পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চিকিৎসকদের অন্যতম প্রাচীন সংগঠন হেলথ সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন, ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর প্রাক্তন সম্পাদক ডাঃ হীরালাল কোনার জানালেন, পশ্চিমবঙ্গ ঠিক কোন্ জায়গায় করোনা মোকাবিলায় পিছিয়ে রয়েছে, প্রাথমিকভাবে কী সমস্যা ছিল, এখন আশু কী প্রয়োজন এবং সরকার ও প্রশাসনের কেন উচিত যাবতীয় তথ্য স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
প্র:- চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে করোনা মোকাবিলায় কী সমস্যা দেখা দিয়েছিল?
উ:- এ কথা সত্যি যে প্রথম দিকে এ রাজ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই, মাস্ক কিছুরই পর্যাপ্ত ‘স্টক’ ছিল না। শুধু রাজ্য নয়, কেন্দ্রের কাছেও ছিল না। তার কারণ রাজ্য, কেন্দ্র উভয়েরই এই বিষয়ে অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, ছিল না প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও। অবশ্যই বিশ্বের কোভিড ১৯ পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে অনেক আগেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। কতগুলি পিপিই, মাস্ক দরকার হবে সেই পরিসংখ্যান নিশ্চিতভাবেই সরকারের কাছে থাকা উচিত ছিল।
পরের ধাপে যখন এগুলির জোগান শুরু হল, দেখা গেল যে যত জিনিসের ‘অর্ডার’ হচ্ছে, তৈরি হয়ে আসছে তার মধ্যে খামতি রয়েছে। গুণগত মান ঠিক ছিল না। জুনিয়র বা সিনিয়র ডাক্তার কারওরই অভিজ্ঞতা ছিল না এই বিষয়ে। এই পিপিই কীভাবে পরতে হয়, খুলতে হয়, কীভাবে খুলে কোথায় রাখতে হয় তার সঠিক প্রশিক্ষণ বা ‘ড্রিল’ হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। যা আদপেই হয়নি। কীভাবে ও কাদের পড়তে হবে সে বিষয়ে আইসিএমআর-এর গাইডলাইন আছে, সেটা অনুসরণ করলেই বিষয়টা সহজ হয়ে যেত, এবং এই গাইডলাইন নিয়মিত আপডেট হচ্ছে। এমন নয় যে যাঁরাই হাসপাতালে ঢুকছেন, তাঁদের সবাইকে একই পিপিই পড়তে হবে, সব চিকিৎসক এই বিষয়টি জানতেনও না, যাঁদের যেমন প্রয়োজন তেমন পরতে হবে। সরাসরি করোনার চিকিৎসার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের একরকম (ফুল পিপিই), যাঁরা অন্য চিকিৎসায় যুক্ত তাঁদের অন্য ব্যবস্থা (যেমন মাস্ক, গ্লাভস), তাই সকলেরই সেই মতো ‘ড্রিল’ বা অনুশীলন হওয়া দরকার ছিল। এ বিষয়ে আইসিএমআর-এর নির্দেশাবলী মেনে চললেই হবে।
আর নিশ্চিতভাবেই এখনও আমাদের রাজ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পিপিই, মাস্ক ইত্যাদির চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব অনেকটাই রয়েছে।
প্র:- রাজ্য সরকারের কী উচিত ছিল না স্থানীয়ভাবে পিপিই, মাস্ক তৈরি করা?
উঃ- হ্যাঁ, অবশ্যই স্থানীয়ভাবে এই পিপিই, মাস্ক তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। স্থানীয়ভাবে এগুলি তৈরির কিছু উদ্যোগের কথা আমরাও শুনেছিলাম। যদি রাজ্য সরকার এ বিষয়ে যথাযথ কাজ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই কাজ হওয়া সম্ভব। তার জন্য সদিচ্ছা ও কার্যকরী পরিকল্পনা অবশ্যই থাকতে হবে।
প্র:- পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক স্তরে ঠিক কোন্ জায়গায় এই মোকাবিলায় সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করছেন?
উ:- আসলে সব তরফেই অনেক কিছু অজানা ছিল। মহামারির অভিজ্ঞতা সাম্প্রতিক অতীতে আমাদের কারওরই ছিল না। পূর্ব প্রস্তুতিও সেই কারণেই ছিল না। কিন্তু একবার যখন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েই গেছে তখন তো প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতেই হবে। সদর্থক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা যখন প্রথমদিকে খামতিগুলোর কথা বলতে শুরু করলাম, তখন কিন্তু মূলধারার সংবাদমাধ্যমও এই বিষয়গুলিকে তুলে ধরতে নারাজ ছিল, তাদের থেকে পূর্ণ সহযোগিতা আমরা পাইনি। মাস্ক, পিপিই-র প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাঁরা সেভাবে শুরুতে জানতেও চাইছিলেন না। এরপর যখন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল তখন সরকার, প্রশাসন যেন মনে করতে শুরু করলেন যে এগুলিতে কেবলই তাঁদের দোষ ধরা হবে, তাঁদের ব্যর্থতা বলে ধরা হবে। এগুলিতে যে ব্যর্থতা সেটা মেনে নিলে আমরা কিন্তু আদপেই দোষ ধরতাম না, কারণ দোষ কারওরই নয়। এহেন পরিস্থিতির সম্মুখীন সকলেই প্রথমবার হচ্ছে। সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও পাশে থাকাটাই কাম্য ছিল।
দেখুন একটা বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার, করোনা করোনার মতো করে ছড়াবে। কতটা ছড়াবে, কতজন সংক্রামিত হবেন কোনওটাই আমাদের হাতে নেই। এই লকডাউন, আইসোলেশন – এগুলোর উদ্দেশ্য হল যাতে একসঙ্গে অনেক লোক সংক্রামিত না হন, খুব খারাপভাবে যাতে রোগটা ছড়িয়ে না পড়ে। কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা আগে থেকে বলা মুশকিল। যদি আট, ন’মাসের জায়গায় তিন মাসে অনেক মানুষ সংক্রামিত হয়ে যান, তাহলে সামলানো মুশকিল হবে। সেইজন্য এই সংক্রমণের পর্যায়টাকে প্রলম্বিত করারই চেষ্টা করা যেতে পারে।
প্র:- এ রাজ্যের সরকার তথ্য গোপন করছেন এমন অভিযোগ উঠছে – তার ফলে কি সমস্যা হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
উ:- একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা জানাটা জরুরি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য। ভৌগোলিক ম্যাপিং প্রয়োজন, যে কোন্ অঞ্চলে কতটা ছড়াচ্ছে, কীভাবে কোথায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তা বোঝার জন্য। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই তথ্যগুলি না জানিয়ে অযথা আতঙ্ক তৈরি করা অনর্থক। বিশেষত যে চিকিৎসকেরা করোনা মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত তাঁদের কাছে তো অবশ্যই যাবতীয় তথ্য, পরিসংখ্যান সঠিকভাবে থাকতেই হবে।
অবশ্যই যত বেশি টেস্ট হবে, তত বেশি আক্রান্ত ধরা পড়বেন। রাজ্য সরকারের তো গোপন করার প্রয়োজন নেই, নিজেদের দোষ মনে করে। যত আক্রান্ত ধরা পড়বেন, সেই মতো দ্রুত চিকিৎসা করাও তো সম্ভব হবে। তাছাড়া এই যে বলা হচ্ছে যে ডায়াবেটিস বা হার্টের অসুখে মারা গেছেন, কোনও করোনা পজেটিভ রোগী – তিনি করোনায় মারা যাননি বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তিনি কো-মরবিড ডিজিজ-এর জন্য মারা গেছেন। এটাও ঠিক নয়। কারণ বৃদ্ধ ও অন্যান্য রোগাক্রান্তদের ঝুঁকি এই রোগে অনেক বেশি। এমনিই তাঁদের মৃত্যুর সম্ভাবনা যারা রোগাক্রান্ত নন, তাঁদের তুলনায় বেশি থাকে। সেইসঙ্গে করোনা-আক্রান্ত হলে তাঁরা আরও ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মৃত্যুর কারণ অবশ্যই করোনা, তা না হলে তাঁরা হয়তো রোগ নিয়েও আরও কিছুদিন বাঁচতেন। সুতরাং অন্য কোনও রোগে ভুগছেন এমন রোগী করোনাতে মারা গেলে, তিনি করোনায় মারা যাননি বলে তত্ত্ব খাড়া করা একদমই ঠিক নয় এবং তা চিকিৎসাবিজ্ঞানের চোখে মিথ্যা।
প্র:- এখন তাহলে কী করণীয়?
উ:- করোনা মোকাবিলায় পুরোটাই স্বচ্ছ, সুষ্ঠু প্রশাসনিক ‘ম্যানেজমেন্ট’-এর বিষয়। ধরা যাক, পাঁচ লক্ষ মানুষ সংক্রামিত হলেন, এই সংক্রমণ আটকানো পুরোপুরি আমাদের হাতে নেই, কিন্তু এই সংখ্যাটা যদি আমরা ৯ বা ১০ মাসে টেনে নিতে পারি, ২/৩ মাসের জায়গায় — তাহলে আমাদের পক্ষে চিকিৎসা করা সহজ হয়। এমনও নয় যে করোনা আক্রান্ত সকলেরই ভেন্টিলেটর প্রয়োজন। সেটা নির্ভর করে কার কতটা সংক্রমণ তার উপরে। এগুলো বোঝার জন্য তো অবশ্যই টেস্ট বাড়াতে হবে ও সঠিক পদ্ধতিতে যাতে তা দ্রুত হতে পারে সেদিকে দেখতে হবে। প্রয়োজন সঠিক ‘ডিটেকশন’ ও ‘আইডেন্টিফিকেশন’। আমাদের রাজ্যে এখনও তা যতটা বেশি সংখ্যায় হওয়া প্রয়োজন হচ্ছে না।
আমরা দাবি জানিয়েছি সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন যে তথ্যগুলি দিতে হবে তা হল:
- কত কিট পাঠানো হয়েছে
- কত জনের টেস্ট করা হয়েছে
- কত জন পজেটিভ এসেছেন
- কত জন নেগেটিভ এসেছেন
রাজ্য সরকারের সাইটে যেন প্রত্যেক দিন এগুলির বিষয়ে স্বচ্ছ তথ্য দেওয়া হয়। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়কেই এটা মেনে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে চিকিৎসকরা, স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এরপর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থতি কীভাবে সামলানো যাবে? এই যে রাজনীতিকরা এত চেঁচাচ্ছেন, তাঁরা আক্রান্ত হলে কে চিকিৎসা করবে? কোনও দলের প্রতি আমাদের চিকিৎসকদের কোনও অযথা প্রেম/বিদ্বেষ নেই। মানুষকে এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে বাঁচানোর জন্য আমাদের শুধু সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা করা হোক।
প্র:- অভিযোগ উঠছে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলিতেও যথাযথ নিয়মবিধি পালন হচ্ছে না।
উ:- কীভাবে টেস্ট করতে হবে, কীভাবে সংক্রমণ আটকাতে হবে আইসিএমআর-এর প্রোটোকল রয়েছে, এও বলা আছে কীভাবে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলিতে নিয়ম মানতে হবে। এবার প্রশাসনের দায়িত্ব তা যাতে মেনে চলা হয় তা নিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষকে যদি আসল তথ্য দিয়ে বোঝানো হয় যে, যত জনের টেস্ট হচ্ছে তাদের মধ্যে কত জন আক্রান্ত, কত জন সেরে উঠছেন, কত জন মারা যাচ্ছেন তাহলে তাদের অকারণ ভীতি কমবে। তাছাড়া মাসের পর মাস শুধু লকডাউন-ই চলল, চিকিৎসাব্যবস্থাতেও খামতি থাকল, মানুষ না খেতে পেয়ে মরল এটা তো কাজের কথা নয়। শহরে কিছু কিছু জায়গায় নজরদারি, টেস্ট শুরু হয়েছে, গ্রামেও আশাকর্মীদের দিয়ে এগুলি করাতে হবে। অবশ্যই তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে প্রস্তুত করে দিতে হবে।
প্র:- প্রশাসনিক বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে কমিউনিটি কিচেন বা ত্রাণের কাজ চলছে তাতেও তো স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি।
উ:- এই উদ্যোগগুলির পেছনে যে সদিচ্ছা তা কার্যকর হবে না যদি না যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের প্রাইমারি টেস্টিং করে, মাস্ক দিয়ে, স্যানিটাইজার দিয়ে কাজ করানো হয়। যাঁরা খাবার খেতে বা নিতে আসছেন তাঁদের নির্দিষ্ট দূরত্ব মেপে দাঁড়াতে হবে। তৈরি খাবার যাঁদের দেওয়া হচ্ছে তাঁদের সেইসঙ্গে সাবান/স্যানিটাইজার দিয়ে এটা বুঝিয়ে বলা যে খাবার আগে তা দিয়ে হাত ধুয়ে তবেই খেতে হবে – এটাও এখন জরুরি।