“জঠরে বিষ লুম্পেন ফিল্ম-মেকাররা আর্ট-কে পার করিয়ে দিক আর্টের সীমানা, আর্ট হয়ে উঠুক কালোদের জিয়নকাঠি। লুম্পেনরা সুন্দর, তাই তো লুম্পেনরা ঐশ্বরিক। লুম্পেনরা সুন্দর, কারণ প্রতিরোধের থেকে বেশি সুন্দর কিছু হয় কি! আর সুন্দরের থেকে বেশি ঐশ্বরিক! চলুন তাহলে। মানচিত্রের শেষ যেখানে সেখান থেকেই শুরু করি যাত্রা, ড্রাগনের দেশে যাত্রা।” লাজ লি পরিচলিত ২০১৯-এ রিলিজ -হওয়া সিনেমা ল্য মিজারেবল-এর ঈসাদের নিয়ে লিখলেন, এদেশের ঈসাদের নিয়ে নাটক করা থিয়েটার অ্যাক্টিভিস্ট অঙ্কুর।
সিনেমা – ল্য মিজারেবল (Les Misérables)
পরিচালক – লাজ লি (Ladj Ly)
রিলিজ – ২০১৯ (2019)
ভাষা – ফরাসি
সময়দৈর্ঘ্য – ১ ঘন্টা ৪৩ মিনিট
পৃথিবীর মানচিত্র তৈরির ইতিহাস বড় মজার – যেখানে মাপজোখ শেষ, সেখান থেকেই শুরু ড্রাগনের দেশ। সামাজিক শ্রেনি-বিন্যাসের মানচিত্রও কোথাও না কোথাও শেষ হয়, আর তারপর থেকেই শুরু লুম্পেন প্রোলেতারিয়েতের দেশ… ‘ল্য মিজারেবল’-এর দেশ…ঈসা-দের দেশ।
পূর্ব প্যারিসের মন্টফারমেল অঞ্চলের কালো ঘেটোর কালো কিশোর ঈসা। মুরগি-চুরিতে হাতপাকানো ডানপিটে ঈসা। ঝপ্ করে সে একদিন সিংহের বাচ্চা চুরি করে ফেলে, রোমানি-দের সার্কাস তাঁবু থেকে। ব্যস্! বাওয়াল চালু! এমনিতেই দু’ দলের রিলেশান টাইট – রোমানিরা ঈসাদের ডাকে ‘নিগ্রো’, ঈসারা রোমানিদের ডাকে ‘জিপসি’। সিংহ-চুরি নিয়ে নিগ্রো-জিপসির জাতিসংঘর্ষ যখন লাগে লাগে, তখন মাঠে নামে তিন পুলিশ – ক্রিস, গওয়াদা আর স্টেফান। এলাকায় টহলদারির ফাঁকে দু’ দলের কাছ থেকেই তোলা তোলে যারা। খবর পেয়ে ঈসাকে তোলে ওরা। কিন্তু তোলাটা একেবারেই সহজ হয় না। ঈসার দলবল পুলিশকে তাড়া করে…তিনটে ষন্ডা ফরাসি পুলিশ ভার্সেস এক পাল কালো কিশোর।
এই কিশোরেরা গ্যাং বেঁধে থাকে – গ্যাং বেঁধে ফুটবল খেলে, খেলাশেষে এক পেট খিদে নিয়ে ফেরিওলার কাছে কম পয়সায় গোটা দলের জন্য খাবার দাবি করে ও তাড়া খায়, ফ্রান্স দ্বিতীয়বার ফুটবল বিশ্বকাপ জিতলে আনন্দ করে একসাথে। পোগবা ওদের ঈশ্বর, এমবাপে ওদের মহম্মদ।
ফ্রান্সের বিশ্বজয়ী টিমের তেইশজন ফুটবলারের চোদ্দজন আফ্রিকা-বংশোদ্ভূত – মালি, কঙ্গো, সেনেগাল, ক্যামেরুন, মরক্কো, গিনি, টোগো, নাইজেরিয়া, হাইতি, অ্যাঙ্গোলা ও আলজেরিয়ার। ফ্রান্সের প্রথমবার কাপ-জেতার মূল কারিগর জিদান-ও আলজেরিয়া-জাত। আলজেরিয়া ফ্রান্সের কবল থেকে মুক্তি পায় ১৯৬৩ সালে। তার ৩৫ বছরের মধ্যে এক আলজিরিয়র হাত ধরেই, মানে পা ধরেই ফুটবল-মানচিত্রে জায়গা পাওয়া…তখন জিদানও হয়ে যান ১০০ শতাংশ ফরাসি! ফরাসি তিরঙ্গা গায়ে জড়িয়েই ঈসারা যায় ঈশ্বর-আরাধনায়…এমবাপে-বরণে। তাও কি ঈসারা ফরাসি? যথেষ্ট ফরাসি?
সাহারার পেশি নিংড়ে গড়ে উঠেছে পারী শহর, সাহারার ঘামে রসদ পেয়েছে পারী সভ্যতা, আর সাহারার রক্তে কলকলিয়েছে পারী সংস্কৃতি। দাস-ব্যবসায়ীরা আর আড়কাঠিরা হাত-পা টিপে টিপে দেখত, দাঁত-মাড়ি পরীক্ষা করত, তবেই কাজ মিলত। হালে জুতে দেবার মতো সবরকম লেবার মেলে হাটেবাজারে – চারপেয়ে টু দু’পেয়ে। এই লেবার চুষেই ঘন হয়েছে বিশুদ্ধ পারী রুচি, গোটা দুনিয়া যার আঁচ পেতে লালায়িত। ওদিকে গত পঞ্চাশ বছর ধরে ফ্রান্সে নানারকম বিল পাশ হয়েছে – কে কত শতাংশ ফরাসি। রুচিসম্পন্নদের প্যারিসে তৈরি হয়েছে ডিটেনশান সেন্টার…বিদেশি ক্যাম্প।
ঈসাকে ছাড়াতে কালো কিশোরেরা গ্যাং বেঁধেই তাড়া করে পুলিশদের। তাড়া খেয়ে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় পুলিশ…বেমক্কা একজনের হাত দিয়ে ফ্ল্যাশগান চলে যায়। ফ্ল্যাশবল গিয়ে লাগে ঈসার মুখে…মারাত্মক জখম হয় ঈসা, তখনকার মত ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কিশোর গ্যাং। ফ্ল্যাশগানটা ছিল গওয়াদার হাতে। গওয়াদা আবার আফ্রিকা-বংশোদ্ভুত ফরাসি পুলিশ। যাই হোক, উদ্ধার হয় সিংহ-শাবক। কিছুটা ধাতস্থ ঈসাকে সঙ্গে নিয়ে তিন পুলিশ সিংহ-শাবক ফেরত দিতে যায় রোমানিদের তাঁবুতে। কিন্তু শুধু হারানো জিনিস ফেরত পেলে কি চলে! নিগ্রোর বাচ্চাকে সবক্ শেখাতে হবে না! রোমানিদের মাতব্বর জোরো, যে আবার সার্কাসের রিংমাস্টারও বটে, হঠাৎ ঈসাকে ঢুকিয়ে দেয় জিমির খাঁচায়। জিমি একটা ফুলসাইজের কেশরওলা সিংহ…প্যান্টে পেচ্ছাব করে ফেলে ঈসা। ‘ল্য মিজারেবল’-এর পরিচালক লাজ লি আমাদেরও ঢুকিয়ে দেন জিমির খাঁচায় – নিষ্ক্রিয় দর্শন হয়ে ওঠে সক্রিয় অভিজ্ঞতা…পাতি কথায় আমাদের ফাটে! মালি-বংশোদ্ভুত লাজ লি আমাদের হ্যারাস করেন। ওদিকে দু’দুবার হ্যারাস্ড হয় ঈসা – একবার পুলিশের হাতে, একবার রোমানিদের হাতে। ছেড়ে দেবার আগে ঈসাকে দিয়ে পুলিশ এও কবুল করিয়ে নেয়, যে লোকে যেন জানে ও পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে!
সব পাড়ার মতো ঈসাদের পাড়াতেও ভ্যারাইটিজ দাদা আছে, যারা দাদাগিরি করে বাঁচে – নেশার দোকান চালিয়ে টু পাইস কামায় কোনো দাদা, তো কেক-ক্যান্ডি-কোলার বদলে ছোটদের নামাজ পড়াতে চায় ইসলামের ঠিকেদারি নেওয়া কোনো দাদা, আবার কোনো দাদা স্রেফ মাতব্বরি করে দিন গুজরান করে। মেটেবুরুজের, থুরি, মন্টফারমেলের অন্যতম দাদা ‘মেয়র’। মেয়র ক্যাডার পোষে, পুলিশের সঙ্গে খাতির রাখে, এলাকার হকারদের সামলায়, রোমানিদের সঙ্গে বাওয়ালে সবার আগে যায়, উঠতি ছোকরাদের দাবড়ে রাখে, লিফ্ট খারাপ হলে বিল্ডিংবাসীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জোগায় – মোদ্দা কথা, এলাকার লোকে মানে মেয়রকে।
এহেন মেয়রের কাছে জখমি ঈসার থেকেও জরুরি হয়ে ওঠে ঈসার জখম হওয়ার ভিডিও, যা কাকতালীয় ধরা পড়ে পাড়ারই আরেক কিশোরের উড়ন্ত ড্রোন ক্যামেরায়। এই ভিডিও হাতে এলে পুলিশকে বাগে পাবে মেয়র, পুলিশের সঙ্গে সওদায় আপারহ্যান্ড নেবে, এলাকার লোক আরও তাঁবে থাকবে তার, এছাড়া কিছু অজানা সুবিধেও হাসিল হয়ে যেতে পারে – মোটমাট আরও ঘন হবে মেয়রের ক্ষমতার মধু-চাক।
পাড়ার মোড়লের এহেন বিবেকহীন ধান্দাবাজি হ্যারাস করে ঈসাকে, আরেকবার। সিস্টেম তাকে আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, তুই নিগ্রোর বাচ্চা! লাথখোর হয়ে জন্মেছিস, লাথখোর হয়েই মরবি। মনে করিয়ে দেয় সেই ঈসাকে, সাদা প্যারিসের কালো ঘেটোতে থেকেও যে সিংহের বাচ্চা চুরি করে বেচতে চায় না, পুষতে চায়। তিন-তিনবার হ্যারাস্ড হবার পর জখমি ঈসা তার দলবল নিয়ে যে খেল দেখায়, শ্রেণি-মানচিত্রে বসবাসকারী বয়ঃসন্ধির কোনো কিশোরবাহিনী কি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারে?
শ্রেণি-মানচিত্রে বসবাসকারী কিশোরেরা ইস্কুলে পড়ে। এদিকে ঈসারা হয় ইস্কুলছুট, নয় ইস্কুল যায় নাম-কা-ওয়াস্তে। বাকি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের মতোই ইস্কুলও সিস্টেমে খাপ খাওয়ানোর পাঠ দেয় – ডানপিটেমি ভোলায়, টুকতে শেখায়, হামবড়ামি ধরায়, বেসিকালি গেরস্ত বানায়। আর সিস্টেমে খাপ খাওয়ানো মানেই শ্রেণি-মানচিত্রে জায়গা পাওয়া। বদলে ইস্কুল কৈশোরের পবিত্র কেড়ে নেয়, মেনস্ট্রিমিং কৈশোরের ব্যক্তিগত কেড়ে নেয়। কিন্তু ঈসাদের বেলায় এ’ ছক খাটেনি। ঈসার লেগেছে মানে সবার লেগেছে, ঈসার অপমান সবার অপমান – হ্যর্ড মেন্টালিটি, মানুষের আদিম অভ্যেস যা লুম্পেনদের জখমকে গভীর করে, পবিত্র করে। আর এই পবিত্র জখম থেকে জন্ম নেয় ককটেল…পেট্রল-বোমা…মলোটভ ককটেল।
আমরা এবার ঢুকে পড়ি সিনেমার শেষ পনের মিনিটে…তুলকালাম শেষ পনের মিনিটে। শেষের শুরুতে আমরা দেখি সেই তিন পুলিশকে। ঈসার জখম হওয়ার ভিডিওটা ততদিনে নানান কলকাঠি নেড়ে চেপে দিয়েছে ওরা। পুলিশের গাড়ি চালিয়ে সেদিন ওরা ঢুকেছে পূর্ব দিল্লির শিব বিহারে, থুড়ি, মন্টফারমেলের কালো পাড়ায়। রেগুলার টহলে।
এলাকায় ঢুকেই একটা অস্বস্তি টের পাচ্ছিল ওরা…এলাকার হাওয়াটা রোজকার মতো নয়। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হয় আট-দশ বছরের একপাল কালো পিচ্চি, ঈসাদের ঠিক জুনিয়র গ্রুপটা। উদয় হয়ে পিচকিরির জল ছেটায় ওদের ওপর, জিভ ভ্যাংচায়, হল্লা করে, গাড়িতে বাড়ি মারে, আর শেষে একটা আধন্যাংটা ড্রাগন গলায় আঙুল চালিয়ে জবাই দেখায়। ওদের অস্বস্তিটা বাড়ে যখন চলন্ত গাড়ির গা ঘেঁষে কয়েকটা লুম্পেন বাইক চালায়, বাইক নিয়ে কেরামতি দেখায় – ওরা টের পায় ওদের ফলো করা হচ্ছে, পুলিশের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
এরই মধ্যে লাজ লি আমাদের নিয়ে যান ঈসার কাছে – আমরা দেখি একটা আকাশচুম্বি ছাদের কার্নিশে পা ঝুলিয়ে পড়ন্ত সূর্যের মুখোমুখি বসে আছে ঈসা, চোখের তলায় জখম নিয়ে…টাটকা, পুরুষ্টু সূর্যের মতো জখম নিয়ে। এরপরেই আকাশ থেকে নেমে এসে পুলিশের গাড়ির সামনাসামনি হয় ঈসা – ওরা কিছু বোঝবার আগেই হুড়ুমতাল পটকা ছুঁড়ে উধাও হয়ে যায়।
খেপে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ওরা তাড়া করে ঈসাকে। দাদার দাদা পুলিশ এবার সলিড চুক্কি খায়…তাড়া করতে করতে ঢুকে পড়ে একটা লো-ইনকাম-গ্রুপ বিল্ডিঙে…ফান্দে পড়ে বগা…পড়ে বাঘা তেঁতুলের খপ্পরে। সস্তা বিল্ডিঙের সরু সিঁড়িতে আটকে পড়ে তিন পুলিশ…পালাবার পথ বন্ধ। ঘোগের বাসার অলিতে-গলিতে, খিড়কিতে-দুয়ারে, খোপে-খাঁজে তখন শয়ে শয়ে কালো কিশোর…ঝাঁকে ঝাঁকে রাগী ড্রাগন। পুলিশের গায়ে উড়ে আসে ঢিল, কৌটো, সোডার বোতল, গাড়ির টায়ার, ভাঙা সাইকেল, জলের ড্রাম, দেয়ালঘড়ি, সুপার মার্কেটের ট্রলি, মর্টার, থুতু, লালা, খিস্তি, দাসত্বের বিষ…পুলিশের এবার হ্যারাস্ড হবার পালা। লাথখোরদের গরম নিঃশ্বাসে দমবন্ধ হয়ে আসে সভ্যতার সেপাইদের।
আজ হিসেব বুঝে নেবার দিন – কোনো দাদাকেই ছাড়া হবে না। আরেক খোচর ড্রাগ পেডলার স্টিনজি পুলিশের হয়ে দালালি করতে এলে লাথি, রড, হাতুড়ি, সিলিন্ডার আর মর্টার দিয়ে ওর গাড়ি ওড়ানো হয়। এরপর ফান্দে ফেলা হয় তোলা-খোর মেয়রকে…ফুঁসলিয়ে ঢোকানো হয় ওই বিল্ডিঙে। বাওয়ালাবাজি দেখে মেয়র চিরকালীন ভঙ্গিতে ওদের ওপর চোখ রাঙায়, কৈফিয়ত চায় – ‘কি ব্যাপারটা কি তোদের? বিরাট রংবাজ হয়ে গেছিস, না? কার থেকে পারমিশন নিয়েছিস?’ ঠিক তখনই ঘটে ঘটনাটা – সামনে এগিয়ে মেয়রের মাথায় বেমালুম ডান্ডা বসিয়ে দেয় ঈসা…ডান্ডা মারে পারমিশনের মাথায়। ব্যস্! গনধোলাই চালু! এক ঘা, দু’ ঘা, তিন ঘা¸ মেয়রের মাথায় পড়তে থাকে হুডি কিশোরদের একের পর এক ঘা! ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার…হাজারবার ম্যাটার! আপাতত শান্তিকল্যাণের মাথায় ঘা! ক্যাডার-খেকো লিডার-রাজনীতির মাথায় ঘা! মুরুব্বিয়ানার মাথায় ঘা! মহম্মদ-আরাধনার জন্য আজ আর আমাদের কোনো ঠিকাদারের জরুরত নেই, নিজেদের হক্ বুঝে নেবার জন্য জরুরত নেই কোনো মোড়লের। এখন থেকে মতাদর্শ আমাদের সেবা করুক, কালো বাস্তব হোক মতাদর্শের ভরকেন্দ্র।
সাদা ঘৃণায় ঘেরা মন্টফারমেলে বেড়ে ওঠা লাজ লি আরও একটা বাজিমাত করেন – সাদাদের বা কালোদের নিছক সাদা-কালোয় আঁকেন না তিনি…তা সে মেয়রই হোক, বা স্টেফান। তিন পুলিশের মধ্যে তুলনায় স্টেফান একটু কম পুলিশ, সাদা হলেও।
লাস্ট সিনে হুডি ঈসা আর স্টেফান মুখোমুখি – ঈসার হাতে মলোটভ ককটেল, স্টেফানের হাতে সার্ভিস রিভলভার। ব্ল্যাক লাইভ্স আর রাষ্ট্র মুখোমুখি! প্রতিরোধের নতুন, মাতব্বরি-হীন কন্ঠস্বর আর সিস্টেম মুখোমুখি! কিন্তু আর কিছু ঘটে না…একদিকে শুধু ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে বোমা, উল্টোদিকে খোলামুখ বন্দুকের নল। একটা থমথমে আবহাওয়ায় সিনেমা শেষ হয়।
যাবতীয় শক্তির উৎস বন্দুকের নলে পাওয়া গেলে সিস্টেম নিশ্চিন্ত হয়, পেট্রল-বোমা ফাটলেই সিস্টেমের মাথা ঘামানো শেষ হয়। ‘ল্য মিজারেবল’-এর ভাবনা বুঝিবা দানা বেঁধেছে ২০০৫-এর প্যারিস রায়টের স্মৃতি-ভিয়েনে, যা এখনো কালো হৃদয়ে জ্বলছে – দুই কিশোর-মৃত্যুর বদলা নিতে শহর জ্বালিয়ে দিয়েছিল সেবার লুম্পেনরা…কিন্তু দশ বছর বাদে দোষী পুলিশরা কোর্টে বেকসুর খালাস পায়। বিচার মেলা তো দূর, কালো ঘেটো যেন আরও ঘেঁটে যায়। মাথা খুঁড়ে মরে মৃত বুয়ানার দাদার আর্তনাদ, শক্তির উৎস তাহলে ঠিক কোথায়?
বুয়ানার দাদা সিয়াখা ছাড়াও কালো পাড়ার অনেককে দিয়েই পরিচালক অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন। লাজ লি জানেন, বোমা না ফাটলেই সিস্টেমের ফাটে! বোতলে পেট্রল না পেলেই সিস্টেম পাগলের মতো খুঁজে বেড়ায় শক্তির উৎস, বোতলে ছুপা অজানা দৈত্যর ঠিকুজি জানতে টিকটিকি লাগায়। সিস্টেম খালি ভয় খায় এই বুঝি দৈত্য বেরিয়ে এল, সিস্টেমের ভিত টলিয়ে দিল, মানচিত্রে কালি মাখিয়ে দিল, আর দলিত লাইভ্স ম্যাটার করল হাতেগরম, থুরি, ব্ল্যাক লাইভ্স।
তাই পেট্রল নয়, মলোটভ ককটেলের মধ্যে লাজ লি পুরে দেন কালো বাস্তব থেকে ছেনে তোলা কালো নজর – মন্টফারমেলের কিশোরদের হাতে উনি তুলে দেন ক্যামেরা। সিনেমায় ঠিক যেমন ক্যামেরা-হাতে পনের বছরের লাজ লি-কে দেখি আমরা, বাজ নামে। বাজের ড্রোন-ক্যামেরাতেই ধরা পড়েছিল পুলিশের কুকীর্তি, যা বেচে খেতে চেয়েছিল কালোদেরই স্বজাতি মেয়র।
প্রথম কালো ফরাসি হিসেবে অস্কার নমিনেশন পাওয়া লাজ লি কালো কিশোর-তরুণদের জন্য চালান ফ্রি ফিল্ম-স্কুল। ‘ল্য মিজারেবল’-কে উনি যেমন লেলিয়ে দেন অলস মধ্যবিত্ত দর্শনের বিরুদ্ধে, আপোষকামিতার বিরুদ্ধে, সহস্রাব্দ-লালিত নৈঃশব্দের বিরুদ্ধে, তেমনই ক্যামেরা হাতে ড্রাগনদের লেলিয়ে দেন সাদা ঘৃণার বিরুদ্ধে, বিশুদ্ধ রুচির বিরুদ্ধে, সহস্রাব্দ-লালিত শোষণের বিরুদ্ধে। দম ধরে রাখতে পারলে ফিল্ম-মেকিং আর থাকবে না কোনো দূরের গ্রহ, অনায়াসে আয়ত্তে আসবে লুম্পেন-দের…শুধু ড্রাগস-ক্যান্ডি দিয়ে আর তখন বশ করা যাবে না ওদের!
কালো আর্টিস্টের এই নতুন দলকে গিলতে মরিয়া হবে পুঁজিবাদী আর্ট প্রোডাকশান…কেড়ে নিতে চাইবে লাথখোরের ব্যক্তিগত, লাথখোরের পবিত্র। কিন্তু ওরা যদি ধরা না দেয়, যদি গড়ে নেয় গ্লোবাল ফিল্ম-মার্কেটের বাইরে নিজস্ব মানচিত্র, সিস্টেমের তখন ফাটবে! ফাটবে কারণ বোতলে তখন পেট্রল ভরা থাকবে না…
জঠরে বিষ লুম্পেন ফিল্ম-মেকাররা আর্ট-কে পার করিয়ে দিক আর্টের সীমানা, আর্ট হয়ে উঠুক কালোদের জিয়নকাঠি। লুম্পেনরা সুন্দর, তাই তো লুম্পেনরা ঐশ্বরিক। লুম্পেনরা সুন্দর, কারণ প্রতিরোধের থেকে বেশি সুন্দর কিছু হয় কি! আর সুন্দরের থেকে বেশি ঐশ্বরিক!
চলুন তাহলে। মানচিত্রের শেষ যেখানে সেখান থেকেই শুরু করি যাত্রা, ড্রাগনের দেশে যাত্রা…
…
অঙ্কুর থিয়েটার অ্যাক্টিভিস্ট ও ‘ডাকঘর পড়ছি’ বইয়ের লেখক।