ঋণ শোধ না করতে পারলে ব্যাঙ্ক কিংবা সমবায় খরিফ কিংবা শীতকালীন সব্জি চাষের জন্য ঋণ দেবে না। শোধ না করতে পারলে সুদে–আসলে অর্থদণ্ড বেড়েই চলবে। আগামী মরসুমে চাষই করতে পারবেন না বহু কৃষক, একরকম ঘোষণাই করে দিলেন এক কৃষক–রত্ন। রাজ্যের চাষিদের ঘরের খবর নিলেন দেবাশিস আইচ।
নির্মল মান্ডির মোট জমি ছ’বিঘা। পুরুলিয়ার বান্দোয়ান ব্লকের প্রত্যন্ত শালডির বাসিন্দা তিনি। গ্রামে ১০০-১১৫টি প্রধানত সাঁওতাল পরিবারের বাস। সকলেই কিছু চাষবাস করেন। নির্মল ২ বিঘায় টমাটো, ২ বিঘায় করলা আর দু’বিঘায় লাউ চাষ করেছেন। টমাটোয় খরচ (বীজ — ১০ গ্রাম ৭০০ টাকা, গোবর, সার, কীটনাশক, সেচ, লেবার) সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। করলায় খরচ হয়েছে ৭-৮ হাজার টাকা। মাচা করলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু, তার জন্য খরচ হয় অনেক অনেক বেশি। প্রান্তিক চাষিদের করলা মাটিতেই লোটায়। করোনা প্রায় পুরোপুরিই লুটিয়ে ছেড়েছে। আড়ত বন্ধ। বাজার বন্ধ। গ্রামের বাইরে বেরনোও বন্ধ। নির্মল ১০ শতাংশ হারে ঋণ নিয়েছেন মহাজনের কাছ থেকে। এই ঋণ শোধ করতে পারবেন কি না জানা নেই। এখন তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। বর্ষায় আমনের সময় নামালে যাবেন। ধান রুইতে। জোড় বাঁধের কারণে জল মিলেছিল বলে চাষ করেছেন। কিন্তু জেলার বৃষ্টির উপর ভরসা নেই যে, তাই নামালই সই।
বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লকের উষরডিহি-সহ সব গ্রামেই একই অবস্থা। চাষি ৪ টাকা কেজি দরে শশা বিক্রি করছেন। কপি, বেগুন টমাটো জমিতেই নষ্ট হচ্ছে। আট-দশ হাজার টাকা খরচ করে করলা, শসা, ভেন্ডির চাষ করেছেন সুনীল মান্ডি। কতটুকুই বা চাষ? শ’চারেক করলা আর শ’চারেক শসা গাছ রয়েছে তার জমিতে। ২০০ ভেন্ডি। এভাবেই হিসেব করেন প্রান্তিক চাষি। পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে দৈনিক ৪৫ কেজি করলা, ৬০ কেজি শসা ঝাঁটিপাহাড়ির আড়তে বিক্রি করতে পারতেন। বাদল মুর্মুর জমিতে ৪০০ বেগুন, ৩০০ করলা আর ৮০০ শসা গাছ রয়েছে। তাঁর হিসেবে অনুযায়ী খরচ হয়েছে ১৭ হাজার টাকা। অথচ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, খাদ্যশস্য, ওষুধ পরিবহনের মতো সব্জিতেও কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য, মাছ, সব্জি গুদামজাত, আড়তজাত, বাজারজাত হয়েছে। আবার এমন হাজার হাজার চাষির ফসল স্রেফ জমিতে পড়ে পড়ে নষ্ট হল। কেননা মাঠ থেকে খুচরো বাজারে আনার শৃঙ্খলটি — চাষি-গ্রামের ভেন্ডার-শহরের বড় ভেন্ডার-কমিশন এজেন্ট-পাইকার-খুচরো ব্যবসায়ী — ভেঙে পড়ল যে। এই অশুভ শৃঙ্খলটি চাষিকে পয়সা দেয় না। খুচরো ক্রেতার পকেট মারে। মাঝখান দিয়ে লাভ ফড়ে আর দালালদের। তবুও, প্রান্তিক জেলার অপ্রস্তুত প্রশাসন সক্রিয়তা দেখাতে পারল না। গ্রামের ঘরে ঘরে যদি সরাসরি বিক্রি করতে পারতেন চাষিরা তাহলে না হয় এ যাত্রা কিছুটা রক্ষা পাওয়া যেত। সেই সুযোগটি পেলেন না ওঁদের অনেকেই। আর এই ব্যবস্থার মূল্য চোকাতে হল চাষি আর সাধারণ ক্রেতাকে। বাঁকুড়ার এই তথ্যগুলি জানা গিয়েছে মানবাধিকার কর্মী দেবব্রত গোস্বামীর সৌজন্যে।
মুর্শিদাবাদের মৌসুমি বিশ্বাস কৃষক-রত্ন। নিজে হাতে শুধু চাষ করেন না, অন্য চাষিদেরও উন্নত চাষের বীজমন্ত্র দিয়ে থাকেন। বহরমপুর ব্লকের ছাগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের চাষির আর চাষবাসের হালহকিকতও তাঁর নখদর্পণে। এই পঞ্চায়েত এলাকায় ১৫ হাজার মানুষের বাস। প্রায় ৮০০০ জন কৃষিকাজে যুক্ত। কেউ সব্জি চাষ করেছেন তো কারও রয়েছে আম-লিচুর বাগান। কলা ও পেঁপে চাষ তো রয়েইছে তার পাশাপাশি অনেকেরই রয়েছে পানের বরোজ। সব্জি, পান, কলা, পেঁপে তাঁরা যেমন খোলা বাজারে নিয়ে যেতেন তেমনি সব্জি মান্ডিতেও। পাইকাররা গাড়ি ভর্তি করে কিনে নিয়ে যেত। লকডাউনের ধাক্কায় মাঠের ফসল মাঠেই পড়ে থাকছে কিংবা বিকোচ্ছে জলের দরে। খুচরো বাজারে অবশ্য বিক্রি হচ্ছে আগুন দামে। এছাড়াও গোয়ালাদের অবস্থাও করুণ। দুধ স্রেফ ফেলা যাচ্ছে। আমূল, ভাগীরথীর মতো সমবায়গুলিই দুধ নিচ্ছে না। বিকোচ্ছে না মিষ্টির দোকানেও।
মুখে মুখে হিসেব দিচ্ছিলেন মৌসুমি। পাঁচ কাঠায় বেগুন চাষ করলে খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। ঠিকঠাক বিক্রিবাটা হলে চাষির ঘরে আসে ৩০-৪০ হাজার। অবশ্যই নিট লাভ নয়। এর থেকে ব্যাঙ্ক, সমবায় কিংবা মহাজনের ঋণ শোধের গল্প রয়েছে। আম-লিচুর এখনও সময় আছে। কিন্তু কলা, পেঁপে? যে চাষি কলা চাষ করেন বিঘা প্রতি তাঁর খরচ ২০-২২ হাজার টাকা। একবার কলার বাগান করলে তিন বছর ফসল দেয়। প্রথম বছর যদি ২০-২২ হাজার টাকা খরচ হয় তবে ভালো বিক্রিবাটা হলে আয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বছরে খরচ অর্ধেক হয় বটে আয় হয় ৩৫-৪০ হাজার টাকা। তৃতীয় বছরে খরচ ৫-৭ হাজার হলে আয় কমে দাঁড়ায় বিশ হাজারে।
পান চাষিদের অবস্থাও সঙ্গীন। পান বারো মাসের ফসল। বরোজ তৈরি করে চাষ শুরু করতে বড় ধরনের খরচ রয়েছে ১০ কাঠায় প্রায় দেড় লাখ টাকা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না-হলে একটি বরোজ টিকে যায় ৪০-৫০ বছর। বাৎসরিক খরচ পড়ে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। বছরে ১০ কাঠা থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় হয়। কিন্তু কৃষিপণ্যের দাম বাড়ে না। দাম বাড়ে বীজের, সেচের, সার, কীটনাশকের। ২১ এপ্রিল রানিনগর ১ ব্লকের ইসলামপুর পাইকারি বাজারে পটল বিক্রি হয়েছে ৬ টাকা কেজি, টমাটো ২ টাকা এবং ঢেঁড়স ৫ টাকা। যে কলা, ৯০-১০০ দিনে পাকে, সেই কলা ভিটামিন দিয়ে কিংবা ওষুধ স্প্রে করতে করতে ৬০-৬৫ দিনেই বাজার জাত করে চাষি। পুরুষ্ট, চকচকে কিন্ত বিষ ভরা সেই ফল, জানালেন এক কৃষক। এর পিছনে বাজারের চাপও রয়েছে। চুক্তিচাষ আর ঝকঝকে মলের চকচকে ফল-সবজি ওষুধ, রাসায়নিকের অপপ্রয়োগকে কি উৎসাহিত করছে? সে আর এক সমীক্ষার বিষয়।
এদিকে চাষির ক্রনিক অসুখ হল ঋণের বোঝা। মহাজনের সুদ মেটাতে হয় ১০ শতাংশ হারে। যাঁদের কেসিসি বা কৃষাণ ক্রেডিট কার্ড রয়েছে তাঁদের ব্যাঙ্ক বা সমবায় থেকে ঋণ মেলে। অধিকাংশেরই কেসিসি নেই। সাধারণত প্রান্তিক বা ছোট চাষিরা ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেন। ১ লাখ টাকাও ঋণ নেন বড় চাষিরা। ছ’মাস আগে ঋণ নিয়েছেন যাঁরা আর ফসল বেচে শোধ করবেন — তাঁদের সমূহ সর্বনাশ। ঋণ শোধ না করতে পারলে ব্যাঙ্ক কিংবা সমবায় খরিফ কিংবা শীতকালীন সব্জি চাষের জন্য ঋণ দেবে না। শোধ না করতে পারলে সুদে-আসলে অর্থদণ্ড বেড়েই চলবে। আগামী মরসুমে চাষই করতে পারবেন না বহু কৃষক, একরকম ঘোষণাই করে দিলেন কৃষক-রত্ন উপাধি ভূষিত মৌসুমি বিশ্বাস। যদি ঋণ একটি পর্যায় পর্যন্ত মকুব করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার? সে কি নেবে? সংশয়ে তিনি। ফসল বিমাতে আরও ভরসা নেই। ওতে লাভ বিমা কোম্পানির, চাষিরা কিস্যু পায় না। পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন তিনি। তবে উপায়? প্রান্তিক চাষিদের যদি ১০০ দিনের কাজ দেওয়া যায় তবে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে তাঁরা। সরকারের কাছে তাঁর আশু দাবিটাও তাই।
কলকাতা, বিধাননগর, নিউটাউনের বিস্তীর্ণ এলাকায় সব্জি আসে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙর এলাকা থেকে। ভাঙর-২ ব্লকের পোলেরহাট এই অঞ্চলের সব্জির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। খুচরো ব্যবসায়ীরাও এখানে আসেন। সপ্তাহে দু’দিন মধ্যরাতের পর থেকে সকাল পর্যন্ত হাট বসে। হঠাৎ লকডাউন ঘোষণায় প্রভাব পড়ে হাটের উপর। যদিও কৃষি ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন কিংবা বেচাকেনায় কোনও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কিন্তু, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান ব্যবহারের সাবধান বাণী ছিল। ভাঙরের খামারাইট কাশীপুরের জমি আন্দোলনের নেতা ও কৃষক মোশারেফ হোসেন জানান, লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে চাষিদের উপর তো বটে শহরের বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সেই প্রভাব কাটার লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি। চাষি যে দামে সব্জি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন শহর সেই সব্জি পাঁচ-সাত গুণ দামে কিনছে।
বাজারে কিংবা হাটে যেতে না-পেরে বহু চাষিকেই দেখা গিয়েছে অর্ধেক দামে খুচরো কিংবা পাইকারকে সব্জি বিক্রি করতে। বহু চাষিকেই দেখা গিয়েছে সাইকেল কিংবা ভ্যান রিকশায় বেগুন, চিচিঙ্গা, বরবটি, ঝিঙে, উচ্ছে, করলা, ক্যাপসিকাম নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঢের কম দামে বিক্রি করতে। সাধারণ সময়ে চাষি স্থানীয় বাজারে সকালে বিক্রি না হলে সন্ধ্যার খদ্দেরের আশায় অপেক্ষা করতেন। এই সময়ে বাজারের বিক্রিবাটার সময় নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় কম দামে ফসল ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। লকডাউন দীর্ঘায়ত হওয়ায় গ্রামের কর্মহীন রাজমিস্ত্রি, ছুতোর কিংবা নির্মাণ শ্রমিকদের অনেকেই সব্জির খুচরো ব্যবসায় নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ অবশ্য কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলেই দেখা যাচ্ছে। অটো বা টোটো রিকশার চালক, দোকান কিংবা মলের কর্মচারীদেরও সব্জি বিক্রেতা হয়ে উঠছেন। এর ফলে চাষি কিছুটা হলেও উপকৃত হচ্ছেন বলে মনে করছেন মোশারেফ।
মোশারেফ জানান, ভাঙরের ৯০ শতাংশ প্রান্তিক চাষি। এঁদের কেউ জমি বন্ধক নিয়ে চাষ করেন, কেউ লিজে চাষ করেন, কেউ-বা ভাগচাষি। ভাগচাষিদের ফসলের অর্ধেক কিংবা তার বেশি জমির মালিককে দিতে হয়। বছরে এক বা দুটো চাষের কড়ারে বছরে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায় লিজ নেন অনেক চাষি। আবার দু’বছরের জন্য বিঘা প্রতি ৫০ কিংবা এক লক্ষ টাকায় জমি বন্ধক নেন অনেকেই। মোশারেফ জানান, সব্জি যেমন সারা বছর হয় তেমনি একই জমিতে একই সময়ে দু’তিন রকম সব্জি চাষ করা যায়। এবং অপেক্ষাকৃত লাভজনক। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে চাষিরা বিপর্যস্ত। পরবর্তী মরসুমে অর্থাৎ শীতকালীন সব্জি চাষে এই করোনাজনিত লকডাউনের ধাক্কার কুফল দেখা দেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। চাষিরা শীতকালীন সব্জি চাষ না করতে পারলে সঙ্কট আরও গভীর হবে।
নদিয়া জেলায় সব্জি চাষ কিংবা কেনাবেচা নিয়ে কোনও সঙ্কট নেই বলেই জানালেন জেলার উপ কৃষি অধিকর্তা রঞ্জন রায়চৌধুরী। তিনি জানান, চাষিরা ফসল বাজারে আনতে বাধা পাননি কিংবা পাইকারি হাট ও বাজারগুলিতে বেচাকেনা হয়েছে। শুধু যাঁরা লোকাল ট্রেনে করে সব্জি শহরে নিয়ে যেতেন তাঁরা অসুবিধায় পড়েছেন। সংখ্যাটি কম নয়। ভোরের ট্রেন ভর্তি সব্জি। দৈনিক চার-চারটি ট্রেন ভরা ছানা। লকডাউনের প্রভাবে শহরে পৌঁছয়নি। নদিয়ার কৃষ্ণনগর-২ ব্লকের ধুবুলিয়া বাজারের উপর নির্ভরশীল ৬৫টি গ্রামের মানুষ। এখানে সব্জি বেচাকেনা একরকম নিয়মিত হয়েছে বলেই জানা গিয়েছে। আবার গ্রামের মুদি দোকানিরাও ভ্যান রিকশা, টোটো চেপে এসে চাষিদের কাছ থেকে পুঁই, পাট শাক, পটল, ভেন্ডি, পেঁয়াজ পাইকারি দরে কিনে বিক্রি করছেন। দাম সামান্য বেশি। ১২ টাকার পটল ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজ্যে মে মাস থেকে পুরোদমে বোরো ধান তোলা হবে। লকডাউনে কৃষি মজুরদের উপস্থিতি অনিশ্চিত। তার প্রভাব যেন ধানকাটায় না পড়ে সেই জন্য ব্যাপক হারে যন্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। ধান কাটা, ঝাড়া, গোলাজাত করার জন্য ঝাড়খণ্ড, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে বর্ধমানে আসেন। রাজ্যের সর্ববৃহৎ শস্যভাণ্ডার পূর্ব বর্ধমানে ২১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। নদিয়া জেলার বোরো চাষ হয়েছে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে। নদিয়ার সহ কৃষি অধিকর্তা জানান, পঞ্চাশ শতাংশ জমিতে ধান কাটা, ঝাড়াই হারভেস্টার দিয়েই হয়। বাকিটা মজুররা করেন। এ বছর লেবারের সমস্যা রয়েছে ফলে মেশিনের ব্যবহার বাড়তে পারে। তবে, যাঁরা বংশ পরম্পরায় আসা মুনিষদের দিয়ে কাজ করান তাদের অনেকেই তাই করবেন। তবে জেলার এত জমিতে হারভেস্টার ব্যবহারের কথা মানতে রাজি নন সাহিত্যিক এবং জমির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ধুবুলিয়ার নতুন ন’পাড়ার বাসিন্দা আনসারউদ্দিন। তাঁর মতে, অনেক চাষিই এখনও পর্যন্ত মেশিনের সঙ্গে নিজেদের রপ্ত করতে পারেননি। মেশিনে ধানের পোয়াল বা বিচালি মেলে না। অথচ গরু-বাছুরদের খাবার জন্য বিচালি প্রয়োজন। ঘর ছাইতেও প্রয়োজন কমে এলেও রয়ে গিয়েছে। আর জেলায় হারভেস্টার এখনও কমই।
রাজ্য কৃষি দপ্তরের সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যে তিন হাজার কম্বাইন হারভেস্টার রয়েছে। একটি হারভেস্টার ঘণ্টায় এক বিঘা জমির ধান কেটে, ঝেড়ে তুলে দিতে পারে। মেশিন পিছু প্রয়োজন হয় তিন জন কর্মীর। হারভেস্টার ভাড়ার খরচ ঘণ্টায় ৮০০ টাকা। অন্যদিকে, বিঘাপ্রতি কাটা-আঁটি বাঁধা-ঝাড়াইয়ের জন্য কৃষি মজুর লাগে গড়ে ১২ জন। কাটার মজুরি জনপ্রতি ২০০ টাকা ও ২ কেজি চাল। কাটার খরচ ২৪০০ টাকা। আবার মাঠ থেকে ধান নিয়ে যাওয়ার ট্রলি ভাড়াও রয়েছে। কোথাও কোথাও তা কম দূরত্ব হলে ৫০০ টাকা। কিন্তু, হারভেস্টার ভাড়া কিংবা কৃষি শ্রমিকের মজুরি সর্বত্র এক নয়। কৃষ্ণনগর ব্লকে বিঘা প্রতি ভাড়া পড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আবার যেখানে ধানের পাশাপাশি পাট চাষ শুরু হয়েছে সেখানে মজুরের সঙ্কট রয়েছে। একদিকে ধান কাটতে হবে, যা মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হবে আবার অন্যদিকে নিড়ানির জন্য পাট খেতেও মজুর চাই। ফলে ধান কাটার মজুরি বেড়ে দাঁড়ায় বিঘা প্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। মজুরের সঙ্কট অনেকটা মিটিয়েছেন ভিন রাজ্য থেকে দলে দলে ফিরে আসা শ্রমিকেরা। কৃষির সঙ্কট একদিন যাঁদের ঘরছাড়া করেছিল।
রাজ্যে যা হারভেস্টার রয়েছে তা দিয়ে প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ ধান তুলে ফেলা সম্ভব বলে মনে করেন আধিকারিকরা। চিরাচরিত ক্ষেতমজুরদের, নামালে যাওয়া শ্রমিকদের প্রবল কর্মহীনতার এই দু:সময়ে হারভেস্টারে অতিরিক্ত উৎসাহ পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে তুলতে পারে। ইতিমধ্যেই কৃষিতে মেকানাইজেশন বহু কৃষি শ্রমিককে পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত করেছে। তাঁরাও আজ কর্মহীন। এই দিকটি এই আপৎকালে ভেবে দেখা জরুরি বলে মনে করেন অনেকেই। ধান তুলতেই হবে, দেখতে হবে কৃষক যেন অভাবী বিক্রি না করেন ২০১৮ সালে যা সাফল্যের সঙ্গে করেছে রাজ্য সরকার। আবার কাজ দিতে হবে অর্থনীতির সর্বনিম্নস্তরের মানুষের হাতেও। এ যেন সঙ্কটের সাঁড়াশি আক্রমণ কিংবা শাঁখের করাত।
দেশেরও অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়। একেই বেকারত্বের হার বিগত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালে দেশের অর্থনীতি থেকে, বিশেষ ভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে ১১ মিলিয়ন কাজ স্রেফ উবে গিয়েছে। এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিক ও কর্মী কাজ করেন। এদিকে কোভিড -১৯ এর প্রভাবে সাড়ে ১৮ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন বলে অর্থনীতিবিদদের অনুমান। ইতিমধ্যে ছোট আইটি সংস্থা থেকে মল কিংবা দোকান কর্মচারীরা, ছোট ব্যবসায়ী থেকে প্রান্তিক চাষি, দুধ ব্যবসায়ী থেকে মৎস্যজীবী, পরিবহন শ্রমিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শ্রমিক-মালিক থেকে অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক সকলেই বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন।
কৃষিক্ষেত্রে সব দলিত চাষিদের ৭১.৩ শতাংশ মজুরি শ্রমিক, ৪৫ শতাংশ দলিত পরিবারই ভূমিহীন। আদিবাসীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ৪৪.৭ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। তাঁদের মাসিক পারিবারিক আয় ৮১৬ টাকা (ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ২০১১)। অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ২০১৪ সালে মাসিক ১৩,৩০০ থেকে কমে ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১০,৩০০ টাকায়। এই পরিস্থিতির জন্য প্রথম ও প্রধান অপরাধী কেন্দ্রীয় সরকার। তাদের চূড়ান্ত আর্থিক ও সামাজিক নীতিহীনতার ফলে মোদী জমানার চতুর্থ বছরে, অর্থাৎ, ২০১৮ সালে দেশের ১ শতাংশ ধনীর সিন্দুকে পুঞ্জিভূত হয়েছে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ। ২০১৬ সালে যে সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫৮.৪ শতাংশ। অন্যদিকে, দরিদ্রতমদের সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। অন্ধকার আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
নির্মাণ শিল্পে কবে ফিরবেন পরিযায়ী শ্রমিকরা তা অনিশ্চিত। তাঁরা চূড়ান্ত অপমান, নির্যাতন, ক্ষুধার প্রকোপ সহ্য করে চলেছেন। সামাজিক ভাবে তো বটেই স্বজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যে ভয়াবহ মানসিক ও শারীরিক আঘাতের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন — লকডাউন ওঠার পর মানসিক ভাবে সুস্থ ও শারীরিক ভাবে কর্মক্ষম হয়ে উঠতেও তো তাঁদের সময় চাই। শুশ্রূষা চাই। কে দেবে সেই সময়? শুশ্রূষার অবকাশ? মালিকরা চান না শ্রমিকরা আবার ঘরে ফিরে যাক। ফিরলেও দেশ জুড়ে সামাজিক দূরত্বের নামে যে সামাজিক কলঙ্ক ও সন্দেহ প্রবণতার চাষ করা হয়েছে তাও এই বিপন্ন মানুষদের দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এই মানুষদেরই নিয়ে চিন্তিত গৈ-গেরামের পাঁচালি কিংবা গো-রাখালের কথকতার মতো গ্রন্থের লেখক আনসারউদ্দিন। যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁরা আদৌ আবার ফিরে যাবেন কি না তা নিয়ে সংশয়ে তিনি। ফিরলেও ক’জনেরই-বা কাজ থাকবে চিন্তা তা নিয়েও। শুধু তাই নয় মাটির মানুষ, রাখাল থেকে লেখক হয়ে ওঠা আনসারউদ্দিনের মন ভারী হয়ে যায় মানুষের সন্দেহপ্রবণতায়। আমাদের তো সন্দেহপ্রবণ মন দূরে দূরে থাকি। এখন আড়চোখে একে অন্যের দিকে তাকাই। সকলেই লক্ষ্য রাখছে কে কোন অস্ত্র বহন করছে। কার কাছে আছে জীবাণু অস্ত্র! টেলিফোনের ওপার থেকে ভেসে এল এক দরদি, মরমি মনের দীর্ঘশ্বাস।
ছবি: উষরডিহি, বাঁকুড়া। দেবব্রত গোস্বামী।
লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।
groundxero.in is working very good, essential journalism…true journalism…i’ve been sharing groundxero.in to all my friends and known people…it is very rare to see such online-news-portal in bengali…sorry, i’m not writing using bengali fonts..hope that will not hurt anyone’s sentiments.. once again, kudos to groundxero.in..jai bhim jai birsa