মহামারী, লকডাউন ও সোনাগাছির মেয়েরা


  • May 19, 2020
  • (1 Comments)
  • 25746 Views

মোদীবাবুর অপরিকল্পিত লকডাউন-এর প্রথম সপ্তাহ পেরনোর আগেই থেকেই সোনাগাছির বেশিরভাগ মেয়েরই অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল। এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের প্রায় ৬ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে আটকে পড়ে যেমন চরম দুর্দশায় পড়েছেন, কলকাতার যৌনপল্লীগুলির প্রায় ১০ হাজার মেয়ের অবস্থা তার থেকে কিছু কম ভয়াবহ নয়। লকডাউনের দিন দশেকের মধ্যেই কোনোরকমে চালডাল ফোটানোর মতো অবস্থাও ওদের থাকত না যদি না বাইরে থেকে ত্রাণ পৌঁছত। লিখেছেন তরুণ বসু। প্রথম কিস্তি। 

 

 

ওরা শয্যা পেতেছে সাগরে, এখন ভয় পাচ্ছে শিশিরে। হ্যাঁ শিশিরই। করোনার শিশির। লকডাউনের শিশির। ওরা মানে নীতা-স্বপ্না-ছবি-মীনা-জরিনা-আসমানী-কোহিনুর–পার্বতী কিংবা মায়া। ওরা মানে সোনাগাছির ‘বেশ্যা’। এটাই ওদের একমাত্র পরিচয়। যদিও এখন ওরা নিজেদের ‘যৌনকর্মী’ বলে পরিচয় দেয় কিন্তু তথাকথিত মূলস্রোতের ভদ্রলোকেরা ওদের বলে পতিতা, বারবনিতা কিংবা আরও ভালো ভাষায় ‘খানকি’।

 

সেই কবে একদিন গণ্ডি-কাটা এক্কা-দোক্কার ছক ফেলে নীতা-স্বপ্না-ছবি-মীনা-জরিনা-আসমানীরা ওদের চেনা আঙিনা ছেড়ে, দুরুদুরু বুকে বেরিয়ে পড়েছিল। বেরিয়ে পড়েছিল অপরিচয়ের শাসন না-মেনে, কল্প-সুখের মিথ্যে স্বপ্ন দেখানো কোনো আড়কাঠির হাত ধরে। আকাঙ্ক্ষা ছিল সামান্য বিত্ত, ছোট্টো একটু সুখ, আর না-চেনা ভবিষ্যতের স্বল্প চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে ন্যূনতম ব্যবধান। কিংবা হয়তো বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল, শ্রম বেচে হতদরিদ্র পরিবারের মা-বাবা-ভাই-বোনদের মুখে এক থালা ভাত জোগানোর জন্যে—কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও বাবা-মায়ের আদেশ-উপরোধে। আবার হতেও পারে স্বামী-পরিত্যক্ত হয়ে, কিংবা শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে ফিরে যাওয়া দরিদ্র বাপের ঘরে ঠাঁই না-মেলায়, বাঁচার নেশায় কোনো অদৃশ্য জীবিকার হাতছানিতে, নিজের অর্জনে জঠর পূরণের তাগিদে, কিংবা অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষায়। আবার কখনও-বা ওদের স্বজনেরা পরিবারের ‘বোঝা’কে ছলনায় ভুলিয়ে এনে এখানে ফেলে দিয়ে গেছে কিংবা বেচে দিয়ে গেছে।

 

ওরা এসেছিল হয়তো-বা বীরভূমের ময়ুরেশ্বর বা মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম কিংবা বর্ধমানের কেতুগ্রাম গ্রাম কিংবা পশ্চিমবঙ্গের জানা বা না-জানা কোনো গ্রাম থেকে। অথবা হতেও পারে, ওরা এসেছিল প্রতিবেশী কোনো রাজ্য ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা বা বিহার থেকে কিংবা বাঁকা পথে আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশ বা নেপাল থেকে।২  বেরিয়ে যেদিন পড়েছিল সেদিন গন্তব্যের ঠিকানাটা স্পষ্ট করে নিতে পারে নি, কেউ স্বপ্নের ঘোরে, কেউ-বা প্রতিদিনের নির্যাতন থেকে যেনতেন ভাবে পালাবার আকুল ইচ্ছায়। বিপ্রতীপে, কোনো শঙ্কাও মনে ঠাঁই দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অবকাশ ওদের ছিল না। কিন্তু বেরিয়ে পড়ার অল্প পরেই, অচেনা পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে, নিজের সহজাত বুদ্ধিতে, স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাকের দেওয়াল লিখনটা ওরা পড়ে ফেলেছিল। আকাঙ্ক্ষার চর ফুঁড়ে তখন মাথা তুলেছে ভয়। চরাচর জুড়ে তখন আশঙ্কা। আপাত-জটিল সহজ গ্রাম্য জীবনে অভ্যস্ত, মূলত নিরক্ষর, বা খুব বেশি হলে নিজের নামটুকু স্বাক্ষর করতে পারা৩ ওদের সে ভয়, সে আশঙ্কা অমূলকও ছিল না। গাঁ-গঞ্জের সমাজ জীবনে ছোটোবেলা থেকেই শুনে এসেছে, লোকের মুখে মুখে ফেরা কথা, ঘরের বাইরে পা রাখা’ একলা মেয়ে’ মোটেই নিরাপদ নয়। ‘অ-নিরাপদের’ ঘটনা কেউ কেউ দেখেছে, শুনেছে অনেকেই, বাড়ি ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া কোনো নারীর সামাজিকভাবে আর সেই পুরনো ঘরে স্বমর্যাদায় ফেরা হয় নি, সে এমনকি বাপের ঘর হলেও। একান্ত নিরুপায়ে-ফেরাদের আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হয়েছে ‘অসতী’র ছাপ্পা। এইসব মাথায় এসে গিয়ে ওদের পুরনো-ঘরে ফেরার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে দেয়। আবারও পা বাড়ায় অন্য কোনো জীবিকার ধান্ধায়। আবারও সহায় হয় অন্য কোনো আড়কাঠি। তারপর একদিন নানা আনাচ কানাচ, আঁকা বাঁকা পিছল পথ পেরিয়ে, বিশ শতকের প্রথমদিকে যেমন মানদা দেবী এসে পৌঁছেছিল  তেমনই ওরাও এসে পৌঁছে যায়, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ‘লালবাজার’ এলাকায়, ‘কলকেতার সোনাগাজি’তে, যেখানে প্রবেশ আছে, প্রস্থান নেই।

 

সোনাগাছি ওদের স্থান দিয়েছে সমাজের এক কৃত্রিম জনগোষ্ঠীর একজন হিসেবে, এক অন্ত্যজ পিছড়ে বর্গের একজন হিসেবে, যাদের সামাজিক কোনো গ্রহণযোগ্যতাই নেই। সরকারি খাতায় ওদের পেশারও কোনো স্বীকৃতি নেই, নেই নিজেদের অস্তিত্ব-র কোনো বৈধ দলিল। কিন্তু সোনাগাছি ঐ সব পরিচয়-অপরিচয়ের দোহাই পেড়ে ওদের ফেরায় নি। প্রশ্ন তোলে নি বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে। বরং ওদের নির্মাণ করে নিয়েছে তার নিজস্ব স্থান-মাহাত্ম্যর খাপে ফেলে, তার মতো করে। তার কর্কশ হাতে মুছিয়ে দিয়েছে ওদের ইতিহাস, ওদের ভূগোল। জীবন-ঘষা পেশার তাগিদে, যৌনতার কানা ঘুষো-তাত্ত্বিক পাঠ নেওয়ার আগেই ব্যবহারিক পাঠ নিতে বাধ্য হয়ে, দালাল-মাস্তান-মালকিন-এর সঙ্গে দর কষাকষি আর টিঁকে থাকার লড়াই ধীরে ধীরে ওদের একদা সরল মুখের উপর কঠিন বাস্তবের পলেস্তারা ফেলে রুক্ষ করে দিয়েছে। ঐ রুক্ষতা দিয়েই ওরা গড়ে নিয়েছে ওদের নিজস্ব ভিন্নতর এক জীবন যাত্রার ছক। সেই ছকের আড়ালে গেঁথে রাখা আছে ওদের ফেলে আসা ভূমির মানুষজনদের ও—বিনিসুতোয়—কারণঘর ছাড়া থেকে সোনাগাছি পৌঁছনোর মধ্যবর্তী সময়েই ওদের অনেকেরই ফেলে আসা পরিবারে ঠাঁই হয়ে গেছে লিখিত-সামাজিক-অনস্তিত্বর তালিকায়। যদিও দায়হীন সমাজের কাছে এটাও অ-মানা সত্যি যে, জেনে বা না-জেনে, ওদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, ওরা ফিরতে না-পারার বিন্দু অতিক্রম করেছিল স্রেফ পেটের তাগিদে, বাঁচার তাগিদে, যদিও সে হয়তো কোনো অস্পষ্ট-জীবিকার হাতছানিতে। পথ ওদের সামনে কিছু ছিল না, অনুভূতিহীন নিরম্বু বাঁধন ছাড়া সমাজ কোনো পথও দেখায় নি।

 

আর পরিবারের সম্মতিতে ঘর-ছাড়াদের, সোনাগাছি পৌঁছে, তাড়া করে ফেরে, একদিকে চালু সমাজের বিধি-নিষেধ ভাঙার অপরাধ–বোধ, অন্যদিকে পরিচিত জনেদের কাছে নিজের পেশা জানাজানির ভয়। ভয় সামাজিক হেনস্থার, ভয় স্ব-সমাজ থেকে পুরো পরিবারের সমূলে উৎখাত হওয়ার।

 

ঐ অপরাধ বোধের তাড়না কিংবা প্রবল অস্বীকৃতির পরও, যেহেতু, বাড়ি-দেশ-ভূমি-ঘরের স্বজন টানের মোহ ওদের নিষ্কৃতি দেয় না, তাই, স্বেচ্ছায় বয়ে চলে বিনিময়হীন এক প্রকাণ্ড দায়। আর তাই, শুধু জীবিকা নয়, ওদের জীবনের, ওদের অস্তিত্বের একটা মানে হয়ে ওঠে সোনাগাছি। যে অস্তিত্বের গভীরে জন্ম নেয় নিজের অর্জনে বাঁচার ‘আত্মশ্লাঘা’র কিংবা ‘আত্মমর্যাদা’র অন্য আর-এক ‘অশালীন’ রূপকথা।

 

এই যাদের ইতিহাস-ভূগোল সেই নীতা-মায়া-জরিনা-স্বপ্নারা এবার ভয় পেয়েছে। করোনার ভয়। লকডাউনের ভয়। খাঁ খাঁ সোনাগাছির হাঁ করা মুখের ভয়।

 

 

করোনার দাওয়াই কিংবা অনীতা-রিনা-শেফালি-র পেটের গল্প

 

সোনাগাছিতে আসা ইস্তক অনীতা-রিনা-শেফালি-জরিনা-রা কলকাতার বনধ দেখেছে অনেকবার। তাই ২২ মার্চ ২০২০ রবিবার দিনটি যখন দেশ জুড়ে ‘জনতা কারফিউ’ হবে বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন তখন অন্যরকম কোনো কিছু ওদের ভাবনায় আসেনি, মূলত, বনধ-এর পূর্ব-অভিজ্ঞতার কারণে। ওদের অভিজ্ঞতায়, পুজো ইত্যাদি বাদ দিয়ে, কলকাতায় বড় বড় পার্টির মিছিল-মিটিং বা ‘বনধ’ মানে সোনাগাছিতে উৎসব। মিটিং-মিছিল মানে বড় রাস্তায় বাইরে থেকে আসা সারি সারি বাস। মিটিং-মিছিল মানে লোক থৈ থৈ সোনাগাছি। শহরে মাটি ফুঁড়ে ওঠা খদ্দের। আর বনধ মানে গাড়ি-ঘোড়াহীন নিঃসাড় সোনাগাছির আলসে দুপুর। এই সময় লাইনে দাঁড়ায় ফ্লাইংরা মানে চলমান যৌনকর্মীরা। তো ‘বনধ’-এর দিনে ওরা আসতে পারে না। অল্প দু-এক জন যারা আসে, তারা, কাছাকাছির (ওদের ভাষায় লোকাল) খদ্দের পেয়ে যায়। আসলি সোনাগাছির বেশির ভাগ মেয়েই তো কাজ করে রাতে, খুব বেশি হলে বিকেল ৪টের পরে। তো সেই সময় থেকে বনধের বাঁধনও আলগা হতে থাকে, তা সে শাসক-বিরোধী যে পার্টিরই হোক আর যত ঘণ্টারই হোক। এবং সন্ধ্যে ৬টার পরে সোনাগাছি ফিরে যায় নিত্যদিনের চেনা সোনাগাছিতেই।

 

জনতা কারফিউ-এর দিন ঘোষণার কয়েকদিন আগে থেকেই অবশ্য ওরা কেউ কেউ’করোনা ভাইরাস’ শব্দটি শুনেছে।  যেমন শাহিনুর বেগমকে করোনার কথা শুনেছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছিল, ‘রোজই তো শুনছি। তোমাদের করোনা যে এর’ম নাচাবে তা কি জানতাম! খাই তো গাঁড় মারিয়ে। ও বালের করোনা খায় না চুলকোয়, তা কি, শুনেছিলাম যখন, তখন জানতাম!’ (হুবহু) সত্যিই ওদের জ্ঞানের দৌড় অনুযায়ী করোনা ভাইরাস খায় না মাথায় দেয়, সেটা ওরা বুঝতে পারে নি, ওদের বিষয় নয় বলে বোঝারও চেষ্টা করেনি। তাই, ২২ মার্চ সন্ধ্যে ৬টায় তালি-থালি-ঘণ্টা-কাঁসর বাদ্য শেষে রাত ৮টায় দেশের সর্ব-উচ্চ সাংবিধানিক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী মোদীবাবু সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে, তাঁর নিজস্ব রঙে-ঢঙে ‘ভাঁইয়ো-বহিনো… …’ বলে যখন ‘ঊদবোধন’ করলেন ‘করোনা দূরীকরণ প্রকল্প’ “লকডাঊন”, মানে, ‘২৩ মার্চ সোমবার বিকেল ৪টে থেকে ১৪ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সারা দেশ জুড়ে তালাবন্দি “উৎসব পালিত” হবে, তখন, যেহেতু সোনাগাছির মেয়েরা যে যার নিজের নিজের ধান্ধায় মগ্ন ছিল, সেহেতু, লক ডাঊনের মানেটা যেকী তা ওরা বোঝার অবকাশ পায় নি, চেষ্টাও করে নি।

 

অর্ধদিবস খোলা ২৩ মার্চও ওরা দেখল সোনাগাছি আছে ঠিক সোনাগাছিতেই, তার স্ব-মহিমায়। এক নতুন অভিজ্ঞতা হল ওদের পরদিন, ২৪ মার্চ। নজরে এল একটা অপরিচিত ছোপ। কিছু লোকাল খদ্দের ছাড়া সেদিন প্রায় বন্ধ সোনাগাছি, তার উপরে দুপুর থেকেই পুলিস-প্রশাসন-এনজিও-কর্পোরেশন অটোয় মাইক বেঁধে করোনা ভাইরাস আর লকডাউনের মানে বুঝিয়ে গেল হাড়হদ্দ করে। ইতোমধ্যে শাসক-মিডিয়া-সোশ্যাল মিডিয়া-‘ভদ্রলোক’-বাহিত গোষ্ঠী সংক্রমণের ধারণাটি ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। ধরে নেওয়া হল, এই ভালনারেবল ‘বেশ্যা’-রাই হবে নিশ্চিত ভাইরাস বাহনের উপযুক্ত মাধ্যম। এরাই তো এইডস ছড়িয়েছে। অতএব এদের গতিবিধিতেই আগে লাগাম দাও। অচিরেই সোনাগাছির সব প্রবেশ পথে বসে গেল পুলিশ পাহারা। রাস্তা থেকে হঠিয়ে দেওয়া হল ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো দালালদের। আর  হেঁটে আসা যে সব খদ্দের সোনাগাছি-মুখো হওয়ার চেষ্টা করেছিল ঢোকার মুখেই তাদের আটকে দেওয়া হল। ফলে পরদিন ২৫ মার্চ থেকে কেউ আর সোনাগাছির পথ মাড়াল না। অনীতা-রিনা-মমতা-শেফালি কিংবা ছবি-মীনা-জরিনা-আসমানী-নীতা-বিপাশারা সেদিন প্রত্যক্ষ করল সোনাগাছির এমন এক নিঃসাড় অচেনা রূপ যার ছবি কখনও ওদের দূর কল্পনায়ও ভাসে নি। এটা ওদের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা।

 

ভিন্ন অভিজ্ঞতা ওদের হলেও, সোনাগাছি কী এমন অবস্থার সামনে পড়েনি কখনও? আমরা এই প্রসঙ্গে সামান্য ইতিহাস চর্চচাকরে নিতে পারি। প্রায় সোয়াশ বছর আগের কথা। ১৮৯৬ সালে বিশ্ব জুড়ে প্লেগ অতিমারী হয়ে দেখা দিয়েছিল। দেখা দিয়েছিল এ দেশে, এ শহরেও। সেদিনের ভারতের রাজধানী এই কলকাতার তখন “ঘোষিত” ঘোর দুর্দিন। উঁচুতলার বাবুবিবিরা লটবহর ফেলে কলকাতা থেকে পালাতে শুরু করেছিল। প্লেগ নিবারণে এলাকায় এলাকায় দ্রুত নানারকম সরকারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। হাসপাতাল খোলা হয়েছিল পাড়ায় পাড়ায়। বিদেশের খ্রিস্টান মিশনারিরা এসেছিল ত্রাণ নিয়ে। সে-সবই ওই মূল স্রোতের মানুষদের জন্যে। এই অতিমারী নিয়ে ‘হিস্ট্রি অ্যান্ড প্রোসিডিংস অফ দ্য বেঙ্গল প্লেগ কমিশন’ নামে ১৮৯৯-এ যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল তাতে নগর-কেন্দ্রে অবস্থিত সোনাগাছির মেয়েদের সম্পর্কে কোনো কথার উল্লেখ নেই। এমনকি ‘পা্বলিক হেলথ রিপোর্ট (১৮৯৮-১৯৭০) ইন্ডিয়া অফিস’ নামে অনেক পরে যে সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল (১৯৭০-এর দশকে) তার ‘প্লেগ ইন ক্যালকাটা’ (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪) অধ্যায়ে একটি শব্দও খরচ করা হয় নি।

 

আমেরিকার ইন্ডিয়ানা রাজ্যের খ্রিস্টান মিশনারি জর্জ ল্যাম্বারট (১৮৫৩-১৯২৮) ভারতে এসেছিলেন ১৮৯৬-এ, রিলিফ মিশন-এ অর্থাৎ ত্রাণকাজে। উনিশ শতকের শেষ দশকে ভারতে একদিকে দুর্ভিক্ষ, তারপর প্লেগ এবং ভূমিকম্প—এই ত্রাহস্পর্শের ধাক্কায় সঙ্গীন অবস্থা।  ল্যাম্বারট-এরকাজের এলাকা ছিল মূলত বোম্বে (বর্তমান মুম্বই) ও তার আশপাশের অঞ্চল যার মধ্যে কামাঠীপুরা ছাড়াও ছিল গিরগাম, ফানাসোয়াদি, ওমবুরখারি। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার সার সংকলন তিনি করেছিলেন ‘ইন্ডিয়া, দ্য হরর স্ট্রাইকেন এম্পায়ার, ফেমিন, প্লেগ অ্যান্ড আরথকোয়েক অফ ১৮৯৬-৯৭ নামে ৪ পাতা কম ৫০০ পাতার একটি গ্রন্থে। এতে তিনি কামাঠীপুরা অঞ্চলে তাঁর ত্রাণ নিয়ে, এদেশের দারিদ্র্য-কুসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর কথা বলেছেন। এখানে বলার কথা এইটি যে, কামাঠীপুরায় তখন ভারতের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লিটি অবস্থিত। কিন্তু ঘটনা হল ল্যাম্বারট-এর প্লেগ নিয়ে লেখা তিনটি অধ্যায়ে (পৃ.৩৩১-৪১৬) যৌনপল্লির কোনো মেয়ের অবস্থা বা ত্রাণ দেওয়ার মতো কোনো বিষয়ের উল্লেখ নেই। এবং তিনি যৌনপল্লিতে ঢোকেন নি তার মিশনারি সূচিতা-সংস্কৃতির কারণে। অন্যদিকে, ইতিহাস সাক্ষী, কলকাতায় ভগিনী নিবেদিতাও প্লেগের সময় উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন। তাঁর বাসস্থানের হাতার মধ্যে সোনাগাছি, রামবাগান, শেঠবাগান-এর অবস্থান। কিন্তু তিনি ‘খারাপ পাড়ার’ মেয়েদের সাহায্যের জন্যে গিয়েছিলেন বলে আমি কোনো সূত্র পাই নি। সুতরাং, সেদিনের সোনাগাছির মানদা-সুকুমারী-কালীদাসী-উষাবালা-রা যে ঐ অতিমারীর সময় কী করেছিল, সে-কথা আমরা জানি না। অনীতা-রিনা-রাও জানে না, জানার কথাও নয়। যেহেতু ওরা এক কৃত্রিম জনগোষ্ঠী, সেহেতু ওদের কোনো পরম্পরা হয় না। এক যৌবনেই ওদের সোনাগাছির পর্ব শেষ হয়ে যায়। নতুন যৌবনের অন্যরা যারা আসে তারা ভুলে যায় ঐ পরম্পরা সংগ্রহের গুরুত্বটি। হয়তো সমসাময়িক সাহিত্যয় কিছু সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু মহামারী নিয়ে লেখা বিশেষত বাংলা সাহিত্যে যেখানে বেশ কম সেখানে ‘শরীর বেচে খাওয়া’ সেই সময়ের পরিযায়ী অসতী-অসূচি-পতিতাদের কথা আলাদা করে কেউ কি ভেবেছিলেন? সন্দেহ আছে। সে যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক।

 

অবস্থা জরিপ করে ২৪ মার্চ ছবি-মীনা-জরিনা-দের সবাই বুঝে গেল, করোনার দাপটে সামান্য হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বাকিরা অল্প দিনের মধ্যেই বেশ অসুবিধায় পড়বে। ফলে, ভাঁজ দেখা দিল, অনেক শান্ত-উত্তাল ঢেউ পেরোনো মীনা-মমতাদের কপালে। উপায় হিসেবে, তাই, মনে মনে যে যার নিজের নিজের ঈশ্বর কিংবা ভবিতব্যের হাতে পরিস্থিতি ছেড়ে দিয়ে, মুখে বলল, ঠিক আছে, অসুবিধে যখন হবে তখন দেখা যাবে। ওদের শেষ আশা ছিল, ২১ দিন পরে লকডাউন উঠে গেলে সোনাগাছি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। অতএব বাকি দিনগুলোর জন্যে ওরা ত্রাণ সংগ্রহ আর নিজেদের হাতে হাত বেঁধে সংকট পার করার তত্ত্বে বিশ্বাসী হল। পিওতর আলেক্সিভিচ ক্রপটকিন (১৮৪২-১৯২১)-এর মিউচুয়াল এইড বা পারস্পরিক সহযোগিতার তত্ত্ব ওরা জানে না, চর্চা করে নি কখনোই, আগামীদিনেও করবে না। তবুও ঐ অচল পেশায় প্রতিদিনের রুক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের তাড়া করে ফেরা, ওরা, এই লকডাউনে, করোনার দাওয়াই সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানে সামাজিক দূরত্ববিধি মেনেই, একে অন্যের সহযোগিতার প্রত্যাশায়, ছুঁয়ে থাকতে চাইল নিজেদের ‘অসামাজিক’ হাত।

 

রাজনীতির ত্রাণ, ত্রাণের রাজনীতি

 

সব স্ব-বৃত্তির মতো ওদের বৃত্তিতেও অর্থ রোজগারের নিরিখে শ্রেণি-ভেদ আছে। সোনাগাছিতে যত যৌনকর্মী আছে তাদের মধ্যে খুব বেশি হলে ১০ শতাংশের রোজগার ভালো। এর পরের ৪০ শতাংশ তাদের নিয়মিত রোজগারে নিজের ও পোষ্যদের চাহিদা একরকম ভাবে মিটিয়ে নিতে পারে। বাকি ৫০ শতাংশই দরিদ্র, কোনো রকমে দিন আনি খাই অবস্থা। সোনাগাছির মোট ৩৬৬৪ জন যৌনকর্মীর মধ্যে থেকে খাপছাড়া ভাবে ৪৫০ জনের উপর ১৯৯২ সালে অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর করা সমীক্ষাটির সূত্রে,মনি নাগ তার ‘সেক্স ওয়ার্কারস অফ ইন্ডিয়া ডাইভারসিটি ইন প্রাকটিস অফ প্রস্টিটুশান অ্যান্ড ওয়েস অফ লাইফ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ঘণ্টা প্রতি আয়ের নিরিখে এ বি সি এই তিন শ্রেণির মধ্যে ‘এ’ শ্রেণির হার ১৯.৮, ‘বি’ শ্রেণির হার ৪৮.৪ এবং ‘সি’ শ্রেণির হার ৩২.৪ (পৃ.৮১)। তারও বক্তব্য হল, সময়-বিশেষে এই হার ওঠা-নামা করে। উপরে আমার দেওয়া শেষ দুটো অঙ্কের হিসেব সামান্য কিছু এদিক-ওদিক হতে পারে, প্রথমটি নয়। ১১ আর একটি কথাও এখানে  মাথায় রাখতে হবে যে, ওদের আয় সংক্রান্ত তথ্য সব সময়ে ওরা ঠিকঠাক ভাবে প্রকাশ করে না, কিংবা করতে পারে না। এরপরও, আমার বক্ত্যব্যেরযে কোনো ইতর-বিশেষ হবে আর একটু এগোলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

 

মোদীবাবুর তিন সপ্তাহের অপরিকল্পিত লকডাউন-এর প্রথম সপ্তাহ পেরনোর আগেই (মোটামুটি ২৮-২৯ মার্চ ২০২০) থেকেই সোনাগাছির বেশিরভাগ মেয়েরই অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল। এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের প্রায় ৬ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে আটকে পড়ে যেমন চরম দুর্দশায় পড়েছেন কলকাতার যৌনপল্লিগুলির প্রায় ১০ হাজার মেয়ের অবস্থাতার থেকে কিছু কম ভয়াবহ নয়। লকডাউনের দিন দশেকের মধ্যেই কোনোরকমে চালডাল ফোটানোর মতো অবস্থাও ওদের থাকত না যদি না বাইরে থেকে ত্রাণ পৌঁছত। প্রথমদিকে বড় মিডিয়া তার স্বভাবধর্ম অনুযায়ী সরকার, সরকারি গিমিক আর করোনার ‘ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস’ দিয়ে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করতেই ব্যস্ত ছিল। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা প্রকাশের আগে এদের কথাও  তাদের মনে পড়ে নি। আর সোনাগাছি তো সেই অর্থে অনেক তুচ্ছ ব্যাপার। তবে কয়েকদিনের মধ্যে খপরওলাদের কাছে লকডাউনের বাজারে ফিল্ড রিপোর্ট সাজাতে সোনাগাছি একটা বেশ খাওয়ানোর মতো ‘সাবজেক্ট’ হয়ে উঠল। যাই হোক, ত্রাণের উদ্যোগ তখন ইতিউতি শুরু হয়ে গেছে, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থার কথা ভেবে। ২৯ মার্চ স্থানীয় বিধায়কও ইসকন-এর তরফ থেকে যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি-র সঙ্গে পর দিন থেকে সোনাগাছি এলাকার মেয়েদের একপ্রস্থ ত্রাণ দেওয়া নিয়ে কথা হয়। ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করবেন, জোগাবেন বিধায়ক ও  ইসকন এবং দুর্বার তার অফিসঘর ত্রাণের কাজে ব্যবহারের জন্যে দেবে এবং কর্মীদের দিয়ে কাজটি করাবে। প্রথমেই একটা তালিকা তৈরি করে ত্রাণ বিলি করা হবে বলে ঠিক হল। কাজটা দুর্বারের পক্ষে সহজ,তাঁদের নিজেদের কর্মী বল থাকায়, যার মধ্যে সোনাগাছির মেয়েরাও আছে। তারা কাজটা করেও ফেলল তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং অঞ্চলটি তাদের কাজের ক্ষেত্র হেতু। অন্যদিকে, বিধায়ক তাঁর নিজের দলের লোকজনদের দিয়ে আর একটি তালিকা করালেন। যথারীতি দুটো তালিকায় মিল হল না। দুর্বারের তালিকায় রাস্তা এবং বাড়ি ধরে ধরে যে সংখ্যা দেখানো হল, বিধায়কের তালিকায় তার থেকে অনেক কম। স্থানীয় কাউন্সিলারের এলাকার এবং তার বাইরে ‘প্রয়োজন আছে’ এমন অনেক মেয়েরই নাম বাদ পড়েছে। কাউন্সিলার ক্ষুব্ধ হলেন। বিধায়ক-কাউন্সিলার দ্বৈরথের কথা সোনাগাছির মেয়েরাও জানে। ফলে বিধায়কের তালিকাটি একটু নাড়াচাড়া করেই বোঝা গেল, ত্রাণ বিলিতে রাজনৈতিক দলের, কিংবা একই দলের মধ্যে আঞ্চলিক স্বপক্ষ-বিপক্ষর পুরনো রোগ ‘এটা আমাদের দলের পাড়া নয়, আমাদের দলের পাড়া নয়, এগিয়ে চল এগিয়ে চল’ দর্শন এখনও রীতিমতো সচল। বিধায়ক চেয়েছিলেন হাজার দুয়েক মেয়েকে একবার কয়েকদিনের মতো ত্রাণ বিলি করতে। অথচ তখন সোনাগাছিতে কাজ-হারা আটকে-পড়া গৃহবন্দি মেয়ের সংখ্যা প্রায় ৪৫০০। যেহেতু যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার তাই তাদের পক্ষেও বাকি মেয়েদের ফেলে রেখে একটা অংশের জন্যে ত্রাণ বিলি করা সম্ভব ছিল না।

 

এরপরও, ৩০ মার্চ ত্রাণ বিলি শুরু হল। কিন্তু সময় গড়াতেই দুপক্ষের মন কষাকষি, কার্যত, এই যৌথ কর্মসূচিতে ইতি টেনে দিল. প্রথমদিনেই ব্যর্থ হল সোনাগাছির প্রথম করোনা-ত্রাণ অভিযান। কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন।মীনা-সীমা-জরিনাদের অবস্থা ইতোমধ্যে আরও করুণ হল। অবশেষে, ৪ এপ্রিল থেকে দুর্বার নিজেই ত্রাণ বিলির কাজ শুরু করল। যেহেতু, দুর্বার যৌনকর্মীদের সংগঠন এবং পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলায় তার শাখা ছড়িয়ে আছে তাই, তাকে ত্রাণের দায়িত্ব নিতে হয়েছে সমস্ত যৌনপল্লির। এই বিপুল দায়িত্ব নেওয়া দুর্বারের মতো সংগঠনের পক্ষেও যেহেতু অসম্ভব, তাই, ত্রাণ দেওয়া শুরু করেই তারা সাহায্যের জন্যে সামাজিক মাধ্যমে আবেদন জানায়। তথাকথিত ক্ষমতাবাদী রাজনৈতিক দলের প্রতি বিশ্বাস হারানো কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখা স্বদেশ-বিদেশের বহু ব্যক্তি এই আবেদনে সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিয়েছেন। সাড়া দিয়েছে কিছু ছোটোবড় সংগঠনও। রামকৃষ্ণ মিশন বিপুল পরিমাণ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাহায্য দিয়েছে দুর্বারের মাধ্যমে। এছাড়াও বহু ব্যক্তি ও ছোটো-বড় সংগঠন নিজ উদ্যোগে স্বাধীনভাবে, সোনাগাছি ছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন যৌনপল্লিতে যেমন রামবাগান, শেঠবাগান, জোড়াবাগান, লখার মাঠ, কালীঘাটের মেয়েদের মধ্যে ত্রাণ বিলি করেছেন। সাহায্য করেছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও, এমনকি, নগদ টাকা দিয়েও। বড়তলা থানা সোনাগাছিতে, গিরিশ পার্ক থানা রামবাগানে নিয়মিত ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন যৌনপল্লিতেও বহু ব্যক্তি-সংগঠন নিয়মিত ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে উল্লেখ থাকা ভালো যে, আমাদের এই আলোচনার কেন্দ্রে শুধু সোনাগাছি, অন্য যৌনপল্লির উল্লেখ সোনাগাছির প্রসঙ্গে যতটুকু প্রয়োজন হয়েছে, ততটুকুই। এতে অবশ্য অন্য অঞ্চলের যৌনকর্মীদের অতীত-ভবিষ্যত ইতিহাস-ভূগোল সম্পর্কে বক্তব্য-সিদ্ধান্তের ইতর বিশেষ হবে না কারণ সঙ্কটের মাত্রা বা পরিমাণ-হার সর্বত্রই সমান।

 

 

লেখাটির দ্বিতীয় কিস্তি – এই লিঙ্কে

 

পাদটীকা

  1. ১৯৯২ সালে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ সোনাগাছির মোট ৩৬৬৪ জন যৌনকর্মীর মধ্যে থেকে এলোমেলো ৪৫০ জনের উপর একটি সমীক্ষা চালায়। ফলাফলে দেখা যায়, যৌন পেশায় মেয়েরা আসে (ক) চরম দারিদ্রের কারণে ৪৯.১০ শতাংশ, (খ) পারিবারিক ঝঞ্ঝাটে ২১.৫৬ শতাংশ, (গ) জীবিকার মিথ্যে আশায় ১৫.৫৬ শতাংশ (ঘ) স্বেচ্ছায় ৮.৬৭ শতাংশ। ১৯১৭ বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ায় এবং ১৯৪৮-পরবর্তী চিনে এই পেশাকে শ্রেণি সমাজে সৃষ্ট এক অনৈতিক পেশা বলে তুলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সে জন্য শুরুতেই যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল তাতে চরম দারিদ্র্যর প্রসঙ্গটিই মূল হিসেবে উঠে এসেছিল। (চট্টোপাধ্যায়, ৯৮-৯৯; ১০৫, ১১৩)।আর এই পেশায় আসে মুলত যে সুত্রে, (ক) বন্ধু বা প্রেমিকের হাত ধরে ৬০.৬৭ শতাংশ, (খ) দালালের মাধ্যমে ৭.১১ শতাংশ, (গ) দালাল বিক্রি করে দিয়ে গেছে ৭.৩৩ শতাংশ, (ঘ) স্বজনরা পৌঁছে দিয়েছে ৪ শতাংশ, (ঙ) আত্মীয়রা বিক্রি করে দিয়ে গেছে ২.২২ শতাংশ, (চ) অন্য কোনো পন্থা না পেয়ে, নিরুপায় হয়ে ১৮.৬ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য যে, এটিই সোনাগাছি সম্পর্কে সবচেয়ে সংগঠিত সমীক্ষা। মনি নাগ বা দেবাশিস বসু (“কলকাতার যৌনপল্লি”, সুধীর চক্রবর্তী সম্পা. যৌনতা ও সংস্কৃতি, পৃ. ৩২১-২৪) প্রধানত এই সমীক্ষাটির উপরই নির্ভর করেছেন। এটি দুর্বার আরকাইভস-এ পাওয়া যাবে।

 

  1. দক্ষিণবঙ্গের যেসব জেলা-মহকুমা থেকে এই পেশায় আসে তার তালিকাটা এরকম,বীরভূমের রামপুরহাট, ময়ুরেশ্বর; মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম, বড়োয়াঁ, ভরতপুর, কান্দি; বর্ধমানের কেতুগ্রাম, কাটোয়া, মন্তেশ্বর, পূর্বস্থলী; নদিয়ার নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, হাঁসখালি, শান্তিপুর, রানাঘাট, চাকদা, হরিণঘাটা; উত্তর ২৪ পরগণার বাগদা, গাইঘাটা, হাবড়া, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, হাড়োয়া, বারাসত;দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, মিনাখাঁ, ক্যানিং, সন্দেশখালি, জয়নগর, কুলপি, কাকদ্বীপ; মেদিনীপুরের কাঁথি, পটাশপুর, এগরা, রামনগর, দিঘা। দেবাশিস বসু গ্রামওয়ারি একটি তালিকা দিয়েছেন (ঐ,পৃ.৩২১-২৪; নাগ, ২০০৬, ৮১-২)। সম্প্রতি এই গ্রামের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বেড়েছে যৌনকর্মীর সংখ্যাও। গ্রামীণ জীবনে, বিশেষত কোনো সামাজিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে, দারিদ্র্য ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কাজের ক্ষেত্র কমে যায়। যেমন আয়লার পরে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হয়েছিল। জনমজুর খেটে বা গৃহশ্রমিকের কাজ করে ক্ষুধা নিবৃত্তি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, সহজে রোজগার করা যাবে এই আশায় বহু মেয়েই আড়কাঠিদের হাত ধরে দেশের বিভিন্ন যৌনপল্লিতে পৌঁছে যায়।সাম্প্রতিক করোনা সংক্রান্ত ত্রাণকাজে গিয়ে যতদূর একটা সাধারণ হিসেব করতে পেরেছি, তাতে, শুধু সোনাগাছিতেই যৌনকর্মীর সংখ্যা৬০০০-এর বেশি। কলকাতার অন্যান্য যৌনপল্লিতেও ওই একই হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণাএবং নদিয়া থেকে কলকাতার পল্লিগুলিতেই বেশি আসে।

 

  1. পূর্বোক্ত ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, যৌনকর্মীদের মধ্যে নিরক্ষর ৮৪.৪ শতাংশ, শুধু নিজের নামটুকু সই করতে পারে ১৪.৯ শতাংশ, পড়তে-লিখতে পারে ০.৭ শতাংশ (এদের মধ্যে ১ জনকে পাওয়া গিয়েছিল যে স্নাতকস্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে।) সাম্প্রতিক অবস্থা এর থেকে উচ্চস্তরের নয়। নিজের ইচ্ছায় কিছুটা অক্ষর জ্ঞান শিখতে হয়েছে এখন মূলত স্মার্ট ফোন ব্যবহারের কারণে, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু তৈরি করতে।

 

  1. প্রথম বাংলায় লেখা কোনো বারবনিতার আত্মকথা শ্রীমতী মানদা দেবীর ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’ বেরিয়েছিল ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে (ইং. ১৯২৯)। মানদা কোনো দিক থেকেই এই পেশাকে গৌরবান্বিত করেন নি। বরং ছত্রে ছত্রে একে পঙ্কিল পথ বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি কখনও মূল স্রোতে ফেরার কথা ভাবেন নি। এখনকার অনেক মেয়েদের মধ্যেও এই মনোভাব দেখা যায়।

 

নটী বিনোদিনীর “আমার কথা” বেরিয়েছিল ১৯১৩-য়, তবে সেটি একজন নটীর অর্থাৎ অভিনেত্রীর জীবন কথা হিসেবেই পরিচিত। এটিই সম্ভবত বাংলায় কোনো নটীর লেখা প্রথম আত্মজীবনী।

 

  1. কিছুকাল আগেও ওদের বেশিরভাগেরই কোনো পরিচয়পত্র ছিল না। দুর্বারের উদ্যোগে কিছু কিছু মেয়ের রেশন কার্ড, ভোটার আইডি, আধার কার্ড ইত্যাদি হয়েছে। বহু মেয়েই এখনও পরিচয়পত্রহীন। আরও একটি তথ্যর এখানে উল্লেখ থাকা ভালো যে, অতি সাম্প্রতিক অতীতের কথা বাদ দিলে,কয়েক বছর আগেও, ওদের গতর খেটে রোজগার করা অর্থ জমিয়ে রাখার জন্যে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের দরজা খোলা ছিল না। লিখতে পড়তে না-পারা যৌনকর্মীরা জীবনের মধ্যভাগ পেরোনোর আগেই রাস্তার ভিখারি হয়ে যেত। এমনকি খুব দাপুটে যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হত না। একশ বছর আগেও এমন্টাই ঘটত। মানদা দেবীর লেখায়ও তার উদাহরণ আছে। (পৃ.১১১) ১৯৯২ সালের পর দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির ছাতার তলায় সংগঠিত হওয়া এবং উষা সমবায়ে অর্থ সঞ্চয়ের কারণে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যদিও বহু মেয়ে বছর কয়েক আগে চিট ফান্ডের কবলে পড়ে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বিশ্বায়ন-পরবর্তী দুনিয়ায় সরকারি ব্যাংকগুলিও এখন যৌনকর্মীদের খাতা খোলাবার জন্যে সোনাগাছিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অবশ্য বৈধ পরিচয়পত্র আবশ্যিক।

 

  1. গ্রাম সমাজে এখনও ওদের পেশা জানাজানি হলে আর ওরা নিজের গ্রামে সহজে, স্বচ্ছন্দে ফিরতে পারে না। পরিবারে যদি জেনে ফেলে তাহলে সেটা তারা প্রকাশ করে না। আর পরিবার না-জানলে অন্য কোনো পেশার পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করে ওরা। এদের বেশিরভাগই কর্মক্ষেত্রে সন্তান-সন্ততিদের রাখে না। অনেকে গ্রামে বাবা-মাএর কাছে রেখে আসে, কিংবা কোনো হোম বা হোস্টেলেও রাখে, প্রতিপালনের অর্থ ওরাই জোগায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এরা পেশাগত পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হয় ‘সোশ্যাল স্টিগমা’র কারণে। নিজেরা যখন গ্রামে ফেরে তখন নিজের ‘বাবু’ (স্থায়ী খদ্দের। বরের ভূমিকা পালন করে। বাবুর পদবি ব্যবহার করে যৌনকর্মীর সন্তানরা)-কে কিংবা কাউকে পয়সা দিয়ে ভাড়া করে বর সাজিয়ে নিয়ে যায়।

 

  1. এরা একটা নির্দিষ্ট সময়ে সোনাগাছি বা এইরকম কোনো যৌনপল্লিতে আসে এবং কাজ শেষে নিজেদের ঘরে ফিরে যায়। এরা এদের পেশার কথা পরিবারে গোপন রাখে। এদের মধ্যে পড়ে গৃহবধু, অবিবাহিত মেয়ে বা অল্প আয়ের গৃহশ্রমিক, নির্মাণকর্মী বা এই ধরণের ছোটোখাটো পেশার মেয়েরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সোনাগাছিতে কিছু কিছু বাড়ি আছে যেখানে শুধু এই ফ্লাইংরা খদ্দেরের সঙ্গে কাজ করার সময়টুকুই ঘরটি বা শয্যাটি ভাড়া নেয়। এমনও দেখা যায় যে, একটি ঘরে তিন/চারটি চৌকি পাতা। তাদের আড়াল করা হয়েছে পর্দা দিয়ে। এই ঘর বা শয্যা ভাড়া হয় ঘণ্টা পিছু। এইসব বাড়িকে সোনাগাছিতে বলে ‘লাইন বাড়ি’।

 

  1. মিশনারি কায়দায় অবশ্য খ্রিস্টান ধর্মের গুনগান, বা যিশুর মাহাত্ম্যর কথা ল্যাম্বারট বেশ ফলাও করেই বলেছেন। তবে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও যোগ করেছেন। কোভিড১৯-এর মতো প্লেগ মহামারীর উৎপত্তিস্থল চিনের উহান প্রদেশ (পৃ.৩৬২)। আরও আশ্চর্য যে, বর্তমান করোনা কালে যেমন এদেশে একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দায়ী করা হচ্ছে সেদিনও তেমনই এই একই দোষারোপ করা হয়েছিল (পৃ.৪০৩)। অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি ভদ্রলোকদের অবহেলা কিংবা গঙ্গাজলে করোনা দূর হয় বলে হিন্দুত্ববাদীদের আজ যেমন প্রচার সেদিনও গঙ্গা জলে প্লেগ দূর হবে বলে প্রচার করা হয়েছিল (পৃ.৪১৭)।

 

  1. হয়তো আমার চোখ এড়িয়েও যেতে পারে; যদি কেউ এমন সূত্র পান, জানালে সংশোধন করে নেব।

 

10. মরাঠি শব্দ কামাঠী-র অর্থ শ্রমিক (ওয়ার্কার), অভিধানগত অর্থ শূদ্রদের শারীরিক শ্রমের কাজ। কামাঠীপুরার (তখন অবশ্য ঐ অঞ্চলের নাম ছিল ‘লালবাজার’) বসতি শুরু হয় ১৭৯৫ সাল নাগাদ যখন বোম্বের সংলগ্ন সাতটি দ্বীপ সংযুক্তির জন্যে নির্মাণ কাজ শুরু হয়, প্রচুর পরিযায়ী নির্মাণ কর্মী বা শ্রমিক এখানে ঘাঁটি গাড়ে। শুরু হয় পরিযায়ী শ্রমিকদের বসতি। সেই সূত্রেই গড়ে ওঠে যৌনপল্লি। ১৮৬৪-তে বোম্বের প্রথম জনগনণায়, কামাঠীপুরায় বারবনিতার সংখ্যা ছিল ৬০১; গিরগাম-এ ১০৪৪, এবং ফানাসোয়াদি ও ওমবুরখারিতে যথাক্রমে ১৩২৩ ও ১৫৮৩। কামাঠীপুরায় ইউরোপ ও জাপান থেকেও মেয়ে পাচার হয়ে আসত। ছিল শ্বেত-পতিতাদের জন্যে আলাদা অঞ্চল—সফেদ গলি। ১৯৯০ সালে কামাঠীপুরায় ১০,০০০-এর কাছাকাছি যৌনকর্মী ছিল মুম্বইএর মোট ২,০০,০০০-এর মধ্যে (তবে এই সংখ্যায় কিছু অতিরঞ্জন থাকতে পারে)। ২০০৬ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০। যৌনপল্লি তুলে দিয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে বাবুদের বাসা, উঁচু উঁচু অট্টালিকা। কিন্তু ঘটনা হল মহারাষ্ট্রে যৌনপেশা উঠে যায় নি, বরং বেড়েছে। যৌনকর্মীরা তাদের স্থান বদল করতে বাধ্য হয়েছে মাত্র।

 

11. তথ্যটি ২০১২-১৩ সালে করা একটা স্যম্পল সার্ভে-র। প্রথম শ্রেণির মধ্যে পড়ে মূলত আগ্রাওলি ও মালকিনরা, যাদের সংখ্যা বেশ কমই। বাকি দুটি শ্রেণিতে পড়ে ছুকরি (যাদের বিক্রি করে দিয়ে যায় কোনো মালকিনের কাছে, তারা সারা জীবন মালকিনের কাছে ভাত-কাপড়ের বিনিময়ে বাঁধা থাকতে বাধ্য। তবে এই প্রথা অতি সম্প্রতি বিলুপ্তির পথে, কিছুটা সচেতনতা তৈরি হওয়ার ফলে) এবং আধিয়া (যাদের আয়ের অর্ধেক অংশ মালকিন পায়)এবং স্বনিযুক্ত বা স্বাধীনভাবে কাজ করে যারা। সাধারণত ফ্লাইংরা সবই স্বাধীন যৌনকর্মী।

 

গ্রন্থপঞ্জী 

Census of India1931 : Vol. VI, Central Publication Branch, Calcutta(Kolkata) : 1933

George Lambart, India. The Horror Stricken Empire: Famine, Plague and Earthquake of 18967: Mennonite Publishing, Elkhart, Indiana: 1898

Moni Nag, Sex Workers of India: Diversity in Practice of Prostitution and Ways of Life, Allied.NewDelhi : 2006

MrinaPande, Stepping Out, Life and Sexuality in Rural India, Penguin. New Delhi : 2003

ProbhaKotiswaram, Dangerous Sex, London. Oxford : 2012

Sumanta Banerjee, Under the Raj Prostitution in Colonial India. Monthly Review Press, New York : 1998

The Parlour and the Streets, Elite and Popular Culture in Nineteenth Century Calcutta, Seagull. Kolkata: 1998(1989)

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়,নিষিদ্ধ কথা আর নিষিদ্ধ দেশ, নিউ এজ, কলকাতা, ১৯৮২(১৩৬১)

প্রজ্ঞাপারমিতা দত্ত রায়চৌধুরী, ফুলমনি চলল কলকাতায় , ঊনিশ ও বিশ শতকের নারী ও গনিকা সমাজ, গাঙচিল, কলকাতা : ২০১৩

প্রার্থনা মুখোপাধ্যায়, গণিকাপুরাণ, মৌসুমী, কলকাতা : ২০০১

বিনোদিনী দাসী, আমার জীবন, সুবর্ণরেখা, কলকাতা : ১৯৮৭

ভারতী দে, সম্পা, যৌনপল্লীর চালচিত্র, দুর্বার, কলকাতা : ২০০১

মনি নাগ, স্বাতী ভট্টাচার্য, দেবদাসী থেকে যৌনকর্মী, ভারতে বারবনিতাদের জীবন, দীপ, কলকাতা : ২০০৭

মৌ ভট্টাচার্য, সম্পা, বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, আনন্দ, কলকাতা : ২০১১

শুভেন্দু দাশগুপ্ত, সম্পা, পশ্চিমবঙ্গ অন্য চোখে–একটি আর্থ সামাজিক প্রতিবেদন, নাগরিক মঞ্চ, কলকাতা : ২০০২

শ্রীপান্থ, কেয়াবাৎ মেয়ে, আনন্দ, কলকাতা : ১৯৯৮(১৯৮৮)

শ্রীপান্থ, দেবদাসী , দে’জ , কলকাতা : ২০০১ (১৯৭০)

শ্রীমতী, মানদা দেবী. শিক্ষিকা পতিতার আত্মচরিত সংজ্ঞা, কলকাতা : ১৩৯২(১৩৩৬)

সুধীর চক্রবর্তী, সম্পা. যৌনতা ও সংস্কৃতি, পুস্তক বিপণি, কলকাতা : ২০০২

 

কৃতজ্ঞতা  স্বীকার

রতন দলুই, ইন্দ্রনীল লাহা, রনিতা ভড়, রজতকান্তি সুর এবং অধ্যাপক সৌমিত্র শ্রীমানী

 

লেখক সামাজিক কর্মী ও প্রাবন্ধিক।

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment