যে সব গবেষণা সরাসরি মানব-কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত যেমন ওষুধ-প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা, সেখানে জ্ঞান-সম্পত্তির প্রয়োগ কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রশ্ন তুললেন অশোক সরকার।
সবাই তাকিয়ে আছে কবে করোনার একটা প্রতিষেধক বেরোবে। প্রত্যাশা এই যে প্রতিষেধক বেরোলেই এই লড়াইয়ে জয় সম্ভব; ততদিন পর্যন্ত চলবে লড়াই। কিন্তু একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। ছোট্ট দেশ কোস্তারিকা বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার কাছে একটা দাবি করেছে – করোনা মোকাবিলা সংক্রান্ত যা যা অত্যাবশ্যকীয় মেডিক্যাল ও অন্যান্য সামগ্রী লাগছে ও লাগবে সেগুলিকে আন্তর্জাতিক মেডিসিন পুল-এর অন্তর্গত করতে, যাতে সেই সব সামগ্রী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং পৃথিবীর গরিব দেশগুলো অর্থের অভাবে সেগুলি থেকে বঞ্চিত না হয়। হল্যান্ড-সহ আর ১৪-১৫টি দেশ এই দাবি সমর্থন করেছে। তার মধ্যে ভারত এখনো নেই।
এই সব সামগ্রীর মধ্যে পড়ে প্রতিষেধক, টেস্টিং কিট, মাস্ক, ভেন্টিলেটর, প্রতিরোধক পোশাক, এবং অন্যান্য ফলপ্রসূ ওষুধ। মনে রাখতে হবে আমেরিকার থ্রিএম কোম্পানি যে এন-৯৫ মাস্ক বানায় তার ৪৪১-টা পেটেন্ট আছে তাদের হাতে। থ্রিএম কোম্পানি যে প্রদেশে অবস্থিত, সেই কেন্টাকি প্রদেশের গভর্নর গত পয়লা এপ্রিল কোম্পানিকে অনুরোধ করেছেন এন-৯৫ মাস্কের পেটেন্ট তুলে নেবার জন্য। কারণ অন্য কোনও নির্মাতা এন-৯৫ মাস্ক বানাতে পারে না। এখনো সেই অনুরোধের উত্তর নেই। কিন্তু ঐ কোম্পানি গত ৭ এপ্রিল মাস্কের একটি নতুন পেটেন্ট আবেদন জমা দিয়েছে। করোনার চিকিৎসায় যে ওষুধগুলি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে – remdesivir, favipiravir, and lopinavir/ritonavir — সেগুলিও পেটেন্টের আওতাভুক্ত, তাই সেগুলো সব নির্মাতা তৈরি করতে পারছে না। টেস্টিং কিট, ভেন্টিলেটর ইত্যাদির যা যা নতুন মডেল বেরিয়েছে, সেগুলি পেটেন্ট করার জন্য অনেক নির্মাতা ও পেটেন্ট কোম্পানি চিনে, আমেরিকায় ও ব্রিটেনে সদাব্যস্ত।
মনে পড়ে যাচ্ছে নিউমোনিয়ার কথা। ২০১৮-২০১৯ সালে ভারতে নিউমোনিয়ায় ১,২৭,০০০ শিশু মারা গিয়েছিল। এই নিউমোনিয়ার যে প্রতিষেধক পিসিভি-১৩ — সেটা আমেরিকার ফাইজার কোম্পানির পেটেন্ট নেওয়া এবং তাদের একচেটিয়া। তাই দাম ১১০ ডলারের মত। ভারতে সেই প্রতিষেধক ব্যবহার হয় না। শুধু পিসিভি-১৩ থেকে ফাইজার কোম্পানির প্রতি বছরে ৩৫০০ কোটি টাকা রোজগার হয়। আরও বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে পোলিও প্রতিষেধকের কথা। পোলিও প্রতিষেধকের আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী জোনাস সাল্ক, সেই প্রতিষেধককে পেটেন্ট করতে দেননি, তার ফলে সারা দুনিয়া জুড়ে সেই প্রতিষেধক পাওয়া গিয়েছিল। তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নিজে পোলিও-পঙ্গু ছিলেন, সাল্কের গবেষণার টাকা যুগিয়েছিলেন তিনি, এবং বহু চাপের মধ্যে সাল্ক যে তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন তার পিছনে রুজভেল্টের প্রছন্ন মদত ছিল। সাল্কের বিখ্যাত উক্তি – পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের পিছনে যে সূর্য তাকে কি আমরা পেটেন্ট করতে পারি? প্রায় ১২৫ বছর আগে জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর আবিষ্কার মাইক্রোওয়েভ-কে পেটেন্ট করতে দেননি। ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনি লন্ডনের হোটেলে বসে জগদীশচন্দ্রের কাছ থেকে শুনে, কয়েক বছর পরে তা পেটেন্ট করেন। জগদীশচন্দ্রই যে মাইক্রোওয়েভের জনক তা জানতে দুনিয়াকে প্রায় ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
পেটেন্ট বব্যস্থা একদিকে যেমন বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি আবিষ্কারকে উৎসাহ জুগিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি পৃথিবী ব্যাপী জ্ঞানের অসাম্য তৈরি করেছে। মেডিক্যাল জগতে, তা শুধু জ্ঞানের অসাম্য নয়, মানুষের বাঁচা-মরার অসাম্যেরও বড় ভাগীদার। এই ব্যবস্থা বহু শতক পুরনো হলেও শিল্প বিপ্লবের সময়ে এর প্রসার ঘটে। শুধু শিল্প অর্থনীতির জগতে নয়, এমনি জন লকের মতো দার্শনিকের প্রভাবে, জমি, বাড়ি, গাড়ি বা টাকার মতো জ্ঞানকেও মানুষের এক সম্পদ যা ব্যক্তি সম্পত্তির অঙ্গ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। অন্য সবের মতো তাই তৈরি হয়েছে জ্ঞান-সম্পত্তি বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি। অন্য সম্পত্তির মতোই জ্ঞান-সম্পত্তিও আগলে রাখা যায়, বিক্রি করা যায়, কাউকে তা থেকে বঞ্চিত করা করা যায়, আবার কাউকে তা থেকে লাভবান করা যায়, এমনকি উইল করা যায়। পেটেন্ট এই জ্ঞান সম্পত্তি রক্ষায় একটা প্রচলিত ব্যবস্থা।
গবেষণালব্ধ জ্ঞান, জ্ঞান-সম্পত্তি ও সার্বিক মানবকল্যাণের মধ্যে সম্পর্কটা খুব জটিল। যে সব গবেষণা সরাসরি মানব-কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত যেমন ওষুধ-প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা, সেখানে জ্ঞান সম্পত্তির প্রয়োগ কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। নোবেল অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্তিগলিজ একসময় একটা হিসেব করেছিলেন যা থেকে ওষুধের অর্থনীতিতে ‘৯০-১০ নিয়ম’ নামে একটা কথা প্রচলিত আছে। পৃথিবীর ৯০ ভাগ ওষুধ গবেষণা হয় ১০ ভাগ মানুষের জন্য, কারণ, তারাই সেই ওষুধ কিনতে পারে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক মেডিসিন পুল’ নামে একটা ব্যবস্থা চালু করে। এটি জাতিসংঘের একটি অর্থভাণ্ডার যারা ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া করে গরিব দেশের জন্য বিশেষ বিশেষ ওষুধ বা প্রতিষেধকের লাইসেন্স নেয় যাতে কম খরচে তার উৎপাদন ও বিলি বণ্টন হতে পারে এইডস, টিবি, হেপাটাইটিস-বি, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের ওষুধ বা প্রতিষেধকের জন্য এই ভাণ্ডার কাজ করেছে। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকের ক্ষেত্রেও এই দাবি এসেছে ১৪-১৫টি দেশ থেকে। শুধু ওষুধ নয়, করোনার ক্ষেত্রে অন্যান্য কিছু বস্তুও এই দাবির অন্তর্গত।
শেষ করার আগে ১৯৭২ সালের ইন্দিরা গান্ধীর সেই সুদূরপ্রসারী নীতির কথা উল্লেখ করতেই হয়। ভারতের পেটেন্ট আইনে একটা আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। আইন করে বলা হয়েছিল ওষুধের ক্ষেত্রে, কোনও ওষুধ কে নয়, যে প্রক্রিয়ায় ওষুধটি তৈরি হয়েছে তাকে পেটেন্ট করা যাবে। অন্য কোনও ওষুধ নির্মাতা ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়ায় সামান্য বদল ঘটিয়ে সেই ওষুধ তৈরি করতে পারবে। প্রোডাক্ট-পেটেন্টের বদলে প্রক্রিয়া-পেটেন্ট চালু হয়েছিল। এতে করে ওষুধকে ব্যক্তি-সম্পত্তির আওতা থেকে বাইরে রাখা গেছিল। আজকে ভারতীয় ওষুধ কোম্পানিগুলির অসাধারণ সাফল্যের মুলে পেটেন্ট আইনের ওই রদবদলকে ভুললে চলবে না।
বড় রকমের সঙ্কট, মানুষকে অনেক শুভ চেতনা দেয়। মহামারীর মোকাবিলায় পেটেন্ট-এর কী স্থান হবে তাই আবার প্রশ্ন করার সময় এসেছে।
লেখক আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
Something to seriously think about. Will the greed of the multinationals allow this?