আন্তর্জাতিক মিডিয়া ওয়াচডগ রিপোর্টার উইদাউট বর্ডারস, প্রতিবছর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলিতে, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ধারাবাহিক ভাবে নিম্নগামী বলে অভিমত প্রকাশ করে চলেছে। এর জন্য মোদী সরকারকেই দায়ী করছে তারা। পশ্চিমবঙ্গও কি সেই পথে হাঁটছে?
গ্রাউন্ডজিরো, ০৩.০৬.২০২০
সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরলে শাসক নিজেকে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ বলে জাহির করতে পারে বটে কিন্তু একই সঙ্গে তার নামের সঙ্গে স্বৈরাচারী বিশেষণটিও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে যায়। স্বৈরাচারী অভিধাটি কেবল অপ্রশংসনীয় নয়, গণতন্ত্রে তার কোনও স্থান নেই। তথাপি বিশ্বের নানা প্রান্তেই প্রভুত্বকামী, কর্তৃত্বপ্রিয় শাসকের বাড়াবাড়ি রকমের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরাও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার শিকার। বিগত ছ’বছরে দেশের কেন্দ্রে স্থাপিত একটি সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী সরকার যে, শুধুমাত্র নিপীড়নেই সিদ্ধহস্ত বার বার আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। আজ দেশের চরম সঙ্কটের দিনে, সেই প্রবল প্রতাপশালী নেতৃত্বের চূড়ান্ত ব্যর্থতা প্রমাণ করে ছেড়েছে তাদের আস্ফালন শূন্যগর্ভ। ছড়ি ঘুরিয়ে দেশের মানুষের পেট ভরানো যায় না। অর্থনীতির হাল ফেরে না। দেশের ও দশের স্বাস্থ্যের ক্রম অবনতিই ঘটে।
এ রাজ্যের শাসকদলটির, তার সর্বময়ী নেত্রীর কর্তৃত্বপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। প্রতিবাদহীনতা, প্রশ্নহীনতায় তার শিকড় যত গভীরে পৌঁছেছে, সেই অনুপাতেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমত পোষণের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে। অধিকার হরণের এই নীতিটি মূলত পুলিশি-রাষ্ট্র নীতির একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। মুখ বন্ধ করতে হলে পুলিশ লেলিয়ে দাও। থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন চালাও, ভয় দেখাও, প্রয়োজনে জেলে ভরো। অতীতের মতোই বিগত দু’মাসে এই পুলিশিরাজতন্ত্রের একাধিক নিদর্শন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রতিবাদ হয়নি যে তা নয়। হাইকোর্টে সরকারের মুখও পুড়েছে। কিন্তু, প্রতিবাদের ধরনটি সেই গন্ধবিচারধর্মী ও সযত্নচয়িত। ফলত, একের পর এক অন্যায় সংগঠিত হয়েই চলেছে। সমাজমাধ্যমে পিপিই কিট নিয়ে আপত্তি জানালে চরম পুলিশি হেনস্থার শিকার হয়েছেন এক চিকিৎসক। পুলিশি বাড়াবাড়ির অভিযোগ নিয়ে সামান্য প্রতিবাদের জেরে জেরার মুখে পড়েন হাওড়ার এক যুবক। বিদ্যুৎ ও জল সঙ্কটে নাজেহাল মানুষের হয়ে প্রতিবাদে সামিল হওয়ায় বর্তমানে ১৪ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর এক বর্ষীয়ান অধিকার রক্ষা কর্মী-সহ ১০ জন। খবর অপচ্ছন্দ হওয়ায় গণশক্তি পত্রিকা ও সিএন চ্যানেলকেও এই সময় শাসকের রুদ্ররোষে পড়তে হয়েছে। মুখঝামটা খেয়েছেন সংশ্লিষ্ট চ্যানেলের সাংবাদিক। সরকারি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বা পরিচয়পত্র না-থাকার অজুহাতে ‘নবান্ন বিট’ করা এই তরুণ সাংবাদিকের এখন এই শাসকদুর্গে প্রবেশ নিষেধ। এবং কয়েকটি এমএসও থেকে চ্যানেলটি রাতারাতি রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার অভিযোগ অবশ্যই নিরপেক্ষ অনুসন্ধান দাবি করে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনতার বিষয়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে খুব শ্রদ্ধাবান এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে নাম করে রোষ প্রকাশেও তা প্রমাণিত। তার সাম্প্রতিকতম নিকৃষ্ট উদাহরণ আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের (সদ্য পদত্যাগকারী) বিরুদ্ধে একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের। ভুল কিংবা ত্রুটিপূর্ণ সংবাদ পরিবেশিত কিংবা প্রকাশিত হলে আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে অনুশীলিত কিছু রীতি বা প্রথা রয়েছে। ক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট খবরের বিরুদ্ধে সম্পাদককে লিখিত ভাবে অবহিত করতে পারেন, যা সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় চিঠিপত্র বিভাগে প্রকাশ করা এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের উত্তর দেওয়া সুপ্রচলিত রীতি। এ ছাড়াও ভুল সংবাদ পরিবেশন বা প্রকাশের জন্য দু:খ প্রকাশ করা এবং ত্রুটি সংশোধন করতেও দেখা যায়। সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও কিছু কম নয়। কিন্তু, সংবাদ ‘ভুল’ এই অভিযোগে ‘দেখে নেওয়া’র মনোবৃত্তি প্রতিহিংসামূলক।
অনির্বাণ চট্টোপাধায়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির যে যে ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে সেগুলি এরকম:
- দাঙ্গা সৃষ্টির লক্ষ্যে অচেতনভাবে উস্কানি দেওয়া, ধারা ১৫৩;
- মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি কর্মীকে তার আইনি ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্য আরেক ব্যক্তির অনিষ্ট করানোর চেষ্টা, ধারা ১৮২;
- সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত করার প্রয়াসে ইচ্ছাকৃত অপমানের মাধ্যমে উস্কানি দেওয়া, ধারা ৫০৪ এবং
- (১) সেনাবাহিনীর কোনও কর্তা, সেনাকর্মী বিদ্রোহ ঘটাতে পারে, (২) জনসাধারণ ভীত বা আতঙ্কিত হতে পারে এই মর্মে ও লক্ষ্যে কোনও বক্তব্য, গুজব, প্রতিবেদন প্রকাশ বা প্রচার করা, ধারা ৫০৫ (১);
- বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে এমন বক্তব্য প্রকাশ কিংবা প্রচার করা, ধারা ৫০৫ (২)
এমন ধারায় তো মামলা দায়ের হয় রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘বাঙুর হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের যথেষ্ট পিপিই কিট দেওয়া হয়নি’ এ জাতীয় এক সংবাদের প্রেক্ষিতে — যা স্বাস্থ্য দপ্তরের মতে ভুল তথ্য — দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধানো, সেনা বিদ্রোহের উস্কানি, বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ঘৃণা বিদ্বেষের সৃষ্টির সম্পর্ক কোথায়? দিল্লি দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া, দাঙ্গায় মদত দেওয়ার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজেপি’র নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। উল্টে গ্রেপ্তার করা হয় এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের। যোগীর পুলিশ দ্য ওয়ারের (The Wire) সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বিরুদ্ধে শুধু মামলা করে ক্ষান্ত হয় না, বাড়ি বয়ে এসে শাসিয়ে বলে যায়, এবার মামলা চালাতে ‘ক্রাউড ফান্ডিং’ করতে হবে। শাহের দিল্লি কিংবা যোগীর উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে এ রাজ্যের ব্যবধানটি কি ঘুচে যাচ্ছে?
এই ধারা অব্যাহত থাকলে পশ্চিমবঙ্গেরও ক্রমে যোগী বা শাহরাজে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া ওয়াচডগ ‘রিপোর্টার উইদাউট বর্ডারস’, প্রতিবছর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলিতে, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ধারাবাহিক ভাবে নিম্নগামী বলে অভিমত প্রকাশ করে চলেছে। এর জন্য মোদী সরকারকেই দায়ী করছে তারা। পশ্চিমবঙ্গও কি সেই পথে হাঁটছে?
এই পরিস্থিতির জন্য অবশ্যই সংবাদমাধ্যমগুলির দায় রয়েছে। প্রতিবাদ তো দূরের কথা ‘লাইফব্লাড’ সরকারি বিজ্ঞাপন নিশ্চিত করতে অমেরুদণ্ডী হয়ে উঠেছে এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম। প্রায় কোনও সংবাদমাধ্যমই তার সাংবাদিকদের উপর শারীরিক আক্রমণ নেমে এলে প্রতিকারে সচেষ্ট হয় না। উপরন্তু পেশাগত ঝক্কি বলে দায় সেরে ফেলে। আনন্দবাজার পত্রিকা তার ব্যতিক্রম নয়। বিপদ বুঝলে সাধারণত ‘ম্যানেজ’ করার কৌশল নিয়ে থাকে প্রায় সকলেই। অন্যদিকে, প্রতিবাদের নৈতিক জোরটাই যেন হারিয়ে বসেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। নাগরিক সমাজ বহুধাবিভক্ত। কিংবা কোদালকে কোদাল বলার রাজনৈতিক পরিণতি নিয়ে সংশয়াকুল।
এই অনুকূল পরিবেশই শেষ কথা বলা শাসক এবং গণতন্ত্রহীনতার ধাত্রীভূমি। তবু, শেষ নাহি যে…।