পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, অর্থাৎ রাষ্ট্র-পুঁজির আধিপত্যের আওতায় থেকে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির নামে শ্রম ও প্রকৃতিকে নিংড়ে নেবার নিওলিবারাল প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন না করে গণতন্ত্র রক্ষা বা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা, এর কোনটাই হয় না। অর্থাৎ, শ্রম/ শ্রমিকের নিজস্ব শ্রেণি-রাজনীতি যদি না থাকে পুঁজিরাষ্ট্রের রাজনীতি থাকবে। নিওলিবারাল ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেলেও শোষণ/ লুটপাট বন্ধ হবে না, জাতিরাষ্ট্র যদি না থাকে, কর্পোরেশান কিম্বা গুন্ডা/যুদ্ধবাজদের রাজত্ব লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ।
যে নতুন সংগঠন এবং যে নতুন/পুরোনো রাজনীতির কথা বলা হচ্ছে, তা নির্মাণের প্রক্রিয়াটা কিরকম হতে পারে? যদিও এ বিষয়ে বিশদ ‘কর্মসূচি’ বাতলে দেওয়া যাবে না, সেটা করাটাও নিছক বাতুলতা ঠেকতে পারে, তবে কিছু সম্ভাবনার প্রসঙ্গে কিছু একেবারেই প্রাথমিক কথা শুরু করা যেতেই পারে। ‘কিছু কথা’ মানে নিতান্তই কিছু কথা, অর্থাৎ এর বাইরেও আরো অজস্র কথা থেকেই যাবে। ‘প্রাথমিক’ মানে একদমই গোড়ার, শুরুয়াতি। ‘কিছু কথা’ আরো অনেক কথা টেনে আনবে, যা প্রাথমিক তা পরের ধাপে পৌঁছবে কালক্রমে, তেমনটা ভেবে নিতে বোধহয় দোষ নেই।
যে নতুন রাজনীতির কথা হচ্ছে, তার সঙ্গে আজকের পুঁজিতন্ত্র এবং মোদি-শা/ ট্রাম্প/ বলসোনারো গোছের বাহুবলী রাষ্ট্রশাসনের যোগ আছে। এ প্রসঙ্গে, হালের করোনা পরিস্থিতিকে পড়া হবে কী করে?
আজকের সময়ের পাঠ।
১.
পুঁজিতন্ত্র যে মানুষের ইতিহাসের পূর্ণচ্ছেদবিন্দু নয়, এবং যাবতীয় পণ্যধামাকা ও মুক্ত অর্থনীতির খুলে-বাজার কী আনোখা চমৎকার দিয়ে যে অধিকাংশ মানুষের জীবনজীবিকা বাঁচানো যাচ্ছে না, যায় না, যাবে না, করোনা মহামারির আগে এটা এমন প্রাঞ্জল করে বোঝা যায়নি। পুঁজিতন্ত্র এর আগেও প্রচুর অবস্থাগত সঙ্কটে (সিস্টেমিক ক্রাইসিস) পড়েছে, কিন্তু ঠিক এমন করে পড়েনি। ধনী-নির্ধন, দেশ/ অঞ্চল নির্বিশেষে, ব্যাধি-কবলিত, কী থেকে কী করে ওঠা যাবে, বোঝাই যাচ্ছে না। করোনা আক্রমণের চেয়ে অনেক বড় বিপদ জলবায়ু-পরিবর্তন, করোনার প্রতিষেধক বা চিকিৎসা আজ না-হয় কাল বেরোবে, জলবায়ু-সঙ্কটের কোনো হাতেগরম চিকিচ্ছে নেই। অথচ যেহেতু সেই বিপদটা তুলনায় দূরের (আদৌ দূরের কি? দেখুন আমপান ঘূর্ণিঝড়ে কী হল — সামনের দিনে আরো ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা ও জলসঙ্কট যে ওত পেতে নেই, সে কথা হলফ করে কেউ বলতে পারে না।), নাহয় সপ্রাণ ও অপ্রাণ সসাগরা পৃথিবী বরফ-গলা জলে ডুবে, রোদে ঝামা হয়ে খেতে-না-খেতে পেয়ে চৌপাট হয়ে যাবে, কিন্তু তা তো আজকেই হবে না — ও নিয়ে বেফাইদা মাথা ঘামিয়ে কী হবে? করোনার ঝামেলাটা হচ্ছে, বিপদটা ঘাড়ে হুড়মুড় করে এসে পড়েছে, ‘ও সব পরে দেখা যাবে’, বলে পার পাওয়া যাবে না। লক্ষ্যণীয়, যতদিন পারা যায়, কালক্ষেপ করা গ্যাছে। ভারতবর্ষে হোক, আমেরিকা- ইউরোপে হোক, চীনে হোক, বাজার ‘খুলে’ রাখা হয়েছিল যতক্ষণ পারা যায়। তা করতে গিয়ে রোগ ক্রমাগত ছড়িয়েছে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক অঞ্চল থেকে ভিন্ন অঞ্চলে। এদিকে, আরো দশরকম মালের সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যাপারটাকেও বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘদিন হল। চিকিৎসা মানে এখন পুঁজিবৃদ্ধি, ভাইরাস-প্রতিরোধে যদি মুনাফা না-থাকে, পুঁজিলগ্নি হবে না। ফলে, কিস্যু করা হয়নি — অথচ গত দশ-কুড়ি বছর ধরে নতুন নতুন রোগজীবাণু বা প্যাথোজেন হানা দিয়েই যাচ্ছে — সার্স, মার্স, সোয়াইন-ফ্লু, এবোলা ইত্যাদি। তাতে কি যায় আসে? বাজার যেহেতু পুঁজিলগ্নি ও পুঁজিবৃদ্ধির বাইরে কোনোরকম যুক্তিটুক্তির মধ্যে ঢুকতে অক্ষম, রোগ প্রতিরোধ করা বা সারানোটা তার হিসেবের মধ্যেই আসে না, যতক্ষণ অবধি না সেখানে মুনাফা করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। মুনাফা, মুনাফা এবং মুনাফা। লগ্নি/ উৎপাদন/পুনরুৎপাদন — এই পুঁজিবৃত্তের মধ্যে না আছে মানবিকতা, না দয়ামায়া, না বিজ্ঞান, না ন্যায়-অন্যায় বোধ। সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিতন্ত্রের — বিশেষত নিওলিবারাল পুঁজিতন্ত্রের — এই অমানবিক, অযৌক্তিক ও অক্ষম চেহারাটা করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্রী রকমের। বেআব্রু হয়ে পড়েছে। ‘খোলা’ বাজারের যাবতীয় পুরুত/যজমানদের এখন বাজার বন্ধ করে রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় মন দিতে হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে হচ্ছে। এই অবস্থাটা নিওলিবারাল সময়ে একটা নতুন অবস্থা — এতদিন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যের ও সামাজিক সুরক্ষার যে বাতিল কথাগুলো কুঁইকুঁই করে কতিপয় রোগাসোগা বামপন্থী বলতো, সেটা এখন সবাই বলছে, চিকিৎসাবিদ, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র, পুঁজিমালিক, বেওসায়ী, রেমিটান্স পাঠানো এনআরআই, মায় বাজারি মিডিয়া। এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে, বামপন্থীদের অন্তত একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং পুরোনো রাজনৈতিক দাবি সমাজগ্রাহ্য হয়ে উঠছে, এই দাবি নিয়ে যদি এখন পথে নামা যায়, তা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ শুনবেন।
২.
করোনা-পরিস্থিতির শিক্ষা — মানুষের (না-মানুষী প্রাণেরও) জীবনের দায় যেমন পুঁজিতন্ত্র নিতে অক্ষম, তা পৃথিবীর বেশির ভাগ বাসিন্দার জীবনধারণের উপায় অর্থাৎ জীবিকা রক্ষায়ও সক্ষম নয়। করোনা হামলা শুরু হওয়া ইস্তক পৃথিবীর সর্বত্র বেকারি বাড়ছে তো বাড়ছেই—লকডাউন উঠলেও কতজন কাজে ফিরতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই, কেননা কাজ, কাজের ক্ষেত্র কিছুই আগের মতো হবে না। ভারতবর্ষের কথা ভাবলে হাড়-হিম করা শিহরণ হয়— কোটি কোটি লোক যুগপৎ কাজ হারিয়ে ও ছেড়ে বাড়ি ফিরছেন, তাঁরা কী করবেন এর পর? চাষবাসের অবস্থা কোথাও ভালো নয়, বিশেষত যেখানে যেখানে বেশি উৎপাদন হয়। কৃষিতে বড় পুঁজি ঢুকে পড়ার পর থেকে কিছু কৃষকের অবস্থা ফিরেছে বটে, কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমাগত কমছে। যেহেতু চাষ ব্যাপারটাই আধড়মুড়ো এখন পুঁজিকবলিত, কী চাষ কতটা কোথায় কখন হবে বা হবে না তা চাষির ইচ্ছা নয়। পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভর করে। গাঙ্গেয় সমতলভূমি থেকে দাক্ষিণাত্যের নদী-অববাহিকা ও মালভূমি, যেদিকেই যাওয়া যাক, চাষ ক্রমশ পুঁজিনিবিড় হচ্ছে—তা সে বড় কোম্পানির বীজ হোক, সার হোক, আর খেত তৈরির/ চারা রোয়ার/ ফসল কাটার/ ফসল ঝাড়ার যন্ত্রই হোক, চাষ করতে গেলে পুঁজির শরণাপন্ন হতেই হবে, এমন অবস্থা প্রায় সর্বত্র। এর অর্থ, খেতে সম্বৎসর যে শ্রম লোকে ও ঘরের গরু-মোষ মিলে দিত, তা এখন আর লাগছে না, সে জায়গায় কোম্পানির মেশিন ঢুকে পড়েছে। ফলে, কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাপ-দাদার জীবিকায় ফিরে যাবেন, সে সুযোগও নেই। তদুপরি, জলবায়ু-বদল জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিবারাত্র চোখ রাঙাচ্ছে, কখন খরা বা বন্যা হবে, ঝড়ে সব তছনছ হয়ে যাবে, তার ঠিকানা নেই। সে সঙ্গে, নগরায়ন, মহাসড়ক তৈরি, বড় বাঁধ, খনিখাদান, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিদ্যুৎ-পরিবাহী তার/ টাওয়ার বসানো ও লোহা/ সিমেন্ট ইত্যাদির কারখানা জাতীয় উন্নয়নকাজ চলছেই— ‘জাতীয় প্রয়োজনে’ চাষজমি ও বনজঙ্গল রাতারাতি লোপাট হয়ে যাচ্ছে, যত মানুষ কাজ ও ভিটেমাটি হারাচ্ছেন, তার ভগ্নাংশের ভগ্নাংশও কাজ পাচ্ছেন না। কাজ পেতে গেলে ঘরবাড়ি ছেড়ে তাঁদের দৌড়োতে হচ্ছে ভিনদেশে কি ভিনরাজ্যে, পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে। সে কাজও যখন চলে যাচ্ছে, কী করবেন তাঁরা? এর সঙ্গে জুড়ে নিতে হবে উন্নয়ন ধামাকার পরিবেশমূল্যও— যত বনজঙ্গল কাটা হবে, কয়লা উঠবে/ পুড়বে, বড় বাঁধ হবে, তত সর্বনেশে হয়ে উঠবে জলবায়ু-সঙ্কট। জলবায়ু-সঙ্কট যত তীব্র প্রত্যক্ষ হবে, তত আরো বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হবেন, চাষি, মৎস্যজীবী, বনবাসী-আদিবাসী, পর্বতবাসী। কোথায় যাবেন, কী করবেন তাঁরা? পুঁজিতন্ত্র ও সর্বরোগহর বাজারের কাছে এর কোনো উত্তর নেই, উত্তর দেবার দায়ও নেই। পুঁজিতন্ত্র যে শেষত শুধু ধ্বংস করতেই পারে, পুঁজি ভিন্ন অন্য কিছু তৈরি করতে পারে না, নিওলিবারাল সময়ে সে কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিলই। ভারতবর্ষে ও বিশ্বের অন্যত্র পরিবেশপন্থীরা ও বামপন্থীদের একাংশ এটা নিয়ে বলছিলেন, এখন অর্থাৎ করোনা পরিস্থিতিতে, তার বাইরেও অনেকে বলছেন। অর্থাৎ, পুঁজিতন্ত্রে যে কিছুই সুরক্ষিত নয়, সেই নির্ভেজাল সত্য আর চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। এদেশের বামপন্থীদের গরিষ্ঠাংশ পুঁজিতান্ত্রিক বড় উন্নয়নে বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে পুঁজিতন্ত্র-বহির্ভূত অন্য কোনোরকম জীবনধারণ বোধহয় অসম্ভব ঠেকে, সুতরাং পুঁজিতন্ত্র-সৃষ্ট যে বিপর্যয়-বৃত্তে (সাইক্লিকাল ডিজাস্টার) পৃথিবী ও পৃথিবীর গোটা প্রাণ-ব্যবস্থা এখন আটকা, তার সঙ্গে নিজেদের রাজনীতিকে যুক্ত করার কথা তাঁরা ভাবতে পারেন না। অথচ পুঁজিতন্ত্র যে ব্যবস্থা হিসাবে অচল শুধু নয় প্রাণঘাতী, মানুষের জীবনজীবিকা রক্ষা করতে গেলে, পৃথিবীর প্রাণব্যবস্থাকে বাঁচাতে গেলে যে পুঁজিতন্ত্র থেকে বেরুতেই হবে, এই কথাটা জোর দিয়ে বলার সুবর্ণ সময় এখন। বামপন্থীদের এটা বলতেই হবে।
৩.
দেশি ও বিদেশি যে বামপন্থীরা অষ্টপ্রহর নিওলিবারাল পুঁজিতন্ত্রকে গাল পাড়েন, তাঁদের অনেকের একটি লাডলা খোয়াব আছে। ইতিপূর্বে যা সবিস্তারে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ওপর তাঁদের অগাধ বিশ্বাস। রাষ্ট্রনির্ভর গোটা দু’-তিন বিকল্পভাবনা (নিওলিবারাল পুঁজিতন্ত্রের) গত বছরকয় ধরে বিশ্ববাজারে ঘোরাঘুরি করছে। তন্মধ্যে প্রধান ‘সাধারণ মূল আয়’, বা ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম, সংক্ষেপে ইউ বি আই, যার মোদ্দা কথাটা হল, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে, লোকে কাজ হারাচ্ছেন ফলে তাঁদের গড় মাথাপিছু ক্রয়ক্ষমতা কমছে, সুতরাং সবাইকে রাষ্ট্র একটা ন্যুনতম টাকা ইউ বি আই বাবদ দিতে থাকবে। এতে বৈষম্য কমবে, সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। মনে থাকতে পারে, গত সাধারণ নির্বাচনের আগে রাহুল গান্ধী ‘ন্যায়’ নামে এ জাতীয় একটা প্রস্তাব এনেছিলেন। আর দুটো ভাবনা পরস্পরের অনুপূরক, একটা হল বৃদ্ধিহ্রাস বা ডিগ্রোথ, দ্বিতীয়টা, গ্রিন নিউ ডিল (নামটা ১৯২৯-৩০ নাগাদ মহামন্দার সময় আমেরিকায় রুজভেল্ট যে নিউ ডিল বা নয়া ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তা অনুসারে)। দুটোতেই গড় জাতীয় আয় অর্থাৎ জিডিপি বৃদ্ধিনির্ভর পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে— যথা সামাজিক বৈষম্য বাড়াতে পারে ও পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে এমন যাবতীয় শিল্পপ্রক্রিয়া থেকে দ্রুত সরে আসা, বিকেন্দ্রীভূত, পরিবেশবন্ধু ও বহুলাংশে স্বশাসিত উৎপাদন ব্যবস্থাতে উৎসাহদান, জলবায়ু-সঙ্কট নিরসনে আশু ব্যবস্থা নেওয়া। সংক্ষেপে সরল করে বলা হল, এই সব কটা ভাবনারই নানান রকমফের আছে। সমস্তটা নিয়ে টিপ্পনী করা যাবে না, কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়। সব কটা ভাবনাতেই— তা সে ইউ বি আই বলুন, ডিগ্রোথ কি গ্রীন নিউ ডিল বলুন—ধরে নেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র বস্তুত মহানুভব, অনেকে মিলে বললেই তা মূলগতভাবেই বৈষম্যমূলক এবং অবাধ পুঁজিবৃদ্ধির অনুকূল বর্তমান সমাজব্যবস্থাটার খোলনলচে বদলে সেটাকে ভালো করে দিতে পারে। ব্যবস্থাটা যে ভালো হবার নয়, তাকে ঠিক করা যাবে না বরং ভেঙে ফেলতে হবে, ভেঙে ফেলার রাজনৈতিক লড়াই চালাতে হবে, এই ব্যাপারটা বিকল্প-প্রতর্কের পুরোটা থেকেই অনুপস্থিত থাকে। করোনা অবস্থা দেখাচ্ছে, রাষ্ট্র এবং তার প্রাকল্পিক মহানুভবতা বস্তুত ঢপের চপ, পুঁজিতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা ভাবে দেখাটা, রাষ্ট্রকে ভরসা করাটা নেহাতই গোলা মুর্খামো। গত নির্বাচনে বিজেপি রাষ্ট্রপক্ষীয় বাজারি মিডিয়া এবং সোস্যাল মিডিয়ায় স্রেফ রাষ্ট্রের শত্রুনাশক পেশীবহুলতা কি নই খেল দেখিয়ে বিস্তর লোকজনকে মোহগ্রস্ত করেছিল। এবার বলার সময় এসেছে, দ্যাখো হে, রাষ্ট্র ব্যাপারটা, বিশেষ বিজেপি প্রচারিত ও সঙ্ঘভাবাবিষ্ট কেন্দ্রীভূত শক্তিশালী রাষ্ট্রভাবনা ব্যাপারটা কোনো কাজের না, তা না দিতে পারে মানুষকে কাজ, না পারে তাদের জীবন বাঁচাতে। যতদিন এই শক্তিশালী রাষ্ট্র রাজ করবে, তত বেশি লোক কাজ হারাবে, উদ্বাস্তু হবে, প্রাণ হারাবে।
৪.
রাষ্ট্র প্রসঙ্গে এদেশের, এই রাজ্যের বামপন্থীরা তাহলে কী বলবেন? প্রথমত, রাষ্ট্রের কাছে ইচ্ছাসূচি পাঠানোর পরিবর্তে, ভারতবর্ষের জাতিরাষ্ট্রের ভিতরকার যে দ্বন্দ্বগুলো আছে তা বোঝার চেষ্টা করাটা বেশি প্রয়োজন। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে, হয়তো তার পরেও অনেকদিন, রাষ্ট্রকে পুরোপুরি অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু কেন্দ্রীভূত, ফ্যাসিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া, রাষ্ট্রকে দুর্বল করার কাজ চালানো সম্ভব। যদি মূল রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া বিরুদ্ধ শ্রেণি-রাজনীতি, অর্থাৎ রাষ্ট্র-পুঁজি বিরুদ্ধতার রাজনীতিতে আধারিত থাকে, রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষ নিয়ে কথা বলা এবং জনমত সংগঠিত করা আজকের বিশেষ পরিস্থিতিতে একটা বড় কাজ হতে পারে। পঞ্চায়েত, পুরসভা, জেলা, রাজ্য অর্থাৎ বিকেন্দ্রীকরণের যে রাষ্ট্র-নির্ধারিত কাঠামো আছে, তার মাধ্যমে এবং তাকে ছাপিয়ে গিয়েও, সর্বস্তরে স্বশাসনের দাবি তোলা যেতে পারে। বিভিন্ন এলাকায় গ্রামসভা ও নাগরিক সভা গড়ে তুলে, জনস্বাস্থ্য, গণবণ্টন ও বিভিন্ন স্থানীয় অর্থনৈতিক উদ্যোগ স্বশাসিত সংস্থাগুলির মাধ্যমে সংগঠিত করা যেতে পারে। এই কাজগুলোর খানিক খানিক এদিকে ওদিকে নানান ভাবে হয়েছে/ হচ্ছে ইতিমধ্যেই— শ্রমিক সমবায় তৈরি, বন, নদী/সমুদ্র, পশুচারণভূমি ইতাদি সামূহিক/ গোষ্ঠী সম্পদের নির্মাণ, গণআন্দোলন পরিচালিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা। জিডিপিকেন্দ্রিক, বৈষম্যমূলক, পুঁজিনিবিড় উন্নয়ন নির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে এই অন্য অর্থনীতির কথা বলা, তার প্রয়োগে যাওয়া একটা বড় কাজ হতে পারে।
৫.
সংসদীয় গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে রক্ষার কথা বলা দরকার, কেননা পুঁজিতন্ত্র ও জাতিরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে পারে না। সব ধরণের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন/ সন্ত্রাসের, পিতৃত্ববাদের, জাত-বর্ণবাদী, জাতিসত্ত্বাগত, ভাষাসত্ত্বাগত, জাতিবাদী ও ধর্মকেন্দ্রিক/ধর্মাশ্রয়ী শোষণের বিরোধিতা করা দরকার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও চারপাশের দুনিয়ায়, বিরুদ্ধতার ও বিরুদ্ধ মত পোষণ করার মত পরিসর যে ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে, সে বিষয়ে সচেতন থেকে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রয়োগেও গণতন্ত্রের ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে বলাটাও দরকার। বর্তমান নির্বাচনী রাজনীতিতে পুঁজির প্রাধান্য যে ক্রমেই প্রকাশ্যে আসছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট চর্চা করা যায়। নির্বাচন সম্পর্কে সাধারণ ভোটদাতাদের ভাবনা কী, এবং বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় আদৌ প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র অনুশীলনের সুযোগ আছে কিনা সে বিষয়েও চর্চা দরকার।
আমাদের দেশে ধর্মীয় ফাসিবাদের যে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে তার বিরুদ্ধে লাগাতার সাংষ্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রচার চালানো, এবং এই বিপদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলাও দরকার।
এই কাজগুলো তখনই অর্থবহ হয়ে উঠবে যখন বামপন্থীরা বুঝতে পারবেন এবং সেই বোঝাটা সমাজে সঞ্চারিত করতে পারবেন যে, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, অর্থাৎ রাষ্ট্র-পুঁজির আধিপত্যের আওতায় থেকে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির নামে শ্রম ও প্রকৃতিকে নিংড়ে নেবার নিওলিবারাল প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন না করে গণতন্ত্র রক্ষা বা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা, এর কোনটাই হয় না। অর্থাৎ, শ্রম/ শ্রমিকের নিজস্ব শ্রেণি-রাজনীতি যদি না থাকে পুঁজিরাষ্ট্রের রাজনীতি থাকবে। নিওলিবারাল ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেলেও শোষণ/ লুটপাট বন্ধ হবে না, জাতিরাষ্ট্র যদি না থাকে, কর্পোরেশান কিম্বা গুন্ডা/যুদ্ধবাজদের রাজত্ব আসবে। আজকের সময়টা ভয়ের এবং আনন্দের, আশঙ্কা ও সম্ভাবনার। রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষি হয়ে বসে থেকে অন্যায় ও বৃথা কালক্ষেপ ভিন্ন যদি অন্য কিছু না করা যায়, নিজেদের উদ্যোগ গড়ে না তোলা যায়, অবস্থাটা ক্রমাগত আরো খারাপ হবে, বামপন্থীরা শ্রমিকমৃত্যু ও রাষ্ট্রের অন্যায় বিষয়ে রাষ্ট্রকেই স্মারকলিপি পাঠাতে থাকবেন। চিন্তাহীন, রাষ্ট্রনির্ভর ও পুঁজিশাসিত যে অসংখ্য দল/ গোষ্ঠী/ ব্যক্তির খুপরিতে বামপন্থী রাজনীতি আটকা পড়ে আছে, প্রথম যৌথ রাজনৈতিক কাজ হোক সেগুলোকে ভেঙে ফেলা। বামপন্থা ও কমিউনিজম মূলে জাতিরাষ্ট্রহীন আর্ন্তজাতিকতার রাজনৈতিক স্ফুরণ, এ ঐতিহাসিক সত্য যেন আর ভুলে না যাওয়া হয়।
লেখক বামপন্থী ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী।
পড়ে দেখুন: নতুন রাজনীতির সন্ধানে—করোনা পরিস্থিতি এবং বামপন্থীরা কী করতে পারেন (প্রথম পর্ব)