতীক ভট্টাচার্য জানান, “এই বাসগুলির বেশির ভাগেই সামাজিক দূরত্বের নিয়ম ভেঙে বহু কর্মী উঠতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ না হলে আসার উপায় নেই। এদিকে আমাদের ১০০% উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই আমরা আবেদন করি আমাদের যেন রোটেশন ভিত্তিতে ডিউটি দেওয়া হয়, যাতে একজন কর্মীর উপর চাপ না পড়ে। একজন কর্মীর ৫ দিনের বদলে ২দিন ডিউটি পড়লে সুবিধা হয় ও সংক্রমণের আশঙ্কাও কমে। আমরা খুশি যে রেজিস্ট্রার জেনারেল উদ্যোগ নিয়ে আমাদের কথা শুনে নতুন নোটিস দিয়েছেন যেখানে প্রতিটি দপ্তরকে বলা হয়ে দপ্তর মুখ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ন্যূনতম কর্মী নিয়ে যেন কাজ করেন ও কীভাবে রোটেশন ডিউটি হবে স্থির করেন।”
নিঃসন্দেহে বিচারকার্য চলা আবশ্যক। কারণ এখনও অধিকাংশ মানুষ বিচারব্যবস্থায় আস্থা রাখেন। কিন্তু যে আইনজীবীরা এই ব্যবস্থার মূল কাঠামো তাঁদের দাবি সঠিক বিবেচনা না করে বা সংক্রমণের আশঙ্কার মুখে তাঁদের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা না করে আদালতের কাজ শুরু করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আইজনীবী মহল। আমরা পরবর্তী পরিস্থতির উপর চোখ রাখব।