গ্রাউন্ডজিরো, ২৪.০৫.২০২০
আমপানের প্রবল তাণ্ডবে কোনও না কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণবঙ্গের ১২টি জেলা। রাজ্যের ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবর্তী উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা। গুঁড়িয়ে গিয়েছে সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল। দ্বীপের পর দ্বীপ, নদীবাঁধ, বাদাবন তছনছ করে দিয়েছে ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়া উম পুন। ২২ মে সিএনএন সরকারি আধিকারিককে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৩.২ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসেবে প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকা। শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকা। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকা ত্রাণ ও উদ্ধার কাজের জন্য বরাদ্দ করেছে। প্রধানমন্ত্রী দুর্গত অঞ্চল পরিদর্শন করে আরও হাজার কোটি টাকা মঞ্জুর করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, শুধু মাত্র দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ১০ লক্ষ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫৬ কিমি নদীবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ৪১ হাজার বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গিয়েছে। নষ্ট হয়েছে ২ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল। ২৩ তারিখ পর্যন্ত রাজ্য প্রশাসনের তথ্য বলছে, রাজ্যে মোট ৩৮৪টি পুরসভা, পুরনিগম ও ব্লক ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ২১,৫০৭ বর্গ কিমি। আক্রান্ত জনসংখ্যা ৬ কোটি ৭৩ লক্ষ।
এ সবই প্রাথমিক হিসেব। শনিবার পর্যন্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ডহারবার, সাগরদ্বীপ, কুলতলি, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, বকখালি, গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং, ডায়মন্ডহারবারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিচ্ছিন্ন। দূরবর্তী দ্বীপগুলির কোনও খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তর ২৪ পরগনার অবস্থাও তথৈবচ। আমপানের ধাক্কায় বিপর্যস্ত মিনাখাঁ, হাড়োয়া, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, স্বরূপনগর, গাইঘাটা, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি-সহ আরও বহু এলাকা।
চা-বাগান সংগ্রাম সমিতির শমীক চক্রবর্তী জানিয়েছেন, উত্তর ২৪ পরগনার মান্ডেলের বিল, পুকুরিয়া, মাধবকাঠি, সামসেরনগরে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম নোনা জলে ডুবে গিয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর সোনাখালিতে ১ কিমি বাঁধ ভেঙে পুরো গ্রাম জলমগ্ন। বাঁধ ভেঙেছে কুলতলির দেবীপুর, দেউলবাড়ি, রংঘেরি, ৪ নম্বর ঘেরি, কৈখালি অঞ্চলে। এছাড়াও বাঁধ ভেঙেছে গোসাবার রাঙাবেলিয়া, জটিরামপুর, সোনাগাঁ মন্মথনগরে।
ধ্বংসের ভয়াবহতা যত দিন যাবে তত প্রকট হবে। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে শুধু আলো, জলই নয় বসে গিয়েছে টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা। জমা জল, বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছ উপড়ে, বাঁধ ভেঙে বন্ধ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা। করোনাভাইরাসের প্রকোপে প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলিতে লোকবলের অভাব ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে এক বড় রকমের বাধা সৃষ্টি করেছে।
ত্রাণ, বিদ্যুৎ না-মেলায় স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ বিপর্যস্ত মানুষ। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পায়নি কলকাতা মহানগর। বিশেষ ভাবে মহানগরীর বস্তি এলাকার দরিদ্র মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিদ্যুৎ-জলের দাবিতে, সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন শিকেয় তুলে পথ অবরোধ ও বিক্ষোভে সামিল হাইরাইজ ও এলিট অঞ্চলের বাসিন্দারা। দু’-তিনদিন ফ্রিজ বন্ধ, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত অঞ্চলের লাগোয়া ভ্যাটে জমছে ১২০০-১৪০০ টাকা কেজির গলদা, বাগদা। ৭০০ টাকা কেজির পাঁঠার মাংস-সহ মহার্ঘ্য খাদ্য। আম-লিচুও। বিদ্যুৎ-জল সরবরাহের বৈষম্যের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বস্তির বাসিন্দারাও। মহানগরীকে সন্তুষ্ট করতে, রাজ্যের অনুরোধে সেনাবাহিনী গাছকাটা, রাস্তা পরিষ্কারে হাত লাগিয়েছে। অন্যদিকে, শহরের কয়েক’শো ঝুগগি-ঝুপড়ির বাসিন্দাদের কাঁচাঘর ধরাশায়ী।
ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দক্ষিণবঙ্গের সর্বত্র। শ্রমিক ও মেশিনের অভাবে অনেক অঞ্চলেই বোরো ধান সম্পূর্ণ তোলা যায়নি। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাট, তিল, কলাবাগান, আম ও লিচুবাগানেরও। কৃষি আধিকারিক এবং জেলা প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী, পূর্ব বর্ধমান জেলায় ৪২,০৭০ হেক্টর জমির বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক পরিমাণ ৩৬০ কোটি টাকা। নদিয়ায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা, বীরভূমে ৪৬২ কোটি টাকা, বাঁকুড়ায় ৩৪৬ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, মুর্শিদাবাদের চাষিরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশেও বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ধীর গতিতে হলেও ত্রাণ বিলির কাজ শুরু করেছে প্রশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি।