যে সরকার অভুক্ত মানুষকে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে দিতে পারে না অথচ তার মুখের খাদ্য কেড়ে নিয়ে চাল থেকে স্যানিটাইজার তৈরির প্রধান উপাদান ইথানল তৈরির ছাড়পত্র দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে পারে — এ রাজ্য তো বটেই কোনও রাজ্যেরই ব্যর্থতার সমালোচনা করার কোনও নৈতিক অধিকার তার নেই। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। অমিত শাহ, যার কার্যকলাপ কালাপাহাড়কেও লজ্জা দেবে, বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একের পর এক স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ করে চলেছেন। জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী-সহ সিএএ-এনপিআর-এনআরসি বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, বাড়ি ফিরতে চাওয়া লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে অবর্ণনীয় পরিস্থিতিতে বন্দি করে রাখা অথচ নিজের ক্ষমতা খাটিয়ে গুজরাতি তীর্থযাত্রীদের ২৮টি এসি বাসে করে হরিদ্বার থেকে গুজরাতে ফিরিয়ে আনা, (একই ভাবে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার লকডাউনের মধ্যেই ২৫০টি বাসে করে রাজস্থানের কোটায় আবাসিক কোচিং সেন্টারে পড়তে যাওয়া ছাত্রদের ফিরিয়ে এনেছে।) অন্যদিকে, আদালতের রায়ের অছিলায় অধ্যাপক ও দলিত মেধাজীবী আনন্দ তেলতুম্বে ও সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী গৌতম নাভালখাকে গ্রেপ্তার — তার শাহি রাষ্ট্র ব্যবস্থার চূড়ান্ত নিদর্শন। সাম্প্রতিক তম উদাহরণ জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র নেতা উমর খালিদ, জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মীরন হায়দার ও সফুরা জারগর এবং কাশ্মীরের তিন সাংবাদিক মাশরাত জাহরা, পিরজাদা আশিক ও গওহর গিলানিকে ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করা।
দেশের সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী রাজের সফল রসায়নাগার হল গুজরাত। সেদিকে তাকালে দেখব সুরাতে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন ও গ্রেপ্তার থেকে শ্রমিকদের ১২ ঘণ্টা কাজে বাধ্য করা এবং ট্রেড ইউনিয়নকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাই এই সরকারের এক ও একমাত্র লক্ষ্য। এভাবেই চরম পুলিশি রাজ্য হয়ে উঠেছে বিজেপি শাসিত মণিপুর, আসাম, উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক। দিল্লিতে নামেই আপ-শাসন। মোদী-শাহের তল্পিবাহক হয়ে উঠেছে আপ সরকার।
এই পটভূমিকায় দেখতে হবে অতি গোপনীয়তায় এবং আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তায় মোড়া কেন্দ্রীয় আমলাদের রাজ্য অভিযান। যার শুরু হয়েছিল কেন্দ্রীয় আমলাদের পাঠানো একাধিক চিঠির মাধ্যমে। যা আসলে এই অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এই চিঠিগুলিতে কলকাতা ও রাজ্যে বিশেষ করে মুসলমান প্রধান এলাকা ও জেলাগুলিতে লকডাউন ব্যবস্থার গাফিলতির উল্লেখ আসলে রাজ্য সরকার এবং সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টির প্রয়াস। যা সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিদ্বেষ সৃষ্টির আরএসএস/বিজেপি’র রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। লক্ষ্য আগামী নির্বাচন। তবলিঘ জামাতকে গোদি মিডিয়ার একপেশে আক্রমণও আসলে এই একই ষড়যন্ত্রের অঙ্গ।
রাজ্য সরকারের চিকিৎসা থেকে রেশন বণ্টনে ব্যর্থতা রয়েছে। বিরোধী জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বিজেপি সাংসদদের ত্রাণকাজে প্রশাসনিক বাধা দান অন্যায়। অন্যায় প্রতিবাদী বামনেতাদের গ্রেপ্তার করে লালবাজারে চালান করা। এর সঙ্গে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দেশে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। ২oo১ সালের জনসুমারি অনুযায়ী এ রাজ্যের জনসংখ্যা ৯১,২৭৬,১১৫ জন। রাজ্যের আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গ কিলোমিটার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ১,০২৯ জন। এই জনসংকুল, বিপুল পরিমাণ দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের রাজ্যে সার্থক সামাজিক দূরত্ব ও স্যানিটাইজার, সাবানে বার বার হাত ধোয়া এবং নিশ্ছিদ্র লকডাউনের কথা ব্যালকনি-নন্দিত বাবু-বিবি, ঘোড়ায় চড়ে গ্রাম পরিদর্শন করা বিপ্লবী, মুর্খের পাণ্ডিত্য প্রদর্শন যাদের পেশা সেই একশ্রেণির সাংবাদিককুল এবং পণ্ডিতম্মন্য অধ্যাপকদের পক্ষেই ভাবা সম্ভব। যে শাহি সরকারের চিকিৎসা খাতে ব্যয় জিডিপি’র ১.২৮ শতাংশ; যে সরকার করোনা পরীক্ষার ত্রুটিপূর্ণ কিট সরবরাহ করে, আবার চোরের মায়ের বড় গলার মতো নাইসেডের আধিকারিককে দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করায়; যে কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী রাজ্যের চাহিদার ন’লক্ষ মেট্রিক টন চালের মধ্যে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ০.১৪ লক্ষ মেট্রিক টন চাল পাঠিয়েছে, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। যে সরকার অভুক্ত মানুষকে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে দিতে পারে না অথচ তার মুখের খাদ্য কেড়ে নিয়ে চাল থেকে স্যানিটাইজার তৈরির প্রধান উপাদান ইথানল তৈরির ছাড়পত্র দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে পারে — তার আর যাই হোক, করোনা মোকাবিলায় — এ রাজ্য তো বটেই কোনও রাজ্যেরই ব্যর্থতার সমালোচনা করার কোনও নৈতিক অধিকার নেই।
যে অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীরা একের পর এক মৃত্যু ও দেশজুড়ে মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মধ্যপ্রদেশে ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি করতে পারে এবং নির্বাচিত সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করে এবং কাজ হাসিলের পর মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে ১৩৮ কোটি মানুষের দেশকে গৃহবন্দি করে ফেলতে পারে, বিন্দুমাত্র প্রস্তুতির সুযোগ, কোনও আলাপ-আলোচনা, পরামর্শের সুযোগ না দিয়ে কেড়ে নিতে পারে তাদের রুজিরুটি, ছুড়ে ফেলে দিতে পারে পথে — তাদের কোনও পদক্ষেপই সৎ, স্বচ্ছ এবং সাধারণ মানুষের হিতের জন্য হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় আমলাদের বকলমে এই শাহি অভিযান, এই বর্গী অনুপ্রবেশকে এই চোখেই দেখতে হবে। বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের সুযোগ নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি ও সংবিধানকে একরকম মৃতবৎ করে তোলা কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাচারীতার আর এক নিদর্শন।
এই অভিযান কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী নীতির এক নির্লজ্জ নমুনা। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায়, কেন্দ্র স্রেফ ক্ষমতার জোরে, মর্জিমাফিক, কোনও রাজ্যে তার আমলা বাহিনীকে এভাবে লেলিয়ে দিতে পারে না। এ শুধুমাত্র সেই রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে হেয়, অপমান বা অসম্মান করা নয় — রাজ্যের মানুষকেও অপমান ও অসম্মান করা।
লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।
A team that arrives from severely affected Delhi are not quarantied. Is there any guarantee they are not asymptomatic carriers?