করোনার জেরে বিপর্যস্ত ভারতের অর্থনীতি। সবচেয়ে বড় আঘাত যদি হেনে থাকে কোথাও তবে তা অসংগঠিত শ্রমিক মহল্লায়, কারিগর, প্রান্তিক চাষি, খেতমজুর, দিন আনা দিন খাওয়া জীবনে, জীবিকায়। শ্রমিক–মজুর–কারিগর বললেই সংসারের রোজগেরে পুরুষদের কথাই মনে হয় আমাদের। জিনাত রেহেনা ইসলাম সেখানেই মেয়েদের খোঁজ পেয়ে যান। মুর্শিদাবাদের এমনই মেয়েদের কথা তাঁর ব্লগে লিখে চলেছেন জিনাত। ‘হ্যাশট্যাগ উইমেন ইন লকডাউন‘ শিরোনামে। লকডাউনের জেরে যাঁদের অনেকেরই এখন আধপেটা, আটাগোলা, শাকপাতা সেদ্ধ জীবন। জিনাতের লেখার জেরে পেট ভরা খাবার জুটেছে কারো কারো। তাঁর অনুমতি নিয়ে গ্রাউন্ডজিরো সেই মেয়েদের কথা পুনঃপ্রকাশ করল।
সিনাপতি হেমব্রম
বাড়ির চালের উপর হাঁড়ি তোলা কেন? সিনাপতি একগাল হেসে বলে, “আজ চাল নাই ,রান্না হবে না! মা কালই হাঁড়ি ধুয়ে বলেছে চাল শেষ।” সিনাপতির মা মাথা নিচু করে বলে, “না, চাল হাঁড়িতে একটু আছে, রোগ এসেছে তো, সবারই অভাব চলছে। বেলা শেষ হতে হতেই জোগাড় হয়ে যাবে কিছু।” সিনাপতি বলে, কাল রাতে শুধু শাক সেদ্ধ দিয়েছে নুন দিয়ে। সিনাপতির মা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, হাঁসের ডিম দিয়ে ভাত খাবে বায়না করছে। এখন কি আর জোগাড় করা যায়!” খাবারের টান। একথা বাইরে বলতে সিনাপতির মা যে অস্বস্তি বোধ করছে তা স্পষ্ট। দারিদ্রেরও একটা অহংকার আছে হয়তো। সরকারের দানের ফিরিস্তির বিজ্ঞাপন এদের কাছে নেই। সারাবছর প্রতিদিন খেতে না পাওয়াটাই এদের কপাল বলে স্বীকার করে নিয়েছে হেমব্রম পরিবার।
বাইশ বছরের সিনাপতি কখনও স্কুলে যায়নি। শারীরিক সক্ষমতা না থাকায় বাড়ির বাইরে তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে যায়। সেনাপতি লকডাউনে কী করছে? জানতে চাইলে বলে, “বনধের সময় বসে আছি। আমার এমনিতে কোথাও যাওয়া হয়না এখন সকলেই যেতে পারছে না। আমার কষ্টটা ভালো করে সবাই বুঝছে।” সিনাপতির মা আঁচলে চোখ মুছে বলে, “গরিব মানুষ আমরা। গেল মাসে চাষের মাঠে একবার কাজ পেয়েছিলাম। এখন তো কাজের কোনও আশা নেই। মেয়েটার লেখা-পড়া হয়নি। আবার বিয়েও হবে না। পেটে না খেলে তো লোক জানতে পারে না! বিয়ে দিতে না পারলে তো বিপদে পড়ে যাব।” চাল বা আলু কি পেয়েছেন? জিজ্ঞাসা করতেই সিনাপতির মা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, “কত লোক এল। লিস্ট করে নিয়ে গেল। বলল চাল-ডাল দেবে। কেউ আসেনি। কেউ কিছু দিল না। আমাদের কেউ মানুষ ভাবে না।” যাক সরকারের উপর কারও তো একবুক দুঃখ আছে যা এখনও গরিবের চোখে জল ভরে দেয়!
ফোটো নিতে চাইলে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে সিনাপতি। বলে, “আমি ভালো করে দাঁড়িয়ে মায়ের পাশে হাসি দেব তখন তুলবেন।” কাজ শেষে কিছুদূর এগিয়ে পেছন ফিরতেই দেখি সিনাপতি ইশারা করছে। কাছে যেতেই কানে কানে বলল, “আমায় খাবার পাঠাবেন বনধ পর্যন্ত? মা খুব রাগ করে ভাত চাইলে। বলে, ”বসে বসে আর কত গিলবি? বাড়ির আর সবারও পেট আছে!” আর আমার পা-টা ঠিক হলে আমার বিয়ে হয়ে যাবে। মা খুব কাঁদে আমার বিয়ে হবে না বলে। আপনি যদি সরকারকে বলে আমার পা-টা ঠিক করে দিতে পারেন ভালো হয়।” সিনাপতির বাড়ি পেরিয়ে দ্রুত চার মাথার মোড়ের রাস্তায় এসে ভাবলাম কোন রাস্তা ঠিক সরকারের কাছে পৌঁছয় জানলে এখনই হাঁটা শুরু করতাম। সিনাপতির সোজা করে পা ফেলা খুব জরুরি। ওর বিশ্বাস ফেরানোটাও জরুরি। ওদের পরিবারের কাছে অসহায়ের আর্তি শুনতে আসা সব লোক সরকারের। আর সরকার মানেই এদের কাছে মিথ্যাবাদী ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী।
বালিকা কিস্কু
জনগনের ভোটে ক্ষমতায় আসা নির্বাচিত সরকার কি সত্যি সত্যি নাগরিকের ভুখা পেটে ব্যথিত হয়? তবে বালিকা কিস্কুদের দেশ কোথায়? সারাবছর বালিকাদের খাবার জোটে না। অভাব যায় না। কেননা নির্দিষ্ট উপার্জন নেই। এদের মাথায় উপরে কেউ হাত রাখার নেই। এবারে এসেছে ভাইরাসের দাপট। নতুন পরিস্থতি। এখন প্রতিদিন সকাল হলেই ভয়। অভাব আর অবসাদ। বালিকা কিস্কুর জীবিকা বলতে সাঁওতালি নাচ প্রদর্শন। বছরের বাকি দিন বালিকা দিনমজুরি করে। মাঝে মাঝে জমিতে চাষের কাজে ডাক পায়। স্বামীও লেবার খাটে। তিন সন্তান ও শাশুড়ি নিয়ে এভাবেই চলে সংসার। শাশুড়ির ভাতাও বন্ধ । দুইবার পেয়েছে এক হাজার করে টাকা। বালিকা কিস্কুর বিদ্যালয়ের মুখ দেখা হয়নি। তবু নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বালিকা খুব সচেতন। ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে এবার। মেয়ে একাদশ শ্রেণি। অভাবের সংসারে এক নতুন পরিস্থিতি লকডাউন। বালিকা কিস্কু খুব সহজেই বলছে, “ভাইরাসের লেগে খাওয়া বন্ধ। দিনে আটা গুলে খাচ্ছি। রাতে ভাত।”
প্রথমে আলু জুটলেও এখন ভরসা মাঠের মিশেলি শাক। ঠিক এই সময় ধান কাটা ও পাটের জন্য লেবার খাটে বালিকা ও তার স্বামী । লকডাউনের জন্য সেটাও বন্ধ। আখার খড়ি ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কেরোসিন কেনার পয়সা নেই। রেশনে থেকে দুই কেজি চাল ও দুই কেজি আটা মিলেছে। তা দিয়ে ছয়জনের আর ক’দিন চলবে!
জনগণের শাসনে জনগণের চেয়ে অসহায় কেউ নেই। কার্লাইল গণতন্ত্রের সমালোচনা করে বলেছিলেন, “এটি হল মূর্খদের শাসন। অশিক্ষিত ও অজ্ঞদের পরিচালিত শাসন ভাল হতে পারে না।” নিজেদের মূর্খ স্বীকার করে নেওয়ার মানে হয় না। কিন্তু অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সত্যিই কি কোনও মানে হয়?এই বিতর্কটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব দরকার ।
তসলেমা
একটি পরিবারের কোনও জীবিকা নেই। কিন্তু তারা বেঁচে আছে। পরিবারের বাচ্চা দুটোও হাড় জিরজিরে অবস্থায় শ্বাস নিচ্ছে। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। গল্প, উপন্যাস ও সিনেমা কিছুর সঙ্গে মেলানো যায় না মুখোমুখি পাওয়া এমন মানুষদের। দেখামাত্রই ছন্দপতন ঘটে নিমেষে। এমনই একজন তসলেমা। বিড়ি বেঁধে জীবনধারণ বছর বত্রিশের মহিলার। স্বামী অসুস্থ। দুই ছেলে। দেড়শো টাকা হাজারে দিনে পাঁচশোর বেশি বিড়ি বাঁধতে পারে না তসলেমা। শরীরে কুলায় না। বিয়ের আগে থেকেই বিড়ি বাঁধা শুরু। ছোটবেলায় মা মারা গেছে। নানির বাড়িতে মানুষ। খালার চেষ্টায় হয় বিয়ে। বিদ্যালয়ের মুখ দেখেনি কখনও। বিয়েই ছিল থাকা খাওয়ার সংস্থান। কিন্তু বাদ সাধল কপাল। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ল। অভাবে শুরু হল আবার বিড়ি বাঁধা। এভাবেই কোনওরকমে চলতে থাকল সংসার। বিড়ি বাঁধা বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে তা কখনও কল্পনাও করেনি তসলেমা। অভাবের সময় গ্রামে গ্রামে চাইতে বেরোতে হয় তসলেমাকে। কখনও মেলে। আবার কখনও খালি হাতে ফিরতে হয়।
খাবার জোগাড় করতে পারলে খাওয়া হয় নইলে খাওয়া হয় না। সারাবছর একই রকম। দিন বদলায় না। সরকারি সুবিধা তেমন জানা নেই। সন্ধান করে দেওয়ার মানুষও নেই। অভাবের দিন তাই প্রতিদিন। লডাউনের জন্য এখন বিড়ি বাঁধা বন্ধ। যদিও এমন অভিজ্ঞতা নতুন নয়। নোটবন্দির সময় এমনটা হয়েছিল। বিড়ি জমা ও পাতা দেওয়া বন্ধ ছিল অনেকদিন। সমস্যা এই যে তখন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চাইতে বেরোনোর বাধা ছিল না। এখন মুশকিল গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র যাওয়া। তাই ছেলেকে দিয়ে কলা বা ছুটির পাতা বা কচুর শাক বা কুমড়োর পাতা বা আমড়া পেড়ে এনে তাই ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করে খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।
তসলেমা দুই সন্তান নিয়ে জেরবার। ছেলেদের খাবার বাঁচানোর জন্য নিজে একবেলা খাচ্ছে। রাতে মাঝে মাঝে খাচ্ছেও না। রান্না আখাতেই। কিন্তু ক’দিন দুই বেলা চলবে জানে না তসলেমা। প্রতিদিন লকড়ি জোগাড় করে এনে দেয় বারো বছরের ছেলে। সময় পেলে নিজেও ঘুরে ঘুরে জোগাড় করে শুকনো পাতা ও কাঠ-কুঠালি। পরিবারকে খাওয়াতে একটুও ক্লান্তি নেই তসলেমার। নেই চেষ্টার ত্রুটি। গ্রামের অবস্থাপন্নদের বাড়িতে কাজ করে দিয়েও খাবার জোগাড় করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিন তো আর এভাবে চারজনের খাবার সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। বিড়ি বাঁধার পয়সা হাতে থাকলে স্বামীর ওষুধটা কেনা হয়। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন ধরে। গ্রামে চাল-আলু বিলি হয়েছে। তসলেমা বলে, “এগুলো তো রান্না করতে হবে। কি দিয়ে করব? একটা ষ্টোভ আছে পুরানো। কেরোসিনের অভাবে পড়ে আছে। লকড়িতে ভাত ফুটনোই কঠিন। আলু রান্না করার তেল- মশলা নেই। চাল-আলু রান্নার ব্যবস্থা করার সাধ্য কি আমার আছে! তাও দুই কেজি চালে চারজনের ক’দিন যাবে? শুধু ভাতটাই তো জোটে না প্রতিদিন।”
এভাবেই লকডাউন ধীরে ধীরে তসলেমাদের পরিবারে মরণ -বাঁচন সংগ্রাম এনে দিচ্ছে। এমনিতেই প্রতিদিন দুবেলা খাবার জোগাড়ের চ্যালেঞ্জ ছিল এতদিন। এখন তো টিকে থাকা নিয়ে আশঙ্কা। পরিবারের অসুস্থতা ও দৈনন্দিন চাহিদা নিয়ে অকুল পাথারে পথ হারাচ্ছে তসলেমারা।
রীনা চৌধুরী
পঁচিশ বছর ধরে চলছে পরিবারের কাঁচের শো-পিস তৈরির কাজ। স্বামীর ডাক পড়েছিল আগ্রায় গিয়ে নতুন ডিজাইন শেখার। তাই বিয়ের পরই পাড়ি দেয় রীনা চৌধুরী। ঘর সংসার সামলে সময় নষ্ট করেনি রীনা। স্বামীর কাছে বসেই তালিম নেয় কাজের। স্বামীর মৃত্যুর পর সাময়িক ভেঙে পড়ে রীনা। তবুও দমে না গিয়ে শুরু করে কাজ। ধীরে ধীরে নিজের তিন ছেলে মেয়েকে কাজের সঙ্গে যুক্ত করে। ঝাউ গাছ, পাখি ,নানা দেব-দেবীর মূর্তি, নৌকা, গরুর গাড়ি এমন সব শো-পিস তৈরি করে নিজের হাতে কাঁচ দিয়ে।
খুচরো,পাইকারি বিক্রি ও নানা মেলায় জিনিষ পৌঁছে দেয় রীনার একুশ বছরের ছেলে। ষাট টাকা থেকে আড়াইশো টাকা পর্যন্ত শো-পিস প্রতি দাম পেয়ে থাকে রীনা। মা-ছেলে বাজার ধরে নিয়েছিল একেবারে নিপুণ হাতে। তখনই বাদ সাধল লকডাউন। ঘরে অর্ডারের জিনিষ তৈরি। নেওয়ার লোক এল না। অন্যদিকে নতুন কাজও বন্ধ।
ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে এখনো কাঁচের শো-পিসে চাহিদা অনেকটাই কম। কিন্তু তা রীনাদের উপর প্রভাব ফেলেনি তেমন। চাহিদা ও বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালোই এগিয়েছে রীনারা। রিসেপসন, পুরস্কার ও উপহারের জন্য রীনার বাড়ি বয়ে আসে নিয়মিত ক্রেতা। অর্ডার মেলে প্রতিদিন। পুজোর সময় বেশি। কাজ শেষ করতে পরিবারের সকলকে দিন রাত এক করতে হয়। একমাত্র দুশ্চিন্তা এখন কবে অক্সিজেন ও গ্যাস সিলিন্ডার মিলবে। অক্সিজেনের অভাবে পড়ে আছে হাতের কাজ। কাঁচ না গলাতে পারলে কাজই শুরু করা যাবে না। একমাসে প্রায় আশি হাজার টাকার ক্ষতি। সরকারি সাহায্য না পেলে টাকা শোধ তো দূরের কথা দিন চালানো কঠিন হবে। ভবিষ্যতের অনিশ্চতায় অন্যমনস্ক রীনা জানায়, যা আয় হয় তা দিয়ে ঘর বাড়ির মেরামত ও খরচ করে সংসার চলে যায় আমাদের। বাকি টাকা দিয়ে লোন মেটাতে থাকি প্রতিমাসে। ইনকাম বন্ধ হলে তো অভাবে মারা পড়ার কথা।” লোনের টাকা তিন মাস দিতে হবে না সে নিয়ে খুব বেশি খুশি নয় রীনা। হাত তো শূন্য হয়ে পড়বে তার আগেই। সাহায্য বলতে এখন পর্যন্ত রেশন থেকে দুই কেজি চাল জুটেছে।
এত বছর ধরে জুড়ে থাকা এই কাজ এভাবে থেমে গেলে কী করে সামাল দেওয়া যাবে জানে না রীনারা। হতাশ রীনা বলে,”অক্সিজেনটাও যদি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত কেউ কাজটা তো চালিয়ে যেতে পারতাম!” সারা পৃথিবী তো আসলে এই অক্সিজেনের খোঁজে এখন মরিয়া। রীনাদের এই অভাবনীয় সঙ্কটের সঙ্গে জুড়েছে নতুন বিপদ। সেটা ভাঙনের। জীবন বাঁচলেও এই ধেয়ে আসা দু-পাড় ভাঙা বিপদে বাঁধ দেওয়ার কোনও আগাম সতর্কতা হাতের কাছে নেই রীনাদের।
মীরা মণ্ডল
প্রতিদিন চারটে করে গামছা। মীরা মণ্ডল নিজের হাতে তৈরি করে। সারাবছরের এটাই ধরাবাঁধা হিসেব। চলছে নাগাড়ে ১৮ বছর। লকডাউনের আগে ঘরে মজুত ছিল মাত্র ২৪ টা গামছা। মহাজন ঘর থেকে নিয়ে গেছে। অন্যসময়ে গামছা বিক্রি ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। লকডাউনের জন্য কম দামেই ছাড়তে হয়েছে। সেই ২০০২ সাল থেকে গামছা বোনা শুরু মীরা মণ্ডলের। শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই মীরা বুঝতে পারে অভাবের সংসার। মাধ্যমিক পাশ মীরা দেরি না করে পয়সার সন্ধানে গ্রামে বেরিয়ে পড়ে। ঘরে বসে কী করা যায় খুঁজতে গিয়ে দেখে গামছাটাই সহজ। গোষ্ঠীর টুকটাক কাজের বাইরে একটা নিজেস্ব কাজ না থাকলে সংসার চলবে না। এলাকা থেকে তেরো কিলোমিটার দূরে গ্রাম। ঘরের কাজ সেরে বাইরে গিয়ে কাজ করাও মুশকিল। তাই গ্রামেই গামছা বোনা দাঁড়িয়ে শিখতে থাকে মীরা। প্রায় তিনমাস দেখে দেখেই কাটে। সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে কেউই হাত লাগাতে দিত না বুননে। মীরা মন ছোট না করে অপেক্ষা করতে থাকে সময়ের। তারপর নিজেই বাড়িতে শুরু করে কাজ। দুই রকমের সুতো দিয়ে গামছা বুনে হাতেখড়ি হয় মীরার। তারপর চার রকমের সুতো দিয়ে বোনে চেক গামছা। লম্বায় চার হাত ও চওড়ায় দুই হাতের গামছা বোনে প্রথম। স্বামী বাইরে রাজমিস্ত্রী খাটে । তাই সংসারের খরচ মীরাকেই যোগাতে হয়। মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্বও তার উপরেই। লকডাউনের জন্য ঘুম ছুটেছে মীরার। কন্যাশ্রীর টাকা ও নিজের লোনের টাকায় মেয়েকে আইন নিয়ে পড়তে পাঠায়। এবার দ্বিতীয় সেমিষ্টার হবে। ফি বারো হাজার সাতশো টাকা। এই সময় মোবাইলে ম্যাসেজ দেখেই আঁতকে ওঠে মা-মেয়ে। ঘুম ছুটে যায় মীরার।
প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি গামছা মহাজনের কাছে দিয়ে মিলত অগ্রিম একশো থেকে দু’শো টাকা। তা দিয়েই চলত দিনের খরচ। এখন সেটাও বন্ধ। এদিকে ঘরে চারটে মানুষ। লকডাউনের পর আবার মহাজন বাড়াতে পারে সুতোর দাম। তাতেও কমবে লাভের হিসেব। বেশি টাকা কেটে নেবে মহাজন। ঘরের কাজ সেরে এত পরিশ্রমের পর যদি উপযুক্ত পারিশ্রমিক না মেলে তাতে খারাপ লাগার কথা। আবার অভাবের ভয়েও মীরা বেজায় অস্থির। লোন ঝুলছে মাথায় ২৫ হাজার টাকার। প্রতি মাসে শোধ দিতে হয় হাজার খানেকের কাছাকাছি। তিনমাস না দেওয়ার সুযোগ এলেও কাজ বন্ধ। পয়সা পাবে কোথায়? মেয়ের ল-পড়ার খরচ চালাবে কী করে? স্বামী লকডাউনের আগেই চলে এসেছে বাড়ি কলকাতার কাজটা আছে কি নেই জানে না। হাতেও টাকাপয়সা আনতে পারেনি। অন্যসময় বছরে আট হাজার টাকা থেকে দশ হাজার এনে দেয়। এবারে হাত খালি।
মীরা অপেক্ষায়। লকডাউন যদি ওঠে! কিন্তু পরিস্থতি আদৌ স্বাভাবিক হবে কি না ভেবে মুষড়ে পড়েছে একদম। মহাজনের কাছেই বিক্রি করতে হয় গামছা। খুচরো বিক্রেতা নেই। নেই সুতো হাতে। লকডাউন না উঠলে মহাজন আসবে না । বরাতও পাবে না। বন্ধ হয়ে যাবে হাঁড়ি। মীরার মত কারিগররা ধুঁকছে। লকডাউন দেশে নয়, ওদের কপালজুড়ে বসেছে যেন! প্রাণে বাঁচলেও পেটে মরতে হবে । তাও রাজি। কিন্তু মেয়ের পড়াশুনা কি আটকে থাকবে? পরীক্ষার ফি কি মুকুব হবে? মীরার জিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরছে গোটা পরিবারকে। মীরাদের দীর্ঘশ্বাস অপেক্ষার অন্ধকারকে আরও নিকষ কালো করছে। ভুলে যাওয়া গল্পের গাঁয়ের দৈত্য ফের যেন ডেরা জাঁকিয়ে বসতে চলেছে। ঘরে ঘরে আতঙ্কের প্রদীপ জ্বলছেই।
আঞ্জিরা
তখন ষষ্ঠ শ্রেণি। আঞ্জিরা মাকে হারাল। সপ্তম শ্রেণিতেই বিয়ে দেওয়া হল আঞ্জিরার। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল চোখের জল মুছে গৃহিণী হয়ে গেল। স্বামী কৃষক। শ্বশুরবাড়িকে জীবনের ঠিকানা স্বীকার করে নিল আঞ্জিরা। কিছুদিন যেতেই সংসারে হাঁপিয়ে উঠল। ঘরের বাঁধন, সন্তানের মায়া কিছুই বাঁধতে পারল না আঞ্জিরাকে। শাশুড়িমা বৌমার মন বুঝে গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করলেন। টেলারিংয়ের কাজ শিখে ও কাজ করতে শুরু করল আঞ্জিরা। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারল না। টানতে থাকল বিদ্যালয়ের চত্বর। ছেলের মা গ্রামের বিদ্যালয়ে কী করে পড়বে? লোকে কী বলবে! অবশেষে শাশুড়িমাকে রাজি করে মুক্ত বিদ্যালয়ে শুরু করে দিল পড়াশুনা। নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে টিউশন নিল। নিজের পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকল ছেলের পড়াশুনা। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিনেই মারা গেল বাবা। শেষবারের মত চোখের দেখাটাও হল না। বিয়ের ১৭ বছর পর আঞ্জিরা পাশ করল মাধ্যমিক। তার ঠিক তিন বছর পর উচ্চমাধ্যমিক। সেই পরীক্ষা ছেলে পাশ করল মায়ের পাশের দুই বছর পর। টেলারিংয়ের কাজের পরিধি বাড়াতে আঞ্জিরা শহরে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করল। বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে দিনপিছু কাজ মিলতে থাকল। টাকাও আসতে থাকল। পেট চালাতে জ্যাম-জেলিও বিক্রি করতে থাকল। শুরু করে দিল জরি-চুমকি কাঁথা ষ্টিচ ও এমব্রয়ডারির কাজ শেখা। তারপর হাজার টাকায় ভাড়া নিল টেলারিং চালানোর জন্য একটি ঘর। ছেলে ইতিমধ্যে ভূগোলে অনার্স পড়ে এমএসসি পড়া শেষ করল। চাকরির পরীক্ষার জন্য কোচিং নিতে শুরু করল ছেলেও। এবারে বসল বিসিএস পরীক্ষায়।
হঠাৎ পথের কাঁটা হল লকডাউন। জীবন সংসার সব নিমেষে থমকে গেল। গ্রাম থেকে তিন কিমি দূরে দোকান। যাওয়ার উপায় নেই। অর্ডার সব পড়ে। টাকা নেই। রাতে ঘুম নেই। সম্বল বলতে ভিটে। সেটা মর্টগেজ দিয়ে টাকা সংগ্রহ কী করে হবে তা নিয়ে পরিবারের সকলের মাথায় হাত। এক বেসরকারি সংস্থা আয়োজিত টেলারিং-এর পরীক্ষায় প্রথম হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় টেলারিং সম্পর্কিত কাজে সুপারভাইজিংয়ের সুযোগ আসে আঞ্জিরার। সেটাও লকডাউনের জন্য আপাতত বন্ধ।
মুর্শিদাবাদে বাল্যবিবাহ এখনও বন্ধ করা যায়নি। বিয়ের পর মুখ বুজে সংসার ছিল একমাত্র রেওয়াজ। নিরুপায় হয়ে সেই দলিলে নাম লিখিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ভাগ্য নিজের হাতেই লিখতে শুরু করেছিল আঞ্জিরা। কাজের সূত্রে গ্রামের বাইরে যাওয়ার কারণে প্রথমেই ‘খারাপ মেয়ে’ বলে দাগিয়ে থামানো যায়নি একসময়ের বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রীকে। সব অমর্যাদা উপেক্ষা করে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় আঞ্জিরা। ছেলেকে নিজের পরিবারের ঢাল হিসেবে তৈরি করে। কষ্টার্জিত এই সংগ্রামে এমন ঝোড়ো হাওয়ার মতো লকডাউন নেমে আসবে কল্পনাতেও ভাবেনি। ভেঙে পড়েছে মন। একের পর এক দিন বিভীষিকার মত কাটছে। প্রায় প্রতিদিনই শহর থেকে টেলারিংয়ের সরঞ্জাম আনতে হয়। নইলে কাজ নির্দিষ্ট দিনে ডেলিভারি দেওয়া যায় না। নতুন করে অর্ডার পাওয়ার সম্ভাবনাও কমছে । অন্যদিকে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অনিয়মিত উপার্জনটাও বন্ধ। নিজের ব্যবসাকে বহু কষ্টে সামলেছিল। এখন রাতবিরেতে উঠে ভিটের জমির কাগজ খুঁজছে। সামান্য জমিটুকু চলে গেলে তো পথে বসতে হবে। চিন্তার ঘোর কাটতেই সকাল হয়ে যাচ্ছে। একটিই চিন্তা। এই লকডাউনের পর আবার কি লকডাউন চলবে? তাহলে কী হবে?
লায়লা
উনিশ বছর ধরে রেশম চাষে যুক্ত লায়লা। লকডাউন এখন হাতের রেখায় ঘর বেঁধেছে। উঠোনে বসে সারাদিন অনিশ্চয়তা আর বিরামহীন প্রহর গুনতি। লকডাউনের কানাঘুষো শুনতেই জলের দরে বিক্রি করতে হল রেশম গুটি। শোবার একটিই ঘর। তাই অগত্যা হার মানতে হল। সময় নিয়ে পরে শুকিয়ে বিক্রি করার বিকল্প কিছু হাতে থাকল না। অন্য সময় সাড়ে তিনশো চারশো টাকা কেজি দরে বিক্রি করে রেশম গুটি। এবার অর্ধেক দামও পেল না। উত্তরবঙ্গ থেকে লোক আসার কথা ছিল। গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ। তাই স্থানীয় মহাজনদের কাছেই রেশমগুটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে লায়লা। শ্বশুরবাড়ি এসে পড়েই রেশমপোকা বা পলু নিয়ে কাজ শেখা শুরু। ফিরে তাকানো আর হয়নি। টানা চলছে কাজ লায়লার।
অষ্টম শ্রেনিতেই বিয়ে লায়লার। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজ নেই। তবু লায়লার মনোবল ঢের। বেকার ও অসুস্থ স্বামী। দুই মেয়েকে কলেজ পড়ানোর দায়িত্ব মাথায় নিয়ে লড়াই। প্রতিদিন ভোরে উঠে পলু বা রেশম পোকার দেখভাল করা। একা সংসার সামলানো। মাঝে মাঝে কৃষিমেলায় যাওয়া। আবার সদর শহরে ছোটাছুটি করা। রেশমপোকা জাত রেশমগুটি বিক্রি করে যা হয় তা দিয়ে পরের চাষের প্রস্তুতি চলে। তিনশো গুটিপোকার ডিমের বরাত জোটে লায়লার। সংসারের অভাবে যদি কখনও রাশ টানতে হয় তবু ইচ্ছা অন্তত পঞ্চাশ গুটিপোকার ডিমের রেশমপোকার চাষ চালিয়ে যাবে। এই পঞ্চাশ দিয়েই শুরু করেছিল প্রথম রেশম পোকা পালনের দিনগুলো। তাই থেমে থাকার উপায় নেই। একটাই ঘরের জন্য বেশি ডিম নিয়ে কাজ চালানোর উপায় নেই। তাই আজ পর্যন্ত তিনশো গুটিপোকার ডিমেই থামিয়ে রেখেছে নিজেকে।
ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য ধরতে হয়েছে টেলারিংয়ের কাজ। কিছু টাকা হাতে এসে পড়লে চাষের কাজে লাগে। এভাবেই চলা। তবু তুঁতের জমিতে এবারও লায়লা জল দিতে পারল না। লকডাউনের জন্য রেশম গুটির উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় জমিতে জলটুকু দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য জোটাতে পারল না। আবার টেলারিং এর কাজও বন্ধ পড়ল লকডাউনে।
বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিল্ক। এর উৎপাদনের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে জড়িয়ে আছেন লায়লার মত অনেক মহিলা। ওরা হয়তো জানে না যে, তার দেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রেশম উৎপাদনকারী দেশ। এও জানে না মোট উৎপাদনের ৯৭ শতাংশ তুঁত সরবরাহকারী পাঁচটি রাজ্যের একটিতে তার নিজের বাস। শুধু জানে গুটিপোকার ডিমকে ভালো করে খাবার দেওয়া। রোগ থেকে বাঁচিয়ে লালন করা। উপযুক্ত দামে বিক্রি করে সারাবছরের হাড়ভাঙা খাটুনির পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা। তারপর গুটিপোকার ডিম ঘরে আনার আগে ঘর শোধন করে রাখা।
সাগরপাড়ায় ঘরে ঘরে মহিলারা রেশম চাষের সঙ্গে যুক্ত। তাদের জন্য আলাদা কী ব্যবস্থা হল লকডাউনে জানে না লায়লারা। পরবর্তী চাষ এপ্রিলের গরমের সময়। কী করে শুরু হবে তা কেউ নিশ্চিত নয়। এমনিতেই এইসময় বেশ কঠিন পলু পালনের জন্য। উপরন্তু লকডাউনের বিপদ। পলু খাওয়ানোর পাতা গরমে শুকিয়ে যায়। সকাল হতেই কাজ শেষ করার চাপ বাড়তে থাকে। এদিকে সংসার ও মেয়েদের কলেজের জন্য আত্মীয়দের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। চারজনের প্রতিদিনের খাবার জোটানো বিরাট চ্যালেঞ্জ। আজকের বাতি নেভানো নিয়ে লয়লার আক্ষেপ “আমাদের ঘরে আলো জ্বলে বটে কিন্তু আঁধার ঘোচে না। বড়লোকদের আলো নেভানো হয়ত মর্জি। আমাদের কারেন্টের বিলের ভয়ে বাতি নেভানো চলে বছরভর।”
মৌসুমি বিশ্বাস
মৌসুমির নিজের হাতের চাষের কলা যাচ্ছে গরুর পেটে। কৃষি বিশ্ব অর্থনীতির ষাট শতাংশ চাষির একজন এই মৌসুমি। লকডাউনে নষ্ট হচ্ছে বিক্রি না হওয়া কলা। ফলের দোকান খুললেও খোলেনি ফলের আড়ত। নষ্ট হচ্ছে পান। পয়সা নেই। পারছে না লেবার খাটাতে মাঠে। লোনের ছয় হাজার টাকা শোধের খাড়া ঝুলছে মাথায়। তবু প্রতিদিন কোদাল আর ঝুড়ি হাতে মাঠে যাওয়ার পুরনো অভ্যাস। মন মানে না। পাঁচ রকম শষ্যের চাষ বছরে। জৈব সারের ব্যবহারও নিজের হাতেই করছে। তাই এখন বীজ, সারের সমস্যা না থাকলেও হাতটান। লোন শোধ করলে পাবে নতুন লোন। মুশকিল এই যে, লোন শোধের ব্যাপারেও অন্ধকারে মৌসুমি। পরে সুযোগ পেলেও তো টাকা দরকার হাতে। যা ফলছে তা যে বাজারজাত হচ্ছে না! তবে তো আগামীতে বিপদ ঘনিয়ে আসছে! ফসল ফলিয়ে নিজেই মাথায় করে বয়ে বাজারে নিয়ে যায় মৌসুমি। এতে কিছু খরচও বাঁচে। এখন খরচ বাঁচানোর চেয়ে খরচ জোগাড় কঠিন হয়ে পড়ছে। মৌসুমি বিশ্বাসের লকডাউন তাই উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে কাটছে। গ্রাম সুনসান। কী যেন হয়ে গেছে দেশে। রোগ আসেনি। কিন্তু ঘরে চাল কমছে প্রতিদিন। ফুরিয়ে গেলে কী হবে কে জানে! বাজার না চালু হলে ঘরে নষ্ট ,আবার খুললে বাজারের পথে সংক্রমণের ভয়। জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। ঘরে সার দেওয়া মেডেলের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় মৌসুমি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “কৃষক রত্ন বলতে লজ্জা লাগে। প্রতিবছর কুড়ি হাজার টাকা লোন না নিলে পারি না চাষ করতে। ঘরে গরু ,ছাগল, মুরগি আছে তাই বেঁচে আছি প্রাণে।”
এ দেশে কৃষকদের জন্য খামারের বাইরে বিকল্প কর্মসংস্থানের চল নেই। মৌসুমি নিজেই টিউশনি শুরু করে দিয়েছে। যে পয়সা পায় তা চাষের কাজে লাগায়। নেই মরক্কো ও রুয়ান্ডার মত ব্যাপক ক্রপ ইন্টেন্সিফিকেশন প্রোগ্রাম। পিছিয়ে নেই মৌসুমি। নিজেই মাটি পরীক্ষা ও জৈব সারের তৈরি করে প্রয়োগ করেছে। নিজের পদ্ধতি লাগিয়ে চাষ করেছে পেঁয়াজ, রসুন, কালোজিরে, আদা, হলুদ।
এলাকায় বড্ড আদর মৌসুমির। শিক্ষিত চাষি মৌসুমির বাড়ি চিনতে কারও অসুবিধে হয় না। গ্রামের মাথায় এসে একবার নাম নিলেই সোজা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখে আসে গ্রামের লোক।
সাধনার জীবন মৌসুমির। সংসার পাতার সময় হয়নি। এম এ পড়তে পড়তেই বাবার মৃত্যুতে পড়া ছেড়ে হাল ধরে সংসারের। মাত্র দু’কাঠা জমি নিয়ে লড়াই শুরু। নিজের হাতেই কোদাল তুলে নেয়। প্রথম দিন চোখের জলে মাটি ভিজে যায়। হাতের অসহ্য যন্ত্রণায় কাহিল হয়ে পড়ে। কিন্তু পরিবারের আর সহায় সম্বল কিছু না থাকায় এভাবেই শুরু মৌসুমির চাষের জীবন। নিজের লেখাপড়া কাজে লাগিয়ে চাষে উন্নতি নিয়ে আসে। আজও বাজারে মৌসুমির কলা সেরা। কাঁদি প্রতি ২৫০-৩০০টি। মাছ চাষেও তাক লাগিয়ে দেয় সকলকে। এখন জেলার নানা প্রান্তে চাষের পরামর্শ দেয় মুর্শিদাবাদের মৌসুমি। জেলার মহিলা চাষিদের জন্য মৌসুমী চিন্তিত। বুলবুলের ঝড়ের পর কোমর শক্তই করতে পারেনি তারা। বিপদের পর বিপদ চলে আসছেই।
মাঠে প্রাণ আছে বিশ্বাস মৌসুমির। মাঠের নিজেস্ব ভাষাও আছে মনে করে মৌসুমি। তাই সংসারের আর এক নাম মাঠ মৌসুমির কাছে। এখানে কাজ। এখানেই কান্না-হাসি। এখান থেকেই উৎসবের জামা। মহামারী জয়ের মন্ত্র।
লেখক একজন শিক্ষক, নারীবাদী সমাজকর্মী, কলাম লেখক। https://jinatspeaks.blogspot.com/
[…] রিপোর্টটি পড়ুন গ্রাউন্ডজিরোতে –পর্ব ১ ও পর্ব […]