আকালের গন্ধ পেতেই তৎপর পুরুলিয়া প্রশাসন। শবরপল্লিতে ত্রাণ বিলি শুরু।


  • March 30, 2020
  • (0 Comments)
  • 1866 Views

জেলা খাদ্য নিয়ামক, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে শবর-প্রধান মহকুমার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিডিওরা সোমবার থেকেই দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। শবর টোলায় যাচ্ছেন ফুড ইন্সপেক্টররা। খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণে বিশেষ ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন থানার অফিসার ইনচার্জদের। জানাচ্ছেন দেবাশিস আইচ

 

শবরপল্লিগুলির দুরবস্থার খবর ছড়িয়ে পড়তেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন। জেলা খাদ্য নিয়ামক, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে  শবর প্রধান মহকুমার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিডিওরা সোমবার থেকেই দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। শবর টোলায় যাচ্ছেন ফুড ইন্সপেক্টররা। খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণে বিশেষ ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন থানার অফিসার ইনচার্জদের। রাজ্যের তো বটেই সবঅর্থেই জেলার দুর্বলতম জনগোষ্ঠীর জন্য এই সঙ্কট মুহূর্তে বিশেষ ব্যবস্থা যে না-করলেই নয় তা জানিয়ে গত ২৮ মার্চ, শনিবার সকালে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, জেলাশাসককে আবেদন জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি। সে খবর বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ করে গ্রাউন্ডজিরো। অবশেষে সে আবেদনে সাড়া পাওয়া গিয়েছে।

 

শবর কল্যাণ সমিতির সূত্র উল্লেখ করে আমরাই প্রথম জানিয়েছিলাম পুঞ্চা ব্লকের নির্ভয়পুর গ্রামের কৈরা শবরটোলায় খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। সমিতির স্বেচ্ছাসেবীরা চেষ্টা করেও প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগাড় করে উঠতে পারেনি। অবশেষে সে কাজটি করেছে পুঞ্চা থানা। রবিবার বিকেলে স্থানীয় ন-পাড়া পঞ্চায়েতে পুঞ্চা থানার ওসি বিশ্বজিৎ মণ্ডল হাজির হয়ে জানিয়ে দেন, সোমবার কৈরায় আপৎকালীন রেশন দেওয়া হবে। সেই মোতাবেক সোমবার অনাহারের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ৭১টি পরিবারকে ৫ কেজি চাল ও ২ কেজি করে আলু দেওয়া হয়। পঞ্চায়েত প্রধানের নেতৃত্বে চাল-আলু বিলি করেন সিভিক ভলান্টিয়াররা। সমিতির স্বেচ্ছাসেবী নমিতা শবর, জয়দেব মাহাতোরা জানান, বিগত প্রায় ১০ দিন কৈরার শবররা কর্মহীন। ইটভাটা, খেতের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা মজুরিহীন হয়ে পড়ে। যাঁরা খেজুর পাতার ঝাঁটা, টুপি কিংবা বাঁশের ঝুড়ি, ঝাঁটা তৈরি করে জীবিকা অর্জন করতেন লকডাউনের প্রভাবে তাঁরাও বাজারে যেতে পারেননি। একেই সারা বছর কাজ নেই, আবার কাজ পেলেও সপ্তাহে তিন-চারদিনের বেশি মেলে না। ফলত করোনার প্রভাবে তারা বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন।

 

গ্রাউন্ডজিরোই প্রথম জানিয়েছিল, মানবাজার দুই ব্লকের চিরুগোড়া শবরটোলার অশীতিপর বৃদ্ধা খান্দি শবরের তিনদিন অভুক্ত থাকা এবং শবর কল্যাণ সমিতির স্বেচ্ছাসেবী ভীম মাহাতর ব্যক্তিগত উদ্যোগে চারটি টোলার ত্রাণবিলির কথা। সোমবার ব্লক আধিকারিক তারাশঙ্কর প্রামাণিক, বোরো থানার ওসি কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, সেকেন্ড অফিসার গোপাল চক্রবর্তী দফায় দফায় বৈঠক করে স্থির করেন ব্লকের ২৮টি শবরটোলাতেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অশক্ত মানুষদের ৫ কেজি চাল ও ২ কেজি করে আলু দেওয়া হবে। বৈঠকে উপস্থিত ভীম মাহাত জানান, ওসি’র কথামতো ১৬টি গ্রামের ৭৮ জনের তালিকা নিয়ে বিডিওর হাতে তুলে দিয়েছেন। বিডিও অন্তত ১০০ জনকে ত্রাণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এছাড়া বাকি ১২টি গ্রামের ৭০ জনের তালিকাও তিনি প্রস্তুত করে ফেলেছেন। উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল বিডিও তারাশঙ্কর প্রামাণিক গ্রাউন্ডজিরোকে জানান, সাধারণ ভাবে ব্লকে কোনও সঙ্কট নেই। কিন্তু, “শবরদের যে জীবনধারণের মান সেখানে ব্যক্তিগত সম্পদ থাকে না, সঞ্চয়ও থাকে না। তাদের দিন আনি দিন খাই জীবন। কোনও সঙ্কট এলেই তারা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ে।” বর্তমান সমস্যার আশু সমাধানের জন্য ব্লকের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, “শবররা পিছিয়ে পড়ার মধ্যে পিছিয়ে পড়া। তাদের মধ্যে যারা বিপন্নের মধ্যেও বিপন্ন তাদের তালিকা পাওয়া গিয়েছে। এবার খাদ্য সামগ্রী বিলি শুরু হবে। খাদ্যসামগ্রী যথেষ্ট রয়েছে। এছাড়াও সহানুভূতি সম্পন্ন কোনও মানুষ বা সংগঠন কিছু যদি দিতে চান তাও আমরা নেব।” জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার থেকেই ব্লক কর্মী, সিভিক পুলিশ, শবর সমিতির স্বেচ্ছাসেবকরা বিডিও ও ওসি’র নেতৃত্বে চাল, আলু বণ্টন করবেন।

 

শবর কল্যাণ সমিতির হিসেব মোতাবেক জেলায় মোট শবরটোলার সংখ্যা ১৬৪টি। জনসংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এই টোলাগুলি প্রধানত পুঞ্চা, মানবাজার এক ও দুই, বরাবাজার ও বান্দোয়ানে রয়েছে। বলরামপুর ও পুরুলিয়া এক ব্লকেও সামান্য কিছু শবর গ্রাম আছে। মানবাজারের মহকুমা শাসক বিষ্ণুব্রত ভট্টাচার্য গ্রাউন্ডজিরোকে জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন, জেলা খাদ্য দফতর, পঞ্চায়েত শবর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ রেশনের ব্যবস্থা অনুমোদন করেছে। স্থির হয়েছে যে সমস্ত শবরদের রেশন কার্ড রয়েছে তারা নিয়মানুযায়ী রেশন পাচ্ছেন। কিন্তু যাদের নেই কিংবা যারা বৃদ্ধ, অশক্ত, রেশন দোকানে যেতে পারেন না তাঁদের মাথাপিছু ১২ কেজি চাল দেওয়া হবে। যা একমাসের রেশন হিসেবে ধরা হবে। এই রেশন ‘ডোর টু ডোর’ বিলি করা হবে।” জানা গিয়েছে এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে তালিকা প্রস্তুত করতে অনুরোধ করেছে জেলা খাদ্য নিয়ামকের দপ্তর।

 

ইতিমধ্যেই সে কাজ হাত দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। মানবাজার ২ ব্লকের তালিকা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। বরাবাজার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রামজীবন মাহাত জানান, করোনার প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার তিন মাস বিনামূল্যে বিশেষ রেশন ব্যবস্থা চালু করছে। মঙ্গলবার থেকেই তা কার্ডধারীদের বিলি করা হবে দু’সপ্তাহের রেশন অর্থাৎ প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক চার কেজি চাল পাবেন। এছাড়াও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কার্ডহীনদের জন্য বিশেষ রেশন দেওয়া হবে।” রামজীবনবাবু জানান, বরাবাজার গ্রামের গারাসাগমা গ্রামে কণক মাহাতো এই বিপন্ন মানুষদের তালিকা তৈরি করেছে। তিনি অন্যান্যদেরও অনুরোধ করেছেন তালিকা প্রস্তুত করতে। প্রসঙ্গত বরাবাজার ব্লকে ৩৭টি ছোট-বড় শবর গ্রাম রয়েছে। মোট পরিবার ৭৭২টি এবং মোট জনসংখ্যা ২৫৬৫। মানবাজার এক ব্লকের তালিকা প্রস্তুত করছেন ফটিক মাহাত।

 

শবরদের অবস্থা খতিয়ে দেখতে জেলা খাদ্য নিয়ামক শুভ্রজিৎ ভট্টাচার্যের নির্দেশে বিভিন্ন ব্লক পরিদর্শন করছেন ফুড ইন্সপেক্টররা। বান্দোয়ানের জারা ঘুরে শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক জলধর শবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আনৌক সোরেন। জলধরবাবু তাঁকে তুর‍্যাঁ, লটপদা সহ বিভিন্ন গ্রামের পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেন। এছাড়াও অনেকেই ডিজিটাল রেশন কার্ড এখনও পাননি বলে জানান। আনৌক সোরেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। মানবাজার দুই ব্লকে ভীম মাহাতর সঙ্গে কথা বলেন ফুড ইন্সপেক্টর বিজয় মান্ডি। ভীম জানান, বিজয়বাবুর সাহায্যে তিনি জেলা খাদ্য নিয়ামকের সঙ্গে কথা বলেন। খাদ্য নিয়ামক তাঁর কাছে শবরদের রেশন নিয়ে তাঁর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চান। ভীম তাঁকে জানান, রেশন নিয়ে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য অন্নপূর্ণা খাদ্য যোজনা বন্ধ না- হলে আজ তাঁদের খাদ্যাভাব দেখা দিত না। খাদ্য নিয়ামক তাঁকে সমস্যাটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন।

 

প্রশাসনের এই তৎপরতায় খুশি শবর কল্যাণ সমিতি। সমিতির সম্পাদক জলধর শবর জেলা প্রশাসন, পঞ্চায়েত ও পুলিশ প্রশাসনের প্রশংসা করে বলেন সরকার না-দেখলে আমরা এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতাম না। সকলকেই ধন্যবাদ জানান তিনি।

 

Share this
Leave a Comment