ইতালির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও করোনা – মিথ বনাম বাস্তবতা 


  • April 8, 2020
  • (1 Comments)
  • 2607 Views

সাধারণভাবে করোনার মৃত্যুহার বিজ্ঞানীদের মতে থেকে শতাংশ অথচ ইতালিতে তা শতাংশ। ইতালির ক্রমভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, উদারবাদী অর্থনীতির আক্রমণে স্বাস্থ্য বাজেটের হ্রাস, প্রবীণ মানুষদের সংখ্যাধিক্য, মুনাফার লোভ, লকডাউন করার ক্ষেত্রে সরকারের গাফিলতি, পরিবেশ দূষণএই সবগুলোই ইতালিতে করোনা অতিমারির জন্য দায়ী। লিখেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক 

 

কথাটা সবাই বলছেন। চিকিৎসক, সমাজকর্মী, মনোবিদ, রাজনৈতিক নেতা, চিত্রতারকা—সবার মুখে এক কথা; স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থায় পৃথিবীর অন্যতম সেরা দেশ ইতালিতে যদি করোনার কারণে এত মানুষ (১৫৬৪২/৬ এপ্রিল পর্যন্ত) মারা যেতে পারেন, তাহলে আমাদের দেশে কী হবে? কথাটির দুটো তাৎপর্য আছে। প্রথমটি আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা যে নিদারুণ তা স্বীকার করে নেওয়া, যদিও কাদের দায়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই হাল তা নিয়ে কোনও আলোচনা মিডিয়াতে কখনও চোখে পড়ে না। দ্বিতীয়টি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল যদি ভালোও হতো (মানে ইতালির মতো?) তাহলেও লাভের লাভ কিছু হতো না। প্রথমে বলে নেওয়া ভালো যে  করোনা সংক্রমণের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে লকডাউন যে অত্যন্ত কার্যকরী পন্থা (যদি তা পরিকল্পিত হয়), সে নিয়ে এই নিবন্ধকারের কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, জনমুখী স্বাস্থ্য পরিকল্পনা থাকলেও করোনা অতিমারির আকার ধারণ করবে, এই ভাবনাতেও আমার বিশ্বাস নেই। তাই যে দেশগুলি ‘উন্নত’ বলে পরিচিত তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং করোনা প্রতিরোধে সে দেশের সরকারগুলির ভূমিকা — এগুলো নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে উঠেছে। এই নিবন্ধ সেই লক্ষ্যে একটি প্রাথমিক প্রয়াস মাত্র।

 

বিশ্বে ইতালি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উন্নত দেশ —  বৈদ্যুতিন প্রচার মাধ্যমের দৌলতে একথা আজ বহুল প্রচারিত এবং বহু মানুষ একথা আজ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য অন্য কথা বলছে। নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্ন থেকে ইতালি নয়া উদারবাদী অর্থনীতির নিয়ম মেনে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ কমাতে থাকে যা চরম আকার ধারণ করে ২০০৮-এর বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার সময়। এই হ্রাসের প্রভাব সরাসরি পড়ে ইতালির স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। ১৯৮০ সালে ইতালিতে হাসপাতালের বেডের সংখ্যা ছিল ৫,০০,০০০ যা কমে ২০২০ সালে হয়েছে ২,০০,০০০। ১৯৮০ সালে সে দেশে এক লক্ষ নাগরিক পিছু আইসিইউ বেডের সংখ্যা ছিল ৯২২, যা বর্তমানে হয়েছে মাত্র ২৭৫। ১৯৯৮ সালে সমস্ত দেশে হাসপাতালের সংখ্যা ছিল ১৩৮১ যা ২০১৯ সালে হয়েছে ১,০০০। এই খণ্ড পরিসংখ্যানগুলো জোড়া দিলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে চিত্রটি ফুটে ওঠে তা নিশ্চিতভাবে কোনও উন্নত দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র হতে পারে না। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালে দেশের স্বাস্থ্যবরাদ্দ খাতে ৩৭ বিলিয়ন ইউরো ছাঁটাই করা হয়েছে ফলে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী — সবার সংখ্যা কমেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী চিকিৎসক ও নার্স মিলিয়ে ৪৬,৫০০ পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। তাই আজ জার্মানিতে যখন প্রতি ১,০০০ নাগরিক পিছু হাসপাতালের বেডের সংখ্যা ৮, ফ্রান্সে ৬ সেখানে ইতালিতে মাত্র ৩.২।

 

এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার আরেকটি বড় কারণ অবশ্যই স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্রমাগত বেসরকারিকরণ। ইতালিতে বেসরকারি হাসপাতালে নাগরিকদের চিকিৎসা হলে, পরে সেই খরচ রাষ্ট্র মিটিয়ে দেয়। ১৯৯৮ সালে ইতালির হাসপাতালগুলির ৬১.৩ শতাংশ ছিল সরকারি এবং ৩৮.৭ শতাংশ ছিল বেসরকারি। ২০১৯ সালে এসে দেখা যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালের পরিমাণ কমে হয়েছে ৫১.৮০ শতাংশ, আর বেসরকারি পুঁজির মালিকানাধীন হাসপাতালের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৮.২০ শতাংশ।

 

এবারে যে মৃত্যুমিছিল তার একটা বড় অংশ লম্বার্ডি অঞ্চলে। ইতালিতে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের কাছে এই অঞ্চলটি ‘এল ডোরাডো’ নামে পরিচিত। এর কারণ ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এখানকার গভর্নর রবার্তো ফরগিনি (বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন) প্রদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্বাস্থ্যবণিকদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ইতালির বেসরকারি হাসপাতালগুলি এই অতিমারির সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে কারণ তারা নতুন পুঁজি বিনিয়োগ করতে রাজি নয়। মিলান শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল সান রাফাল এই কঠিন সময়ে প্রস্তাব দিয়েছে যদি নাগরিকরা আর্থিক সাহায্য দেয় তবে হাসপাতালের মাল্টিজিমে আইসিইউ খোলা যেতে পারে। অথচ এই হাসপাতালের মালিক যে কোম্পানি তার মূল্য ১.৩৫ বিলিয়ন ইউরো। এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে সরকারিভাবে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়নি। প্রকৃত অর্থে ইতালির বহু মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। চিকিৎসক ও নার্সদের অপ্রতুলতা সামাল দিতে মানবিকতার ডাকে সাড়া দিয়ে ৬৫ জনের একটি দল পাঠিয়েছে কিউবা সরকার। হাসপাতালে চিকিৎসার আবেদন জানালে বলা হচ্ছে, ”No mask, stay at home, call an ambulance if you can’t breath”।

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে একটা কথা আছে, “TRIAGE”। এর অর্থ যুদ্ধ ও মহামারির সময় চিকিৎসার জন্য উপলব্ধ সুবিধাগুলিকে বিচার করে হাসপাতালে আগত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মধ্যে তাদেরই চিকিৎসা করা যাদের বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। ইতালিতে চিকিৎসকরা এই নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন কারণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার রসদ যথেষ্ট ছিল না।

 

এই সঙ্কটের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো চিকিৎসক ও নার্সদের বিশাল সংখ্যায় মৃত্যু। এর কারণ চিকিৎসা কর্মীদের গড় বয়স ৬০ এর বেশি ফলে করোনার আক্রমণ তাদের ওপর প্রাণঘাতী হয়েছে। এদের অনেকেই বর্তমান সময়ে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমদিকে সরকার চিকিৎসকদের সংখ্যা কমে যাবে এই আশঙ্কায়  স্বাস্থ্যকর্মীদের বাধ্যতামূলক করোনা পরীক্ষা করায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। সার্ডিনিয়া প্রদেশে বহু হাসপাতালে দেখা গেছে ৯০ শতাংশ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত। তাই ইতালির সরকারকে আজ অবশ্যই এই বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার দায় নিতে হবে।

 

এবার আসা যাক বয়সের প্রশ্নটিতে। একথা সবাই বলছেন যে বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে করোনা প্রাণঘাতী হতে পারে। ১৮৬১ সালে ইতালি দেশটির জন্ম। বর্তমানে এই দেশটি দ্বিতীয় প্রবীণতম দেশ (প্রথম জাপান)। ইতালির জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে। ইতালির ক্ষেত্রে তাই দেখা যাচ্ছে করোনা আক্রান্ত মানুষদের গড় বয়স ৭২.৫। এই বিষয়টিকে আমরা একটু অন্যভাবে আলোচনা করতে চাই। ইতালিতে জন্মের হার অত্যন্ত কম কারণ তরুণ প্রজন্ম সন্তান নিতে উৎসাহী নয়। এই উৎসাহিত না হওয়ার একটা বড় কারণ এ দেশের আর্থিক সঙ্কট। এর ফলে শ্রমজীবীদের কাজের সুযোগ কমছে, আর্থিক উপার্জনও কমছে। ইতালির অর্ধেক শ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ১১ ইউরো উপার্জন করে। এর মধ্যে আবার ৬ শতাংশের উপার্জন ৭.৫০ ইউরোর কম। এই কম মাইনে পাওয়া শ্রমিকদের বেশিরভাগটাই আবার চুক্তিভিত্তিক, যাদের কাজের স্থায়ী চরিত্র নেই। এর ফলে ইতালির তরুণ শ্রমিকদের মধ্যে পরিবার গঠনের মানসিকতা কম। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ইতালির তরুণ প্রজন্মের উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে দেশান্তরী হওয়ার প্রবণতা। সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৮ সালে দেশ ছেড়েছেন ১,১৭,০০০ মানুষ, ২০১৯ সালে সংখ্যাটা হয়েছে ১,২০,০০০। সরকারি তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ৫৩ লক্ষ ইতালির মানুষ কর্মসূত্রে বিদেশে বাস করেন। যদিও অনেকের মতে সংখ্যাটা আরও বেশি। বর্তমান সময়ে ইউরোপে যত শতাংশ চিকিৎসক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে থাকেন তার মধ্যে ৫২ শতাংশ ইতালির চিকিৎসক।

 

এর ফলে ইতালির জনসংখ্যাও কমছে। গত এক বছরে দেশের জনসংখ্যা কমেছে ১,১৬,০০০। স্বাভাবিকভাবে ইতালিতে আজ প্রবীণ মানুষদের ভিড়। চিকিৎসক, কারখানা শ্রমিক, ট্রাক ও বাস ড্রাইভার- প্রবীণ মানুষদের আধিক্য। খুব কম মানুষেরই বোধহয় একথা জানা যে ইতালিতে অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়েছে। বিষয়টি স্বাভাবিক নয়। এই মানুষরা এমনিতেই অনেকে শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্র ও কিডনির সমস্যাতে ভোগেন ফলে তারা করোনার সহজ শিকার হয়েছেন।

 

করোনা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে লকডাউন যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায় (যদিও একমাত্র নয়) সে নিয়ে প্রথম থেকেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিকা দিয়ে আসছে। কিন্তু আজ সেখানকার অনেক শ্রমিক সংগঠনের অভিযোগ (সেই অভিযোগ ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত) যে প্রথম থেকেই সরকার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। পুঁজিপতিরা ইতালিতে সংক্রমণ শুরু হয়ে যাওয়ার পরেও কারখানাগুলিতে উৎপাদন বন্ধ করেনি। একদিকে বয়োবৃদ্ধ শ্রমিক, অন্যদিকে দেরিতে এবং অকার্যকরী লকডাউন পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করেছে। যেমন শিল্প সমৃদ্ধ সিরিয়ানা ভ্যালিতে ২০১৯ সালে মোট যত মানুষ মারা গেছেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে তত মানুষ মারা গেছেন। মুনাফার লোভ কারখানা বন্ধ করতে দেয়নি। শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে চলে গেছে তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় নয় এমন কারখানাগুলিকে বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

 

ইতালি বলতে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সূর্যকরোজ্জ্বল ফলের বাগান সমৃদ্ধ রোমান সভ্যতার ইতিহাস বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা ছবির মতো দেশটাকেই বোঝায় না। এখানে এমন জায়গা আছে যেখানে শিল্পজাত দূষণের কারণে ইউরোপে তারা কুখ্যাত। যেমন পো ভ্যালি। এইসব জায়গায় বহু মানুষ ধারাবাহিকভাবে ফুসফুসের সংক্রমণজনিত রোগে ভোগেন, প্রতিবছর ফ্লুতে সে দেশে বহু লোক মারা যান।

 

এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল ইতালিতে সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকত তাহলে করোনার আক্রমণে এত অল্প সময়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত না। সাধারণভাবে করোনার মৃত্যুহার বিজ্ঞানীদের মতে ৩ থেকে ৫ শতাংশ অথচ ইতালিতে তা ৮ শতাংশ। ইতালির ক্রমভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, উদারবাদী অর্থনীতির আক্রমণে স্বাস্থ্য বাজেটের হ্রাস, প্রবীণ মানুষদের সংখ্যাধিক্য, মুনাফার লোভ, লকডাউন করার ক্ষেত্রে সরকারের গাফিলতি, পরিবেশ দূষণ — এই সবগুলোই ইতালিতে করোনা অতিমারির জন্য দায়ী। তাই এদেশের বিশেষজ্ঞরা যেভাবে  ইতালির  স্বাস্থ্যব্যবস্থার ছবি আঁকছেন তা আদৌ যুক্তিসঙ্গত কি? এ প্রশ্ন বোধহয় তোলার সময় হয়েছে।

 

লেখক স্কুলশিক্ষক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী।

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Subhasish on April 12, 2020

    ভালো লাগল। একটা পর্যবেক্ষণ থাকলে ভালো হতো, যে অঞ্চলে দূষণ এর কারণে এমনিতেই ফুসফুস আক্রান্ত মানুষ, সেখানে করোনা’র ভূমিকার তথ্য দিলে আরও শক্তিশালী হতো লেখাটা। আর দরকার তথ্যসূত্রগুলো দেওয়া।

Leave a Comment