কলকাতা শহরের একজন নাগরিক সবুজ দাস। তাঁর সত্তর বছরের মা’কে নিয়মিত ডায়ালিসিস করতে হয়। এতদিন পর্যন্ত গন্তব্য ছিল জোকা ইএসআই হাসপাতাল। কিন্তু করোনা চিকিৎসার জন্য রাজ্য সরকার এরকম জরুরি পরিষেবার জন্য নির্ধারিত একটি হাসপাতালকে রাতারাতি অধিগ্রহন করল। চরম অসুবিধায় রোগী ও তাঁর পরিবারের মানুষেরা। ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। চিকিৎসা বন্ধ বহু মানুষের। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজ্য সরকারের এহেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে প্রশ্ন করলেন সবুজ দাস।
‘করোনা ভাইরাস’ সংক্রমন ও তৎজনিত ‘লকডাউন’ এখন বিশ্বজুড়ে এক এবং একমাত্র আলোচ্য বিষয়। সারা বিশ্ব কীভাবে করোনা সংক্রমন থেকে মুক্ত হতে পারে তার রাস্তা খুঁজতে ব্যস্ত চিকিৎসক, গবেষক থেকে রাষ্ট্রনেতারা। মূলধারার গণমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া – যেখানেই চোখ রাখা যায় সবখানে সবাই করোনা আক্রান্ত ও মৃতের পরিসংখ্যান চর্চাতেই ব্যস্ত। অথচ সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর এর থেকে বেশি সংখ্যায় মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। এর থেকে অনেক বেশী মানুষ ক্যানসার, হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যান কিডনিজনিত অসুখে। এইচ আই ভি-তে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। পার্থক্য এটাই যে করোনা মহামারীর রূপ নিয়েছে। এবং এই ভাইরাস সংক্রমন নিয়ে মানুষের খুব কিছু জানা নেই। আমাদের দেশ তথা রাজ্যেও এর অন্যথা হচ্ছে না। এটা যেমন ভালো কথা যে সকলেই এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মোকাবিলায় একসঙ্গে লড়ছেন তেমনি করোনা আটকাতে লকডাউন পরিস্তিতিতে অবহেলিত হচ্ছে অনান্য মারন রোগে আক্রান্ত মানুষজনের চিকিৎসা। যেমন ক্যানসার আক্রান্ত মানুষ ও কিডনির রোগে আক্রান্ত ডায়ালিসিস রোগীদের চিকিৎসা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ রাজ্যে তেমনই কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাইব।
আগেই বলে নেওয়া ভালো করোনার চিকিৎসার সাথে অন্য রোগের চিকিৎসার তেমন কোনো সরাসরি যোগ না থাকলেও যেহেতু এই রোগের ভাইরাস সংক্রমন ঘটাতে পারে তাই একই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা হাসপাতলে অন্য রোগের রোগীদের পাশাপাশি এর চিকিৎসা হওয়া প্রায় অসম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের মত। অন্যদিকে হঠাৎ করে “লকডাউন” ঘোষণার ফলে যানবাহন পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্যান্য নানাবিধ রোগ, যার জন্য নিয়মিত বিরতিতে রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হয়, সেইসব রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
কিন্তু করোনা কে আটকাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার কর্তৃক বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে যে ভাবে পরিষেবা তুলে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাতে ক্যানসার, হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী ও কিডনীর সমস্যাক্রান্ত রোগীরা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। পূর্ব কলকাতার বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতাল প্রথম থেকেই করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ছিলো। তারপর মধ্য কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। পরবর্তীতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলা সদর হাসপাতাল এম আর বাঙুরকেও কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমনের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের লাগাতার “লকডাউন” ঘোষণার সময়কালে হঠাৎ করেই রাজ্য সরকার জোকা ইএসআই হাসপাতালকে কোভিট-১৯ চিকিৎসার জন্য অধিগ্রহন করে, সেখানে চিকিৎসারত রোগী বা তাদের পরিবারকে না জানিয়েই। প্রত্যেকেই অবগত আছেন যে জোকার এই হাসপাতালটি মূলত রাজ্যের ও তার বাইরের বিমা কর্মচারীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত। এই হাসপাতাল চত্ত্বরেই পিপিপি মডেলে বেসরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১৭৫ থেকে ২০০জন কিডনী রোগীর ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা ছিলো। এখান থেকেই এই সব কিডনি রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয়ি সিটিভিএস এবং এভি ফিসচুলার ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু হঠাৎ করেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে সব রকম চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এবং সমস্ত রোগীকে মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে চাওয়ায় অথৈ জলে পড়েন এই সমস্ত রোগী ও তার পরিবারের লোকজন। আমি ডাক্তার নই। স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথেও জড়িত নই। কিন্তু আমি একজন রোগীর পরিবারের মানুষ হিসাবে লক্ষ্য করছি যাদের সপ্তাহে দুই বা তিনটে ডায়ালিসিস চলে তারা এবং তাদের পরিবারের লোকজন কি দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।
ইএসআই হাসপাতালে (জোকা) চিকিৎসাধীন ডায়ালিসিস রোগীদের এভাবে তড়িঘড়ি মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্তে অনেক রুগীকেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। জোকা ইএসআই পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ। রোগী ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমতঃ ওখানেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া আর তা সম্ভব না হলে আগামী তিন মাসের জন্য দক্ষিণ কলকাতা কিংবা তার আশেপাশে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডায়ালিসিস চালিয়ে যাওয়ার অনুমতির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু মেডিক্যাল সুপার তা করতে অপারগ বলে জানান। এমন কী বিজ্ঞপ্তি জারি করা ছাড়া কোনো রকম “সাইনিং অথোরিটি” নেই বলেই সবাইকে জানান দেন। এই বৃহৎ হাসপাতালটিকে রাজ্য সরকার কোভিট-১৯ চিকিৎসার জন্য অধিগ্রহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে দিয়েই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় সেরেছেন। রোগী ও তার পরিবারের দাবী জোকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মানেননি। এই মানুষগুলি চেয়েছিলেন সুব্যবস্থা। কারণ তাঁরা আই পি (ইনসিওরড পারসন)। অর্থাৎ আগে পয়সা জমা রেখে পরে চিকিৎসার জন্য আসেন। কিন্তু সে কথায় তেমনভাবে কর্ণপাত করার চেষ্টা করেননি সুপার। ফলত চরম দুর্ভোগের মধ্যে আছেন অনেক রোগী ও তার পরিবার।
মানিকতলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জোকায় চিকিৎসাধীন রোগীদের ‘বহিরাগত’দের মতো ব্যবহার করছেন বলে অনেক রোগী ও তার পরিবারের মানুষজনের অভিযোগ। তাঁরা দক্ষিন কলকাতার কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র চেয়েছিলেন যেহেতু তাদের বেশির ভাগ অংশ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও কলকাতা শহরের দক্ষিণ অংশের বাসিন্দা – এই লকডাউনের সময় তাঁদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য। এমন কী সুদূর হলদিয়া থেকে এখানে ডায়ালিসিস করতে আসেন, এমন মানুষও আছেন। যেমন আসেন ডায়মন্ড হারবার, আমতলার গোতলার হাট, বারুইপুর, জয়নগর ও মগরা হাট থেকে। যানবাহন বন্ধ থাকায় অনেকেই হাসপাতালে থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছিলেন। আবার অনেকে গাড়ি না পেয়ে CKD-V রোগীকে বাইকে বসিয়েই নিয়ে ডায়ালিসিস নিতে আসছিলেন। এগুলি রোগীর বাড়ির লোকের পক্ষে কতটা কষ্টকর এবং রোগীর ক্ষেত্রে কতটা বিপজ্জনক সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারবেন। ডায়ালিসিস চলাকালীন কোনো রকম সঙ্কটের মুখোমুখি হলে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চিকিৎসা পাওয়া যেতো। এমতাবস্থায় সেটাও বন্ধ হলো। মানিকতলা ইএসআই যেহেতু উত্তরে অবস্থিত তাই সেই হাসপাতালের টাই-আপ মুলত উত্তর কলকাতার ডায়ালিসিস কেন্দ্রগুলির সঙ্গে। ফলতঃ বর্তমানে রোগীদের বেশিরভাগ অংশটাই তেঘরিয়া, লেকটাউন, উল্টোডাঙাতে অবস্থিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ডায়ালিসিস নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সুদুর তেঘরিয়া থেকে কাওকে ফিরে যেতে হচ্ছে রানীহাটি। আবার কাওকে উল্টোডাঙ্গা থেকে মগরাহাট রাত একটা কিংবা ভোর চারটে’তে। এবং তাদের বাইক-ই সম্বল। কিন্তু যাদের বাইক নেই বা যাদের বাসে কিংবা খেয়া পেরিয়ে চিকিৎসা নিতে আসতে হয় তারা এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছন।
আমার মায়ের সত্তর বছর বয়স। আগে কোনো দিন বাইকে সওয়ার হননি। বাধ্য হলেন চার ঘন্টা ডায়ালিসিস নেওয়ার পরে বাইকে চড়ে বাড়ি ফিরতে। সেটাও এখন দুরত্ব বেড়ে যাওয়ার জন্য সম্ভব হচ্ছে না। ফলতঃ সাধ্যের বাইরে গিয়েই গাড়ি ভাড়া করে মাকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। মাসে তেরোটা ডায়ালিসিস। খরচটা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এদিকে কাজ না থাকায় মাইনেপত্র ঠিকঠাক নেই। এক মানসিক যন্ত্রণা ও চরম অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্য দিন কাটাতে হচ্ছে। যারা আরও দূর থেকে চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরত্ব থেকে বাসে বা অটো রিক্সাতে আসতেন তারাও বড় গাড়ি ভাড়া করে অনেকটা বেশি ভাড়া দিয়ে আসছেন। অনেক রোগী বা তার পরিবার জানাচ্ছেন তাদের পক্ষে এতো খরচ সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই আমার মতো সপ্তাহে তিনটে ডায়ালিসিসের জায়গায় দুটো ডায়ালিসিস নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলতঃ রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকছে। ঠিকঠাক গাড়িও প্রয়োজনের সময়ে পাওয়া যাচ্ছেনা। অনেক পরীক্ষাকেন্দ্র বন্ধ থাকায় রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিন, ক্রিয়েটিনের পরিমাণ বোঝা যচ্ছে না। তার মাঝে কেন্দ্র পরিবর্তন হওয়াতে রক্তের সেরোলজি টেস্ট বাধ্যতামুলক হচ্ছে। যার খরচ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিশেষে ৮০০ টাকা থেকে ৪২০০ টাকা। অল্প বেতনের শ্রমিক কর্মাচারীরা যারা ইএসআই-তে চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের পক্ষে এই ব্যয় প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এটা একটু সরকার, প্রশাসন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বোঝার চেষ্টা করুন।
এমতাবস্থায় কয়েক দিন আগেই তিন জন ডায়ালিসিসের রোগী মারা গেলেন। যাদের দু’জনের নাম এখুনি জানা যাচ্ছে। একজন বিমল সিং, অপর জন বিশ্বনাথ সেনাটি। হলদিয়া থেকে আসা মানুষজনের খবর এখনও জানা যাচ্ছে না।
‘আইএফটিইউ’ নামের এক শ্রমিক সংগঠন শ্রম দপ্তরের কাছে এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ডেপুটেশান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের ধন্যবাদ। মূলধারার গণমাধ্যম এটা নিয়ে খবর করছে না। আমার অজানা অচেনা এই রকম মারন রোগে আক্রান্ত অসংখ্য রোগীদের কি অবস্থা জানতে পারছি না। তবে এই “লকডাউন” আর “সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং”র সময় মানুষ কীভাবে চিকিৎসা পাচ্ছেন কিছুটা অনুমান করাই যায়। আমি শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অসহায়তা আর উদ্বেগটুকু বুঝতে পারছি। যদি এই লেখা থেকে আমার মায়ের মতো চিকিৎসাধীন মানুষগুলি ও তাঁদের পরিবারগুলির অবস্থা কিছুটা সহানুভূতি ও তৎপরতার সঙ্গে দেখা হয় তাহলে অনেকগুলি প্রাণ এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারে।